“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ১৮
(নূর নাফিসা)
.
.
রহিমা আজ চুপচাপ কাজ করে গেছে। কখনো মনে হয়েছে কথাটা জানিয়ে দিয়ে ঠিক করেছে আবার সায়মার কষ্ট দেখে কখনো মনে হয়েছে কাজটা ঠিক হয়নি! সায়মার বাবা আর ভাই কেউই আজ বাড়িতে নেই। তখন থেকে সায়মা নিজ রুমে পড়ে পড়ে কান্না করছে আর ফারহানা হক ছেলের ঘরে পড়ে আছে বউ আর নাতিদের নিয়ে। আর রহিমা নিজের ইচ্ছেমতো কাজকর্ম সম্পাদন করে যাচ্ছে।
আসরের নামাজ আদায় করে শেষ বিকেলে রান্নার জন্য কিচেনে এসেছেন ফারহানা হক। রহিমা সবজি কেটেকুটে রেখেছে। তিনি রহিমার উদ্দেশ্যে বললেন,
“ছাদে যাসনি?”
“হু, একলা একলা পানি দিয়া আসছি।”
“কেন? সায়মা যায়নি?”
“উহু। আপায় কাঁদতাছে সেই তখন থেকে!”
ফারহানা ব্রু সামান্য কুচকে তাকালো তার দিকে। অত:পর চুলা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো সায়মার রুমের উদ্দেশ্যে। এখন আবার কেন গেলো তা দেখতে রহিমাও পিছু পিছু ছুটলো। সায়মা গুটিসুটি মেরে দুই হাটু জড়িয়ে ধরে আনমনে বসে আছে ফ্লোরে। কান্না করায় চোখ ভেজা এখনো তবে গড়িয়ে পড়া অশ্রু নেই। ফারহানা রুমে আসতেই সায়মা বসা থেকে উঠে দাড়ালো। মেয়ের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
“কাঁদছিস কেন এখানে বসে বসে? সেই ছেলের কাছে ফোন করিস নি? কি বলেছে সে?”
সায়মা দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে মলিন মুখে জবাব দিলো,
“করিনি কল।”
“করিসনি কেন? কথা বলে আজকের মধ্যেই ম্যানেজ করতে বল৷”
কথাটা বলে ফারহানা হক আবার চলে গেলেন। সায়মার চোখ থেকে আবারও অশ্রু ঝরছে! মা কখনোই তার সাথে এভাবে কথা বলে না! তবে আজ বলছে কেননা তিনি কষ্ট পেয়েছেন মেয়ের কৃতকর্মে! ফারহানা যাওয়া মাত্র সায়মা দৌড়ে কিচেনে চলে এলো। আর পেছন থেকেই মাকে ঝাপটে ধরে কান্না করতে করতে বারবার বলে যাচ্ছে,
“সরি মা। সত্যিই জানি না আমার কি হয়েছিলো সেদিন! আমি এমনটা করার কথা ভাবিও নি কখনো! সরি!”
ফারহানা হক চুলো জ্বালাতে যাচ্ছিলেন। মেয়ের জন্য আর পারলেন না! তিনি চুলা জ্বালানো রেখে আড়ালে চোখ মুছে নিলেন যেটা রহিমার চোখে দৃশ্যমান। মনে পড়ে গেলো ফেলে আসা দিনের কথা! ভাইয়ের দ্বারা যতবার কষ্ট পেয়েছে ততবার এভাবে চোখ মুছে নিয়েছে মা। ছোট বোনটাও যখন এভাবে চলে গেলো হাউমাউ করে কেঁদেছে মা! হোকনা সে যত ভালো আর খারাপ, সন্তানের জন্য মায়ের মন ঠিকই কাঁদে! কে চায় তার সন্তান অন্যায় করুক! কে চায় তার সন্তানের অকল্যাণ হোক! সব মা তো সন্তানের সুখটাই কামনা করে৷ আর কষ্টগুলো নিজের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে রাখতে চায়৷ যদিও কখনো কখনো পাথর ফেটেই বেরিয়ে আসে সেই কষ্ট!
