#কালো জাদু (শেষাংশ: ২য় পর্ব )
তিথির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে বুঝতে পারছে না এসব কি হচ্ছে। খানিক বাদেই হাসিবুরের নাম্বার থেকে কল এলো। তারমানে সে এখনও হসপিটালে। তাহলে বিছানার এই হাসিবুর কে? তিথি ভয়ে ভয়ে বিছানার দিকে তাকায়। হাসিবুর ওর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। তিথির ভয় লাগে৷ ভীষণ ভয়। এক পা দুই পা করে পিছু যেতে যেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে। তারপর একটা চিৎকার। অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়৷ সবাই দৌড়ে আসে ওদিকে। এসে দেখে তিথি মেঝেতে পড়ে আছে।
.
জ্ঞান ফেরার পর তিথি কারো সাথে কোনো কথা বলে না। কালো একটা পুতুল হাতে বিছানার মাঝখানে থমথমে মুখে আসন পেতে বসে আছে৷ তিথির বাবা-মা বারংবার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন, ‘মা কি হয়েছে বল না। এমন করছিস কেন?’
.
এতক্ষণে হসপিটাল থেকে হাসিবুর এবং আজমল সাহেব ফেরে এসেছন। সবাই তিথির রুমে। তিথি হঠাৎ বলে উঠলো, ‘তোমরা এখান থেকে চলে যাও আমি একা থাকবো।’
তিথির মামা মতিন সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা মা, হাসিবুরকে রেখে আমরা..
কথা শেষ করার আগেই তিথির বলল, ‘না।’
‘তাহলে তোমার মায়ের সাথে থাকো।’
‘না।’
তিথিরকে একা রেখেই সবাই অন্য রুমে গিয়ে বসলেন। সবাই নীরব। কারো মুখে কোনো কথা নেই। মতিন সাহেব নীরবতা ভেঙে গম্ভীরমুখে বললেন, ‘আমার মনে হয় কবিরাজ দেখানো দরকার।’
তিথিরের বাবা মোজাম্মেল হোসেন এসব তাবিজ-কবিরাজ বিশ্বাস করেন না। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কবিরাজ দেখানোর কিছু নেই মতিন৷ ভয় পেয়ে মেয়েটা এমন করছে।
– ‘কবিরাজ এলে তো কোনো ক্ষতি নেই। অকারণ তো আর মেয়েটা ভয় পায়নি। আমার চেনাজানা একজন ভালো কবিরাজ আছে উনাকে কাল আসতে বলবো।’
.
পরেরদিন বিকেলে দু’জন লোক এসেছে। কবিরাজ এবং তার সহকারী। লোকটির মুখে দাড়ি। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। কোরআনে হাফিজ। তিথির বড় মামাদের এলাকায় বেশ নামডাক। নাম রাফসান উদ্দিন। লোকে রাফসান মোল্লা ডাকে৷ এক সময় একটা মাদ্রাসায় হাফিজি পড়াতেন। এলাকার লোক নানান সমস্যা নিয়ে আসতো। প্রায়ই অনেকের বাড়িতে যাবার ডাক আসে। তিনি গিয়ে আহামরি কিছু করতেন না, কোরআনের যে আয়াত ইচ্ছে সেটা পড়ে ফুঁ দিয়ে চলে আসতেন। কিভাবে যেন কাজ হয়ে যায় নিজেও বুঝতে পারেন না। অথচ এসব আয়াত পড়ে সবাই ফুঁ দেয় কাজ হয় না। এক সময় রাফসান উদ্দিন বুঝতে পারেন উনার ভেতরে আধ্যাত্মিক একটা ক্ষমতা আছে৷ হঠাৎ হাফিজি পড়ানো বাদ দিয়ে নানান ধরনের বইপত্র পড়ার পাশাপাশি কবিরাজি শুরু করে দেন। কাজও হয় মানুষের। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সুনাম। উনার সঙ্গের সহকারী ছেলেটির নাম সাহেল রহমান৷ ভীষণ সাহসী ছেলে৷ এতদিনে রাফসান উদ্দিনের অবিজ্ঞতার থলি ভরপুর৷ অল্পতেই সবকিছু বুঝে ফেলতে পারেন৷ এসব বিষয়ে প্রচুর পড়ালেখাও করেছেন।
‘হুজুর চা নেন।’ মতিন সাহেব চা নিয়ে এসেছেন।
রাফসান উদ্দিন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘সবকিছু আমার জানা দরকার। পুরো ঘটনা আপনি জানলে বলা শুরু করেন।’
মতিন সাহেব বলতে শুরু করেন,
‘আমার ভাগ্নীর বিয়ে হয়েছে ওর চাচাতো ভাইয়ের সাথে। গতকাল ওদের বাসর রাত ছিল। কিন্তু ছেলেটা হঠাৎ রক্তবমি করায় তাকে হসপিটাল নেয়া হয়। রাত বারোটার সময় হাসিবুর ফিরে আসে তিথির কাছে। খানিক বাদেই আবার হসপিটাল থেকে হাসিবুর আর আজমল সাহেব কল করেন। মেয়েটা ভয় পেয়ে যায়৷ হাসিবুর হসপিটালে থাকলে এই ছেলেটা কে?’
