“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ২
(নূর নাফিসা)
.
.
কাইয়ুম আহসানের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে সায়ান মাহমুদ। বেসরকারি কলেজে চাকরি করে। গতবছর বিয়ে হয়েছে৷ দু সপ্তাহ আগে কন্যা সন্তান হয়েছে। বাড়ির বউ পিংকি এখন বাবার বাড়িতে আছে বাচ্চা নিয়ে। সায়ানও সেখানেই থাকছে বাচ্চা হওয়ার পর। মাঝে মাঝে এ বাড়িতে এসে দেখা করে যায়।
ছোট ছেলে আয়ান মেহবুব। স্কুল জীবনে ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিলো। তবে কলেজ লাইফে পড়াশোনায় বরবাদ হয়ে গেছে! তিনবার এইচএসসি দিয়েছে! বর্তমানে ভার্সিটির শেষ ধাপে আছে! বিএ কমপ্লিট করতে যাচ্ছে তাও বছরে বছরে ইম্প্রুভ দিয়ে! স্কুল জীবনের মতো পড়াশোনা করলে এতোদিনে তার মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে যেতো। কিন্তু তা হলো না। পড়াশোনার ইচ্ছে ছেড়েই দিয়েছিলো, তবুও এখন চলছে তার বাবামায়ের ধাক্কায়।
মেয়ে মিশকাতুল আয়মান সবার ছোট। বিয়ে দিয়েছে দুই বছর হলো। সাত মাসের একটা বাচ্চাও আছে। তবে পড়াশোনা করছে এখনো। মেডিক্যালে পড়ছে।
এবাড়িতে রহিমার কাজ, ঘর ঝাড়ু দেয়া, প্রতিদিন ঘর মুছে দেওয়া, থালাবাটি ও হাড়িপাতিল মাজা, সপ্তাহে একদিন আসবাবপত্র মুছে দেওয়া। আর রান্নাবান্না সব মারিয়া কাইয়ুম করে। পিংকি দুএক দিন রান্না করেছিলো কিন্তু তার সব খাবারে সবাই মিষ্টি স্বাদ পায়! যা কারোই রুচিতে আটে না! তাই সে আর রান্না করে না। এবাড়িতে বউ হিসেবে তার কাজ মারিয়া কাইয়ুমের রান্নার কাজে সাহায্য করা। আর নিজেদের কাপড়চোপড় ধুয়ে দেওয়া। অতিরিক্ত কাপড়চোপড় সব রহিমা কেচে দেয়।
সকালে মারিয়া কাইয়ুম রান্নাবান্না শেষ করে রেখেছে। সকাল সকাল মন মেজাজ খারাপ হওয়ায় রহিমা রাতের এটো থালাবাটি ধুয়ে নিলো বকবক করতে করতে। মারিয়া কাইয়ুম ধমক দিলে চুপ হয় আবার একটু পরই অটোমেটিক তার বকবকানি শুরু হয়!
মারিয়া কাইয়ুম বেশ কয়েকবার ডেকে এলেন আয়ানকে। কিন্তু আয়ান “উঠছি” বলে আর উঠার নাম নেই! ভার্সিটির ক্লাসের সময় পাড় হবে তখনই তার ঘুম ভাঙবে! ক্লাস করে না ঠিকমতো। মাঝে মাঝে কোচিং-এ যায় এতটুকুই তার পড়াশোনা! মারিয়া কাইয়ুম আজ এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়ানের মুখে মেরে এলেন! এবার হকচকিয়ে উঠে পড়লো আয়ান! মায়ের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বললো,
“এটা কি করলে আম্মু! আমাকে ভেজাতে গিয়ে তুমি বিছানাটাই ভিজিয়ে দিলে!”
“বেশ করেছি ভিজিয়েছি! এতো ঘুম কেন তোর চোখে! নামাজ পড়ার জন্য একদিনও ডেকে তোলা যায় না! এখন ভার্সিটির সময়ও স্বপ্নে খেয়ে তারপর উঠবে!”
“তাই বলে তুমি পানি মারবে!”