ফারহানা হক সায়মাকে ছাড়িয়ে মুখোমুখি হয়ে দুহাতে গাল মুছে দিলেন। অত:পর মাথায় চুমু দিয়ে বললেন,
“এখন কেঁদে কি হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। যেটা করতে বললাম সেটা করো গিয়ে৷ যাও। তোমার সুখ দেখতে চাই আমি।”
সায়মা আবারও তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপিয়ে রাখলো। ফারহানা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“যেতে বললাম না! সায়মা, রান্নার দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। আর একবারও যেন কাঁদতে না দেখি।”
“আই লাভ ইউ মা।”
সায়মা নিজের রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আয়ান বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলো। কিন্তু মন খারাপ থাকায় সায়মা ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলো। এখন সে ডায়াল করার সাথে সাথেই রিসিভ হলো,
“কত বস্তা ঘাস কাটলে? যার জন্য তিনঘণ্টা যাবত আমাকে ডায়ালের পর ডায়াল করে যেতে হলো!”
“ফাজলামো রাখো।”
“মন খারাপ?”
“ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার আছে।”
“আমিও তো ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার জন্যই এতোক্ষণ যাবত কল করে যাচ্ছি!”
“ওকে, বলো।”
“আগে বলো, তোমার কি হয়েছে?”
“ধুর! বললে বলো তো। কিছু হয়নি আমার।”
“হুম, রুমেলের ব্যাপারটা এবার মাথা থেকে নামিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও। ব্যাটা মাকড়সার জালে আটকে গেছে!”
“মানে! তুমি কি তার সাথে কিছু করেছো?”
“আরে! এত জ্বলছে কেন তার জন্য?”
“আয়ান আমি বারবার নিষেধ করেছি তোমাকে কোনোরকম ঝামেলায় জড়াতে। এভাবে নিজের ক্ষতি করবে তুমি। মেরেছো নাকি তাকে? তার চাচা কিন্তু পুলিশ অফিসার। জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়বে তোমাকে।”
“আরে! তার চাচা যা-ই হোক, ওসব কিছু করিনি আমি। তাকে তার কর্মের প্যাচে ফেলিয়ে তাল গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছি।”
“তোমার কথা বুঝতে পারছি না কিছু। সরাসরি বলো।”
“তার এক্সকে বউ বানিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরিবারে হয়তো তাজ্জব কান্ড হচ্ছে। এবার ঠেলা সামলে নেক রুমেল বাবু।”
“সিরিয়াসলি! আয়ান, তুমি একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করতে পারো না। রুমেল মোটেও ভালো ছেলে না৷”
“আরে, সব খোঁজ খবর নিয়েই তো কাজ করলাম। তার এক্সও একই লেভেলের। বন্ধুবান্ধব মিলে অনেক কষ্টে খুঁজে বের করে কাজটা কমপ্লিট করলাম। এবার ঘুম পেয়েছে খুব। তুমিও ঘুমাও আমিও ঘুমাই। গুড আফটারনুন।”
“বেড আফটারনুন! আমার কথা শোনো আগে। এমনি এমনি ফোন দেইনি আমি।”
“ঝামেলা শেষ তো, আবার কি?”
“রহিমা মায়ের কাছে সব বলে দিয়েছে।”
“হোয়াট!”
“হুম। মা বলেছে আজকের মধ্যে তুমি নিজের পরিবারকে ম্যানেজ করে কনফার্ম করবে। তোমার পরিবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলে আমাদের আবার বিয়ে হবে। নতুবা কি হবে জানি না আমি।”
আয়ান হতাশাজনকভাবে বললো,
“গুড আফটারনুন ফেরত নিলাম। ঘুমাবো না আর।”
“দ্যাটস গুড। অপেক্ষায় রইলাম তোমার কনফার্মেশনের।”
তখন থেকে রাত পর্যন্ত বাবার পিছু পিছু ছুটেছে আয়ান। তার পরদিন কাইয়ুম সাহেব হক সাহেবের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করলেন। কেননা সেদিন হসপিটালে দেখে সায়মাকে ভালো লেগেছে কাইয়ুম সাহেবের কাছে। ওদিকে সায়মা আর রুমেলের বিয়েটাও ভেঙে গেল। মহা কান্ড ঘটেছে সেদিন রূমেলের বাড়িতে। মেয়েটি তার বউ বলে পরিচয় দিলে রুমেলের পিতামাতা বকাঝকা করলেন৷ রুমেল অস্বীকার করায় তারা বিয়ে দিয়ে দিলেন। মামারাও উপস্থিত ছিলেন বিয়েতে। আর মামারাই সায়মার পরিবারে জানিয়েছে বিষয়টি। সকাল হতেই আরেক ঘটনা! রুমেল ফেঁসে যাওয়ায় রাতে ইচ্ছেমতো মারধর করে তার বউকে। আর রুমেলের কর্মে রাগান্বিত হয়ে তার বাবাও ইচ্ছেমতো মারে তাকে। এখন স্বামী স্ত্রী উভয়েই হসপিটাল ভর্তি!
