“কাজের বেটি রহিমা” পর্ব- ১৫

0
810

“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
কিছুটা ভয়ে ভয়েই কলিং বেল বাজালো আয়ান। সায়মা কল দিয়ে নিশ্চিত হলো সে এসেছে কিনা। অত:পর দরজা খুলে তার টিশার্ট ধরে টেনে ভেতরে এনে আবার দরজা লক করে দিলো৷ এসময় রহিমাকে এখানে দেখে আয়ান বিস্মিত হলো। সেদিকে তোয়াক্কা না করে সে ঘরে এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে সায়মাকে নানান কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। সায়মা কোনো প্রত্যুত্তর না করে আবার তার টিশার্ট টেনে ধাক্কিয়ে নিজের রুমে নিয়ে দরজা আটকে দিলো। শোনা গেলো সায়মার চেচামেচি! কান্নার সাথে আয়ানের উপর সমস্ত রাগ ঝাড়ছে! আয়ান কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছে না! তবে এটা বেশ বুঝতে পারছে এসবের মূলে রয়েছে কাজের বেটি রহিমা।
রহিমা ডাইনিং টেবিলের পাশে দাড়িয়ে সায়মার চেচামেচি শুনছিলো। এক পর্যায়ে দেখলো দরজা খুলে ধাক্কিয়ে রুম থেকে বের করে দিলো আয়ানকে! আবার দরজা লাগিয়ে সে কান্না করছে। আয়ান রহিমার দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। যা দেখে রহিমা কঠিন একটা ঢোক গিললো। কিন্তু আয়ান জিজ্ঞাসা করলো শান্ত গলায়,
“বাড়িতে কেউ নেই?”
“আমি আছি।”
আয়ান দাতে দাত চেপে বললো,
“আমি তো আর অন্ধ না। আর কেউ নেই?”
রহিমা দু’দিকে মাথা নেড়ে “না” জবাব দিলো। আয়ান এবার দরজায় নক করে বললো,
“ইতু, ওপেন দ্যা ডোর৷ প্লিজ লিসেন, কাল রাতে ঘুম আসছিলো না টেনশনে তাই খেয়ে ফেলছি! বিশ্বাস কর। অনেকদিন যাবত আমি হাতও লাগাইনি। প্লিজ, কান্না করো না। দরজা খুলো।”
কয়েকবার বলার পরেও দরজা খুললো না। আয়ান আবারও রহিমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“বাড়ির সদস্যগন কি ফিরবে না আজ?”
রহিমা মাথা নেড়ে না করলে আয়ান বললো,
“আমার ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।”
“এহ! আমি পারতাম না।”
“তোকে তো এখন!”
“আপাগো…!”
রহিমা আয়ানের ভয়ে চিৎকার দিতেই সায়মা দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এবং রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
“এখনো যাওনি তুমি! খবরদার, রহিমার সাথে কোন খারাপ হয়েছে তো!”
এবার আয়ান সুযোগ পেয়ে সায়মাকে সহ ঠেলে রুমে প্রবেশ করলো। সায়মা তাকে বের করে দিতে চাইছিলো কিন্তু এবার আয়ানের জয়। সায়মাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সে আজ এখানে থেকে যাবে। আর রহিমার উদ্দেশ্যে ভেতর থেকে আয়ান বলে দিলো যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে। রহিমা ড্রয়িং রুমে এসে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো। অত:পর রুমের লাইট অফ করে দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো। যার ফলে বাইরের আলো এসে রুম এখন আচছা অন্ধকার। দুতিন ঘন্টা পর সায়মা রুম থেকে বেরিয়ে রহিমাকে দেখে গেছে এবং মেইনডোর সহ ঘরটাও চেক করে গেছে। সায়মার পিছু পিছু আয়ানও ঘুরেছে। যদি দেখে যাওয়ার বদলে সায়মা তার কাছ থেকে পালায় সেই সন্দেহে। আয়ানের এই কান্ডে মনে মনে হাসি পেলেও প্রকাশ্যে বিরক্তিকর মনোভাব ফুটিয়ে তুলেছে সায়মা।
সকালে রহিমা ঘুম থেকে উঠে সায়মার রুমের দরজা খোলা দেখলো। “আপা” বলে হাক ছাড়লো কিন্তু সাড়া পেল না। দরজার কাছে এসে দেখলো কেউ নেই ভেতরে। পরক্ষণে দেখলো মেইন দরজা খুলে দুজন কথা বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করছে। সায়মার পড়নে তাতের শাড়ি। যে পোশাক পড়ে তাতেই ভালো মানায়। শাড়িতেও দারুণ লাগছে তবে শাড়ি পরহিতা সায়মাকে দেখে রহিমার মন খারাপ হয়ে গেছে। সে কিছু বলার আগে সায়মা ই বললো,
“খুজছিলি নাকি? ছাদে গিয়েছিলাম হাটতে।”
রহিমা বাথরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বললো,
“ছয়টা বাইজা গেছে আমি চইলা যাই৷”
“থাক না আরও কিছুক্ষণ। নাস্তা রেডি করি, একসাথে খেয়ে তারপর যা। ওবাড়িতে যাওয়া মাত্র দশ মিনিটের ব্যাপার।”
“আধ ঘন্টা লাগে আমার।”
“রিকশায় যাবি।”
রহিমা মুখ ধুয়ে এলো। আয়ান টিভি অন করে সোফায় বসলো। সায়মা চুল খোপা করে রুম থেকে বেরিয়ে আয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,
“কি খাবে বলো? পরটা ভাজি খাবে না ভুনা খিচুড়ি রান্না করবো?”
