“কাজের বেটি রহিমা” পর্ব- ১৯

0
2478

“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ১৯
(নূর নাফিসা)
.
.
লাল মিয়া বাসায় যাওয়ায় আজ হক মঞ্জিলে আসতে দেরি হলো রহিমার। দেরি হয়ে যাওয়ায় আজ সে একটুও বিশ্রাম নেয়নি। ঝটপট কাজে লেগে গেছে। জমে থাকা কাজগুলো করে তারপর বিশ্রাম নিয়ে ড্রয়িং রুমে মেঝেতে বসলো। সেখানে সায়মা, ইশতিয়াক ও এলেন বাচ্চাদের কোলে নিয়ে টিভি দেখছিলো। সায়মা কোলে থাকা বাচ্চাকে ইশতিয়াকের কাছে দিয়ে রহিমাকে ডেকে নিয়ে গেলো,
“চল এবার, ছাদে যাই। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।”
রহিমা বসা থেকে উঠে সায়মার সাথে ছাদে এলো। গাছে পানি দেওয়া শেষ করে রহিমাকে বললো,
“গোলাপ গাছের পাশে দাড়া, ছবি তুলি।”
“এহ! ছবি তোলা লাগবো না। ছবি দিয়া কি হইবো। বাস্তবে পেত্নী মোবাইলে বিউটিফুল ভুত্নি! ভুত্নি মুত্নি ছাইড়া আমারে বাস্তবেই দেখেন।”
“বড্ড বেশি কথা বলিস! দাড়া চুপচাপ।”
“ধুর!”
রহিমা সামান্য বিরক্তি নিয়ে গোলাপ গাছের কাছে দাড়ালো। সায়মা বললো,
“ওড়না ঠিক কর।”
রহিমা ওড়ানা ঠিক করলে সায়মা বললো,
“এমন পেঁচার মতো হয়ে আছিস কেন? হাসি দে একটু!”
রহিমা দাঁত বের করে “ই” করে রইলো যা দেখে সায়মা বললো,
“দাঁত কেলিয়ে আছিস কেন! ঠোঁট মিলিয়ে সুন্দর করে হাসি দে।”
রহিমা দুই ঠোঁট মিলিয়ে প্রশস্ত করে রইলো। যার ফলে তার জীর্ণশীর্ণ মুখখানার গাল দুটো আর দেখা যাচ্ছে না! সায়মা বিরক্ত হয়ে বললো,
“মিস্টার বিন এর মতো এমন করে আছিস কেন! সুন্দর করে হাসি দে!”
কিভাবে হাসবে, তা নিয়ে রহিমা কনফিউশানে পড়ে গেলো! বিভিন্ন ভাবে মুখ নাড়াচাড়া করছে। আজ যেন হাসতেই ভুলে গেছে! সায়মা তার কান্ড দেখে বললো,
“এই, তোর হাসতে হবে না। হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক ভাবে থাক। ভুলেও কপাল কুচকাবি না।”
রহিমা গোমড়া মুখু হয়ে রইলো আর সায়মা এমনিতেই ছবি তুলে নিলো। তাও সেই হাসি নামক জোকারের থেকে ভালো দেখাচ্ছে। দুইটা শুট নেওয়ার পর সায়মা তার চুল ঠিক করে নিজের হাত কানের পেছনে নিয়ে চুল গুজে দেওয়ার ভঙ্গিতে দেখিয়ে বললো,
“এইভাবে কানের পেছনে হাত রাখ।”
“কানে ধরতাম ক্যা আপা! আমি কোনো অপরাধ করছি?”
“না, অপরাধ করিসনি। এটা ছবি তোলার স্টাইল।”
“ধুর! স্টাইল আর ফিস্টাইল! আরও কত কিছু দেখমু এই জীবনে! আরে, ছোটবেলা মকতবে গেলে পড়া না পারলে ওস্তাদ কানের লতি টাইনা দাড়া করায় রাখতো। এগুলারে স্টাইল বলে না, আপা। এগুলা ন্যাংটা কালের শাস্তি।”
“আমি তোকে কানের লতি টানতে বলিনি। এভাবে ধর।”
“সেই একই তো হইলো না! ওস্তাদ কানের লতি টানতে কইছে আর আপনে কানের ডগা! নিচ থেইকা উপরে আইলেই কি শাস্তি স্টাইল হইয়া গেলো!”
