কাননে ফুটিল ফুল — ২০

0
17

কাননে ফুটিল ফুল — ২০ (১০০০+ শব্দ)

আফরোজা বেগম এগিয়ে গিয়ে কোলে নিলেন বাচ্চাকে। তারপর সারজিমের কাছে নিয়ে গেলেন। সারজিম ছেলের কানে আজান দিল।

কিছুক্ষনের মধ্যে নৈশীকে কেবিনে শিফট করা হলো। অ্যানেস্থেশিয়ার প্রভাবে নৈশী ঘুমাচ্ছে। সারজিম এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীর কপালে হাত রাখল। নৈশী চোখ খুলে তাকাল সাথে সাথে। দুর্বল কন্ঠে সারজিমকে জিজ্ঞাসা করল, “ও দেখতে কার মতো হয়েছে? আমি খুব করে চেয়েছিলাম, ও যেন দেখতে তোমার মতো হয়।”

সারজিম ওর কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিয়ে বলল, “আমিও কিন্তু চেয়েছিলাম ও যেন তোমার মতো হয়। আমি তোমাকে এই বিষয়ে কিছু বলব না এখন৷ জ্যোতিকে বলছি ওকে তোমার কাছে নিয়ে আসতে৷ তুমি নিজেই নাহয় দেখে নিও।”

ধবধবে সাদা তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা আদুরে বাচ্চাটিকে নিয়ে জ্যোতি এগিয়ে এলো নৈশীর কাছে। ও দেখতে কার মতো হয়েছে এসব কিছুই নৈশীর মাথায় রইল না নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে। জ্যোতি বাচ্চাকে ওর পাশে শুইয়ে দিল। নৈশী ছেলের গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, “আমার সোনা বাবা।”

অবশেষে অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকার শেষে নতুন প্রভাতের অরুণোদয় এলো ওদের জীবনে। আন্দালিব নামের কালো ছায়াটা বিদায় নিল শেষপর্যন্ত।

____

গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলো নৈশী। দুইটা বাটিতে আলাদা নাস্তা এনে রাখল শুভ্র আর মিথির সামনে। দুজনেই এক টেবিলের দুপাশে বসে হোমওয়ার্ক করছে। শুভ্র আর মিথি সম্পর্কে চাচাতো ভাইবোন। ওরা দুজনেই এবার ক্লাস নাইনে পড়ছে। এদের সম্পর্কটা অনেকটা দা কুমড়া টাইপ। মিথি একটা বাটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে নৈশীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওয়াও, আই লাভ নুডুলস। থ্যাংক্স চাচি।”

শুভ্র ওর কথা শুনে পাশ থেকে বলে উঠল, “সত্যিই মিথি, তোরা মেয়েরা পারিসও ন্যাকামি করতে। সামান্য নুডুলস। খাবি তো খা৷ এত ঢং করে বলার কী আছে সেটা?”

শুভ্রর কথা শুনে মিথি চোখ পাকিয়ে তাকাল। নৈশী চাটি মারল ছেলের মাথায়, “এখানে ন্যাকামির কী দেখলি তুই? আজকাল দেখি তুই ওকে সহ্যই করতে পারিস না৷ এরপর থেকে ওর পিছনে লাগতে দেখলে মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না বলে দিলাম।”

শুভ্র জানে, এটা শুধু কথার কথা নয়। সত্যিই মা ধরে মার দেবে৷ ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে হোমওয়ার্কে মন দিল। নৈশী চলে গেল। মিথি নুডুলসের বাটি নিয়ে চটজলদি খেয়ে ফেলল। শুভ্রও নিজের বাটিটা নিয়ে খেতে শুরু করল। তখনই চেঁচিয়ে উঠল মিথি, “চাচি, দেখে যাও শুভ্র কী করছে।”

নৈশী দৌড়ে এলো, “কী হয়েছে?