“মারবো না আবার! আজ গ্লাস এনেছি, কাল থেকে বালতি নিয়ে আসবো!”
“এটা কোনো কথা! এখন বিছানা শুকাবে কি করে!”
“শুকাতে হবে না। ভেজা বিছানাতেই থাকবি তুই!”
মারিয়া কাইয়ুম ছেলেকে বকাঝকা করতে করতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। আয়ান ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির জন্য রেডি হলো। অত:পর গোমড়া মুখু হয়ে বেরিয়ে এসে বসলো ডাইনিং টেবিলে৷ কাইয়ুম সাহেব পত্রিকার দিকে ঘাড় নিচু রেখেই চশমার উপর দিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
“আয়ান কি আজও বিছানায় মুতু দিয়েছে? তাই কি বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইছিলো না? স্বভাব পাল্টায়নি এখনো!”
কিচেনে হাড়িপাতিল গুছিয়ে রাখতে রাখতে রহিমা শব্দ করে হেসে উঠলো আর গ্লাসে পানি নিতে নিতে মারিয়া মুখ চেপে হাসলো। বাবার মস্করায় আয়ান মেজাজী গলায় বলল,
“রহিমা! খাবার নিয়ে আয়!”
মারিয়া পানি পান করে খাবার আনতে গেলো কিচেনে। দুজনেই খাবারের বাটি নিয়ে আসছে। আয়ান প্লেট উল্টো করে আজ নিজেই খাবার তুলে ঝটপট খেয়ে নিচ্ছে। কাইয়ুম সাহেব পত্রিকা রেখে চেয়ার সোজা করে টেবিলমুখী হয়ে বসলেন। অত:পর আয়ানের উদ্দেশ্যে বললেন,
“প্রতিদিন একই কথা বলি, পড়াশোনা ভালোমতো করো। ফলাফল ভালো হবে। তাই বলে আবার নকল দিয়ে খাতায় ফলাফল ভালো করে এসো না। একটু নিজে চেষ্টা করে পড়াশোনায় মনযোগ দাও। তাহলে শুধু খাতার ফলাফল না, সাথে জীবনের ফলাফলও ভালো হবে। পড়াশোনা বড়ই আরামের কাজ। শুয়ে-বসে করতে পারো। অন্যথায় কোনো কঠিন কাজে তোমাকে লিপ্ত করা হচ্ছে না আপাতত। তুমি শুধু এখন পড়াশোনা করবে।”
আয়ান খাবার চিবাতে চিবাতে কিছু বলতে গেলে কাইয়ুম সাহেব বাধা দিয়ে বললেন,
“মুখের খাবার শেষ করে কথা বলো। ভদ্রতা শেখো।”
আয়ান মুখের খাবার শেষ করে বললো,
“পড়াশোনা আরামের কাজ? ঘরে বসে বসে তুমি বুঝবে কি দুনিয়াতে পড়াশোনার মতো কষ্টের কাজ আর দু’একটা নেই! কোন আমলে মেট্রিক পাশ করে বসে আছো। এই মেট্রিক পাশ আমিও করেছি। সেটা খুব সহজই ছিলো। কলেজ তো আর পড়নি যে কলেজের চাপ বুঝবে! কলেজ পড়লে বুঝা যায়, আরাম ব্যারাম হতে সময় নেয় না।”
“আমার সাথে তুলনা করলে তোমার চলবে! আমার সময়ে মেট্রিক পাশ হলে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতো চাকরি দেওয়ার জন্য। আর তোমার সময় এম এ পাশ থাকলেও চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যায়!”
“জুতার তলা ক্ষয় হওয়ার আগেই ফেলে দিবো, সেই চিন্তা তোমাকে করতে হবে না!”
“তাই নাকি! তা এক জুতা ফেলে আরেক জুতা পাবে কোথেকে শুনি? রোজগার না করলে টাকা আসবে!”
