কাছে_কিবা_দূরে
পর্ব_২৩
#সাবিকুন_নাহার_নিপা
তানিকে রেগে যেতে দেখে শুভ্র হেসে ফেলল। বলল,
“ইউ মেইড মাই ডে ডিয়ার বেটার হাফ। এই তো তুমি আগের ফর্মে ফিরে এসেছ। ”
তানি রাগী গলায় বলল, আপনি দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
শুভ্র গম্ভীর হয়ে গেল। বলল,
“আসলে ঢাকা ফিরে গিয়ে আমাকে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পে যেতে হবে।
তানির এবার একটু মন খারাপ হলো। কিছু না বলে চলে গেল। এতো মন খারাপ লাগছে। কতগুলো দিন শুভ্র কাছে থাকবে না।
শেষ পর্যন্ত তানি শুভ্র’র সাথে গেল না। মাহফুজা ফোন করে যেতে বললেও তানি কয়েকটা দিন থাকার জন্য অনুরোধ করলো। যাবার সময় শুভ্র বলল,
“ভালো থেকো তানি।”
তানি কোনো কথাই বলল না। মুখ ভার করে বসে রইলো। শুভ্র কিছু সময় অপেক্ষা করলো তানির মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। কিন্তু তানি কোনো উত্তর ই দিলো না। শুভ্র তানির মুখোমুখি বসে বলল,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো তানি। কিন্তু তুমি তো পণ করে বসে আছ যে আমার কোনো কথাই শুনবে না। তাই আমি সেই কথাগুলো লিখে রেখেছি। পড়তে তো নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? আমি চাই সেই লেখাগুলো পড়ে তারপর তোমার যা ভালো খারাপ বলার আছে সেগুলো শুনতে।
কথাটা বলে একটা লাল মলাটের ডায়েরি তানির পাশে রেখে চলে গেল।
শুভ্র চলে যাওয়ার পর তানি অনেকক্ষন কাঁদলো অভিমানে। ডায়েরি ছুঁয়েও দেখলো না। অনেক বেলা পর্যন্ত না খেয়ে ঘুমালো।
ঘুম থেকে উঠে দেখলো বাসায় কেউ নেই। এক আত্মীয়ের বাড়িতে সবাই দল বেঁধে বেড়াতে গেছে। একা বাড়িতে তানির একা একা কিছুই ভালো লাগছিল না তাই ডায়েরি পড়তে শুরু করলো।
ডায়েরি টা পুরোনো হলেও লেখাগুলো নতুন। ডেট দেখে বুঝলো লেখাগুলো ওর অসুস্থ থাকার সময়ের।
ডায়েরির প্রথম পাতার লেখাঃ
তানি এই ডায়েরি টা কয়েকবছর আগে আনিকা দিয়েছিল আমার জন্মদিনে। ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই বলে কখনো লেখা হয় নি। কক্সবাজার যাওয়ার আগে হঠাৎ চোখে পড়ায় ভাবলাম তোমাকে নিয়ে কিছু একটা লিখব কিন্তু তোমাকে পড়তে দেব না। যখন আমরা বুড়ো হয়ে যাব কিংবা আমি তোমার আগে মরে যাব তখন তুমি এই ডায়েরি হাতে পেয়ে পড়তে শুরু করবে। ডায়েরির লেখা পড়ে আনন্দে চোখ ভিজিয়ে ফেলবে কিন্তু সেই দৃশ্যটা সামনাসামনি দেখব না। কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্যরকম বলেই ডায়েরি তে এখন অন্যকিছু লিখতে হচ্ছে।
প্রথম পাতার এইটুকু লেখা পড়েই তানির চোখ ভিজে উঠলো।
দ্বিতীয় পাতা থেকে একটানা অনেকখানি লিখেছে শুভ্র।
তানি তুমি কয়েকদিন ধরে আমার পাশে নেই। বিছানার একটা অংশ ফাঁকা। আমার রাতে একফোটাও ঘুম হয় না। বুক টা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এইটুকুতেই এতো কষ্ট! তাহলে তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে তো মনে হয় মরেই যাব।
তানি আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে আছে? ওই যে তোমাকে ড্রেন থেকে হাত ধরে তুলেছিলাম? তুমি অনবরত কাঁদছিলে আর আমি তোমাকে বোঝাচ্ছিলাম। কী অদ্ভুত না! জীবনে আমি কোনোদিন ও ভাবিনি যে তোমার সাথে আমার দ্বিতীয় বার দেখা হবে। তোমাদের বাড়িতে তোমাকে যখন প্রথম বার দেখলাম তখন আমি ধাক্কা খেলাম। আরে এ তো সেই মেয়েটা! তোমার চোখেও তখন বিস্ময়ভাব প্রবল। আমি তখন ই বুঝেছি যে তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ। আমি ব্যাপার টা চেপে গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার হলো আমার মনে কেমন একটা চাপা আনন্দ হলো, অথচ আমি কিন্তু তোমার প্রেমে পড়িনি প্রথম দর্শনে। তবুও এতো আনন্দ হলো যেন পুরোনো ভালোবাসা ফিরে পেয়েছি।