মিথি কাঁদকাঁদ মুখ করে বলল, “দেখ তোমার ছেলে কী করেছে। তুমি যাওয়ার পর নিজের নুডুলস তো খেয়ে শেষ করেছে, এখন আমার ভাগেরটা নিয়েও খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।”

শুভ্রর পিঠে বেশ জোরেশোরেই কয়েক ঘা মার পড়ল এবার।

“এসব হচ্ছেটা কী শুভ্র? পড়াটা শেষ হোক, আজ তোকে আমি দেখাচ্ছি মজা। মিথি, তুই পড়তে থাক। আমি তোর জন্য আবার নুডুলস নিয়ে আসছি।”

নৈশী চলে গেল। মিথি শুভ্রর কাছে এগিয়ে বলল, “এইমাত্র আমাকে ন্যাকা বলেছিস না? সেজন্যই রিভেঞ্জ নিলাম। এরপর আমাকে খোঁচাতে আসলে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দেব তোকে।”

শুভ্র বিরস বদনে খেতে থাকল। সত্যি, এই পাজি মেয়ের সাথে কথা বলতে যাওয়াই ভুল হয়েছে। বদবুদ্ধি সব এই মেয়ের মাথায় কিলবিল করে সারাদিন। নিজের ভবিষ্যত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে শুভ্র। সাব্বির চাচ্চু বলেছে ওকে, তার সাথেও অনেকটা এমনই হয়েছিল। সাব্বির চাচ্চুর চাচাতো বোনও তার জীবনটা এমন তেজপাতা করে দিত সবসময়। অথচ দাদি নিজের ছেলের সাপোর্ট না করে সবসময় সেই মেয়েটার সাপোর্ট করত। আর সাব্বির চাচ্চুকে মার খেতে হতো তখন। পরে সেই মেয়েটাই চাচার বউ মানে শুভ্রর চাচি হয়ে গেছে। শুভ্রর মনে হয় ওর সাথেও এমন কিছুই হবে৷ মা নিশ্চিত এই মেয়েটাকেই নিজের ছেলের বউ বানাবে। শুভ্রর অবশ্য তাতে খুব একটা আপত্তি থাকবে না। মিথিটার চেহারা খারাপ না। ধবধবে ফর্সা না হলেও চেহারায় মায়া আছে। ফোলা ফোলা গালদুটো দেখলেই কেমন দুই আঙুলে টিপে দিতে ইচ্ছে করে। দুপাশে বিনুনি দুলিয়ে স্কুলের বারান্দায় হাঁটার সময় খুব মিষ্টি লাগে ওকে দেখতে। শুধু একটাই সমস্যা, এই মেয়ে একেবারে পাজির পাঝাড়া। সেটা অবশ্য বিয়ের পরে শাসন করে ঠিক করা যাবে।

নিজের এলোমেলো ভাবনায় নিজেই চমকে গেল ও। ধূর, এই মেয়েটাকে নিয়ে কীসব ভাবছে ও। খাওয়া শেষ করে আবার পড়ায় মন দিল শুভ্র। নইলে এই মেয়ে আবার মায়ের কাছে কিছু একটা বলে নালিশ করে দেবে দেখা যাবে।

নৈশী বসে আছে ব্যলকনিতে। বসে বসে ভাবছে পুরোনো কিছু কথা। অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। সেই ঘটনার পর সেই যে আন্দালিব দেশ ছাড়ল তারপর কয়েক বছরেও ওর কোনো খবর পায়নি নৈশী। তবুও ওর মনের মধ্যে ভয় থেকেই গিয়েছিল৷ যদি কখনও আন্দালিব ফিরে এসে আবার ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করে। তাই নিজের মতো করে আন্দালিবকে খোঁজার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এই ব্যাপারে নৈশীকে সর্বোচ্চ সাহায্য করেছিল ওর চাচাতো ভাই। আমেরিকায় প্রচন্ড প্রভাবশালি একজন নৈশীর চাচা। তাদের মাধ্যমে প্রায় বছর ছয়েক চেষ্টা করার পরে আন্দালিবের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। নৈশী সবই বলেছিল চাচাকে আন্দালিবের ব্যাপারে। আন্দালিবের খোঁজ পাওয়ার কিছুদিন পরেই নৈশীর চাচাতো ভাই ফোন করেছিল নৈশীকে। বলেছিল, “মানুষ যতই খারাপ হোক না কেন, নিজের প্রাণের মায়া সবার আছে নৈশী৷ আন্দালিবের সাথে যা করার করেছি। বেঁচে থাকবে কিনা ও জানি না৷ বেঁচে থাকলেও আর জীবনে তোমাদের দিকে হাত বাড়াবার সাহস করবে না। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।”

