“কাজের বেটি রহিমা” পর্ব- ৬

0
1004

“কাজের বেটি রহিমা”
পর্ব- ৬
(নূর নাফিসা)
.
.
রহিমা ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতেই শুনতে পেল নবজাতকের কান্না! সায়ানের রুমের দরজাও খোলা, সায়ানকেও দেখতে পেয়েছে ড্রয়িং রুমে। তার মানে গোলাপি ভাবি বাচ্চা নিয়ে এসে পড়েছে!
রহিমা বাচ্চাকে দেখার জন্য উৎফুল্ল হয়ে নিজের পার্সটা রাখলো কিচেনে। অত:পর তারাহুরো করে সায়ানের রুমের দিকে যেতে লাগলো। রুমের ভেতর বাচ্চার পাশে পিংকি এবং মারিয়া কাইয়ুম আছে। দরজার কাছে যেতেই পিংকি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“এই দাড়া! এখানে আসছিস কেন?”
“বাবুরে দেখতাম।”
“গোসল করে এসেছিস?”
“হু।”
“এখানে এসে হাতমুখ ধুয়েছিস?”
রহিমা মাথা দু’দিকে নাড়তেই পিংকি বললো,
“ভালোভাবে হাতমুখ ধুয়ে আয় আগে।”
রহিমা কিছুটা বিরক্ত বোধ করলো পিংকির কথায়। তবুও বাবুকে দেখার জন্য সে হাতমুখ ধোয়ার জন্য বাথরুমে গেলো। আয়ান ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেডে জেল নিয়ে খাচ্ছিলো। রহিমা সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই আয়ান বললো,
“সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বাবুর কাছে যাচ্ছিস? দেখবি এখন আবার বলবে এইটুকু যেতে যেতে ময়লা লেগে গেছে শরীরে।”
রহিমা তার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সায়ানের রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“বাবুর কান্নার আওয়াজে আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠছেন না আপনে?”
আয়ান মুখ চেপে মৃদু হাসলো শুধু। কিন্তু কিছু বললো না। খাওয়াতে ব্যস্ত সে। তবে রহিমা নিশ্চিত, তাকে হুমকি দেওয়ার জন্য নয় বরং বাবুর কান্নাকাটির কারণে আয়ান আজ দ্রুত ঘুম থেকে উঠেছে।
রহিমা রুমে প্রবেশ করতেই পিংকি তাকে আবারও দাড় করিয়ে দিলো। অত:পর কিছু একটা তার শরীরে স্প্রে করে দিলো এবং একটা বোতল থেকে দুতিন ফোটা তরল পদার্থ তার হাতে ঢেলে দিয়ে বললো হাত মেসাজ করতে। রহিমা তার কথামতো কাজ করতেই ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব করলো। তাই উৎফুল্লতার সাথে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবি, এইটা কি দিলেন?”
“হ্যান্ড স্যানিটাইজার।”
“কি?”
“হ্যান্ড স্যানিটাইজার।”
“ওহ্! কিজন্য দিলেন?”
“তোর হাতে জীবানু আছে, তা দূর করতেই এটা দিলাম।”
“আমি কিছুক্ষণ আগে সাবান দিয়া মাইজ্জা গোসল করছি আবার এইমাত্র সাবান দিয়া হাতমুখ ধুইছি। তাইলে জীবানু আসে কোত্থেকে!”
“জীবানু খালি চোখে দেখা যায় না। বাতাসে উড়ে। বুঝতে পেরেছিস!”
রহিমা মনে মনে বললো,
“একটু আগে যা কইছেন তা হান্ড্রেড পার্সেন ঠিক কইছেন ছোট ভাইজান! শিক্ষিত নামের এক কুক্ষাত ভাবি এই গোলাপি! হুহ্! কত নমুনা! শুধু বাবুটারে দেখমু বইলা আইছি। নয়তো গোলাপির রংও দেখতে আইতাম না!”
