কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-৭

0
3389

কাছে_কিবা_দূরে
পর্ব-৭
লেখা: Sabikun Nahar Nipa

সারারাত এপাশ ওপাশ করে শেষ রাতে ঘুমিয়েছিল তানি। বেশীক্ষন ঘুমাতে পারে নি। ভোর থাকতেই উঠে পড়েছে। শুভ্র তখনও ঘুমিয়ে। রাতে অনেকক্ষন ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকার পর ঘুমিয়েছে। তানি ঘুম থেকে উঠে ব্যলকনিতে গেল। শহরটা কেবল ব্যস্ত হতে শুরু করছে। তিনতলার ব্যলকনি থেকে নিচের বস্তি স্পষ্ট দেখা যায়। তানি রেলিঙে চোখ রেখে দেখছে কিভাবে বস্তির বউয়েরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে স্বামীদের খাবার বানিয়ে দিচ্ছে। এক রান্নাঘরে সবার ই আগে রান্না করার তাড়া। এই নিয়ে কয়েকজন একচোট ঝগড়াও করে নিলো। ব্যাপার টা কী মিষ্টি লাগছে তানির! রোজ সকালে উঠে স্বামীর জন্য ঝটপট খাবার তৈরী করা, টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দেয়া, গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া এই ব্যাপারগুলোর মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা আছে, ভালোবাসা আছে। তানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় আনিকার ঘরের দিকে। আনিকা গুনগুন করে পড়ছে। আনিকার ঘরের দরজায় হাত রাখতেই আনিকা মিষ্টি করে হেসে বলল, গুড মর্নিং ভাবী।

“শুভ সকাল। তুমি রোজ সকালে উঠে এমন পড়াশোনা করো?”

“হ্যাঁ। সামনে পরীক্ষা তো তাই। আমি আবার পড়ে মনে রাখতে পারি না। যত পরীক্ষা এগিয়ে আসে তত সব গুলিয়ে যায়। ”

তানি নিঃশব্দে হাসলো। আনিকা বই বন্ধ করে তানির দিকে তাকিয়ে বলল, আজ তো তোমাদের বাড়ি থেকে লোকজন আসবে।

“হ্যাঁ “।

“তুমি কী চলে যাবে তাদের সাথে? ”

তানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মনে হয় না।

“কেন?”

“তোমার ভাইয়া যেতে পারবে না। আর বিয়ের পর স্বামী ছাড়া গেলে আমার অনেক কথা শুনতে হবে। ”

আনিকা অবাক গলায় বলল, ভাইয়া কেন যাবে না?

“জানিনা। হয়তো তার যেতে ইচ্ছে করছে না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আর কত ই বা করবে! ”

আনিকা বুঝলো তানির মন খারাপ তাই আর কথা বাড়ালো না। প্রসঙ্গ পাল্টে সাজগোজের আলাপ শুরু করলো।

ব্রেকফাস্টের টেবিলে তানি আর শুভ্র’র দেখা হলো। শুভ্র খেতে খেতে গল্প করছিলো। তানি যে গম্ভীর হয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছিলো সেটা খেয়াল করে নি। মাহফুজা দেখতে পেয়ে বলল, কোনো সমস্যা তানি?

“না মা। আসলে খেতে ইচ্ছে করছে না”।

“তাহলে অন্যকিছু খাবি?”

“না মা আমি এখন যাই। একটু মাথা ব্যথাও করছে। ”

মাহফুজা আর আটকালেন না। চলে যাওয়ার পর বলল, মেয়েটা হয়তো মানিয়ে নিতে পারছে না। প্রথম বারের ভয়ানক অভিজ্ঞতা থেকে এখনো বের হতে পারে নি বোধহয়।

কিন্তু শুভ্র ঠিক ই বুঝলো তানির ম্যুড অফের কারণ। শুভ্র অভ্রকে বলল, খাওয়া শেষে একটু আমার সাথে যাবি, একটা কথা আছে।

*******

আনিকা মুখ কালো করে বলল, মা ভাবীর মন খারাপ কেন তা আমি জানি।

মাহফুজা অবাক হয়ে বলল, কেন?