“উহুম।”
“বিরিয়ানি?”
“তোমাকে রান্না করতে হবে না। রহিমা করুক।”
“কেন? তুমি নিশ্চিত নাকি যে আমার রান্না খাওয়ার অযোগ্য হবে?”
“বউয়ের হাতের রান্না এখন খাবো না।”
“কি আযব! মানুষ শখ করেও তো খেতে চায়! আর তুমি!”
“আমার বাড়ি গিয়ে শখ করে প্রতিদিন রান্না করে খায়িয়ো। তার আগে একবারও না।”
সায়মা কিচেনে গিয়ে খাসির মাংস পানিতে ভিজিয়ে এলো। রহিমা জিজ্ঞেস করলো,
“আপা, কি রান্না করমু?”
“বিরিয়ানি।”
আয়ান জবাব দিলো,
“যা-ই করার দ্রুত করবি। দশ মিনিটের মধ্যে।”
রহিমা কিচেনে চলে গেলো। এবং সায়মা এসে আয়ানের কাছে সোফায় বসলে আয়ান বললো,
“উঠো।”
“কেন?”
“উঠতে বলছি, উঠো।”
সায়মা উঠে পড়লে আয়ান বিপরীত পাশের সোফা দেখিয়ে দিলো বসার জন্য। সায়মা তার কান্ডে রাগ করে এখানে না বসে থেকে রহিমার কাছে চলে গেলো। আয়ান টিভি দেখতে দেখতে তুলনামূলক উঁচু স্বরে বললো,
“ইতু, তুমি কি জানো? এজ এ লাভার, রহিমা আমাকে পছন্দ করে?”
আয়ানের কথায় সায়মা বিস্মিত! আর রহিমা হতবাক! সে জানতো তাহলে রহিমা তাকে পছন্দ করে! আর সায়মা তো এমন কিছু ভাবতেও পারেনি! সে রহিমার দিকে তাকাতেই রহিমা হাত দ্রুত চালাতে লাগলো। সায়মা আবার আয়ানের কাছে এসে বিপরীত সোফায় বসে বললো,
“কি বলছো এসব?”
আয়ান একই স্বরে বললো,
“রহিমা আমাকে ভালোবাসে। রেগে আর বেগে, আমি তাকে যেভাবেই আঘাত করি সে কখনো আমাকে রিটার্ন করে না৷ তবে একটু মেজাজ দেখায় আর অভিমান করে। আমি তো এমনই। আর সে এমন আমির প্রেমে পড়ে গেছে। ইতিমধ্যে সেটা তার কৃতকর্ম প্রকাশ করে দিয়েছে। তুমি কি জানো, তোমার আমার বিয়ের ব্যাপারে শুনে সে কতটা কষ্ট পেয়েছে? আমি তার চেহারা দেখে বুঝে গিয়েছিলাম সেটা। কিন্তু তোমার টেনশনে আমি তাকে উক্ত বিষয়ে সান্ত্বনা পর্যন্ত দিতে পারিনি। সেদিনের পর থেকে তো তাকে আর হাসতেও দেখলাম না। যেখানে সে কারণে অকারণে হাসতো। অযথাই বেশি কথা বলতো, চাপা ও দুষ্টুমিতে মশগুল থাকতো।”
আয়ানের কথায় সায়মার চেহারায় চিন্তার ছাপ ভেসে উঠলো! আয়ান রহিমার উদ্দেশ্যে বললো,
“রহিমা, আমি তোকে সবসময়ই একজন ভালো ফ্রেন্ড মনে করি। ফ্রেন্ডরা যেমন হাসাহাসি, মারামারি করে ঠিক তেমনই! আর তুই বেশি গাল ফোলাতে জানিস তাই তোকে রাগাতে ভীষণ ভালো লাগতো। কিন্তু তোর অস্পষ্ট প্রেম আমার কাছে স্পষ্ট হলেও আমি তোর প্রেমে সাড়া দিতে পারিনি সেজন্য দুঃখিত। সমাজ কিন্তু সেটা মোটেও মানবে না। যদিও আমি সমাজ মানি না। কিন্তু তুই যেই স্থানে নতুন কদম ফেলেছিস আমি আরও অনেক আগেই সেই স্থানে ভ্রমণ করেছি। এখন শুধু স্থান পাকাপোক্ত করা অর্থাৎ দায়িত্ব পালন করার পালা। আমি তোর শত্রুমিত্র হওয়ার প্রেক্ষিতে একটা দোয়া রাখি, খুবই ভালো একজনকে পাবি যার সাথে তুই সেই স্থানে ভ্রমণ করতে পারবি৷ যে তোকে কেয়ার করবে সবসময়। তবে একটা উপদেশ, সমাজ ছাড়াতো আর কেউ চলতে পারে না। সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে মানবে না এমন অর্থাৎ তোর পছন্দের সে যেন বিত্তশালী না হয়। তোর সাথে মানানসই এমন কারো মাঝে ভালোকে পছন্দ করিস যে কখনো তোকে তোর লেভেল দেখাতে পারবে না। বরং সম্মান দিতে জানবে। আর আমি জানি, তুই তোর আপাকে খুব ভালোবাসিস। এখন তোর আপা আমার বউ হওয়ায় আবার তার শত্রু হয়ে যাস না৷ এটা মাথায় রাখিস সে তোর শত্রু না, বরং সে তোর শত্রুর বউ।”