“এতো টাকা দিয়ে কি হবে! তুমি যেমন তোমার ছয়তলা বাড়ির ভাড়া দিয়ে বসে বসে খাও আমিও খাবো।”
“বাড়ির ভাড়া দিয়ে বসে বসে খাই সেটা দেখলে, আর এই বাড়িটা যে কোথেকে এলো সেটা দেখলে না?”
“সেটাও তো দেখছি! ব্যবসা করে তুমি যে ব্যবসায় বড়সড় মাইর খেয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিছো!”
“তার আগে যে সেই ব্যবসার অবস্থা বড্ড ভালো ছিলো আর তা থেকেই তোমরা বেঁচে আছো সেটা দেখবে না?”
“এতোসব দেখে লাভ কি! শেষ ভালো যার, সব ভালো তার – এই নীতি খুব মানি আমি। শেষ পর্যন্ত তো হারিয়ে বসে আছো সেটাই মূখ্য বিষয়। উক্ত নীতি অনুসারে এখন সবটাই আমার ভালো হোক। পকেট ফাঁকা হয়ে গেছে, পাচশো টাকা দাও। নতুবা ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ।”
“দুদিন আগে দুই হাজার নিয়েছো এখনই পকেট ফাঁকা! এতো বড় ছেলে ইনকাম নেই এক টাকা! দিনে নাকি তার খরচ হয় হাজার টাকা!”
“হাজার চাই নি তো। পাঁচশো চেয়েছি আজ। না দিলে আমি ভার্সিটি যাবো না, বাসায়ই থাকি আর তুমি ক্লাস করাও৷ আমি বসে বসে তোমার কাছে পড়ি।”
রহিমা হেসে বললো,
“খালু তো ভার্সিটি পড়ে নাই। তো খালুর কাছে কি পড়বেন ছোট ভাইজান? এ বি সি ডি?”
আয়ান ধমকে বললো,
“তুই চুপ থাক!”
আর মারিয়া সামান্য বিরক্তি নিয়ে তাকালো রহিমার দিকে। কেননা তিনি কারো কথার মাঝখানে কথা বলা পছন্দ করেন না। রহিমা বড্ড বেশি কথা বলে। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সে ভুলে যায় এবং বলে ফেলে! এখন রহিমা চুপ! আর কাইয়ুম সাহেব আয়ানের উদ্দেশ্যে বললেন,
“পঞ্চাশ টাকা দিবো, বাসে আসা যাওয়া চলবে। রেগুলার তুমি পঞ্চাশ টাকা করে পাবে এখন থেকে। প্রয়োজনে কিন্ডারগার্ডেনের বাচ্চাদের সাথে স্কুল ভ্যানে তুলে পাঠিয়ে দিবো। কিছু পথ ভ্যানে বাকি পথ বাসে কিংবা হেটে। তবুও অতিরিক্ত খরচের জন্য এক টাকাও না!”
আয়ানের খাওয়া এতোক্ষণে শেষ। সে আজ বেসিনে না গিয়ে প্লেটেই পানি ঢেলে ঝটপট হাত ধুয়ে উঠে যেতে যেতে বললো,
“তুমিই গিয়ে স্কুলে ভর্তি হও আর স্কুল ভ্যানে করে নিয়মিত স্কুলে যাও। বেকার মানুষ যেহেতু, তোমার পড়াশোনার প্রয়োজন আছে। সাথে আম্মুকেও নিয়ে যেও। সময় ভালো কাটবে।”
আয়ান রুমে চলে গেলে রহিমা ফিসফিসিয়ে বললো,
“খালু, আপনের ছোট পোলা আস্ত একটা কামলা। দেখছেন, ক্যামনে গাপুসগুপুস খাইয়া গেলো! যেন বৃষ্টি নামবো তাই ধান কাটতে যাইতাছে জলদি কইরা!”