মনে মনে কথা বলতে বলতে রহিমা মারিয়ার কাছ থেকে বাচ্চাকে কোলে নিলো। বাচ্চার মুখ দেখে রহিমার মুখে উচ্চারিত হলো, “মাশাল্লাহ।”
ফুটফুটে শিশু দেখতেই তার প্রাণ জুড়িয়ে গেছে! মনে মনে এটাও ভাবলো যে, “বড়লোকের ঘরেই কি আল্লাহ শুধু এমন ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা পাঠায়? গরীবের ঘরে কেন সহজে চোখে পড়ে না?”
পরক্ষণে আবার ভাবলো,
“না, বাবা-মা যেমন থাকে বাচ্চারাও তেমন হয়। বাবা মা ফর্সা তো বাচ্চারাও ফর্সা আর বাবা মা কালো তো বাচ্চারাও কালো। আর যদি তা না হয় তো সেটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্য।”
রহিমার কোলে থাকাকালীন মারিয়া কাইয়ুম জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর হাতের কি অবস্থা, রহিমা? ব্যাথা আছে এখনো?”
“না, আম্মা। সাইরা গেছে।”
“ওষুধ খেয়েছিস ঠিকমতো?”
“হু।”
“ব্যান্ডেজ খুলবে কবে?”
“ডাক্তার এক সপ্তাহ রাখতে বলছে।”
অত:পর মারিয়া কাইয়ুম বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। দুতিন মিনিট পরেই পিংকি বাচ্চাকে নিয়ে নিলো রহিমার কাছ থেকে এবং কাপড়ের ঝুড়ি দেখিয়ে বললো,
“ভালোই হয়েছে তুই এসে গেছিস। কাল বাড়ি ফিরে যখন শুনলাম তুই ছুটিতে আছিস, তখন খুব বড় টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার তো তেমনভাবে নড়াচড়া নিষিদ্ধ। মা তো বাচ্চাকেই রাখবে। তাহলে ময়লা কাপড়চোপড় কাচবে কে! আগে জানলে আমি আসতামই না এখানে। দ্রুত ধুয়ে দে। অনেকগুলো জমে গেছে।”
রহিমা ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে কাপড়ের ঝুড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। আর মনে মনে বললো,
“হায়রে মানুষ! হাতে যে ব্যান্ডেজ করা, সেইটাও চোখে পড়লো না! কাপড় কি এক হাতে কাচা যায়, সেই আক্কেলও কি নাই!”
রহিমা কাপড় কেচে বারান্দায় শুকাতে দিলো। হাতের ব্যান্ডেজ ভিজে একাকার। সে অন্য হাতে ব্যান্ডেজ খুলতে খুলতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। মারিয়া কাইয়ুম দেখে বললো,
“এটা খুলছিস কেন?”
“ভিজে গেছে, আম্মা।”
“ভেজালি কেন?”
“কাজ করতে গেলে কি আর এতোকিছু খেয়াল থাকে!”
“এখন প্রব্লেম হবে না?”
“ধুর! কাজের বেটিগো পবলেম আর টবলেম! কাজ করমু, রোজগার করমু, ভাত গিলমু। ব্যাস, দিন শেষ। কি কাজ করা লাগবো বলেন।”
আয়ানের রুম ঝাড়ু দিতে এসে আয়ানকে রুমে দেখতে পেল রহিমা। আয়ান কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। রহিমা তাকে বললো,
“ভাইজান কোথায় যান?”
“কেন?”
“আমারে একটা ই আইন্না দিবেন?”
“ই কি?”
“ই। কি জানি বলে!”
“আমি কি জানি কি বলে!”
“ওহ্, ওইযে সেন্টু গেঞ্জি আর টাউজার!”
“সেন্টু গেঞ্জি আর টাউজার! এগুলো দিয়ে তুই কি করবি?”
“আরে, পোশাক না। ওইযে হাতে দিয়া ঘষা দিয়া যে জীবানু ধ্বংস করে সেই জিনিস। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে। বাবুরে কোলে নেওয়ার আগে ভাবি দিলো। নাম মনে রাখতে সেন্টু গেঞ্জি আর টাউজার মনে রাখছি।”
“স্যানিটাইজার?”
