কামরা নাম্বার তিন ছয় নয় (দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব)

0
1611

গল্প : কামরা নাম্বার তিন ছয় নয় (দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব)

নিথর জনশূন্য মাঠের উপর দিয়ে একঝাঁক পাখি উড়ে গেল ছটফটিয়ে। ডানা ঝাপটানোর শব্দে কিছুক্ষণের জন্য চারপাশ গমগম করে উঠেছিল। পাখিগুলো আঁধারে মিলিয়ে যাবার পরেই আবার নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে আশপাশের পরিবেশ। ডান দিকে প্রায় বিশ হাত দূরে মাঝারি আকারের পুকুর। সেখানে জল আছে অনেক। আধা চাঁদের মলিন আলো পড়ে সেই জল চকচক করছে। নড়ছে না। এই দু’সেকেন্ড আগে জলের উপর একটি পাতা পড়ল; সেই শব্দ আমার কানে এসেছে। টুপ!

ফের নিঃস্তব্ধতা। পুকুরের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাম না জানা প্রায় পঁচিশ ফুট উঁচু গাছটা মাথা উঁচু করে প্রকৃতি পাহারা দিচ্ছে। দূরে কোথায় কে যেন সেতারে সুর তুলেছে। রাফায়েত এখনও ছুটছে। প্রায় তিন মিনিট ধরে একই গতিতে ছুটে চলেছে সে। কিন্তু তিন মিনিটে একটুও এগোতে পারেনি। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাপাদাপি করছে। চেষ্টা করছে এগিয়ে আসার কিন্তু পারছে না।

আস্তে করে পাশে বসে যিনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন, তাঁকে আমি চিনি। সেই বয়স্ক লোকটা। অবশ্য এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার চেহারা এবং পোশাক-আশাকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন তার পরনে সাধারণ শার্ট-প্যান্ট। মাথায় একটি চুলও নেই। মুখে দাড়ি-গোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। চামড়া কুঁচকে গেলেও চেহারায় ক্লান্তি নেই। মুখটা গম্ভীর এবং বাঁকানো। তিনিই আমাকে দু’বার সাবধান করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমি যেন এখান থেকে চলে যাই। তখন তাঁকে পাগল মনে হলেও এখন তার প্রতি ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর তাঁকে পাগল মনে হচ্ছে না। কিন্তু তিনি যে ভরসার মানুষ, সেটাও ভাবতে পারছি না।

তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “চলো খোকা, তোমাকে সেই বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাই।”

“কোথায়?” তোতাপাখির মতো প্রশ্ন করলাম আমি।

“যেখানে যাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলে। সেই রহস্যময় কক্ষ, তিন ছয় নয়। যেখানে গেলে কেউ আর জীবিত অবস্থায় ফিরে আসে না।”

তিনি আমার কাঁধে হাত রাখার পরেই শরীরটা কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছিল। তখন পাত্তা দেইনি৷ এখন টের পাচ্ছি, এই লোক আমার দেহ এবং মস্তিষ্ক দু’টোকেই বশ করে ফেলেছে। হতে পারে এই লোকটাই কালপ্রিট! তার সাথে যাওয়া মানেই তো বিপদ! কিন্তু আমি আর আমার মাঝে নেই। আমার দেহ-মন কোনোটাই আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই৷ সুতরাং লোকটার দেখানো পথেই শান্ত ছেলের মতো মাথা নিচু করে এগিয়ে চললাম।

পথে কয়েকটা কথা বলল লোকটা। কথাগুলো এরকম, “রাফায়েত এখনও ছুটে আসার চেষ্টা করছে! হা হা হা! কেন যে শুধু শুধু এত পরিশ্রম করে ছেলেটা! তার ভালো করেই জানা, শত চেষ্টা করলেও সে কাউকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। তবুও কেন যে প্রতিবার এই ব্যর্থ চেষ্টা চালায়!

