“কাজের বেটি রহিমা” পর্ব- ১৭

0
990

“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ১৭
(নূর নাফিসা)
.
.
পাঁচদিন পর রহিমা কাজে এলো। তার মা এখন আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ। কিন্তু কাজ তো আর বন্ধ রাখতে পারবে না। কাজ বন্ধ করে দিলে অন্ন আসবে কোত্থেকে! তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর দুই বাড়িতে কাজ করবে না। কাজকর্ম ও বেতন বেশি হওয়ায় কাইয়ুম ভিলায় কাজ করবে। কিন্তু হক মঞ্জিলের কাজটা ছেড়ে দিবে। এখন তো আর কারো পড়াশোনা ও ভরনপোষণের খরচ নেই। সুতরাং এতেই চলে যাবে তার মাকে নিয়ে ছোট সংসার। দিনের অর্ধেকটা সময় এখন থেকে অসুস্থ মায়ের জন্য রাখবে।
কাইয়ুম ভিলায় আসতেই মারিয়া কাইয়ুম জিজ্ঞেস করলো,
“তোর মা এখন কেমন আছে?”
“একটু ভালো হইছে, আম্মা।”
“যাক, টেনশন করিস না। শুধু নামাজ পড়ে পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করিস। সবকিছুর মালিক আল্লাহ।”
“হু।”
রহিমার কণ্ঠ শুনে পিংকি রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
“রহিমা এসেছিস? ভালোই হয়েছে। তোর মা কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“তোর সেই বোনটা দেখতে আসে মাকে?”
“না।”
“হুহ্! বস্তির ছেলেমেয়ে গুলোকে এজন্যই দেখতে পারি না। না আছে আত্মসম্মান, না রাখে পরিবারের খোঁজখবর! পেটে ভাত না চললেও প্রেম চলে ঠিকমতো! আর যারতার সাথে যেখানে সেখানে বশত গড়ে তুলে! কোনো বোধ নেই!”
পিংকির কথায় রহিমা ক্ষেপে গিয়ে বললো,
“ভাবি, একজনের জন্যে সকলের উপর আপনে আঙুল তুলতে পারেন না। ভালা খারাপ সব জায়গায়ই আছে।”
“শোন, একটা ভাত পরিক্ষা করলেই হাড়িভরা ভাতের খবর পাওয়া যায়। আর বস্তিতে তো এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। আজ তোর বোন গেছে, কাল দেখবি পাশের বাসার কেউ চলে গেছে, হতে পারে লালসায় পড়ে তুইও চলে যাবি একসময়! এসবের কি গ্যারান্টি আছে।”
“হু! বস্তির মানুষ খারাপ, আর আপনারা ধনীলোকেরা খুব ভালা, তাই না? গোপনে গোপনে বিয়া কইরা দুই চাইর সংসার বাধে সেইটা কিছু না! আর বস্তির পোলাপান পালায় গেলেই সেইটা অনেক কিছু! বস্তির মানুষ দুই বিয়া করলে কইবো লুইচ্চা! আর ধনী লোক দুই বিয়া করলে কইবো সামর্থ্য আছে করছে। সুতরাং সেইটা সুন্নত৷ কিন্তু বস্তিতে আর সুন্নত হয় না! আর পিরিতি কম কোনদিক দিয়া! আপনে নিজের কথাই চিন্তা কইরা দেখেন স্কুল ভার্সিটি পাড় করতে করতে কয়টা প্রেম কইরা আসছেন। আর বস্তির পোলাপান করলে দোষ। এইযুগে এমন কোনো ধনী লোক আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়ে নাই যে প্রেম করে নাই!”
“মুখ সামলে কথা বল, বেয়াদব মেয়ে! বড্ড বেশি চাপা করতে জানিস!”
