“কাজের বেটি রহিমা”
সূচনা পর্ব
(নূর নাফিসা)
.
.
জীর্ণশীর্ণ দেহের অধিকারী রহিমা। রাস্তা দিয়ে হনহনিয়ে হেটে যাচ্ছে কর্মস্থলে। সামনের গলির মোরের দিকে তিনটা ছেলে দাড়িয়ে। বেশ দেখেই বুঝা যায় বাজে লোক! বয়স অল্পই হবে৷ একটার হাতে সিগারেট ধরানো, আর বাকি দুইটা কথার সাথে সাথে পাশের জনের উড়ানো সিগারেটের ধুয়া খাচ্ছে। রহিমা নিকট দিয়ে হেটে যেতেই তাদের মধ্যে একজন সিটি বাজালো। রাহিমা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের পথে অগ্রসর হলো। রহিমা চোখ ফিরিয়ে নিতেই এবার দুইজন সিটি বাজানো শুরু করলো আরেকজন ভেটকি মাছের মতো ভেটকাচ্ছে! রহিমা এবার তাদের দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বললো,
“কি ভাই? সমস্যা কি? সিটি বাজান ক্যা? মুতে ধরছে? আশেপাশে টয়লেট নাই?”
তাদের মধ্যে একজন নির্লজ্জের মতো হেসে বললো,
“না আফা, টয়লেট নাই।”
এবার রহিমা তুলনামূলক তেজি কণ্ঠে বললো,
“হারামজাদা, টয়লেট না থাকলে রাস্তার মাঝখানে বইসা প্রস্রাব কর। মাইয়া মানুষরে ডাকছ ক্যা? মাইয়া লোক দেখলেই মুখ চুলকায়? মুখ বরাবর জুতা মাইরা চুলকানি বন্ধ কইরা দিমু।”
ছেলেগুলোর মুখের হাসি উড়ে গেছে। হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই রহিমা সামনে থাকা ট্রাফিক পুলিশের উদ্দেশ্যে হাক ছাড়লো,
“পুলিশ ভাই। এই পুলিশ ভাই। এদিকে আসেন তো একটু! হারামজাদা গুলার মুতামুতির ব্যবস্থা কইরা দিয়া যান।”
রহিমার ডাকে পুলিশ এদিকে তাকাতেই ছেলেগুলো দ্রুত গলিতে ঢুকে পড়লো। রহিমা হনহনিয়ে আবার হাটতে লাগলো।
নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে রহিমা। বস্তিতে তার পরিবারের বসবাস। পরিবার বলতে মা আর ছোট বোন আছে। বড় একটা ভাইও আছে তবে বলা যায় থাকতেও নেই! বিয়ের পর নিজের সংসার আলাদা করে নিয়েছে। কিছুদিন যেতেই কাজকর্ম করে নিজের হাত কিছুটা উন্নত হয়েছে এবং শ্বশুর বাড়ি থেকে কিছু অর্থ পেয়ে বস্তি ছেড়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এক টুকরো জমি কিনে সেখানেই ঘর বেঁধেছে। কিনেছে কি না সেটাও নিশ্চিত জানা নেই। কারো মুখে শোনা যায় গৃহস্থালির কাজকর্ম করে বিধায় মালিক থাকার জায়গা দিয়েছে, কারো মুখে শোনা যায় ভাড়া থাকে আবার কারো মুখে শোনা যায় লোনের উপর টাকা নিয়ে কিনেছে জমি। কিন্তু সঠিকটা জানে না রহিমা ও তার মা। জানার প্রয়োজনও মনে করে না। যেদিন সে হাড়ি ভিন্ন করেছিলো সেদিনই রহিমা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছে। কিছুদিন যেতেই যখন সে বললো, বউ বাচ্চা নিয়ে সে নিজেই চলতে পারছে না তাই তাদের ভার নিতে পারবে না। সেদিন থেকে রহিমা তাকে ভাই হিসেবে ত্যাগ করে নিজে উপার্জনের হাল ধরে। মাকেও ভাইয়ের খোঁজ নিতে দেয় না। তখন তার বয়স ছিলো তেরো বছর। আর এখন উনিশ পেরিয়ে বিশ এর দিকে যাচ্ছে৷ তার ভাইও অল্প বয়সেই বিয়ে করে ফেলে। ভার ছেড়ে দেওয়ার পরও কিছুদিন বস্তিতে কাটিয়ে হাত উন্নত হওয়ায় সে বস্তি ছেড়ে চলে যায়। এ পর্যন্ত একবারের জন্যও আসেনি স্বজনদের দেখতে। মাঝেমাঝে রাস্তাঘাটে দেখা যায়, কিন্তু সাক্ষাৎ হয় না।