“হু। হু। দাম কত?”
আয়ান হেসে উঠলো এবং বললো,
“তোর সেন্টু গেঞ্জি আর টাউজার পড়া লাগবে না। কারণ তোর বেশিরভাগ সময় কাটে চুলোর ধারে! এগুলো ব্যবহার করে চুলোর পাশে গেলে চুম্বকের মতো টেনে আগুন ধরে যাবে। সাথে সাথেই ঠোসা পড়ে তখন টাউজারের পরিবর্তে প্লাজু হয়ে যাবি।”
“হায় হায়! কি কন! উপকারের চেয়ে দেখি বেশি যন্ত্রণার জিনিস! থাক, লাগবো না।”
“তোর হাত দেখি?”
সেদিনের ঘটনা মনে হাতেই রহিমা হাত থেকে ঝাড়ু ফেলে ঝটপট হাত লুকিয়ে ফেললো। আয়ান তার কান্ড দেখে বললো,
“হাত লুকাতে বলিনি। দেখাতে বলেছি।”
“আপনে কই যাইবেন, যান। আমি ঘর ঝাড়ু দিমু।”
“তুই হাত দেখাবি, নাকি ওই হাতটাও ফুটো করবো?”
রহিমা দূর থেকেই হাতের পিঠ উল্টে দেখালো। আয়ান দেখে ঠোঁটের কোনে ইতরমার্কা হাসি ফুটিয়ে বললো,
“সাবধানে থাকিস। পরবর্তীতে পাশের হাতে আটটাও হতে পারে!”
রহিমা তেজে ঝাড়ু হাতে নিয়ে রুম ঝাড়ু দিতে লাগলো। আয়ান বেরিয়ে গেলো।
আয়ান সকালে বেরিয়েছিলো আবার দুপুরে বাড়ি ফিরে এসেছে বোন আয়মানকে নিয়ে। বড় ভাইয়ের বাবুকে দেখতে এসেছে আয়মান। এখানে থাকবে কিছুদিন। এমনিতেই বাড়ির কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে রহিমা। আয়মান এলে তার ব্যস্ততা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কারণ আয়মানের বাচ্চারও যথেষ্ট কাজকর্ম করতে হয়! আজ পুরোটা সময় তার ব্যস্ততার মাঝেই কাটলো। একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলারও যেন সময় হলো না।
ঝটপট কাজ করে দুইটা বাজতেই সে বেরিয়ে গেলো। আর যাইহোক, কাজে যাওয়ার সময়টা মেইনটেইন করার চেষ্টা করে রহিমা।
গেইট দিয়ে বের হওয়ার সময় লাল মিয়া বিদ্রুপস্বরূপ বলে উঠলো,
“কি রে পেত্নী! চেহারার এই অবস্থা ক্যান? ভাবিজান ফিরা বুঝি টাইট দিছে আজকা? ফাঁকিবাজ গো এমনে টাইটেই রাখতে হয়।”
রহিমা বিরক্তির সাথে বললো,
“ঝগড়া করার মুড নাই। কথা কইবেন না কইলাম!”
লাল মিয়া দাত কেলিয়ে বললো,
“মুড ক্যামনে থাকবো! আছাড় মারলে মুড ঠিক থাকবো নাকি! দিছে নাকি দুই চাইরটা মুঙ্গুর!”
এমনি আয়ান এসে হাজির। শেষ কথা শুনে লাল মিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“সমস্যা কি তোর? রহিমার সাথে তুই প্রায়ই এমন করিস কেন?”
“কই ভাইজান?”
“কই মানে! আমি দেখি না নাকি! সবসময় আজেবাজে কথা বলিস, ঝগড়াঝাঁটির চেষ্টা করিস। এই রহিমা, ডিস্টার্ব করে না তোকে?”
“হু ভাইজান। সবসময় টিতকারী মাইরা কথা কয় এই ব্যাডা!”