“উচিত কথা বললেই বেয়াদব হইয়া যাই আর আপনারা সাধু! দিনরাইত ফোনে সংসার জমান, ঘরের খাবার পঁচাইয়া রেস্টুরেন্টে টাকা ফালান সেইগুলো খুব ভদ্র মানুষের পরিচয়! আপনারা যান রেস্টুরেন্টে আর বস্তির গরিবরা না হয় যায় খোলামেলা পার্কে! তফাত তো এইটুকুই না! তাইলে তারা কেন আজেবাজে হইয়া যায়! আর পালানোর কথা কইলেন না? মানুষ কখন পালায়, জানেন? যখন তার পরিবার তারে শাসনে রাখে এবং বুঝতে পারে সম্পর্ক মানবো না তখন পালাইয়া যায়। যেই শাসনটা আপনাগো ধনী পরিবারে দেখা যায় না! মা বাপের কাছে নির্লজ্জের মতো আইসা সরাসরি জানায় দেয় প্রেম করে, পছন্দের মানুষ আছে! আর বাপ মা কি সুন্দর কইরা মাইনা নিয়া আয়োজন কইরা বিয়া দেয়। এইসব আমাদের বস্তিতে চলে না। কারো সাহস হইবো না, মা বাপের কাছে নির্লজ্জের মতো আইসা এইসব কইতে। আর যদি বলে তো ঝাটার বারি কপাল বরাবর পড়বো। তবে একেবারে নাই যে সেইটাও আমি কইতাম না। কারণ ভালো খারাপ সব জায়গাতেই আছে। আপনাদের ধনী পরিবারেও ভালো খারাপ সব আছে।”
খুব তেজ নিয়ে কথাগুলো বললো রহিমা। না, সে প্রেম করে পালিয়ে বিয়েকে সাপোর্ট করে না। কিন্তু একজনের জন্য যে পুরো জাতের বদনাম করলো পিংকি তাই সে এভাবে যুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে। একজনের জন্য সবাইকে খারাপ বলবে সেটা তো মেনে নেওয়া যায় না! মৌমাছির দোষ মৌচাকে কেন পড়বে!
এতোক্ষণ যাবত দুজনকেই চুপ করতে বলছিলেন মারিয়া। কিন্তু কেউই থামেনি। রহিমার কথা বড্ড লেগেছে পিংকির গায়ে! তাই সে মারিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“মা, দেখেছেন! দেখেছেন কেমন চাপা করছে!”
“চুপ করো। সবই দেখছি আর সবই শুনছি। তুমিই কম কিসে! কথার শুরুটা তো তুমিই করেছো না! এক ভাত দিয়ে হাড়িভরা ভাতের অবস্থা জানাতে এসেছো। এবার তার স্বাদ নিবে না! ভুল বলেনি তো রহিমা!”
মারিয়া রহিমাকে না বলে তাকে বলায় পিংকির চোখে পানি টলমল করছে! সে রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“হ্যাঁ, আমিই বেশি বলি! কিন্তু এই মেয়েকে এই বাড়িতে আর কাজে রাখা যাবে না। বাবাকে বলে নতুন কাজের মেয়ে নিয়ে আসবো।”
“কোথাও যাবে না রহিমা। এবাড়িতেই কাজ করবে সে।”
“তাহলে আমার জন্য আলাদা কাজের মেয়ে রাখবো।”
পিংকি রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। রহিমা বিড়বিড় করতে করতে কিচেনের দিকে গেলো। মারিয়া রহিমাকে ধমকে বললেন,
“একদম চুপ! আর একটা কথাও যেন না শুনি তোর মুখে!”
রহিমা চুপচাপ কাজ করে গেলো। আজ আয়ানের দেখা পেল না সে। দুদিন আগে তার মাকে দেখতে আয়ান বাসায় গিয়েছিলো। তখনই তার মুখটা কেমন মলিন দেখাচ্ছিলো। কিন্তু কোনো বিষয়ে কিছু বলেনি৷ শুধু মায়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে চলে এসেছিলো। তাছাড়া সায়মার সাথে হসপিটালেই শেষ দেখা ও কথা হয়েছিলো। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। তাদের বিয়ের ব্যাপারস্যাপার কতদূর হলো তা খুব জানতে ইচ্ছে করছে রহিমার।
ভাবতে ভাবতে কাজের মধ্যে সময়টা পাড় করলো রহিমা। অত:পর হক মঞ্জিলে এলো। আজই হিসেবনিকেশ মিটিয়ে এবাড়িতে কাজ ছেড়ে দিবে সে। কিন্তু এখানে এসে ঘটলো ভিন্ন কিছু! রহিমা আসতেই সায়মা তাকে ধরে নিজের রুমে নিয়ে গেলো।
“ভালো আছেন আপা?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তোর মা কেমন আছে?”