মারিয়া কাইয়ুম তার কথা শুনে নিচু স্বরে ধমক দিলেন। আর কাইয়ুম সাহেব তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে ছেলের কথায় হেসে বললেন,
“আমি তো পড়ি ই আমার পড়া। অন্য লোকেরা শুধুমাত্র শিরোনাম পড়ে পত্রিকা রেখে দেয়। কিন্তু আমি তা করি না। অক্ষরে অক্ষরে পুরো পত্রিকা পড়ে শেষ করি। দেশের খবরাখবর নিতে হলে ভালোভাবেই নিবো। চালের মাঝে ধান বাছতে গিয়ে শুধু পাথর কেন তুলে আনবো! লেখা তো পড়ার জন্যই ছাপিয়েছে, না কি? তারউপর টাকা দিয়ে কেনা পত্রিকা। তাহলে শুধু শিরোনাম পড়ে কেন রেখে দিবো।”
রহিমার কথায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করায় রহিমা ভাবলো তার কথা শুনেনি। তাই সে মারিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“আম্মা, খালু দেখি ধ্যান্দা! কানে শুনলো না আমার কথা!”
মারিয়া কাইয়ুম চোখ পাকিয়ে তাকালো তার দিকে আর রহিমা চুপ হয়ে গেলো৷ কাইয়ুম সাহেবও তাকিয়েছেন কিন্তু কিছু বলার আগেই রহিমা চুপ হয়ে যাওয়ায় আর কিছু বললেন না তিনি। কিন্তু রহিমা মনে মনে বললো,
“হইছে এইবার! ভালা কথা কানে শুনে না, ধ্যান্দা বলায় খালুর কানে পৌছায় গেছে কথা!”
ওদিকে আয়ান নিজের রুম থেকে চেচিয়ে বাবার কথার ভিত্তিতে জবাব দিলো,
“হু, তুমি বেশি শিক্ষিত। অনেক পড়ো, আরও পড়ো। পড়ে পড়ে মুখুস্ত করে ফেলো। তারপর খাতা কলম নিয়ে নিজেই পত্রিকা লিখে ফেলো। এবার আমার টাকা দাও।”
কাইয়ুম সাহেব গলার আওয়াজ কিছুটা উচু করে বললেন,
“বেশি শিক্ষিত না হয়ে তোমার মতো গর্দভ হলে চলবে? অল্পবিদ্যা ভয়ংকর, সেটা জানো না? বলবো, ‘পিঠে মশা বসেছে তাকে হত্যা করো।’ আর তুমি কুড়াল এনে মশা হত্যার বদলে বাবা হত্যা করবে। দারুণ না ব্যাপারটা?”
কথা বলতে বলতে দুইশো টাকা পকেট থেকে বের করে টেবিলে রাখলেন কাইয়ুম সাহেব। ওয়ালেট আর ফোন হাতে রুম থেকে বেরিয়ে আয়ান দুইশো টাকা ওয়ালেটে রাখতে রাখতে হাসিমুখে বললো,
“একদমই মন্দ না ব্যাপারটা। তবে তার চেয়েও বেশি দারুণ হবে, বাবা যদি কুড়াল কেনায় টাকা খরচ না করে ছেলের পকেটে খরচ করে। বাড়িতে কুড়াল না থাকলেই তো হয়! বাবাও বাঁচলো, ছেলেও বাঁচলো! এখন যেহেতু দুইশো দিলে, পাঁচশো টাকার নোটটা তাহলে সন্ধ্যায় রেডি রেখো। রহিমা দরজা লাগিয়ে দিয়ে যা। কামলার শোধটা পরে তুলবো।”
বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো আয়ান। এদিকে রহিমা স্তব্ধ! তার গলার স্বর কি এতোটাই উঁচু! আয়ান রুমের ভেতরে থেকে শুনলো কিভাবে তার ফিসফিস! রহিমা দরজা লাগাতে লাগাতে বিড়বিড় করে বললো,
“বাপে ধ্যান্দা আর পোলায় ইতর বান্দা! একজনের কানের কাছে কইলে শোনে না। আরেকজন সুদূর থেইক্কা শুইন্না ফেলে! হুহ্! ইতর আয়না, পূরণ হবে না তো আপনের শোধ তোলার বায়না। আপনে ফিরতে ফিরতে আমি বাড়িতে থাকলে তো মনু ময়না!”