কাঞ্চাসোনা #০৯,১০

0
2211

#কাঞ্চাসোনা
#০৯,১০
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
০৯

সকালের জন্ম হয়েছিলো কুয়াশা পড়া সকালে।চারদিকে কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে ছিলো।পাখির কিচিরমিচির,কুয়াশায় ডাকা সকাল সব মিলিয়ে খুব স্নিগ্ধ লাগছিলো।তখনি বাচ্চাটা তার স্বরে কেঁদে জানান দেয় সে এসে গেছে এই মায়ার পৃথিবীতে।তারেক আশ্চর্য হয়ে বাচ্চাটাকে দেখলো,কি সুন্দর স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।এই মিষ্টি শীতের সকালে মিষ্টি বাচ্চাটার আগমনে তার মন পুলকিত হয়।শীতের সকালের সাথে মিলিয়ে বাচ্চাটার নাম রেখে দিলো সকাল।সকালের মুখেও সব সময় এক আকাশ স্নিগ্ধতা বিরাজ করে,কিন্তু আজকে তার মন একটুও ভালো নেই।আকাশে আজ স্নিগ্ধতার বদলে মেঘ জমেছে।দুঃখী মুখে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুবর কিছুটা দূরে।
সকালের দিকে ধ্রুবর জ্বর কিছুটা কমে আসে কিন্তু সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা।অফিসে ফোন করে ছুটির কথা বললে,স্যার জানায় কোন ছুটি পাওয়া যাবে না তাই ধ্রুব চুপচাপ রেডি হয়ে নেয়।পরের চাকরি করে,কিছুই করার নেই।সকাল পাশেই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে।ধ্রুব হাত ধরে কাছে টেনে নেয়।একহাতে গালে ধরে বলে,
“তুমি এভাবে মন খারাপ করে আছো কেন?”

ধ্রুবর শরীরটা আসলেই খুব খারাপ।সমসময় হাসিখুশি থাকা মুখটা আজকে ফ্যাকাসে লাগছে।তারপরেও অফিস যেতে হবে ভেবেই সকালের কান্না পাচ্ছে।এই কয়দিনেই ধ্রুব সকালের ছোট মনে বাড়ি বানানোর আয়োজন শুরু করে দিয়েছে,অলরেডি ইট সিমেন্ট আনা হয়ে গেছে এখন শুধু ফাউন্ডেশন গড়ার অপেক্ষা।জ্বর আছে কিনা দেখার জন্য সকাল উঁচু লম্বা ধ্রুবর কপালে হাত ছোঁয়ায়।এখনো হালকা জ্বর বিদ্যমান।সকাল আদেশের সুরে বললো,
“আজকে অফিসে যেতে হবে না।”

ধ্রুব সকালের লম্বা বেনী হাতে পেঁচিয়ে নেয়।
“ম্যাডাম অফিসে না গেলে চাকরি যে চলে যাবে।”

সকাল ধ্রুবর গভীর চোখে তাকায়।কেমন লাল হয়ে আছে।শরীরের থেকে চাকরি বেশী বড়ো!সকালের অভিমান হয়,
“চলে যাক।”

ধ্রুব হাসে,
“চাকরি চলে গেলে বউকে খাওয়াবো কি?”

সকাল ছোট বাচ্চার মতো বললো,
“খেতে হবে না।”

ধ্রুব চুপচাপ তার বউয়ের ছেলেমানুষী দেখে।তারপর গাল টেনে বলে,
“তাড়াতাড়ি চলে আসবো সোনা।তুমি মায়ের সাথে গল্প করো,বই পড়ো সময় কেটে যাবে।”

তারপর খুব নরমভাবে কপালে একটা চুমু দিয়ে বেড়িয়ে যায়।সকাল কপালে হাত দিয়ে চোখে হাসে।লোকটা এতো ভালো কেন?সকালকে যেন সবকিছু হাত ধরে শিখিয়ে যাচ্ছে।

অফিস থেকে এসে ধ্রুব বিছানায় বসে আছে।সকাল আসলে কাছে ডাকে।তারপর একটা শপিং ব্যাগ সকালের হাতে দিয়ে বলে,
“এটা তোমার।”

সকাল ব্যাগ থেকে মোবাইল সেট বের করে।মোবাইল দেখে সে খুবই খুশী হয়।ধ্রুব সকালের হাত টেনে কাছে বসায়।চোখে চোখ রেখে বলে,
“এখন থেকে যখন মন চাইবে,এটা দিয়ে আমাকে ফোন দিবে।”