সায়মা তার দিকে তেড়ে এসে একটা গোলাপ ছিড়ে ফেললো এবং রহিমার কানে গুজে দিয়ে বললো,
“কানে ধরতে হবে না। গোলাপের ডাটায় ধরে রাখ, তাহলেই হবে।”
সায়মা আবার আগের জায়গায় চলে এলো আর রহিমা বুকে থু থু দিলো। সায়মা যেইভাবে তেড়ে এসেছিলো, সে ভেবছে এই বুঝি তাকে ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিবে! সায়মার কথামতো এবার রহিমা কাজ করলো এবং ফটোশুট সুন্দর হলো। অত:পর সায়মা তাকে যেভাবে বসতে বললো, সে ঠিক সেভাবেই বসলো। সায়মা তাকে গাছে থাকা একটা গোলাপের ডাটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“প্রথমে গোলাপটা এভাবে ধরে মুচকি হেসে গোলাপের দিকে তাকিয়ে থাকবি। তারপর আমি যখন বলবো তখন গোলাপ থেকে গন্ধ নেওয়ার ভঙ্গিতে থাকবি।”
সায়মার কথামতো রহিমা প্রথমে গোলাপের দিকে তাকিয়ে থাকলো। অত:পর যখনই দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে গন্ধ নিতে গেলো তখনই চিৎকার দিয়ে সরে এলো!
“ও মা গো! কি ঢুকলো গো! আপা গো, নাকে পোক গেছে! এইবার কি হইবো গো!”
কথাটা বলেই রহিমা নাক ঝেড়ে লাফাতে লাগলো ছাদে! সায়মা প্রথমে থমকে গেলেও তার কথা শুনে ও কান্ড দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! রহিমা লাফাচ্ছে আর সায়মা হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়েছে! রহিমা তার হাসি দেখে বললো,
“অন্যের দুঃখে হাসতে নাই আপা। সাহায্য করতে হয়। কি করমু তারাতাড়ি বলেন! নাকের ভিতর কেমন জানি লাগতাছে!”
সায়মা হাসতে হাসতে ছাদের কোনে রাখা ঝাড়ুটা দেখিয়ে বললো,
“তুই তো বেশ ভালো ঝাড়ু চালাতে পারিস। শলার ঝাড়ুটা নিয়ে নাকের ভেতর ঝাড়ু দে। পোকামাকড় সব দূর হয়ে যাবে।”
“ধুর আপা! আপনে খুব খা..খা.. হাচ্চু!”
অবশেষে হাচিতেই রহিমার মুক্তি! নাক থেকে মশা বের হয়ে এসেছে সর্দির সাথে। ওদিকে সায়মা হাসতে হাসতে বললো,
“আমি কি? খুব খারাপ হাচ্চু? হিহিহি.. ”
তার হাসির উপর রাগ করে রহিমা বললো,
“আপনি আমার নাকের সর্দি।”
“ছি! রহিমা!”
রহিমা পানির ট্যাংক এর কাছে এসে কল ছেড়ে নাকে মুখে পানি ছিটিয়ে এলে সায়মা তাকে নিজের কাছে ডাকলো৷ রহিমাও এসে তার পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়ালো। সায়মা একটা ছেলের ছবি স্ক্রিনে রেখে রহিমার হাতে ফোন দিয়ে বললো,
“দেখতো পছন্দ হয় কি না?”
“এই ব্যাডা কেডা?”
“আরে দেখ না আগে! ওদিকে আরও কয়েকটা আছে। সবগুলো দেখ।”
রহিমা একে একে ছয়টা পুরুষের ছবি দেখলো। অত:পর বললো,
“দেখলাম তো আপা।”
“কোনটাকে পছন্দ হয়েছে?”