পরবর্তী এক সপ্তাহে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেলো দু পরিবারের মাঝে। এখনো ছেলের পড়াশোনা শেষ হয়নি বলে আয়ানের বাবা তারাহুরো না করলেও সায়মার মা নানান অযুহাতে বিয়েটা তারাতাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উনার চেষ্টাতেই বিয়ের দিনতারিখ পাকাপোক্ত হলো। এবার রহিমার শান্তি। অবশেষে কাজটা তার দ্বারা সফল হলো! কিন্তু হক মঞ্জিলের কাজ ছাড়তে পারলো না। বিয়ে পর্যন্ত তাকে আটকে রাখা হবে। তবে রহিমা এখন দুপুরে হক মঞ্জিলে যাওয়ার পূর্বে তার মায়ের সাথে দেখা করে খাবার ও ওষুধ খায়িয়ে আসে। বিয়ে পর্যন্ত এভাবেই চলবে।
আজ দুপুরে কাইয়ুম ভিলা থেকে বের হওয়ার সময় লাল মিয়াকে গান গাইতে শুনলো রহিমা। এতোক্ষণ ছিলো না, রহিমাকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখেই সুর টানা শুরু করেছে লাল মিয়া। হনহনিয়ে হেটে রহিমা তার কাছে এসে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। তাকে এভাবে তাকিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে লাল মিয়া সুর থামিয়ে ব্রু কুচকে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। রহিমা বললো,
“থামলেন ক্যা? গাইতে থাকেন।”
লাল মিয়া বিরক্তির সাথে বললো,
“তোর কাছে জিগাইয়া গাইমু!”
“আমার জন্যই তো গান, তাইলে আমার কাছে জিগাইবেন না তো কার কাছে জিগাইবেন? গাওয়া শুরু করেন। আজ পুরাটা শুইনা তারপর যামু।”
“তোর জন্য গাই মানে! তোর জন্য আমি গান গামু ক্যা? যা ভাগ!”
“হুহ্! কিছু বুঝি না মনে করছেন? আমার জন্য গান না তো কার জন্য গান? আমি আইলেই আপনে গায়ক হইয়া যান। আর আমি চলে গেলেই আপনে আবার দারোয়ান লালু মিয়া হইয়া যান! আজ যাইতাম না। পুরা গান শুইনাই যামু।”
“গাইতাম না আমি। দেখি ক্যামনে শুইনা যাস।”
রহিমা হেসে উঠলো আর লাল মিয়া বিরক্তিকর ভাব নিয়ে বললো,
“আমি কোনো কিছু কইলেই গিয়া বিচার দেস, শাসাইয়া যাস আর তুই যে পা পাড়া দিয়া ঝগড়া লাগছ, আমার উপর হাসাহাসি করছ। আমি কার কাছে বিচার দিমু? যাই এহন খালুর কাছে বিচার দেই গিয়া?”
রহিমা অট্টহাসি থামিয়ে মুখে মৃদু হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পছন্দ করেন আমারে?”
প্রশ্ন শুনে লাল মিয়ার গলা কিছুটা নরম হয়ে এলো,
“সেইটা জাইন্না তুই কি করবি? তুই তো ছোট ভাইজানরে পছন্দ করছ।”
“ছোট ভাইজানের বিয়া ঠিক হইছে জানেন না?”
“হু, এইটাও তো জানি। ছোট ভাইজান তোরে পছন্দ করে। বিয়ার দিন আসার আগেই হয়তো শুনমু দুইজন বিয়া কইরা আইসা পড়ছস।”
রহিমা তার কথায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো এবং বললো,
“আর যদি না করি বিয়া তাইলে আপনে বিয়া করবেন?”