সকাল খুশী মনে বললো,
“আচ্ছা।”

“কি করলে সারাদিন।”

সকাল মাথা নেড়ে বললো,
“মায়ের সাথে একটু কাজ করেছি আর উপন্যাসের বই পড়েছি।”

ধ্রুব হাতে হাত রেখে বললো,
“সকাল আমি আমার মা-বাবার একমাত্র ছেলে,তো উনারা তোমার থেকে একটু আদর যত্ন আশা করবেই।মুখে না বললেও তুমি করবে।আম্মা তো তোমাকে রান্না বা কঠিন কোন কাজ করতে দিতে চাইবে না,আর ধুয়া-মুছা সব তো ছুটা বুয়াই করে।তুমি কি করবে,তুমি এই কাজগুলো করতে পারো সকালে আব্বা-আম্মাকে চা বানিয়ে দিলে,খাবার বেড়ে দিলে।আম্মা যখন রান্না করে তখন আম্মার কাছে থাকবে,মাঝে মাঝে নিজেই জোড় করে রান্না করতে চাইবে,বলবে মা আপনি বসে বসে আমাকে দেখিয়ে দিন আমি করে দেই।আব্বা আম্মার রুম গুছিয়ে দিলে,আম্মার প্রেসার বাড়ে কিনা খেয়াল করে তেতুলের শরবত বানিয়ে খেতে দিলে।এখন শীতকাল একটু গরম পানি করে উনাদের অজু করতে দিতে পারো।আব্বা প্রতিদিন রাতে আধা চা খায় উনার চা বানিয়ে দিলে উনি খুব খুশী হবে।আব্বা আম্মার সাথে গল্প করবে মানুষের বয়স হলে একটা গল্প করার মানুষ খুঁজে।বুঝেছো।”

সকাল মাথা নাড়ে।ধ্রুব আবার বলে,
“সকাল আমার খেয়াল যত্ন কর আর না করো আম্মা আব্বার দিকে খেয়াল রাখবে।তুমি তো জানই উনারা কেমন।তোমাকে কতো শখ করে এনেছে,তুমি প্লিজ তাদের একটু ভালোবেসো।”

ধ্রুব খুব সুন্দর করে সকালকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে।সকাল এগুলো মনোযোগের সহিত মাথায় গেথে নেয়।

ধ্রুব সকালের গালে লেপ্টে থাকা চুল কানের পিছনে গুছিয়ে দেয়।আদর করে বলে,
“আমি চাই আমার বউটা সবচেয়ে ভালো আর লক্ষি বউ হোক।”

সকাল সাথে সাথেই বললো,
“হবো।”

“আচ্ছা কালকের রিক্সার হুডের ব্যাপারে জানতে চাইবে না?”

সকাল বলে,
“আপনিই তো বললেন না।”

“তুমি আসলেই বুঝোনি?”

“না।এতো দাম কেন?”

“ওই খাওয়া-দাওয়া করে আরকি।এইজন্য।”

সকাল অবাক হয়ে বললো,
“রিক্সায় খাওয়া-দাওয়া!”

সকালের সোজা সোজা কথায় ধ্রুব খুব মজা পায়।
“এই খাওয়া সেই খাওয়া না পাখি।কিস মিস খায় বুঝেছো?”

সকাল অবিশ্বাস চোখে তাকিয়ে থাকে মানে রিক্সায় এসব?কিভাবে? ছিহ।ধ্রুব সকালের মুখ দেখে হেসে দেয়,
“সকাল এখন অনেক কাপল আছে রিক্সাই এসব করে।”

ছিহ,ছিহ করে সকাল মাথা নাড়ায়।

ধ্রুব হেসে কাতর গলায় ডাকে,
“সকাল..”

সকাল প্রশ্ন চোখে তাকালে ধ্রুব বলে,
“মাথাটা খুব ধরেছে একটু হাত ভুলিয়ে দাও”

সকাল তার মোলায়েম হাতে ধ্রুবর মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়।ধ্রুব আবেশে চোখ বন্ধ করে আছে।সকাল মাথায় হাত ভুলিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায় এতো ভালো,বুঝদার স্বামী তার কপালে লিখার জন্য।ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে ভাবে এই ধ্রুবটা তার,সবটাই তার,এসব ভাবতে ভাবতে এক অভাবনীয় কাজ করে বসে,টুপ করে নরম কোমল ঠোঁট দিয়ে ধ্রুবর কপালের মধ্যিখানে চুমু দিয়ে দেয়।ধ্রুব সাথে সাথেই চোখ খুলে তাকায়।সে বিষ্ময়কর চোখে তাকিয়ে।সকাল আর ধ্রুবর কাছেই থাকে না তার করা কাজে সে নিজেই লজ্জায় রাঙ্গা।একছুটে বারান্দায় চলে যায়।

