কামরা নাম্বার তিন ছয় নয় (প্রথম পর্ব)

0
1949

গল্প : কামরা নাম্বার তিন ছয় নয় (প্রথম পর্ব)
লেখক : মো. ইয়াছিন

কামরা নাম্বার তিনশো উনসত্তর শুনেই গলায় কাঁপন ধরে গেল সুপারভাইজার আসলামের। তারপর কেন সে আমাকে রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে সাবধান করে দিলো সেই অতি ভয়ঙ্কর রহস্য তখনও আঁচ করতে পারিনি আমি। চাবি এগিয়ে দিতে গিয়ে হাতটা থরথর করে কাঁপছিল তার। একহাতে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে আঙুলের ইশারায় তিনতলার একদম শেষ মাথার ঘরটা দেখিয়ে দিলো সে।

রহস্য এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু না।
আমি যখন চাবি হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলাম তখন এক বয়স্ক লোক কোত্থেকে যেন এসে আমার হাত ধরে ফেললেন। গলাটা নামিয়ে আস্তে করে বললেন, “ফিরে যাও ছোকরা। ভালো চাও তো ফিরে যাও। আঁধার নামার আগে পালিয়ে যাও এখান থেকে।”

ফিরে যাব! চাকরি হওয়ার পর আজই প্রথম স্টাফ কোয়ার্টারে এসেছি। আর আজকেই ফিরে যাব!

কথা এড়িয়ে যাচ্ছি দেখে তিনি বললেন, “কামরা নাম্বার তিন ছয় নয়। এই তিন সংখ্যার মানে জানো তুমি?” বলে ফিকফিক করে বিকৃত হাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি। ফের শান্ত গলায় বললেন, “জানো না? কোনোদিন জানতেও পারবে না। আমি আবারও বলছি, চলে যাও এখান থেকে। না হলে আজ রাতেই…” খিকখিক করে হাসতে হাসতে চলে গেলেন ভদ্রলোক। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এই বুড়ো লোকটার কথা আমি স্টাফ কোয়ার্টারের যতজনকে বললাম, সবাই কোনো এক অদ্ভুত কারণে আঁতকে উঠে আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। এমনকি কোয়ার্টারের সুপারভাইজার আসলামকে বলার পর সে-ও কাঁপা হাতে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বলল, “ওসব কিছু না। কেউ হয়তো আপনার সাথে মজা করেছে।”

কিন্তু তার কথায় যে ভয় ছিল, সেটা তার চোখ-মুখ আর কথা বলার ভঙ্গি দেখেই আঁচ করতে পেরেছিলাম। সে নিশ্চয়ই আমার থেকে কিছু একটা আড়াল করছে। কিন্তু ঠিক কী আড়াল করছে? কেনই বা এতটা ঘাবড়ে আছে ওরা? কী এমন আছে ওই তিনশো উনসত্তর নাম্বার ঘরে?

তিনতলার চওড়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ লোকটাকে আবারো দেখতে পেলাম। বিকেলের মিষ্টি রোদে খালি পায়ে ঘাসের উপর পায়চারি করছেন তিনি। মাথাটা আকাশের দিকে তাক করে সূর্যের দিকে চেয়ে কী যেন বিড়বিড় করছেন আর আঙুল নাড়াচ্ছেন।

কী অদ্ভুত! এ কেমন জায়গায় এসে পড়লাম রে বাবা!
শ্বাস ফেলে এক পলকের জন্য চোখ বুজে ফের নিচে তাকিয়েছি অমনি দেখি লোকটা আগের জায়গায় নেই। এই একটু সময়ের ব্যবধানে নিচ থেকে তিনতলায় উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তাঁর গায়ে জড়ানো ভারী শাল, সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, গায়ে আতর কিম্বা গোলাপজলের গন্ধ। এবার মুষ্টিবদ্ধ একটি হাত মুখের সামনে ধরে গলা খাঁকরি দিয়ে কঠিন গলায় বললেন, “ফিরে যাবে না খোকা? মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বাবা ভাবছেন ছেলে আমার শহরে চাকরি পেয়েছে। এবার আমাদের দিন ফিরবে। কেবল আমিই জানি আজ রাতে…”

“আজ রাতে? আজ রাতে কী?” হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন তিনি। যার ফলে আতঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করেও জবাব পাইনি। আসরের আজান শোনা যাচ্ছে। আজ ছুটির দিন। তাই স্টাফ কোয়ার্টারে লোকজন গমগম করছে। তবে তিনতলার এই চওড়া বারান্দায় আমি ছাড়া কেউ নেই। আজানের খানিক পর একজন সাদা টুপি মাথায় দিয়ে দরজা খুলে বেরোলেন। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, “কামরা নাম্বার তিন ছয় নয়?”

“জি।”

“আয়াতুল কুরসি পারেন?”

