কাছে_কিবা_দূরে পর্ব_১৬

0
3222

কাছে_কিবা_দূরে
পর্ব_১৬
#সাবিকুন_নাহার_নিপা
যে রিসোর্টে শুভ্র, তানি এসেছে সেখানের জানালা খুললেই সমুদ্র দেখা যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুভ্র জানালা খুলে মুগ্ধ চোখে কমলা রঙা আকাশ, আর সমুদ্রের ঢেউ দেখে। দুটো সকাল দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কেবল। প্রতিটি সকালে ই চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলেছে, একটা জীবন কেন মানুষ পায়! আর সে জীবন টা কেন এতো ছোট। আরেকটু দীর্ঘ হলে কতো ভালো হতো৷

কক্সবাজার আসার দিন টা দুজন মিলে ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। জার্নি করার সময় শুভ্র’র ঘুম হয় না। তানি পুরো সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে আর শুভ্র কাটিয়েছে তানিকে দেখে। সারারাত তানিকে দেখতে দেখতে শুভ্র একটা কথা উপলব্ধি করতে পারলো। অভ্র কে যে ও বলেছে তানির প্রেমে পরেছে সেটা আসলে সত্যি না। শুভ্র তানিকে ভালোবেসে ফেলেছে। তানির রাগ করা, ঠোঁট টিপে হাসা, কপাল কুচকে ঘুমানো, কথায় কথায় লজ্জা পাওয়া সব টাই ও ভালোবেসে ফেলেছে। শুভ্র তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে তানিকে ভালোবাসার কথা জানাবে। জীবন খুব ই ছোট। এক একটা দিন চলে যাওয়া মানে জীবন থেকে এক একটা মুহুর্ত শেষ হয়ে যাওয়া৷ তাই আর লুকোচুরি না, তানিকে বলে দেবে যে তানি আমি তোমার ড্রেনওয়ালা হতে চাই। প্রথম জীবনে সেই ড্রেনওয়ালা অল্প সময়ের জন্য তোমার হাত ধরেছিল কিন্তু আমি সারাজীবন তোমার হাত ধরতে চাই।

কক্সবাজার আসার পর একটা গোটা দিন শুভ্র তানির সাথে কাটিয়েছে। সমুদ্রের জলে গা ভিজিয়েছে, খালি পায়ে হাত ধরে হাটাহাটি করেছে। রাতে দুজন মিলে জ্যোৎস্না বিলাস ও করেছে। এই সময়ে দুজনেই সবকিছু ভুলে নিজেদের মতো সময় কাটিয়েছে। বাড়ি থেকেও ফোন করে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে নি। মাঝরাত পর্যন্ত দুজন মিলে গল্প করে শেষরাতে ঘুমিয়ে গেছে। আর বিছানার ইন্ডিয়া, পাকিস্তানের বর্ডারও আস্তে আস্তে উঠে যেতে শুরু করেছে।

*****
তানির ঘুম ভাঙলো একটু দেরীতে। উঠে দেখলো শুভ্র ঘরে নেই। ভাবলো একা একা বোর লাগছে বলে হয়তো হাটতে বেরিয়েছে। এই সুযোগে তানি চটপট একটু সেজে নিলো। এখানে আসার সময় ব্যাগে শুধু শাড়িই নিয়ে এসেছে। বাড়িতে সালোয়ার কামিজ পরলেও এখানে শাড়ি পরবে। তানি এতোদিনে বুঝে গেছে যে শুভ্র শাড়ি খুব পছন্দ করে। তাই একেক দিন একেক রঙের শাড়ি পরে নিজেকে একটু সাজিয়ে নেয়।

তানি আজ নীল রঙের শাড়ি পরেছে। শাড়ির সাথে গোলাপি ব্লাউজ। এই ব্লাউজে শাড়ির রঙ টা আরও ফুটে উঠেছে। দুহাত ভর্তি নীল চুড়ি, কানে নীল সাদা পাথরের ছোট দুল আর কপালে ছোট টিপ পরেছে। শুধু লিপস্টিক দেয়া বাকী ছিলো তখন ই শুভ্র ঘরে এসে হাজির। তানিকে দেখে অপলক তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। তানি অপ্রস্তুত হয়ে মাথানিচু করে ফেলল। স্বাভাবিক হবার জন্য জিজ্ঞেস করলো,

“কোথায় গেছিলেন?”

শুভ্র’র ঘোর ভাঙলো। বলল, এই তো একটু হাটতে বেরিয়েছিলাম। ”

তানি খেয়াল করলো শুভ্র’র হাতে একটা শপিং ব্যাগ। কিছু একটা যে ওর জন্য এনেছে সেটা বুঝতে পারলো। শুভ্র ব্যাগ টা ট্রলির ভিতর রাখলো। তানি মিটিমিটি হাসলো। শুভ্র আজ প্রপোজ করে ফেলবে নাকি! না শুভ্র স্পষ্টভাষী মানুষ, সে নিশ্চয়ই সিনেমাটিক ভাবে প্রপোজ করবে না। সরাসরি ই হয়তো বলে ফেলবে তানি আমি তোমাকে ভালোবাসি।

হঠাৎ ই তানি শব্দ করে হেসে ফেলল। শুভ্র বলল, কী হলো হাসছ কেন?

তানি বলল, না এমনিই।

“এমনি এমনি কেউ হাসে?”