ধ্রুব কিছু বলে না চোখ খুলে সকালের চলে যাওয়া দেখে।বাচ্চাটা নিজেই তাকে চুমু দিয়েছে!এটাইতো ধ্রুব চাইছিলো পাখি ডানা ঝাপটে নিজেই ছটফটিয়ে সইচ্ছায় ডাকুক,মন থেকে বুকে টানুক।খুশীতে ধ্রুবর মনে আতশবাজি ফুটে।ধ্রুব কিছুক্ষণ শুয়েই থাকে তারপর আস্তে করে বারান্দায় ঢুকে যায়।সকাল গ্রীলে হাত রেখে রাতের উজ্জ্বল চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।আজকের চাঁদটার উচিত ছিলো লজ্জায় মেঘের আড়ালে মুখ ঢাকা তা না করে কেমন বেহায়ার মতো সকালকে দেখে হাসছে।ধ্রুব নিঃশ্বব্দে সকালের পাশে এসে গ্রীলে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।আস্তে বলে,
“আজকের চাঁদটা একটু বেশীই সুন্দর তাই না বউ।”

আচমকা ধ্রুবর কথা শুনে সকালের মনের ছোট পিঞ্জিরা কেঁপে ওঠে, লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ে।চাঁদের উপর ভিষণ অভিমান হয়,একটু মেঘের আড়াল হয়ে গেলে কি হতো!ধ্রুব স্পষ্ট দেখে তার বউ লজ্জার বহর খুলে সারা গায়ে লেপ্টে নিচ্ছে।ধ্রুব এই প্রথম সকালের পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।কানের লতির কাছে মুখ ছুঁইছুঁই করে ঘোর লাগানো গলায় ফিসফিসিয়ে বললো
“আমি কি এতোই খারাপ সোনা?”

ধ্রুবর সম্মোহনী ডাকে সকালের সুপ্ত অনুভূতিরা কাঁপে।তার পিছনে ধ্রুব লেপ্টে আছে,সারা শরীরে অজানা শিহরণ।সকাল হাফসাফ করে বললো,
“সরে দাঁড়ান না!”

ধ্রুব সরে না,সকালের ভেতরটা আরো নাড়িয়ে দিতে,ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছাটাকে টেনে বের করতেই বললো,
“আগে উত্তর দাও।তারপর ছাড়ছি।”

সকালের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।ধরা গলায় বলে,
“ভালো।”

ধ্রুব সকালের কানে তার ঠোঁট আলতো ঘষে বলে,
“ভালোবাসার মতো ভালো তো?”

সকাল ধ্রুব সংস্পর্শে এসে কথা বলতে পারছেনা।সে ধ্রুবকে কি করে বলবে সকাল তাকে একটু একটু ভালোও বেসে ফেলছে।লজ্জায় বেশী কিছু না বলে ছোট করে উত্তর দেয়,
“জানিনা তো।”

ধ্রুবর বিষাক্ত ইচ্ছেরা আবারো জেগে উঠে।দেহ নাড়িয়ে মন কাঁপিয়ে অনুভূতিরা উল্টাপাল্টা ছুটে চলে।সে বউটাকে কিভাবে বুঝাবে ধ্রুব যে তাগড়া যুবক।বিষাক্ত ইচ্ছেরা তাকে বেশী জ্বালায়।সকাল আগে থেকে একটু ফ্রী হয়েছে কিন্তু তারপরেও সকালের মাঝে স্পষ্ট সংকোচের দাগ দেখা যাচ্ছে।ধ্রুব সরে এসে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে সকালের দিকে তাকায়।ধ্রুবর চোখের ভাষাটা সত্যিই সকালের বুকটা পুড়িয়ে দিচ্ছে,তলপেটে প্রজাপতির ঝাঁক উড়ে উড়ে সুরসুরি দিচ্ছে।কেমন মাতাল করা আশায় মন মেতে উঠে,সকালও সমানতালে ধ্রুবকে দেখে।ধ্রুব যেন চোখ দিয়েই তার পিচ্ছি ছাত্রীকে শিখাচ্ছে,চিনাচ্ছে,জাগিয়ে তুলছে।
সকালের ছটফটানি ধ্রুবর চোখে পড়ে।গভীর গলায় বললো,
“এতো ভয় পাও কেন?”