“আগের চেয়ে একটু ভালো। তবে আমি আর কাজ করতে পারতাম না দুই বাড়ি। একটা কাজ ছাড়তে হইবো। জানেনই তো, মা সারাদিন একলা ঘরে পইড়া থাকে।”
“কি বলছিস তুই! কাজ ছেড়ে দিবি!”
“হু। মা অসুস্থ না!”
“কবে ছাড়বি?”
“এই মাস তো শেষই। আর আইতাম না।”
“আর ক’টা দিন একটু ম্যানেজ কর। খালামনি আর মামারা ঘিরে ধরেছে বিয়ের জন্য। তারা সবাই চায় আত্মীয়ের মাঝে নতুন আত্মীয়ের সৃষ্টি করতে। মা বাবাও রাজি হয়ে গেছে! কাল নানুবাড়ির লোকজন আসবে কথা পাকা করতে! হয়তো আংটি পড়িয়ে যাবে।”
“ভাইজানরে কিছু জানান নাই?”
“জানিয়েছি। সে আরও বেশি টেনশনে আছে! বাধ্য হয়ে বলেছে পালিয়ে যেতে! এটা কি সম্ভব! ভাইয়ার কর্মেই বাবা কতটা কষ্ট পেয়েছে! এবার এমন কিছু হলে দুর্ঘটনা ঘটবে নিশ্চিত! এখন আমার মনে হচ্ছে সেদিন বিয়েটা করাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। তাহলে এতোটা ডিপ্রেশনের সৃষ্টি হতো না। থাকতাম, তার গার্লফ্রেন্ড হয়েই থাকতাম! কারণ সে গার্লফ্রেন্ড বাঁচাতে না এলেও বউকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। বিয়েটা যে কেন করতে গেলাম!”
সায়মা নিজের মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো খাটে। অত:পর আবার বলতে লাগলো,
“জানিস? সেদিন আমার কি হয়েছিলো সত্যিই আমি জানি না! তবে এটা জানি, সতেজ মস্তিষ্কে আমি এই ভুলটা হতে দিতাম না আয়ানকে দিয়ে। তারপরও একটা পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিলাম পরিবারকে মানিয়ে নেওয়ার, সেটাও বিফলে গেলো! আর এই রুমেল যে এমন কিছু করবে আমি ভাবতেও পারিনি! মা তো এতোদিন আমার বিয়ের কথা তুলেইনি! এই বদমাইশটার জন্য সব এলোমেলো হয়ে গেছে! তুই কিছু একটা কর না! যেকোনো ভাবে ভেঙে দে বিয়েটা। আমার আয়ানকে নিয়েও ভয় হয়! আমি নিশ্চিত, কৌশলে কিছু করা সম্ভব না হলে সে পাগলের মতো যেকোনো পদক্ষেপ নিতে দুইবার ভাববে না!”
রহিমা পড়ে গেলো মুশকিলে! কি করা যায়! বন্ধু হয়ে তার বিপদে তারা পাশে থেকেছে এইমুহূর্তে তাদের বিপদে পিছিয়ে পড়া মোটেও ঠিক হবে না। কিছু একটা করা প্রয়োজন। কিন্তু কি করবে!
রহিমা চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। ফারহানা হক তাকে দেখে তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলো। রহিমা জবাব দিয়ে চলে গেলো কাজে হাত লাগাতে। ভাবছে তো ভাবছেই। ভাবনার শেষ হচ্ছে না৷ ভাবতে ভাবতে বাবুদের কাপড়চোপড় ধুয়ে ঘর মুছে দিলো। সায়মা সেই যে তার রুমে বন্দী হয়েছে বের হয়নি আর। হয়তো কান্না করছে!