তুমি যেমন বৃষ্টির দিনে আমার কথা ভাবতে তেমন আমিও ভাবতাম। কিন্তু আমাদের ভাবনার মধ্যে পার্থক্য ছিলো। যেমন ধরো বৃষ্টি হচ্ছে তখন কাছে অভ্র থাকলে ওকে বলতাম জানিস একবার একটা মেয়ে এমন বৃষ্টিতে ড্রেনে পড়ে ব্যাঙের মতো বসেছিল। তারপর দুজনে মিলে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতাম। এরকম অনেকবার হয়েছে। ভাবনার পার্থক্য হলেও মিল ছিলো, এটা কী শুধুই কাকতালীয়! আমি জানি না।
আমার খুব ভালো লেগেছিল যখন শুনলাম তুমিও আমায় নিয়ে ভাবতে। কতটুকু ভালো লেগেছিল সেটা তোমাকে বোঝাতে পারব না। তবে তারচেয়েও বেশী ভালো লেগেছিল যে আমি তোমার জীবনের প্রথম প্রেম সেটা শুনে। তুমি আমার জীবনে দ্বিতীয় নারী ছিলে। পুরুষ মানুষ প্রথম প্রেমিকা কিংবা স্ত্রীর সাথে যেমন থাকে, কিংবা অনুভূতি যেমন হয় দ্বিতীয়বার তেমন হয় না। তোমার ক্ষেত্রেও তেমন হয়েছে। এই যে আমি তোমাকে এতো লেগপুলিং করি, বিরক্ত করি, এটা কোনোদিন ই অবন্তীর সাথে করি নি। অবন্তীর সাথে কথা বলতে হতো মেপে মেপে। অবন্তীর রাগের ধাত ছিলো। সেটা তোমার মতো নাকি ফোলানো রাগ না, ভয়ংকর রাগ। রেগে গেলে মানুষ থেকে পশু হয়ে যেত। সেজন্য আমি অবন্তী কে ভয় পেতাম। তোমার সাথে এই ক’মাসে যতগুলো সুন্দর মুহূর্ত তৈরী হয়েছে অবন্তীর সাথে তেমন কোনো সুন্দর মুহূর্ত আমার মনে পড়ে না। আমাদের একসাথে আয়োজন করে, কিংবা হুটহাট রিকশায় চড়ার ও সুযোগ হয় নি, অবন্তীর রিকশায় চড়া পছন্দ না বলে।
তোমার আর অবন্তীর স্বভাবের যেমন পার্থক্য ছিলো তেমনি আমারও আচরণে ভিন্নতা ছিলো। তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার কখনো মনে হয় নি যে এটা বলা যাবে না, তানি রেগে যাবে। বরং তোমাকে রাগাতেই বেশী ভালো লাগে আমার।
এবার কিছু অন্য কথা বলি, কক্সবাজারে যখন বন্ধুটি আমাকে তোমার ব্যাপারে বলল, তখন মুহুর্তের মধ্যে আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলাম। কেন হলাম তা জানি না, সত্য মিথ্যা কোনো বাছ বিচার না করেই বারবার মনে হতে লাগলো আমি কী আবারও ঠকে গেলাম! কেন বার বার আমি এভাবে ঠকে যাই! তাহলে আমি কী মানুষ হিসেবে সত্যিই খারাপ।
অবন্তীর সাথে আমার প্রায় আড়াই বছরের সংসার ছিলো। সংসার টা আমার ই ছিলো কেবল। অবন্তীর ছিলো না। এই আড়াই বছরে আমার একবারও মনে হয় নি যে অবন্তী আমাকে ঠকাচ্ছে। আমাকে পরিবার থেকে দূরে রাখা, মেন্টাল টর্চার, রোজ রোজ অশান্তি। পর্যাপ্ত পকেট মানি না পেলে আক্রমণ এসব করলেও কখনো মনে হয় নি অবন্তী অসৎ ছিলো। বন্ধুদের সাথে আউটিং এ যাবার কথা বলে অবন্তী যে বেরিয়ে গিয়েছিল তখনও মনে হয় নি যে অবন্তী কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে গিয়েছিল।
এক্সিডেন্টের পর অবন্তীকে হসপিটালে আনার পর ডাক্তার রা বলল, মেয়েটার হাজবেন্ড স্পট ডেড। অথচ আমি তখন অক্ষত শরীরে হসপিটালের করিডোরে বসে আছি। জীবন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া স্ত্রীর কথা না ভেবে এই একটা কথাই আমাকে বারবার ভাবালো। তাহলে আমি অবন্তীর কে!
অবন্তী যে হোটেলে উঠেছিল সেখানে অন্য এক ছেলেকে স্বামী পরিচয় দিয়ে উঠেছিল। এক্সিডেন্টের খবর তারাই অবন্তীর বাড়িতে জানিয়েছিল।
চলবে….
(ধামাকা পর্বের বাকী অংশটুকু কাল)