সকাল হেসে বললো,
“ভয় পাই না।”

ধ্রুব হাতমুড়ে দাঁড়ায়।ফিচলে হেসে বললো,
“তাই?”

সকাল নিজেও হাসে।মাথা নাড়িয়ে বলে,
“হ্যাঁ।”

ধ্রুব সকালকে ভয় দেখাতে পিছনের দেয়ালে দিকে ঠেলে দেয়।তারপর সকালের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“এখন ভয় পাচ্ছো।”

সকাল মাথা নাড়িয়ে বলে,
“মোটেই না।”

ধ্রুব সকালের নরম শরীরের সাথে একটু চেপে দাঁড়ায়।বিরবির করে বলে,
“এখন?”

সকাল ধ্রুবর চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়।
ধ্রুব সকালের নরম কোমল ঠোঁটের কাছে নিজের পুরু ঠোঁট এগিয়ে নেয়।দুজনে দুজনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,ধ্রুব চোখ দিয়েই পাগলকরা ইচ্ছা সপে দেয়,সকাল দ্রুত মাথা নেড়ে না করে।দুজনের নিশ্বাসের মধুর আলিঙ্গন হয়,হয়না শুধু তাদের।ধ্রুব এখন মোটেও মজা করছে না,তিরতির করে কাঁপা ঠোঁট তাকে চুম্বকের মতো টানছে।ধ্রুব ফিসফিস করে বললো,
“জান একবার প্লিজ।শুধু একবার।”

সকাল অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলে।সে কথা ধ্রুবর কাছে বোধগম্য হয় না।সে ঘন শ্বাস ফেলে ঠোঁট ছোঁয়িয়ে দেয়,সকাল চোখ বন্ধ করে থাকে অস্বাভাবিক গতিতে হৃদপিণ্ড ছুটে চলছে।ধ্রুবর একবার ছুঁয়ে মন ভরে না,আরেকবার ছোঁয়,আরেকবার ছোঁয়।
তখনি মিসাইলের মতো মনোয়ারা সকালকে ডেকে উঠে রাতের খাবার খেতে।ধ্রুব আরো শক্ত করে সকালকে ধরে বলে,”পরে যেও। প্লিজ।”

সকাল ধ্রুব কথা শুনে না।সে যেতে পারলেই বাঁচে,মোচড়ামুচড়ি করে ধ্রুবর থেকে ছুটে চলে যায়।দূরে গিয়ে বুকে থু থু ছিটিয়ে পড়ে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজিম।’
ধ্রুব অসহায় মুখে তাকিয়ে থাকে।তার মায়ের উপর খুব রাগ হচ্ছে এমন মূহুর্তে কেউ ডাকে?বাচ্চা বিয়ে করিয়েছে এখন বাচ্চাকে বুঝি ছোঁয়াও যাবে না।কি মুশকিল!কি যন্ত্রনা!

চলবে….