রহিমা প্রথমে রাস্তা নির্মাণ কাজে যুক্ত হয়েছিলো। ইট ভেঙে দিতো। অত:পর ময়লার গাড়ি টানার কাজে৷ অত:পর ময়লার ফ্যাক্টরিতে। প্রায় দুবছর তার এসব কাজ চলার পর তা সাধ্যের বাইরে চলে আসে৷ ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়ে, শক্তিসামর্থ্যের অভাব দেখা দেয়। এসব কাজ তার দ্বারা হবে না তাই স্বল্প শক্তির প্রয়োজন এমন কাজ খুজতে লাগলো। পেয়ে গেলো বাড়িতে কাজের বুয়া হিসেবে কাজ। প্রথম যে বাড়িতে প্রবেশ করেছে এখনো সেখানেই আছে। গত চার বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে কাইয়ুম ভিলায়। বেতন মোটামুটি ভালোই পায় যা দ্বারা তার সংসার এবং ছোট বোনের পড়াশোনার খরচ চলে যায় কোনমতে। কিন্তু কিছুদিন আগে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। যার ফলে ওষুধ পথ্যের খরচে হাতটান পড়ে যায়৷ তাই অন্যত্র কাজ খুঁজে আরও একটা বাড়িতে কাজ পায়। কাইয়ুম ভিলায় অর্ধেক বেলা কাজ করার পর যেটুকু সময় অবশিষ্ট থাকে সেটুকু সময় সে ওইবাড়িতে অর্থাৎ হক মঞ্জিলে কাজ করে। এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে সে মায়ের চিকিৎসা করায় এবং কিছু সঞ্চয় রাখতে পারে। মেয়েটা কাজে যেমন পাকা, কথায় তেমন পটু! একটু চাপাটে স্বভাবের!
হাটতে হাটতে রহিমা চলে এলো কাইয়ুম ভিলায়। সময় সকাল সাতটা, আবহাওয়া বেশি গরম না হলেও রহিমা ঘেমে একাকার! কারণ এতোটা পথ অতিক্রম করে এসেছে তারউপর হাটার যে গতি, আট-দশ বছরের বাচ্চা হয়তো দৌড়েও পারবে না তার হাটার সাথে! বাসায় কলিং বেল বাজালে মিসেস মারিয়া কাইয়ুম এসে দরজা খুলে দিলেন। রহিমা সালাম দিলে তিনি সালামের জবাব দিলেন ঠিকই সাথে ঘর্মাক্ত শরীর দেখে প্রতিদিনের মতো তাকে বিশ মিনিট বাইরে দাড়িয়ে থাকতে বললেন। প্রতিদিন তিনি বলে দেন এভাবে হাপিয়ে কাজে না এসে যেন রিকশা করে আসে। কিন্তু এই মেয়ে বড্ড হিসাবি। রিকশা ভাড়ায় খরচ হবে তাই রিকশায় আসে না। মারিয়া কাইয়ুম বলে দিয়েছেন পর্যন্ত, আসার সময় সে রিকশা করে এলে যাওয়ার ভাড়া তিনি দিয়ে দিবেন। কিন্তু না, হিসাবি মেয়ে তাতেও রাজি না! সে দেক আর যে-ই দেক, রিকশা ভাড়া তো যাবেই!
প্রায় পনেরো মিনিট ধরে রহিমা বাইরে দাড়িয়ে আছে। এমন সময় বাড়ির দারোয়ান লাল মিয়া ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে এসেছে। রহিমাকে বাইরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আটাশ দাত বের করে হাসি দিয়ে বললো,
“আজকাও তোরে শাস্তি দিছে! কান ধরছ না ক্যা? কান ধর!”