“হ্যাঁ হাসে।”

“আচ্ছা হাসা শেষ হলে চলো। এমনিতেই পেটে ইঁদুর দৌড় শুরু করছে। ”

তানি মৃদু হেসে বেরিয়ে গেল।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে দুজন যখন ঘুরতে গেল তখন ই শুভ্র’র এক কলেজ ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়ে গেল। শুভ্র’র সাথে কুশল বিনিময় শেষে যখন তানির দিকে চোখ পড়লো তখন প্রশ্ন করলো,

“উনি কে?”

“তোর ভাবী। কয়েক মাস আগে বিয়ে করেছি”।

শুভ্র’র বন্ধু বিচিত্র চোখে তানিকে দেখতে লাগলো। তানির অস্বস্তি হলো ঠিক ই কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারলো না। বন্ধুর দৃষ্টি শুভ্র’র নজরে এলো। কৌতুহলী গলায় বলল, তুই কী তানিকে আগে থেকেই চিনিস?

লোকটা বিস্মিত গলায় বলল, ওনার নাম সত্যিই তানি?

এই প্রশ্নটায় তানিও বিব্রত বোধ করলো। এই ভদ্রলোক কে তানির চেনা পরিচিত মনে হচ্ছে না কোনোভাবেই। কোথাও কখনো দেখেছে কী না মনে করতে পারলো না।

শুভ্র বলল, মানে কী?

ভদ্রলোক হেসে বলল, না আসলে ভাবীকে কেমন চেনা চেনা মনে হলো। মনে হচ্ছে এর আগেও দেখেছি।

পরিবেশ কিছুটা হালকা হলেও শুভ্র’র মনের শঙ্কা কাটলো না। বন্ধুর মুখের অভিব্যক্তি যে অন্যকিছু বলছিল সেটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তানিকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলো না। তানি নিজে থেকেই বলল,

“আমি আসলে ঠিক মনে করতে পারছি না যে ওনাকে কোথাও দেখেছিলাম কি না! ”

শুভ্র ব্যাপার টা উড়িয়ে দিয়ে বলল, আরে ব্যাপার না। হতে পারে তোমাদের কখনো দেখা হয়েছিল কিন্তু তোমার মনে নেই, ওর হয়তো সেজন্য পরিচিত লাগছে।

“হু।”

কিছুক্ষণ বাইরে কাটিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রিসোর্টে ফিরে এলো। তানির বাইরে ভালো লাগছিল না তাই শুভ্র’ও জোর করলো না। তানি ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়লো। সেই ঘুম ভাঙলো শেষ বেলায়। দেখতে পেল শুভ্র ঘরে নেই, ভেবে নিলো হয়তো বাইরে হাটতে গেছে। তানি ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় কিছু সময় বসে রইলো কিন্তু শুভ্র’র কোনো খবর নেই। ফোন করেও পেল না। তানির মনে অজানা একটা ভয় জন্ম নিলো। এই ভয়টা অমূলক সেটা তানি জানে। তবুও অস্থিরতা বেড়ে চলছে। এই অস্থিরতা দূর হলো শুভ্র’কে কে দেখার পর। শুভ্র হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, তানি জলদি করে সব গুছিয়ে নাও আমরা এখন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হচ্ছি।

তানি বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। শুভ্র অপেক্ষা না করে নিজেই রুমে গিয়ে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করলো।
তানি জিজ্ঞেস করলো, আমরা চট্টগ্রাম কেন যাচ্ছি?

শুভ্র গোছাতে গোছাতে উত্তর দিলো,

“কারণ আমরা এখন ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেব”।

তানি ভয়ার্ত গলায় বলল, বাড়িতে কিছু হয়নি তো? আমি তো বিকেলে ফোন করে শুনলাম সবাই ভালো আছে”।

“বাড়ির সবাই ঠিক আছে কিন্তু আমার জরুরী কাজ পরে গেছে।”

তানি আর কিছু বলল না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব গুছিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।

বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত তানি কোনো কথা বলল না। শুভ্র’ও আগ বাড়িয়ে কিছু বলল না। বাসে ওঠার আগে হালকা কিছু খাবারও দুজনে নিঃশব্দে শেষ করলো। চট্টগ্রামে পৌছাতে ওদের সময় লাগলো চার ঘন্টার মতো। এই পুরো সময় টায় শুভ্র কোনো কথা বলল না। তানিও চুপচাপ রইলো। ওর মন টা খারাপ হয়ে গেল। ঠিকঠাক ভাবে ঘুরতেও পারে নি তার আগেই এমন চলে যেতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই শুভ্র’র জরুরী কোনো কাজ পড়ে গেছে নাহলে এতো তাড়াহুড়ো কেন করবে!

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার জার্নিতে শুভ্র ঘুমিয়ে কাটালো। তানি অবাক হলো কারন ও যতদূর জানে তাতে শুভ্র বাস, ট্রেনে ঘুমায় না। অথচ এখন ঘুমুচ্ছে। রাতের খাবার খাওয়ার সময় তানি ওকে ওষুধ খেতে দেখেছিল। সেটা যে ঘুমের ওষুধ ছিলো তা বুঝতে তানির অনেক সময় লেগেছে।

কক্সবাজার থেকে যে মিথ্যে কাজের বাহানায় শুভ্র ঢাকায় ফিরেছে সেটা তানি টের পেল তিন, চারদিন পর। এই তিন চারদিনে চোখে পড়ার মতো তেমন জরুরী কোনো কাজ শুভ্রকে ও করতে দেখে নি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here