#কাঞ্চাসোনা
#১০
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

দুপুরের দিকে সকালের প্রচন্ড পেট ব্যাথা হয়ে মান্থলি পিরিয়ড শুরু হয়।নতুন পরিবেশ,নেই কোন পদক্ষেপ।হাজারো অসস্থি নিয়ে মনোয়ারাকে জানায়,তিনি তখনি প্রয়োজন সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেয়।সবসময়ই সকালের প্রচন্ড পেট ব্যাথা হয়।মায়ের কাছে থাকাকালীন সারাক্ষণ মায়ের কাছে শুয়ে থাকতো মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে বলতো,আর প্যানপ্যান করে এটা সেটার আবদার করতো।তার শাশুড়ী ফ্রী মানুষ,সকালকে খুবই ভালোবাসে আর যত্ন করে।উনি সকালকে গিয়ে শুয়ে থাকতে বলেন।
মনোয়ারার মনে পড়ে তার নতুন বউ হয়ে আসার পরের গল্প।প্রেম করেই বিয়ে করেছিলো দুজনে।কিন্তু শশুড়-শাশুড়ী মেনে নিতে পারেনি,বিশেষ করে উনার শাশুড়ী।কথায় কথায়,প্রতিটা কাজে মনোয়ারাকে খুঁচা দিয়ে কথা বলতেন।মনোয়ারা আসাদের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকতেন।না পারতেন সইতে না পারতেন মা বাবাকে বলতে।বাবা-মা কে কিভাবে বলতো নিজের পছন্দের বিয়ে করেছে তো!আসাদ অবশ্য ভালো ছিলো,সে বুঝতে পারতো মনোয়ারার কষ্ট হচ্ছে,তাই উনাকে বুঝাতেন,ভালোবাসায় কষ্টটা ভুলিয়ে দিতে চাইতেন।পিরিয়ডের ব্যাথায় যখন কান্না করতো তখন উনার শাশুড়ী বলতেন “এসব কাজ না করার ধান্দা।যত্তডং।”মনোয়ারা ব্যাথা নিয়েই কাজ করতো মাঝে মাঝে আসাদ মায়ের থেকে লুকিয়ে এটা সেটা করে দিতো।তারপর আরেক সমস্যা হলো মনোয়ারার বাচ্চা হয় না।দশ বছরেও যখন বাচ্চা হলো না তখন শাশুড়ী আসাদকে আবার বিয়ে করাতে চাইলে আসাদ না করে দেয়,তারপর দুজনকে ঘর থেকে বের করে দিলে আসাদ মনোয়ারাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে।আসার বছরেই মনোয়ারার কোলজুড়ে আসে,মিতু-ধ্রুব।দুজনের সেকি আনন্দ।শেষ বয়সে অবশ্য তার কাছেই তার শশুড়-শাশুড়ী ছিলেন,উনি নিজেই তাদের সেবা যত্ন করেছেন।কিন্তু ওই যে মনে একটা কষ্ট লেগেছে,সেটা ভুলতে পারেননি।উনার মনে হয়না উনার শাশুড়ী উনার সাথে কোনদিন ভালো করে কথা বলেছে,বা একটু বউয়ের সম্মান দিয়েছে।সবসময় কাজের মেয়ের মতোই ব্যবহার পেয়ে মনোয়ারা ভেবেছেন,আমার ছেলের বউ আমার আরেক মেয়ে হবে,কখনো কষ্ট দিবো না।বুকে আগলে শিখাবো।আমার প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলবো।আমি যেই কষ্টগুলো পেয়েছি আমার বউকে কখনোই এই কষ্টগুলো পেতে দেবো না।

ধ্রুবর অফিস থেকে আসতে আসতে রাত হয়ে যায়।আজকে একটু বেশিই কাজ ছিলো।বাসায় এসে সকালের শুকনো মুখ দেখে।সকাল মুখ শুকনো করেই সবার সাথে খেতে বসলো।অল্প খেয়ে উঠে গেলো।ধ্রুব চুপচাপ দেখলো।রুমে গিয়ে দেখে সকাল শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে।আজ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কারনটা ধ্রুব বুঝলো না,ভাবলো শরীর খারাপ লাগছে হয়তো তাই।
বউয়ের সঙ্গ না পেয়ে ধ্রুব মন খারাপ করে শুয়ে পড়ে,কিন্তু ঘুম আসেনা,মাত্র দশটা বাজে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমানো যায়!চুপ করে বিছানায় শুয়ে থাকে।
সকালের পেটের ব্যাথায় অসহ্য লাগছে।দাঁত কামড়ে সহ্য করে মাকে খুব মনে পড়ছে।মা একটু হাত ভুলিয়ে দিলেই যেন ব্যাথাটা নিমিষেই দূর হয়ে যায়।ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।শব্দ না হলেও হালকা ফুপানো শোনা যায়।ধ্রুব উঠে লাইট জ্বালিয়ে সকালের সামনে এসে ফ্লোরে বসে।অবাক হয়ে বলে,
“তুমি ঘুমোও নি?”

সকাল হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।
“কাঁদছো কেন?বাবা মাকে মনে পড়ছে?”

সকাল কিছু বলেনা।উনার সাথে এতোটা ফ্রী এখনো হয়নি যে নির্দিধায় সব বলা যায়,আড়ষ্ট হয়ে সকাল চোখ বন্ধ করে নেয়।ধ্রুব শান্ত হয় না সে থাকতে তার এতো আদরের বউ কান্না করবে কেন?
“দেখি উঠে বসো তো।”

ধ্রুব সকালকে টেনে বসায়।
মুখোমুখি বসে সকালের হাত তার দু’হাতে মুঠোয় নিয়ে আদর মাখিয়ে বললো,
“সোনা পাখিটার কি হয়েছে ? আমাকে না বললে বুঝবো কি করে?”