“ভাইয়া নাকি বলেছে যে তাদের বাড়িতে যেতে পারবে না। আর ভাইয়া না গেলে ভাবীও যেতে পারবে না সেজন্য। ”

“শুভ্র যাবে না কেন? বিয়ের পর প্রথমবার তো স্বামী, স্ত্রী একসাথেই যায়।”

“জানিনা”।

মাহফুজার কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। শুভ্র’কে বিয়ে করানোর উদ্দেশ্য ছিলো একটা নরমাল লাইফে ফিরিয়ে আনা। ছেলেটা হাসছে, মজা করছে ঠিক ই তবুও ভিতরে ভিতরে যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা আর কেউ না জানলেও সে জানে। এইজন্যই চেয়েছে একটা ভালো লক্ষীমন্ত মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে। মুখে কিছু না বললেও বিয়ে নিয়ে শুভ্র’র ও যে আতংক আছে সেটা মাহফুজা ভালো করেই জানে। তানিকে দেখার পর মনে হয়েছে এই মেয়েটা বউ হলে শুভ্র একটা নতুন জীবন পাবে। মেয়েটার মুখে যে মায়া আছে সেই মায়ায় ঠিক ই আটকে ফেলবে।

তানির সাথে মাহফুজার দেখা হয়েছিল রাস্তায়। একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকা এসেছিল তানি। সেদিন মাহফুজা বিজয় স্মরনী থেকে রাস্তা পাড় হয়ে ওপারে আসছিলো গাড়ি ধরবে বলে। ফুট ওভার ব্রিজ পাড় হতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। জ্ঞান ফেরার পর দেখলো একটা অচেনা মেয়ে ব্যস্ত হয়ে কাগজ দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছে। তানি সেদিন মাহফুজার জন্য চাকরির ইন্টারভিউ টা দিতে পারে নি। প্রথম দেখায় মেয়েটা’কে এতো ভালো লেগেছে যে ফোন নম্বর চেয়ে রেখেছিল। তারপর আস্তে আস্তে বিয়ের কথাবার্তা হলো। শুভ্র’ও রাজী হলো। মাহফুজা ভেবেছিল শুভ্র রাজী হবে না। কিন্তু শুভ্র মায়ের পছন্দ, ইচ্ছে দুটো ই মেনে নিলো।

মাহফুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিয়ে হয়েছে মাত্র ক’টা দিন। এখনও পর্যন্ত দুজন দুজন কে ঠিকঠাক চিনলো ই না। দুজনের ই সময় দরকার। সময় নিশ্চয়ই সব ঠিক করে দেবে।

******

“ভাবী আসবো?”

তানি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। শাড়ি ঠিকঠাক করে বলল, আসুন।

অভ্র ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এটা কিন্তু আনফেয়ার ভাবী। আমি যেহেতু তুমি বলছি, তোমাকেও তুমি করে বলতে হবে।

তানি স্মিত হেসে বলল, আচ্ছা তুমি বলব কিন্তু আমি ভাইয়া বলে ডাকব তোমাকে।

অভ্র খুশি খুশি গলায় বলল, বাহ! আমিও তবে একটা বোন পেয়ে গেলাম।

তানি হাসলো।

অভ্র গম্ভীর হয়ে বলল, ভাবী তোমার সাথে কিছু কথা আছে।

“হ্যাঁ বলো”।

“ভাবী কথাটা ভাইয়া সংক্রান্ত “।

তানি শুকনো ঢোক গিলল। কী বলবে শুভ্র’র ব্যাপারে? ভয়ংকর কিছু বলবে না তো! এমন কিছু না বলুক যেটা তানিকে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দিক।

তানি কাঁপা গলায় বলল, কী হয়েছে?

অভ্র হেসে ফেলল। বলল, ভাবী তুমি প্লিজ নরমাল হও। সিরিয়াস হওয়ার মতো কিছু না।

তানির তবুও ভয় লাগলো। অভ্র লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ভাবী ব্যাপার টা ভাইয়ার পাস্ট নিয়ে। বিয়ের আগে তোমাকে শুধু জানানো হয়েছিল ভাইয়ার আগের বউ রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে তাই তো?