“আল্লাহর সৃষ্টি, সবই ভালা।”
“সব ভালো হলে চলবে না। একটা পছন্দ কর।”
“না, সব তো আল্লারই সৃষ্টি। একটারে বেশি সুন্দর কইলে আবার আল্লাহ নারাজ হইবো। তাই আমার সব গুলারেই পছন্দ হইছে।”
রহিমার কাছ থেকে নির্দিষ্ট পছন্দ খুঁজে না পাওয়ায় সায়মা বিরক্ত বোধ করে বললো,
“সব গুলোর সাথে তো আর তোর বিয়ে দেওয়া যাবে না। একটা পছন্দ করতে হবে। যেকোনো একটা বল।”
“কিহ! বিয়া!”
“বিয়া না। বিয়ে।”
“সে যাই হোক! আমি বিয়া টিয়া করতাম না। আমার একটারেও পছন্দ হয় নাই। একটাও ভালা না। আপনার ফোন ধরেন! ধরেন!”
কথা বলতে বলতে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে রহিমা তড়িঘড়ি করে সিড়ি দিয়ে নেমে গেলো। আর সায়মা পেছন থেকে ডাকতে লাগলো,
“আরে শোন তো! রহিমা? এখন যে সব অপছন্দ বললি, এখন আল্লাহ নারাজ হবেন না?”
রহিমা তার কথা শোনার জন্য বসে নেই। হনহনিয়ে নেমে গেছে নিচে। সায়মা এখানে দাড়িয়ে আয়ানকে কল করলো এবং কথা বললো বেশ কিছুক্ষণ।
.
পরদিন কাইয়ুম ভিলায় আসার পর আয়ান তাকে নিজের রুমে ডাকলো। রহিমা রুমে যেতেই আয়ান তাকে বসতে বললো,
“বস এখানে। এবার আমি যা বলবো তা খুব মনযোগ দিয়ে শুনবি। না হলে এবার তোর নাকে ভোমরা ছেড়ে দিবো।”
গতকালের ঘটনা সায়মা আয়ানকে জানিয়ে দিয়েছে তাই রহিমা ব্রু কুচকে তাকালো আয়ানের দিকে! আয়ান ফোনে সেই ছবিগুলোই বের করে একে একে বলতে লাগলো,
“তেমন উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চ-মধ্যবিত্ত ছেলে তোর জন্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে এদের অবস্থা মোটামুটি ভালো। অবস্থা মূল বিষয় না, মূল বিষয় হচ্ছে সে মানুষ হিসেবে কেমন। দেখ, সে একজন শিক্ষক। কিন্ডারগার্ডেনে চাকরি করে৷ ভালো মনের মানুষ। দৈহিক সৌন্দর্য তো দেখতেই পাচ্ছিস। উচ্চতা তোর সমান হবে। আর সে একজন সেলসম্যান। মানে বিক্রয়কর্মী। পন্য অর্ডার করলে বাসায় বাসায় ডেলিভারি দেয়। ইনকাম মোটামুটি ভালোই। কিন্ডারগার্ডেনের শিক্ষকের চেয়ে বেশ ভালো। তোর চেয়ে লম্বাও হবে। আর আমার মতো ভুরি কম! আমি তো খাই বেশি তাও ভুরি বাড়ে না। তবে এই লোক মনে হয় কৃপণ টাইপের। না খেয়ে খেয়ে ফিট থাকার চেষ্টা করে। আমাদের এদিকে প্রায়ই ডেলিভারি দেয়, কখনো রিকশা বা কোনো গাড়িতে আসতে দেখিনি। তোর সাথে মিল আছে বটে। এই দেখ, সে একজন দোকানদার। মুদি দোকান আছে। একটু স্বাস্থ্যবান বটে। দোকানীরা বসে থেকে থেকে যেমন হয় আরকি। তবে মানুষ হিসেবে ভালো। বয়সটা পঁয়ত্রিশের এপারওপার হবে। উচ্চতায় তোর সমান কিংবা দুএক ইঞ্চি শর্ট হতে পারে। ওটা ফ্যাক্ট না। আমার আর ইতুর মধ্যেও তো তেমন একটা তফাত নেই। মাত্র দুএক ইঞ্চি লম্বা আমি। এতে কি আমাদের বেমানান মনে হয়? নিশ্চয়ই না। সবদিক এতো মিলিয়ে পাওয়া যায়না।”
“ভাইজান, থামেন তো আপনে। আমার এইগুলা একটারেও পছন্দ না। আমি এহন বিয়া করতাম না।”
“আরে, মাত্র তো তিনটা দেখালাম। সবগুলো দেখ আর ভালো লাগার মতো মনোভাব নিয়ে দেখ নিশ্চয়ই একজনকে পছন্দ হয়ে যাবে।”
আয়ান আবার বলতে লাগলো। রহিমা বিরক্তির সাথে শুনতে ও দেখতে বাধ্য। ছয়জনের ডিটেইলস বলার পর আয়ান জিজ্ঞেস করলো,
“এইবার তোর বিবেক খাটিয়ে বলতো এদের মধ্যে কাকে বেশি ভালো মনে হয়েছে?”