“লাল মিয়া, আরেকদিন যদি এমন কিছু দেখি বা শুনি তবে তোর অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়বো। এখানে থাকতে হলে ভদ্রলোকের ন্যায় থাকবি। মনে থাকে যেন! রহিমা, এরপর যদি লাল মিয়া তোকে ডিস্টার্ব করে তো ডিরেক্টলি আমার কাছে বলবি।”
লাল মিয়াকে শাসিয়ে আয়ান গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। রহিমাও লাল মিয়াকে ভেঙচি কেটে চলে গেলো। আর লাল মিয়া রহস্যমাখা দৃষ্টিতে তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো!
রহিমা বেরিয়ে হাটতে শুরু করলো হক মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে। আয়ানও সেই পথেই হাটছিলো ধীর গতিতে। রহিমা ঘনঘন পা ফেলে আয়ানের পাশাপাশি আসতেই আয়ান তার দিকে একটা গিফট বক্স এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এটা রাখ।”
রহিমা হাটা থামিয়ে বললো,
“কি?”
“গিফট।”
“কি গিফটা?”
“টিকটিকি, তেলাপোকা, ইঁদুরের বাচ্চা, সাপের বাচ্চা।”
“হুহ!”
রহিমা বক্স না নিয়ে ব্রু কুচকে ভেঙচি কেটে আবার সামনে পা ফেলতেই আয়ান ধমকে বললো,
“ধর!”
“আমি এগুলা নিমু ক্যা? আপনের দরকার, আপনেই রাখেন!”
এবার আয়ান স্বাভাবিক গলায় বললো,
“নে ধর। ওসব নেই। ভালো কিছু আছে। টাকা খরচ করে কেনা। টাকা দিয়ে নিশ্চয়ই ইঁদুরের বাচ্চা কিনবো না!”
“ভেতরে যা-ই থাকুক, আমারে গিফট দিবেন ক্যা?”
“এইবার না লাইনে এসেছিস! শোন, তুই যেহেতু আমার শত্রু। জেনেশুনে নিশ্চয়ই আমার জন্য ভালো কাজ করবি না। কিন্তু তোর নিজের অজান্তেই আমার একটা উপকার করে ফেলেছিস। যার জন্য আমার পকেট খরচ করে কিছু গিফট করলাম। ইচ্ছে তো করছিলো রেস্টুরেন্টে ট্রিটসহ আরও অনেক কিছু দেই। কিন্তু আপাতত আমার পকেট ফাঁকা।”
আয়ান রহিমার হাতে বক্স ধরিয়ে দিয়ে শার্টে আটকানো সানগ্লাসটি চোখে পড়ে নিলো৷ অত:পর প্যান্টের পকেটে এক হাত রেখে অন্যহাতে ফোন চাপতে চাপতে আবার বাড়ির দিকে চলে এলো। রহিমার কাছে তার চলাফেরা, স্টাইল পুরোই হিরোর মতো। এতোক্ষণ যাবত লাল মিয়া গেইটের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে তাদের কিছু আদানপ্রদান ও কথা বলতে দেখেছে। আয়ানকে ফিরে আসতে দেখে সে দ্রুত সরে এলো।
এদিকে রহিমা ভাবছে, বক্সের ভেতরে কি সত্যি সত্যিই কোনো সুন্দর গিফট আছে নাকি এই আয়না ভাইজান তাকে ইঁদুরের বাচ্চার মতোই ভয়ংকর কিছু গিফট করেছে! সকালে হাতে আগুন নিয়ে দাড়িয়ে ছিলো তাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য, আর এখন সে সুন্দর গিফট দিবে সেটা কি বিশ্বাস্য! সকাল থেকে এইটুকু সময়ে তার জন্য কি এমন ভালো কাজ করে ফেললো যার ফলে আয়ান তাকে সুন্দর কিছু গিফট করতে আসবে! রাস্তায় দাড়িয়ে কি এখন বক্সটা খুলে দেখবে একবার!
রহিমা বক্স খুলবে কি খুলবে না তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে ছোট ছোট কদমে হাটছে। পরক্ষণে কাজে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে তা মনে হতেই বক্স পার্সে রেখে হনহনিয়ে হাটতে লাগলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here