নৈশী বুঝেছিল আন্দালিবের সাথে খারাপ কিছুই করা হয়েছে কিন্তু তাতে ওর একদমই খারাপ লাগছিল না। বরং আন্দালিবের শিক্ষা হয়েছে ভেবে একটা মানসিক শান্তি পাচ্ছিল ও। নিজের কাছের মানুষগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে আন্দালিবকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করবে না ও। চলার পথে যেসব আগাছা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের গোড়াসহ উপড়ে ফেলাই ভালো।

জীবনে চলার পথে খুব পরিচিত মানুষ হঠাৎ করে অপরিচিত হয়ে ওঠে আবার অনেকসময় অপরিচিত কেউ হয়ে ওঠে আপনের চেয়েও আপন। আন্দালিবের কথাই ধরা যাক না। সারজিমের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল সে। আফরোজা বেগম, সাব্বির তারা একেবারে ঘরের লোকের মতো মনে করত আন্দালিবকে। সারজিম চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করত ওকে। অথচ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে সেই আন্দালিবই কিনা সারজিমকে একেবারে প্রাণে মেরে ফেলতে চাইল। চেনা মানুষের অচেনা রূপ প্রকাশিত হলো সবার সামনে। আবার পাঁচটা কলেজপড়ুয়া ছেলে, যাদের ওরা চেনে না জানে না, তারাই বিপদের দিনে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে এগিয়ে এলো সারজিমের জন্য। এমনকি সারজিমকে নিয়ে আসার পরেও মাঝেমধ্যেই ছেলেগুলো কল করত সারজিমের খোঁজ নিতে।

সারজিম সুস্থ হয়ে ওদের সবাইকে ইনভাইট করেছিল বরিশালে বেড়াতে আসার জন্য। ওরা সত্যিই এসেছিল। নৈশী দেখেছিল তখন ওদের। বড্ড পরোপকারী ছেলেগুলো। ওদের সব বন্ধুদের মধ্যে বন্ডিংটাও ছিল চোখে পড়ার মতো। নৈশী ওদের বন্ধুত্ব দেখে প্রার্থনা করেছিল মনে মনে, এদের মধ্যে কেউ যেন বড় হয়ে আন্দালিবের মতো স্বার্থান্বেষী বন্ধু না হয়।

ব্যলকনিতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অতীতের কথা মনে করছিল নৈশী। পেছন থেকে সারজিম ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, “রুমে ফিরে কয়েকবার করে ডাকলাম। কোনো সারা নেই। আপন খেয়ালে ডুবে আছেন দেখছি। কী এত ভাবছেন ম্যাডাম?”

নৈশী ওর প্রশ্নের জবাব দিল না। তার বদলে চায়ের কাপটা পাশে রেখে হেসে উঠে দাঁড়াল। প্রিয় পুরুষের শরীরের উষ্ণতায় প্রিয় কবিতার দুলাইন বলল,

“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার,

জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার…।”

(সমাপ্ত)

🔴নোট-
“কাননে ফুটিল ফুল” এই পর্যন্তই ছিল। আমার লেখা যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে বইটই থেকে পড়ে নিতে পারেন আমার ই-বই, ❝বিষাদবেলা ফুরায়ে যায়❞। বইটি পেয়ে যাবেন এখানে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here