এখন সবটাই নিরব! সায়মা ভাবনাসহিত নিষ্পলক তাকিয়ে আছে আয়ানের দিকে আর আয়ান টিভির চ্যানেল পাল্টাতে ব্যস্ত। এদিকে কাজ করতে করতে আয়ানের কথা শুনে ও ভেবে রহিমার দুচোখ থেকে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভেতরটা যেন হঠাৎ করেই পাথর থেকে পাহাড় ন্যায় ভারি হয়ে গেছে। আবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই ভারি অনুভবটা দীর্ঘ নিশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এসেছে। এবং তুলোর মতো হালকা হয়ে গেছে মন! নিজের মনকে শক্ত করে সে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। অত:পর চোখ মুছে ট্রেতে বাটি গুলো তুলে বেরিয়ে আসতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। সায়মা কিছুটা ভরকে গেছে! তার বাবা মা কি এতো সকালেই চলে এলো! সে তো বলেছিলো যেন বিকেলে আসে! দরজার লক ক্যামেরা দিয়ে ওপাশের লোককে দেখে আরও ভরকে গেছে সে! আয়ান ইশারায় জিজ্ঞেস করতেই সে ঠোঁট নাড়িয়ে উচ্চারণ করলো ,”রুমেল!”
রহিমা আবার কিচেনে এসে ট্রে রেখে দ্রুত বটি হাতে বেরিয়ে এলো। আর আয়ান উঠে সায়মাকে সরিয়ে সে দরজা খুললো। রুমেল একাই আছে। ঘরে অপরিচিত ছেলে দেখে সে বিস্মিত! ছেলের পেছনে দাড়িয়ে সায়মা! আয়ান তার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
“কি ভাই? কাকে চাই?”
রুমেল তাকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে ব্রু কুচকে বললো,
“আপনি কে?”
সায়মা আয়ানকে সরিয়ে রুমেলকে ধাক্কা দিয়ে আবার বাইরে ঠেলে দিয়ে বললো,
“সে তোর যম। সাহস কি করে হয় আবার এখানে আসার! ভাগ্য ভালো থাকতে থাকতে বিদায় হ। নতুবা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবি না।”
সাথে সাথেই দরজা লাগিয়ে দিলো সায়মা। আয়ান চাইছিলো কিছু বলতে কিন্তু সায়মা তাকে দরজা খুলতেই দিলো না। সে নিশ্চিত একটা গন্ডগোল বাধিয়ে ছাড়বে আয়ান। তাই রুমেলের সম্মুখীন হতে দিলো না তাকে। রুমেল কিছুক্ষণ সায়মাকে ডেকে ডেকে দরজায় থাপ্পড় আর লাথি দিয়ে চলে গেলো। রহিমা বটি রেখে আবার খাবারের ট্রে নিয়ে এলো। আয়ান ও সায়মা সোফায় বসেছে। তাদের একসাথে দেখলে যে রহিমার কষ্ট হবে আয়ানের সেই ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সায়মা এবার স্বেচ্ছাতেই বিপরীতে বসেছে। রহিমা টেবিলে ট্রে রাখতেই সায়মা বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“এতো তারাতাড়ি শেষ!”
আয়ান ঢাকনা খুলতে খুলতে বলতে লাগলো,
“কাজের বেটি রহিমার ম্যাজিক, বুঝলে!”
তবে কথাটা বলা মাত্রই মেজাজ চড়ে গেলো আয়ানের! ঢাকনা খুলে দেখলো এক প্লেটে কাচা মাংস, এক প্লেটে চাল, এক প্লেটে আদা বাটা, এক প্লেটে মশলা! আয়ান রেগেমেগে বললো,
“এসব কি!”
রহিমা জবাব দিলো,
“ক্যা? কাজের বেটি রহিমার ম্যাজিক! আপা বলছে বিরিয়ানি রান্না করতে, আর আপনে বলছেন যেন দশ মিনিটে করি। আমি তো দুজনরেই ভালোবাসি। তাই কারো কথাই ফেলতে পারি নাই! দশ মিনিটে এইটুকুর বেশি বিরিয়ানি রান্না করতে পারি নাই। এইবার খান।”
আয়ান রেগে ঠাস করে ঢাকনা লাগিয়ে দিলো আর সায়মা হেসে কুটিকুটি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here