সকাল আস্তে করে বললো , “এমনিই।”

“মিথ্যা বলা লাগবে না সত্যিটা বলো।”

সকাল যানে ধ্রুব সত্যিটা বের করবেই।সে আস্তে বললো,
“পেট ব্যাথা।”

ধ্রুব ব্যাস্ত হয়ে বললো,
“হঠাৎ পেট ব্যাথা কেন?কখন থেকে?”

সকাল বিব্রতবোধে চোখ নামিয়ে নেয়।ধ্রুব বুঝতে পারে ব্যাথাটা কিসের।কিছুক্ষণ চুপ করে বললো,
“কখন শুরু হলো?”

ধ্রুব বুঝে গেছে?কিভাবে বুঝলো?সকালের এবার লজ্জায় মরে যাবার অবস্থা।চোখের মনি এদিক ওদিক ঘুরায়।ধ্রুব সকালের লজ্জা দেখে বলে,
“সকাল পিরিয়ড হওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।এটাতে এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।এটা আল্লাহ প্রদত্ত।আর ভেবো না ছেলেরা এসব বুঝে না বা জানে না।সব ছেলেরাই বুঝে।আমিও বুঝি।আমি তোমার হাজবেন্ড তোমার সব ব্যাপারে আমাকে বলবে।তোমার কি বেশী কষ্ট হচ্ছে?”

ধ্রুব সব কথা এতো সহজ স্বাভাবিকভাবে কি করে বলে?সকাল চুপ থাকে।ধ্রুব সকালের হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললো,
“বেশি ব্যাথা করছে?”

প্রচন্ড ব্যাথা করছে সকাল মাথা নাড়িয়ে কেঁদে দেয়।সকালকে কাঁদতে দেখে ধ্রুবর ভালো লাগেনা।কাছে টেনে একহাতে জড়িয়ে ধরে।
“ওষুধ খেয়েছো?”

“মা দিয়েছে।”

ধ্রুব সকালের চোখের পানি মুছে বললো,
“দেখি,কেঁদে কি অবস্থা করেছো মুখের।যাও ফ্রেস হয়ে আসো।”

সকাল ফ্রেস হয়ে আসতে আসতে ধ্রুব রান্না ঘরে যায় পাতিলে পানি নিয়ে চুলায় বসায়,সচরাচর তার আব্বাকে দেখেছে পানি গরম করে হট ব্যাগে নিয়ে তার আম্মাকে দিতে আজকে সে দিবে তার বাচ্চাটাকে ।সকাল ধ্রুবকে রুমে না পেয়ে বেরিয়ে এসে রান্না ঘরে পায়।অবাক হয়ে বলে,
“আপনি এখানে কি করছেন?”

ধ্রুব বললো,
“পানি গরম করে হট ব্যাগে নিয়ে দিব।তুমি পেটের উপর রাখলে আরাম পাবে।”

ধ্রুবর এই ছোট ছোট খেয়াল,যত্নগুলো সকালের মনে ভালোবাসা বাড়ায়।নিজেকে খুব ভাগ্যবতী ভাবায়।চুলায় বসানো পাতিলের দিকে তাকিয়ে থাকে।ধ্রুবই আবার বলে,
“তখন ভাত খেতে পারলেনা,কিছু খাবে?”

সকাল দুষ্টুমি করে বললো,
“খেলে কি রান্না করে খাওয়াবেন?”

“বলেই দেখো।”

সকাল ভেবে বললো,
“নুডুলস খাবো।”

ধ্রুব মাথা নাড়িয়ে হাসে আর বলে, “যাক বাবা পারা জিনিসই খেতে চাইলে।”

ধ্রুব নুডুলসের সামগ্রী রেডি করে।সকাল এগিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়।
“কেন আর কিছু রান্না করতে পারেন না?”

“ভাত,ডাল,আলু ভর্তা,মাছ ভাজি,নুডুলস,কফি।এগুলোই৷ পারি।আম্মা শিখিয়েছে একা থাকলে যেন চলতে পারি।”

সকাল অবাক হয়ে ধ্রুবর কথাগুলো শুনে।
“তারপর বলে আম্মা যদি এখন দেখে আমার জন্য রান্না করছেন কিছু বলবেনা?”