“দেখ লালু, বেশি বেশি কথা কম কম কইবি। নাইলে লাল মিয়া থেকে নীল মিয়া বানায় দিমু।”
লাল মিয়া দুই হাতের ব্যাগ এক হাতে নিয়ে রহিমার মাথায় ঠুসি দিয়ে বললো,
“ছেমরি, তুই আমার নাম নিয়া ভেঙ্গাইলি ক্যা?”
রহিমা ব্যাথা পেয়ে মাথায় মালিশ করতে করতে কান্নার ভঙ্গিতে ভেতরে হাক ছাড়লো মারিয়া কাইয়ুমের উদ্দেশ্যে,
“আম্মা….! আম্মা….!”
মারিয়া কাইয়ুমকে কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে লাল মিয়া ব্যাগ দরজার পাশে রেখে, ব্যাগের উপর সত্তর টাকা রাখলো। আর পা বাড়ালো দোতলা থেকে নিচ তলায় যাওয়ার জন্য সিড়ির দিকে। সাথে বলতে লাগলো,
“আম্মা, আশি টাকা ফেরত আইছিলো৷ দশ টাকায় আমি চা বিস্কুট খাইছি।”
এদিকে রহিমা জিদ্দি কন্ঠে বললো,
“লালুর বাচ্চা কালু! তুই চা বিস্কুট খাইছোস? না সিগারেট খাইছোস?”
লাল মিয়া তার কোনো জবাব না দিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেছে। রহিমার মুখে এমন কথাবার্তা শুনে মারিয়া ধমকের সাথে বললো,
“রাহিমা! এসব কি ধরনের কথাবার্তা! তোকে না বলেছি মুখের ভাষা ঠিক করতে! আমরা কিভাবে কথা বলি সেগুলো ফলো করতে পারিস না!”
“ফলো তো করতাছি ই আম্মা! তবে এই বেডার লগে কোনো মানুষ ভালো কথা কইতে… না সরি। ভালো কথা বলতে পারবো না। অযথা আমার মাথায় মারছে! আপনাগো দিকে তাকাইয়া খালি কিছু কই না!”
“অযথা তোকে মেরেছে? এসব ভাষার জন্যই মেরেছে নিশ্চয়ই। মুখের ভাষা ঠিক করবি। আর তুই তার সাথে তুইতোকারি করিস কেন? সে তোর কত বড়, তুই জানিস! না হলেও তো দশ বছরের বড় হবে।”
“শুনেন আম্মা, বয়স আর উচ্চতা দেখলেই মানুষ বড় হইয়া যায় না। মানুষের মন দেইখা বলতে হয় সে বড় না ছোড। আর আপনারা সবাই যে আমারে দেখতে পারেন না, ওইডা খুব ভালো জানি আমি। কারো সহ্যই হয় না আমারে! সাপোর্ট পামু ক্যামনে! দরকার নাই কারো সাপোর্টের। লাথিঝাটা খাইয়া দুইটা পয়সা রোজগার কইরা পেটে ভাত দিয়া জীবন পাড় করতে পারলেই হইলো।”
কথা বলতে বলতে সত্তর টাকা মারিয়ার হাতে দিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে হনহন করে কিচেনের দিকে চলে গেলো রহিমা। মেয়েটা বড্ড চঞ্চলতার সাথে ইমোশনাল বানিয়ে ফেলতে পারে মানুষদের সেটা এবাড়ির সবাই জানে। তাই প্রথম প্রথম তার কথায় ইমোশনাল হয়ে থাকলেও এখন কেউই আর ইমোশনাল হয় না। কেউ একটু মজা করে সাপোর্টার হয় আর কেউ মজা করে আরেকটু রাগিয়ে দেয়। যেমনটা করলেন এখন কাইয়ুম সাহেব। ডাইনিং টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন তিনি। রহিমার কথাবার্তা শুনে আর মেজাজ দেখে তিনি একটু সাপোর্টার হতে এলেন। তাই পত্রিকা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তিনি বললেন,
“রহিমা, তুই চিন্তা করিস না। লাল মিয়াকে মিডিয়ার জগৎ থেকে বহিষ্কার করে দিবো।”
রহিমা কিচেনে ব্যাগ রেখে আবার বাইরে এসে বললো,
“শুনেন খালু, আমি আপনাগো এই সান্ত্বনা চাই না। কারণ আমি সিনেমার নায়িকা না, কোনো সাইড নায়িকা হইয়াও কাজ করি না। মোট কথা সিনেমার সাথে আমার কোনোই সম্পর্ক নাই। আপনে মিডিয়ার লোক হইয়া থাকলে আপনাগো লালু নিয়া থাকেন। লালুরে পত্রিকায় ছাপায় দেন, টিভির ভেতর ঢুকায় দেন, মোবাইলের ভেতর ঢুকায় দেন, সিনেমা হলের দারোয়ান বানায় দেন আমি কোনো কিছুই কইতাম না। আর আম্মা কইছে না শুদ্ধ ভাষায় কথা কইতাম, আমি অত শুদ্ধ আর বিশুদ্ধও কইতে পারতাম না! আমি তো ভালা না, আপনারা ভালা লইয়াই থাইকেন।”
রহিমা আবার চলে গেলো কিচেনে। ওদিকে মারিয়া দরজা লাগিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে জানালার ধারে দাড়ালো৷ আর নিচে থাকা লাল মিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“লাল মিয়া, তুই রহিমার গায়ে হাত তুলছিস কেন? অপরাধ করলে বুঝিয়ে দিবি। মেয়েদের গায়ে হাত তুলবি কেন! স্বভাব পাল্টা। আর কোনোদিন যেন না শুনি এমন কিছু!”