লাল মিয়া চুপ হয়ে গেছে। তার নয়ন জোরা চকচক করছে। জবাব যেন দৃষ্টিই দিয়ে দিচ্ছে। তবুও রহিমা তার মুখের জবাব পাওয়ার আশায় দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলো,
“করবেন না?”
“তুই সারাজীবন থাকতে পারবি আমার সাথে?”
“আপনে রাখতে পারলে পারমু। তবে আমার মা রে সংসারে ঠাঁই দিতে হইবো। মা রে আমি একা ছাড়মু না।”
লাল মিয়া ওষ্ঠে হাসি রেখে বললো,
“মায়ের সেবা করতে পারলে তো নিজেরে সৌভাগ্যবান মনে করমু। আঠারো বছর আগে এতিম হইছি, বারো বছর আগে অনাথ হইছি, আর এগারো বছর চলে এই বাড়িতে কাজ শুরু কইরা উপার্জন করতাছি। কিন্তু যাগো দ্বারা এই পৃথিবী দেখলাম উপার্জনের দুইটা ভাত মুখে দিতে পারলাম না। এইটাই আফসোস।”
“পরিবারের আর কেউ নাই?”
“চারটা বড় ভাই আছে গ্রামে। বাপের ভিটা নিয়া দুদিন পরপরই মাথা ফাটাফাটি! দেখতে যাইতেও ইচ্ছা করে না। আগে বাপ মা’রে অশান্তিতে রাখছে আজ নিজেরা অশান্তিতে আছে। আমারে বিয়া করলে কিন্তু শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য হইবো না তোর। এইটুক ভিটা নিয়া কামড়াকামড়ি আমি করতে পারতাম না। এখানে আছি, ভালা আছি।”
“আপনে তো এত্তো ব্যাডার সাথে ম্যাচে থাকেন। আমি থাকমু ক্যামনে!”
“বউ নিয়া কি আর ম্যাচে থাকমু! বাড়ি ভাড়া কইরা নিমু। টাকা জমাইতাছি, সুযোগ হইলে জায়গাজমি কিনা নিমু।”
রহিমা আর কথা না বলে চলে যাচ্ছিলো তাই লাল মিয়া জিজ্ঞেস করলো,
“পারবি না থাকতে?”
রহিমা গেইটের বাইরে দাড়িয়ে বললো,
“আর জীবনেও কিন্তু সিগারেট খাইতে পারবেন না।”
“খাই না তো। মাঝে মাঝে দুইএক টান। তুই চাইলে ওইটাও ক্যান্সেল।”
“অবশ্যই চাই। পান ও খাইতে পারবেন না।”
“এইটা আর খারাপ কি? মাঝেমধ্যে হইতেই পারে।”
“না, মাঝেমধ্যেও হইতে পারবো না।”
“পরে, দেখা যাইবো।”
“না, পরে দেখাদেখি নাই। সব কথা আগেই পাক্কা।”
“আইচ্ছা।”
রহিমা মুখ চেপে হেসে বললো,
“তাইলে আমি রাজি আছি। তবে আমার মা আমার গার্জিয়ান। মায়ের সাথে কথা বলতে পারলে আর মা অনুমতি দিলে আমার আপত্তি নাই। মা অনুমতি না দিলে আমিও রাজি না।”
“এখন কি তুই বাড়ি যাবি?”
“হু।”
রহিমা চলে গেলো। সে বাড়িতে আসার দশ মিনিট পরেই কিছু ফলমূল হাতে লাল মিয়া এলো তাদের বাড়িতে। মাত্র মাকে খাওয়ানো শেষ করেছে রহিমা। এমনি লাল মিয়ার আগমন। রহিমা লাল মিয়ার সাথে পরিচয় করালো মাকে। অত:পর লাল মিয়া কথাবার্তা বলে রহিমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইলো। লাল মিয়া সম্পর্কে মুখে জেনে এবং মেয়ের মাঝে ইতিবাচক মনোভাব দেখে রহিমার মা মত দিলো। কেননা যেহেতু মেয়ের চেনাজানা সেহেতু নতুন করে তার চেনার প্রয়োজন নেই। মেয়েটা ছোট থেকেই লড়াই করছে জীবন নিয়ে। এবার ভালো কারো হাতে তুলে দিতে পারলেই তিনি শান্তি। এই মেয়েকে নিয়েই এখন তার যত চিন্তা।