ধ্রুব জ্বিভ দিয়ে ‘চ’কারান্ত শব্দ করে বললো,,
“কিছু বলার কি আছে?আমার বউকে আমি রান্না করে খাওয়াতেই পারি।”

“আমাদের গ্রামে হলে বলতো বউয়ের নেউটা।আঁচলের নিচে পড়ে থাকা পুরুষ।”

সকালের কথা শুনে ধ্রুব হাসে।
মাথা নেড়ে বলে,
“বউয়ের নেউটা হবো না তো পাশের বাড়ির ভাবির নেউটা হবো?”

সকাল মুগ্ধ চোখে ধ্রুবকে দেখে শ্যামবর্ণা গায়ে কালো গেঞ্জি ভেতর দিয়েই বলিষ্ঠ দেহ নজর কাড়ছে।ধ্রুবর সাথে বিয়ে হবার পর থেকেই সকালের নজর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।এই যে চুপিচুপি ধ্রুবর আগাগোড়া গ্রোগাসে গিলে এটা কি ভালো কথা?ধ্রুব আড়চোখে বালিকার সুচালো দৃষ্টি দেখে মনে মনে হাসে।রান্না শেষ হলে সকাল খায়,খেয়ে খুব প্রসংসা করে।ধ্রুব প্রশংসা শুনে খুবই খুশী হয়।

তারপর ধ্রুব আর সকাল দুজনে বিছানার মধ্যিখানে বসে।ধ্রুব তার বুকে হেলান দিয়ে সকালকে বসিয়ে পেটে হট ব্যাগটা রাখে।সকাল মাথা নামিয়ে মুচকি হাসলে ধ্রুব বলে,

“সুন্দরী হেসো না হেসো না।যা কষ্ট দিচ্ছো সারাজীবন মনে থাকবে।”

ধ্রুব সানিধ্যে সকালের মন ভালো হয়।সব কথাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুব্দ।বিরবির করে বলে,
“কি কষ্ট দিলাম।”

ধ্রুব মাথা কাত করে সকালের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“যদি সেটা বুঝতে,পাগলের মতো শুধু আমাকেই খুজতে।”

সকাল মনে মনে ভাবে,ধ্রুব বাবু আমি বোধহয় কিছুটা বুঝে গেছি।তাইতো আপনি কাছে এলে সারা শরীরে বিষব্যাথা চিরবিরিয়ে ওঠে।আপনার ঘ্রান পেলেই মাথা গরম হয়ে যায়।মাথা দুলিয়ে বললো,
“আচ্ছা।”

সকাল খুব সহযভাবে ধ্রুবর কোলে শুয়ে পেটে মুখ গুজে দিলো।যদিও কাজটা খুব সহজ ভেবেই করেছিলো এখন নাকের ডগা লাল হচ্ছে,ধ্রুব শরীরের মাতোয়ারা ঘ্রান নাকে দিয়ে ফুসফুসে গিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে।সকাল পেটে নাক ঘষে ঠোঁঠ নাড়িয়ে ধ্রুবর শোনার মতো ফিসফিস করে বললো,
“মাথায় হাত ভুলিয়ে দিন।”

ধ্রুবর মুখ আবেশে ভরে উঠে।চোখ স্থির করে সকালকে দেখে।সকালের ছোঁয়ায় পিঠ বেয়ে ঠান্ডা স্রোত ছুটে যায়।সে যানতো অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।সকাল যেন তার ছোট ছোট দোলায় তাকে দুলিয়ে যাচ্ছে।তার দেহ অবস হয়ে আসে।সকালের কথা মতো মাথার চুলে আলতো করে হাত ভুলায়।সকাল চোখ খুলে ধ্রুবকে দেখে।ধ্রুব সকালের তাকানো দেখে হেসে ফেলে বললো,
“কি দেখো?”

সকাল এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,
“গান শুনবো।”

ধ্রুব মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আমিতো গান পারি না জান।”

সকাল বাচ্চাদের মতো করেই বললো,
“না আমার জন্য পারতে হবে প্লিজ।”

“এটা কি গান গাওয়ার সময়?”