এদিকে রহিমা কিচেনে থেকে বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। তবে শব্দ জোরে হলেও কথা স্পষ্ট না। তার বিড়বিড় শুনে কাইয়ুম সাহেব আবার বললেন,
“তোর আম্মা বকে দিয়েছে লাল মিয়াকে। আবার এমন কিছু করলে লাল মিয়ার বিচারের ব্যবস্থা করবো। তুই কাদিস না রহিমা।”
রহিমা আবার বেরিয়ে এসে বললো,
“খালু, শুনেন। আমি অন্যসব মাইয়ার মতো ছিচকাদুনে না যে কথায় কথায় কান্না কইরা বন্যায় ভাসায় দিমু। এই লালুর মতো দশটা লালুরে সোজা করা আমার পক্ষে ব্যাপার না। রাস্তা দিয়া আসার সময়ও তিনটারে দৌড়ানি দিয়া আইছি। খালি আপনাগো দিকে তাকাইয়া ছাইড়া দিলাম লালুরে। হুহ্!”
হঠাৎ পাশের রুম থেকে চেচানো কণ্ঠে ভেসে এলো,
“রহিমার বাচ্চা! একটা দিনও তোর জন্য শান্তি মতো ঘুমাতে পারি না! তোর বস্তির সব ঝগড়াঝাটি, বিচার-আচার কি এই বাড়িতে আনতে হবে! আর একটা শব্দ উচ্চারণ করে দেখ তুই। ছয়তলার ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে সোজা পাকা রাস্তায় ফেলে দিবো!”
বাড়ির ছোট ছেলে আয়ানের ধমকে এবার রহিমা চুপ করে কিচেনে চলে গেলো। এ হচ্ছে আরেক বান্দর। না, এটা কোনো পশু না। এটা মানুষের বাচ্চাই তবে রহিমার মনের উপাধি বান্দর! এ বাড়িতে কাজ করার বর্ষে রহিমা আজও কোনো ভালো কাজ হতে দেখেনি এই বান্দরের দ্বারা। সারাক্ষণ অন্যের কাজে সমালোচনা করা, নিন্দা করা, বকাঝকা করা, সোজা কথা প্যাচিয়ে ত্যাড়া বানানো আর ঘাড় ত্যাড়ামো তার স্বভাব! যদি কেউ বলে ডানে যা, তো সে যাবে বামে! পরিবারের সকল সদস্যকে জ্বালিয়ে মারে সাথে কাজের লোককেও! আর কথায় কথায় রহিমার ডায়ালগ, “শুধু এই কাজের বেটি রহিমা বইলা আপনাগো দিকে তাকাইয়া এখনো কাজ করি আপনাগো বাড়িতে৷ নাইলে কোনো রোবটও টিকতো না! রোবট তো আর পালাইতে পারতো না। হয় দোতলা থেইকা ঝাপ দিয়া আত্মহত্যা করতো, না হয় বাস্ট হইয়া নিজে ফিনিশ হইতো সাথে এই বাড়িও পুড়াইয়া ফিনিশ কইরা যাইতো।”