রহিমা চেহারায় বিষন্নতার ছাপ ফেলে বললো,
“ভাইজান, এদের একটারেও পছন্দ হয় নাই। এদের চেয়ে শতগুণে ভালা এলিয়েনের মতো দেখতে লম্বা সেই লাল মিয়া। গায়ের রঙ লাল না হইলেও শ্যামলা। সাদাসিধা মানুষ, মনটাও অনেক ভালা। উচ্চতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। আপনের চেয়েও বেশি। দুইজন একসাথে খাড়াইলে মনে হইবো আপনে কলাগাছ আর লাল মিয়া তাল গাছ! আপনে বড় ভাইজানের সাথে খাড়াইলে যেমনটা মনে হয়। তার চেয়ে বড় কথা, আমারে অনেক পছন্দ করে। কাল মা’র সাথে কথা বইলা আইছে বিয়ার ব্যাপারে।”
“এ!”
“হু।”
“তোর মা কি বললো?”
“মা আমারে জিগাইয়া তথ্য নিছে তারপর আলহামদুলিল্লাহ বলছে।”
“তলে তলে এতো ডুবে আছিস! শুধু শুধু আমি এতো অস্থির হয়ে ঘটকের মতো ঘুরাফেরা করছি কেন তোর জন্য! যা, ভাগ এখান থেকে।”
রহিমাকে ভাগতে বলে আয়ান নিজেই তার আগে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কিচেনে এসে ফ্রিজ খুলে একটা আপেল হাতে নিলো। অত:পর ড্রয়িং রুমে বাবার পাশে এসে বসলো। কাইয়ুম সাহেব পত্রিকায় ডুবে আছেন। আয়ান আপেল খেতে খেতে বললো,
“আব্বু, চৌদ্দ তারিখ রহিমার বিয়েটাও দিয়ে দাও। পাত্র ঠিক করে ফেলছি। বেচারা লাল মিয়া গেইটে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। বিয়েটাও তো করে ফেলা দরকার। চুল দাড়ি পেকে গেলে আবার বাচ্চাকাচ্চা বাবাকে দাদা বলে ডাকবে। তার চেয়ে ভালো লাল মিয়া আর রহিমার বিয়েটা হয়ে যাক। মিয়াও রাজি, বিবিও রাজি৷ তুমি হ্যাঁ বললেই বিয়েটা পড়িয়ে দেয় কাজী!”
কাইয়ুম সাহেব পত্রিকায় তাকিয়েই নিঃশব্দে হেসে উঠে বললেন,
“ভালোই তো! রহিমা করছে তোমার ঘটকালি আর তুমি করছো ঘটকের ঘটকালি! লুকিয়ে লুকিয়ে ঘটকালির উপর পিএইচডি করছো নাকি?”
“বুড়ো কালে নাকি মানুষ শুধু দোষ খুঁজে বেড়ায়। আজ বুঝলাম, তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছো আব্বু। আম্মু কিন্তু আগের মতোই স্ট্রং।”
“হা হা হা, তাইতো এখনো আগের মতোই খুন্তি নিয়ে দৌড়ায়।”
“হুম, রাইট।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here