সকাল ভাব নিয়ে বললো,
“বউ বললে,অসময়ও সময় হয়ে যায়।”

ধ্রুব সকালের নাক টেনে দিয়ে বললো,
“আরে বাব্বা আমার বউ তো বেশ কথা শিখেছে।”

সকাল আহ্লাদী মুখে হাসে।ধ্রুব মিষ্টিমুখের অধিকারীনির দিকে তাকিয়ে থেকে মাথাটা নিচু করে চিবুকে একটা চুমু খায়,ফিসফিস করে বললো,
“তোমাকে এতো আদর আদর লাগে কেন জান।”

সকাল ছটফটিয়ে বললো,
“গান শুনবো।”

“শুনে আবার হাসবে না কিন্তু।”

সকাল ভালো মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বললো,
“আচ্ছা।”

ধ্রুব কিছুক্ষণ চুপ থাকে।ভার্সিটিতে থাকতে বন্ধুরা মিলে কতো গান গাওয়া হতো।সে তার পুরুষালী গলায় গেয়ে উঠে,

❝ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে…..
ভালবাসার নাও ভাসাবো,
ভালবাসি বলে….❞

❝তোমার চুলে হাত বুলাবো,
পূর্ণ চাঁদের তলে …..
কৃষ্ণচূড়া মুখে তোমার,
জোসনা পড়ুক কোলে…..
আজকে জড়ায় ধরবে,
তোমার মনকে আমার মন….
গাইবে পাখি, গাইবে জোনাক ;
গাছ গাছালি বন….❞

❝এত ভালবাসা গো জান,
রাখিও আঁচলে….
দোলাও তুমি, দুলি আমি ;
জগত বাড়ি দোলে …..❞

❝শব্দ ঘুমের মূর্ছনাতে,
বাতাসও সুর তোলে…..
ভালবাসার শিশির কণা,
পড়বে ও আঁচলে….
এত ভালবাসা গো জান,
রাখিও আঁচলে….
দোলাও তুমি, দুলি আমি ;
জগত বাড়ি দোলে …..
ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে…..
ভালবাসার নাও ভাসাবো,
ভালবাসি বলে……❞

সকাল এক নজরে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে থাকে।ধ্রুব সকালের দিকে তাকিয়েই গানটা গায়।সকালের চোখে মুখে সুখের রেশ লেগে আছে।ধ্রুব বিবস হয়ে তাকিয়ে আছে,এই যে অপেক্ষা এই যে দাঁত কাঁমড়ে পড়ে থাকা,এগুলো তো এই মেয়েটার খুশীর জন্যই।ধ্রুব সকালে চোখে স্পষ্ট ভালোবাসা দেখতে পায়,এই যে এখন ডাগর চোখের ঝাপটানোতে পাগলের মতো তাকে কাছে ডাকছে ধ্রুব এই জায়গাটা তৈরি করে নিয়েছে বলেই তো!ধ্রুব ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।হালকা হয়ে আসা গলায় বলে,
“কি দেখো? ”

সকালের দুই চোখ তখনো ধ্রুব সারা মুখে বিচরন করছে।লাল কালচে ঠোঁট গুলো ছোঁয়ার অদম্য ইচ্ছায় ভেতরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে।ভেতরে কি জানি ভাঙ্গচুর হচ্ছে সেই ভাঙ্গচুরের চোটে গলা বুজে আসে।বুজে আসা গলায় বললো,
” আমার এতো পাগল পাগল লাগছে কেন?”

সকালের এই কথাগুলো ধ্রুবকে সুখ দেয়।কিছু না বলে গভীর চোখে সকালকে দেখে।সকালের চোখে আজ অন্য নেশা নেই ভয়,শুধু উজ্জ্বল চোখে তাকে দেখছে।দুজনের চোখে চোখে কথা হয়,অনুভূতির বিচরণ হয়।সম্মোহনী চোখে তাকিয়ে দুজনের মন অজানা কথায় মেতে উঠে।সকালের এমন সম্মোহনী দৃষ্টি দেখে ধ্রুব সাহস পায়।সে তার তুলতুলে বাচ্চা বউটাকে খানিকটা উপরে তুলে নরম গোলাপী ঠোঁটে স্বাধ খুঁজে নেয়।সকালের চোখে পানি আসে,অবশ্যই সুখের পানি।ধ্রুবকে ঠেলে দুরে সরিয়ে বালিশে শুয়ে বলে,
“আমি ঘুমাবো ডিস্টার্ব করলে মিতু আপুর রুমে চলে যাব।”

ধ্রুব মনে মনে হু হা করে হাসে।হুমকি দিচ্ছে?আজকে কি বেশীই লাজে লাল হচ্ছে না?আদরের পরিমান বেশী হয়ে গেলো নাকি?আহা বাচ্চা বউ!অসুস্থ পাখিকে আর বাসা থেকে উড়াতে ইচ্ছে করে না,আজকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি উড়েছে,ধ্রুব এখনো উড়ছে,একাকি।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here