কোয়ার্টারে পৌঁছে তিনশো উনসত্তর নাম্বার রুমের সামনে দাঁড়াতেই দরজাটা আস্তে করে খুলে গেল। অথচ ভেতরে কেউ নেই। মানুষ তো দূরে থাক, একটি বেড়ালছানাও নেই। আমি অবচেতনে ঘরের ভেতরে পা রাখলাম। অতঃপর দরজাটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরে আলো নেই। সব বাতি নেভানো। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে থেকে আবছা সাদাটে আলোর মতোন পড়েছে। গভীর কালোয় লোকটাকে বিছানায় বসতে দেখা গেল। সেই বয়স্ক লোকটা। ভীষণ বিরক্তিতে ঝাঁজালো গলায় বলে উঠল, “ত্রিশটি তাজা প্রাণ নিয়েছি আমি। প্রতি মাসে একটি শক্ত মানুষ। ত্রিশ মাসে ত্রিশটি। সবাইকে আমি বশ করতে পেরেছিলাম। সবকয়টা আমার কথামতো উঠাবসা করেছে। কিন্তু, কিন্তু আমি কখনোই ওদেরকে মারতাম না। মেরেছি বাধ্য হয়ে। কারণ ওরা আমার কথা শুনেনি। আমার বশে থেকেও আমাকে খোদা মানেনি। আমার মুনিব, আমার খোদা ইবলিসকে ওরা খোদা মানেনি। এর কারণ ওই রাফায়েত। ওই রাফায়েত দিনের আলোয় কী পড়িয়ে দেয় বুঝি না। সবাই প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়ে যায় তবুও নিজের ইমান নষ্ট করতে চায় না। আমাকে, আমার মালিক ইবলিসকে খোদা মানতে চায় না। তাই সবার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তোকেও আমি বশ করেছি। তোর শরীর, মস্তিষ্ক দু’টোই আমার নিয়ন্ত্রণে। তবুও আমি জানি তুই আমাকে খোদা মানবি না। তোদের ইমানী শক্তির কাছে আমি পরাজিত হতে হতে জেনে গিয়েছি। এই ইমানী শক্তির কাছে আমার এসব জলভাত। সুতরাং মরার জন্য প্রস্তুত হ।”

চট করে উঠে দাঁড়িয়ে আমার মুখের সামনে এসে নিচু গলায় বলতে লাগল, “দুঃখ করো না খোকা। শুধু তুমি নও, এরকম বহু মানুষ আমার হাতে মরেছে। তোমার পরে আরো অনেক মরবে। যতদিন পর্যন্ত তোমাদের ইমানী শক্তি পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ততদিন আমাদের এই কর্মকান্ড চলবে। আমি আমার কাজ ঠিকমতো করে যাব। আজ তুমি মরবে। এর ঠিক একমাস পর আরো একজন। তারপর আরো একজন। মানুষেরা আসতেই থাকবে। তোমাদের এই কোয়ার্টারের মালিক, যার প্রতিষ্ঠানে তোমরা চাকরি করো, ওই লোকটা এ-ঘরে দ্বিতীয় খুন হওয়ার পর ঘরটা নিষিদ্ধ করে দেয়। তারপর আমি কী করেছি জানো খোকা? ওই লোকের দু’টো মেয়ে ছিল। বড়ো মেয়েটা সদ্য সতেরো বছরে পা রেখেছিল তখন। একদিন সেই মেয়েটা রক্তবমি করে মরে গেল। কাজটা আমিই করেছিলাম৷ সাথে কিছু চিহ্ন দিয়ে আসি। যাতে করে ওই ভদ্রলোক দ্বিতীয় মেয়ে হারানোর ভয়ে এই ঘর খোলা রাখে এবং প্রতি মাসে লোক পাঠায়। এবং তা-ই হচ্ছে। প্রতি মাসে নতুন নতুন লোক পাচ্ছি আর…”

থেমে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “বলো, ইবলিস আমার খোদা।”

আমি ছিলাম লোকটার বশে। এখনও আছি। তবুও তার কথামতো বলতে গিয়ে আমার মুখ দিয়ে অন্য কথা বেরিয়ে এল। মুখ ফসকে বলে ফেললাম, “আল্লাহ্ আমার খোদা।”

“এত বড়ো সাহস!” বলেই এক হাতের আঘাতে আমাকে উড়িয়ে ফেলে দিলো। বোধহয় কোনো এক টেবিলের উপর পড়েছি। টেবিলে বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখা। আমার কাঁধে ব্যাগ ছিল, হঠাৎ উড়ে পড়ায় ব্যাগের একটি হাতল ছিঁড়ে গেছে। ব্যাগের কথা ভাবতেই আমি একটু বিস্মিত হয়ে পড়লাম। সকালে গ্রাম থেকে আসার সময় মা ব্যাগে করে কোরআন শরিফ দিয়েছিলেন না!