শেষ পর্যন্ত রহিমার ভাবনার ইতি ঘটলো। আর ভাববে না তাদের নিয়ে। লুকোচুরি করে পুতুল বউ খেলা গেলেও সংসার নামক খেলাটা খেলা যায় না। তাই এবার রহিমা সত্যটা জানাতে বাধ্য। পরে যা হবার হবে। ইশতিয়াকের রুম থেকে ফারহানাকে ডেকে ফারহানার রুমে এসে জানিয়ে দিলো সায়মার আর আয়ানের বিয়ের ব্যাপারে। তার সাধ্যমতো যতটা সম্ভব গুছিয়ে বুঝিয়ে বলেছে। তাদের ডিপ্রেশনের কথা জানাতেও বাদ রাখেনি। তাছাড়া রুমেলের ব্যাপারটাও ফাস! ফারহানা স্তব্ধ! এছাড়া আর কোনো ভঙ্গিমা প্রকাশ পায়নি তার চেহারায়! তিনি রহিমার হাত ধরে চলে এলেন সায়মার রুমে। দরজা ভেতর থেকে লক করে উক্ত বিষয়ে সত্যতা যাচাইয়ে সায়মাকে জিজ্ঞেস করতেই সায়মা থমকে গেছে! মাকে জানানো টা কি রহিমার উচিত হয়েছে! এখন সে কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না! তাই সে নিরব! তাকে নিরব থাকতে দেখে ফারহানা ধমকে বললেন,
“চুপ করে আছিস কেন?”
সায়মা মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে ধাধানো কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, সত্যি।”
“ছি! একটা বার ভাবলি না আমাদের কথা! এখন তো মেরে মেরে বুঝানোর বয়স রয়ে যায়নি তোর! নিজের ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা অনেক আগেই আয়ত্তে এসে গেছে। এমন একটা ভুল কিভাবে করতে পারলি! তোর বাবা জানতে পারলে ব্যাপারটা কতটা খারাপ হবে ভাবতে পারছিস! ছেলে মাথা কেটেছে আর মেয়ে এবার গলা কাটবে!”
সায়মা কান্না আর চেপে রাখতে পারছে না! সে কান্নাসহিত বললো,
“সরি মা! সেসময়ে তোমাদের মেয়ে অবুঝ হয়ে গিয়েছিলো! এমনটা করার কথা কখনোই ভাবিনি। পছন্দটা আস্তে আস্তে মন থেকে উত্তোলিত হয়েছে। আর বিয়েটা হঠাৎ! আমি চাইনি এভাবে তোমাদের অবাধ্য হতে! কষ্ট দেওয়ার কথা তো ভাবিও না কখনো৷ কিন্তু ভুলটা থেকে মুক্ত হতে নিরবে অনেক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিলাম!”
“এইসব ব্যপারে আর কোনো কথা উচ্চারণ করবি না। চুপচাপ সেই ছেলেকে বল তার পরিবারকে ম্যানেজ করতে। বিয়ে আবার হবে। আর উক্ত বিষয় যেন মাটি চাপা পড়ে যায়। তোর বাবার কানে গেলে খুব খারাপ হবে। আর শোন, মা বাবা সমন্ধ ঠিক করলে যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন নিজেরা দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকে। আর সেই দায়বদ্ধতা হয়ে থাকে মেয়েদের শক্তির উৎস। পিতামাতার মর্যাদায় গর্বিত হয়ে শ্বশুর বাড়িতে মাথা উঁচু করে চলতে পারে। যেই সুযোগটা থেকে তুই বঞ্চিত হলি। নিজের সুখ আর দুঃখের জন্য নিজেই দায়ী থাকবি। সন্তান তো, ফেলে দিতে পারি না।”
ফারহানা হক চলে গেলেন। সায়মার অনেক কান্না আসছে। মা কষ্ট পেয়েছে ভীষণ। নিজের কাছে সে এখন নিকৃষ্ট সন্তান, যে কি না জন্মদাত্রীকে কষ্ট দিলো!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here