“পারি।”

“নামাজ পড়েন তো?”

“পড়ি। ইয়েব, কখনো সখনো মিস হয়ে গেলে কাজা পড়ে নেই।”

সাদা পাজামা আর ফুলহাতা গেঞ্জি পরিহিত লম্বা দাড়িওয়ালা ফরসা লোকটি অমায়িক হেসে দু’পা এগিয়ে এলেন। বললেন, “সব সময় জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করার চেষ্টা করবেন। এতে ইমান ঠিক থাকবে। আর সদা সর্বদা জিকির করবেন। এতে মালিক আপনার প্রতি খুশি থাকবেন। চলুন, নামাজে যাই।”

এখনও কোয়ার্টারের রুমে ঢুকিনি। ফলে সব জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে হাঁটছি। দু’টো গাঁটরি কাঁধে করে মসজিদের পথে এগোতে এগোতে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা, এই তিনশো উনসত্তর নাম্বার রুমের ঘটনাটা কী? সবাই এমন কাহিনী করছে কেন?”

ভদ্রলোক আমার কাঁধ থেকে একটি ব্যাগ টেনে নিয়ে মাথায় করে এগিয়ে চলতে চলতে বিড়বিড় করে বললেন, “কামরা নাম্বার তিন ছয় নয়।” তার ঠিক পরেই তাঁর চোখে-মুখে আবছা ছায়া নেমে এল। এরপর তিনি আর কোনো কথা বললেন না। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। দৃষ্টি নিচু করে ঢোক গিলে বললেন, “আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে গেলেই ভালো হবে।”

সবাই চলে যাওয়ার পরও মসজিদের সামনে ছোটো দেয়ালের উপর বসে আছি। মসজিদের মুয়াজ্জিন পরিচয় দিয়ে একজন খুব কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এতক্ষণ একা এক কী বিড়বিড় করছিলেন আপনি?”

উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, “একা কোথায়? ওই সাদা গেঞ্জি পরা ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম।”

তিনিও আমার মতো করে কোমর সমান দেয়ালের উপর বসলেন। মিয়নো গলায় প্রশ্ন করলেন, “কোয়ার্টারে নতুন?”

“জি।”

“জানি না কী করতে এসেছেন। দোয়া করি যেন সহিহ-সালামতে ফিরে যেতে পারেন।” তিনি উঠে যাচ্ছিলেন। তখন চট করে তাঁর হাত ধরে বলি, “এমন কথা কেন বললেন?”

আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জানালেন তিনি, “একটু আগে আপনি যার সাথে কথা বলছিলেন, সে মানুষ নয়। মানুষ হলে আমিও তাকে দেখতে পারতাম। কিন্তু আমি কাউকে দেখিনি। শুধু দেখেছি আপনি একা একা কথা বলছেন। আমার অনুমান সত্যি হলে আপনি যার সাথে কথা বলেছেন, সে রাফায়েত। চিন্তার বিষয় হলো, খুব খারাপ কিছু না ঘটলে রাফায়েত কারোর সামনে আসে না। নিশ্চয়ই আজ কারোর সর্বনাশ হবে। আপনি আজকের রাতটা সাবধানে থাকবেন। খোদা হাফেজ।”

এশার নামাজের পর প্রায় আধা ঘন্টা ধরে বাইরে বসে আছি। কোয়ার্টারের ওই অদ্ভুতুড়ে ঘরে উঠার কোন ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু এই কোয়ার্টার ছেড়ে কোথাও যেতেও পারব না। এই শহরের কাউকে আমি চিনি না। আজই শহরে এসেছি। আবার আজকেই ফিরে গেলে মা-বাবা কষ্ট পাবেন। উনারা অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছেন। এটা আমার প্রথম চাকরি। প্রথমটাতেই গন্ডগোল করলে…

না না, ফিরে যাওয়া যাবে না।
দেয়ালে বসে পা দোলাচ্ছিলাম এমন সময় আমার কানের পাশ দিয়ে কে যেন হাওয়ার বেগে ছুটে গেল। তার পরেই দেখি অনেক দূর থেকে কে যেন দৌড়ে আসছে। তার পরনের সাদা পাজামা আর লম্বা হাতলওয়ালা গেঞ্জিটা চাঁদের মতো আলো ছড়াচ্ছে। এই লোকটাকে আমি আগেও দেখেছি। আজ বিকেলে যে আমাকে মসজিদে নিয়ে এল। মুয়াজ্জিন বলেছেন এই লোকটার নাম নাকি রাফায়েত। আবার বলেছেন, রাফায়েত বিপদ না দেখলে আসে না। অথচ সে আসছে। খুব দ্রুত দৌড়ে আসছে সে। কিন্তু কেন? এত তাড়া কেন তার? কে এখন বিপদে পড়তে চলেছে? কে?

চলবে

[এই গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here