তখনও লোকটার মায়া কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তাও ব্যাগের চেন খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিতেই কোরআন শরিফের স্পর্শ পেলাম। সেটি ব্যাগ থেকে বের করতে করতে বলতে শুরু করলাম, “আয়ুযুবিল্লা হিমিনাশ…”

যতই পড়ছিলাম লোকটা ততই চিৎকার করছিল। এত চিৎকার যেন আমার কানের পরদা ফেটে যাবে। মনে হচ্ছিল লোকটার চিৎকারে বিল্ডিংয়ের দেয়ালের সব ইট খসে পড়বে। মাথার উপরের ছাদ ভেঙে পড়ে যাবে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ঝড় উঠবে।

সত্যি সত্যি ঝড় উঠে গেল। খোলা জানালাটা ঠাস ঠাস করে বারি খেতে লাগল। আমি আরো জোরে কোরআন পড়তে লাগলাম। আরো জোরে। যতই পড়ছি লোকটার চিৎকার বাড়ছে। আরো বাড়ছে। সেইসাথে মানুষের রূপ মুছে গিয়ে তার আসল শয়তানি চেহারা ভেসে আসছে। বোঁচা নাক, জলপাই পাতার মতো কান, কুকুরের মতো দাঁত আর বেড়ালের মতো দু’টো চোখ। গায়ের চামড়া পাটের বস্তার মতো। মাথায় একেবারে চুল নেই। লিকলিকে কালো প্রায় ছয় ইঞ্চি সমান জিহ্বা বেয়ে লালা ঝড়ছে। থরথর করে গা কাঁপছে তার। সে হাঁটু হেঁড়ে বসে পড়েছে। চিৎকার দিতে দিতে আগুন ধরে যাচ্ছে তার গায়ে।

একসময় পুড়ে ছাই হয়ে গেল লোকটা। সেই ছাই থেকে আবার তার দেহ গড়ে উঠছিল দেখে ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই, পরক্ষনেই দেখি খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির জল এসে ছাইটুকু একসঙ্গে মিশে নতুন রূপ নেওয়ার আগেই সেটাকে ধুয়ে নিয়ে গেছে। আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল। মাথাটা ঝিম ধরে আসছিল ক্রমশ। তাই কোরআন শরিফ আস্তে করে টেবিলের উপর রেখে দেই। তার ঠিক পরেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ি।

পরদিন চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে গ্রামের পথে রওনা দেই। তবে ফিরবার আগে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিককে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেই। যে নিজের একটি মেয়েকে বাঁচানোর জন্য তরতাজা ত্রিশটি প্রাণ বিসর্জন দিতে একবার ভাবে না, তার ঠাঁই একমাত্র জেলখানায় হওয়া উচিৎ।

ফেরার পথে শুনেছি রাফায়েত নাকি জিন। ভালো জিন। সবাই নাম শুনেছে। দেখেনি কেউই। অথচ আমার কী সৌভাগ্য! একদিনে দু’বার দেখেছি তাকে। যাক, সেসব ভেবে কাজ নেই। শহরে আসার সময় কিছু টাকা সঙ্গে এনেছিলাম। এখন কি টাকাগুলো নিয়ে আবার গ্রামে ফিরব? এরচে’ বাবার জন্য লুঙ্গি আর মায়ের জন্য একটি শাড়ি কিনে বাসে উঠেছি। প্রচন্ড গরম লাগছে। অস্বস্তি হচ্ছে। জানি, সব টাকা দিয়ে শাড়ি-লুঙ্গি কিনে নিয়েছি বলে বাবা-মা ইচ্ছেমতো বকবে৷ তা করুক। মাথা নিচু করে শুনে নেব। কিন্তু চাকরিটা যে পেয়েও ছেড়ে দিলাম। সেটা কেন ছাড়ালাম? ওসব বোঝাব কীভাবে? তাঁরা কি বিশ্বাস করবে যে তাঁদের ছেলে একটা খারাপ জিনকে শাস্তি দিয়ে ফিরে এসেছে?

সমাপ্ত

লেখক : মো. ইয়াছিন

[“তিন ছয় নয়”-এর মানেটা কিন্তু জানা হলো না। যদিও এর অর্থ বলার ইচ্ছে আমার ছিল। কিন্তু পরে আর বলা হয়নি। সাধারণত এরকম গল্পে ছোটোখাটো কিছু রহস্য থেকেই যায়৷ অন্য লেখকদের বেলায় সেটা কতটুকু তা তো জানি না। তবে আমি এরকমটা প্রায়ই করি। আশা করি এইটুকু পাঠকরা মেনে নেবেন। সবার জন্য শুভকামনা।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here