তানি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। অভ্র বলল,

“কিন্তু আরও কিছু ব্যপার আছে যেগুলো জানানো হয় নি। জানানো হলে হয়তো তোমাদের বিয়েটাই হতো না, এই ভয়ে মা জানায় নি।
ব্যাপার টা হলো, ভাইয়া যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল তার নাম ছিলো অবন্তী। অবন্তী ভাইয়ার ক্লাসমেট। বিয়ের আগে হাসিখুশি একটা কাপল ছিলো ভাইয়া আর অবন্তী। ক্যাম্পাসে পারফেক্ট কাপল হিসেবে খুব বিখ্যাত ও ছিলো। অবন্তীকে কোনো এক বিচিত্র কারনে মা পছন্দ করতেন না। মুখে কিছু না বললেও ব্যাপার টা বোঝা যেত। অবশ্য পছন্দ না করার মতো অনেক কারণ ও ছিলো। ভাইয়া ইউনিভার্সিটির টপ স্টুডেন্ট ছিলো। পাশ করে বেড়োলেই ইউনিভার্সিটির টিচার হয়ে যাবে। এক কথায় ব্রাইট ফিউচার ছিলো।

অভ্র একটু থামলো। তানি বলল,

“তারর?”

“কিন্তু অবন্তী ছিলো মিডিয়াম টাইপ স্টুডেন্ট। ভাগ্যগুনে হয়তো চান্স পেয়েছিল ভার্সিটিতে। কিংবা আগে পড়াশুনায় ভালো ছিলো, ভার্সিটিতে এসে বিগড়েছে। যার লাইফে কোনো এমবিশন ছিলনা। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে বিলং করতো বলে তার স্বপ্ন ছিলো লাক্সারিয়াস লাইফ লিড করবে। কিন্তু নিজে কিছু করবে এরকম কোনো ব্যাপার ছিলো না। অর্থাৎ হাজবেন্ডের টাকায় সব হবে।

“তারপর “?

“মায়ের অবন্তীকে অপছন্দের কারণ ছিলো অবন্তী কিছুটা উগ্র টাইপ ছিলো। আল্ট্রা মর্ডান এটাও দোষ অবশ্য ছিলো। আর সেই খরচ টা মেইনটেইন করতো ভাইয়া। টিউশনি করে যা পেত তার পুরোটা’ই দিয়ে দিতো। মা চাইতো না ভাইয়া টিউশনি করুক, বরং সেই সময় টা ভাইয়া পড়ায় মন দিক সেটা চাইতো। এই নিয়ে মায়ের সাথে ভাইয়ার ঝামেলা হলেও ভাইয়া চুপচাপ ছিলো।

আরেকটা দোষ ছিলো অবন্তীর সেটা হলো ঝগড়া করে বাসায় এসে ভাইয়া কে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা। মেজাজ বিগড়ে গেলে যেমন রাগারাগি করে বিল্ডিং এর লোকজন জড়ো করতো তেমন রাগ কমলে এসে কান্নাকাটি করতো। এমন কি ভাইয়ার পা ধরে কান্নাকাটি করতো। আর ভাইয়া ভুলে গিয়ে ক্ষমা করতো। এরপর হঠাৎই বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলো। মা তো রাজি না, ভাইয়া কিভাবে কী সামলাবে কুল, কিনারা পায় না। হঠাৎই সুইসাইড করার চেষ্টা করলো অবন্তী। ভাইয়ার হাতে বিয়ে ছাড়া আর কোনো অপশন রইলো না। বিয়ে করে বাসায় নিয়ে এলো।

“তারপর কী হয়েছিল? মা মেনে নিয়েছিল?”

“হ্যাঁ। বিয়ে যেহেতু হয়েছে না মেনে তো উপায় নেই। ভাইয়া তখনও স্টুডেন্ট। ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। মা সহজ ভাবেই অবন্তীকে মেনে নিলো। কিন্তু অবন্তীর মধ্যে টিপিক্যাল বউদের স্বভাব রয়ে গেল।

এরপর শুরু হলো ভাইয়ার জীবনের ভয়ংকর অধ্যায়। অবন্তী ভাইয়াকে নিয়ে ওভার পজেসিভ। তার কথা ছিলো, ভাইয়ার ধ্যান, জ্ঞান সব জুড়ে কেবল সে ই থাকুক। আমরা কেউ থাকতে পারব না । এমনকি মা’ও না। আনিকা, কিংবা আমার সাথে হেসে কথা বললে ভাইয়ার উপর শুরু হতো মেন্টাল টর্চার। মা প্রথম প্রথম ছেড়ে দিলেও পরে যখন প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল তখন মা’কেও অবন্তী তুই তোকারি করে অশ্রাব্য গালাগালি করতো।

“আর তোমার ভাইয়া কিছু বলতো না? ”

“ভাইয়া খুব বোঝাতো। কিন্তু সে কিছু বুঝবে না। উল্টো ভাইয়াকে গালাগালি দিয়ে, ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে দুনিয়াসুদ্ধ লোক এক করতো।

“কী সাংঘাতিক”?

অভ্র হেসে বলল, আরে ভাবী বাড়িওয়ালা পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে আমাদের উইদাউট নোটিশে বাড়ি ছাড়তে বলেছিল।”

“এরকম ও মেয়ে হয়?”

“হয়। এরপর কী হলো শোনো, ভাইয়া রেজাল্ট খারাপ করলো। খারাপ করলো মানে টপ টেনে থাকতে পারলো না। এখন শুরু হলো ঘরের মধ্যে মহা প্রলয়। অবন্তী সুইসাইড করবে।

“মেয়ে তো মনে হচ্ছে সাইকো ছিলো। ”

“উঁহু ওগুলো ওর স্বভাব ছিলো। অতিরিক্ত লোভে বুদ্ধিজ্ঞান লোপ পায়। এরপর ভাইয়ার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে চাকরি হলো। এখন শুরু হলো আলাদা বাসায় উঠবে। আলাদা সংসার না হলে সে থাকবে না। বাধ্য হয়ে মা নিজেই ভাইয়াকে সেটা করতে বলল।

ভাইয়াকে ছাড়া থাকতে হবে, কষ্ট পেলেও মানসিক শান্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু ভাইয়া ভালো ছিলো না। নিজে কিছু না বললেও আমরা বুঝতাম। আমাদের সাথে দেখা করতে এসে ফিরে যাবার সময় তার মন ভার থাকতো। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো সব। অবন্তী এরমধ্যে এক্সিডেন্ট করলো। ও যদি মারা না যেত তাহলে ভাইয়া মারা যেত শিওর। অবন্তী নিজেই মেরে ফেলতো রাগের মাথায়। অনেকবার রেগে গিয়ে ভাইয়ার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।
অবন্তী মরে যাবার পর ভাইয়ার মানসিক অবস্থা খুব খারাপ হলো। কারও সাথে কথা বলত না, কোথাও যেত না, একলা একলা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতো। মা কান্নাকাটি করে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে নরমাল লাইফে ফিরিয়ে এনেছে। এখন বলো এই অবস্থায় কী ভাইয়ার পক্ষে তোমাকে মেনে নেওয়া এতো তাড়াতাড়ি সম্ভব?

তানি কেঁদে ফেলল। আহারে! মানুষ টা কতো কষ্ট পেয়েছে আর ও কী না তাকে নিয়ে……

অভ্র বলল, আরে তুমি কাঁদছ কেন? কেঁদোনা প্লিজ।

“আমি ওনাকে ভুল বুঝেছি।”

অভ্র স্মিত হেসে বলল, এখন তো ঠিক বুঝলে। এবার ভাইয়ার উপর রেগে থেকো না।

তানি তবুও কাঁদতে লাগলো।

অভ্র বলল, ভাবী ভাইয়ার হৃদয়ের মরুভূমিতে যে করে হোক গোলাপ কিন্তু তোমাকেই ফোটাতে হবে।

তানি অবাক হয়ে তাকালো।

অভ্র ব্যস্ত গলায় বলল, হয়েছে হয়েছে এবার তোমাকে পার্লারে সাজতে যেতে হবে”

“ওনাকে কী স্যরি বলব”?

অভ্র ঠোঁট টিপে হেসে বলল, তোমার কিছু বলার দরকার নাই। দেখোনা তোমার উনি কিভাবে তোমার রাগ ভাঙায়।

তানি লজ্জা পেল। অভ্র হাসতে হাসতে বলল, একটা মজার ব্যাপার শোনো, আমি অবন্তী কে কখনো ভাবী ডাকি নি। তোমাকেই কিন্তু ডাকলাম। ভাইয়ার দ্বিতীয় বউ হলেও আমার কিন্তু প্রথম ভাবী।

তানিও অভ্র’র সাথে হেসে ফেলল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here