রাফসান উদ্দিন খুবই শান্ত। যেন এগুলো খুব একটা জটিল বিষয় না। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
– ‘যে ছেলেটার রক্তবমি হয়েছে তাকে ডাক্তার দেখে কি বললো?’
– ‘কোনো রোগ নেই৷ সবই ঠিক আছে৷’
– ‘আর মেয়েটার অবস্থা এখন কেমন?’
– ‘সে খুব কম কথা বলছে৷ সকালে খানিকটা ভালোই ছিল। কথা বলেছে। কিন্তু রাতে কারও সাথে ঘুমোতে চায়নি।’
– ‘স্বামীর সাথেও না?’
‘না…।’
থেমে গেলেন মতিন সাহেব। ভেতর ঘরে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। তিনি কিছু না বলেই দ্রুত সেদিকে ছুটে গেলেন। হাসিবুর রক্তবমি করছে৷ বমি করতে করতে মাটিতে নেতিয়ে পড়ে যাচ্ছে। মতিন সাহেব তাড়াতাড়ি এসে রাফসান উদ্দিনকে জানান। তিনি সহকারী কে নিয়ে হাসিবুরকে দেখতে যান। হাসিবুর মাটিতে পড়েও বমি করছে৷ শরীরের সমস্ত র*ক্ত যেন বের হয়ে যেতে চাচ্ছে। রাফসান উদ্দিন হাসিবুরের অবস্থা দেখে খুব ব্যস্ত হয়ে বললেন,
– ‘তাড়াতাড়ি একটা গ্লাসে করে পানি আনেন কেউ।’
তারপর আপন মনে কিছু একটা পড়তে শুরু করলেন। গ্লাস আনা হলো। তিনি ফুঁ দিয়ে পানি ছিঁটে দিলেন হাসিবুরের গায়ে। খানিক বাদেই বমি বন্ধ হয়ে হাসিবুর অজ্ঞান হয়ে গেল। রাফসান উদ্দিন ঘেমে গেছেন। উনাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। সিটিং রুমে মতিন সাহেবকে ডেকে নিলেন। তারপর খানিক শান্ত থেকে বললেন,
– ‘ছেলেটার কোনো রোগ ধরা পড়েনি না?’
– ‘না।’
রাফসান উদ্দিন পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাল রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছে বললেন,
– ‘ছেলেটাকে কেউ মেরে ফেলতে চাচ্ছে৷ আমার ধারণা জা*দু করা হয়েছে। ওর বাবাকে ডেকে আনেন।’
আজমল সাহেবকে আনা হলো। দেখে মনে হচ্ছে খুব ভেঙে পড়েছেন।
রাফসান উদ্দিন বললেন, ‘আমার ধারণা ছেলেটিকে জাদু করে মা*রার চেষ্টা চলছে। আপনাদের কি সেরকম কোনো শ*ত্রু আছে?’
তিনি ভয়ার্ত গলায় বললেন
– ‘না হুজুর।’
– ‘আপনার ছেলের আছে?’
– ‘এই মা হারা ছেলের সাথে কে এমন করবে হুজুর।’
– ‘যার সাথে বিয়ে হয়েছে সেই মেয়েটিকে দেখতে চাই।’
রাফসান উদ্দিনকে তিথির সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। সে একা একা বসে আছে৷ আগের থেকে অনেক স্বাভাবিক। রাফসান উদ্দিন রুমে গিয়ে বললেন,
– ‘কেমন আছেন?’
তিথি কোনো জবাব না দিয়ে হাতের পুতুলের দিকে তাকিয়ে আছে।
– ‘আপনার স্বামী একটু আগে র*ক্তবমি করেছে জানেন?’
তিথি নীচের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘আমার কোনো স্বামী নাই।’
– ‘আপনার তো কাল বিয়ে হলো।’
তিথি কোনো জবাব দিলো না৷ রাফসান উদ্দিন ব্যাগ থেকে একটা তাবিজ বের করে মতিন সাহেবকে বললেন তিথির হাতে বেঁধে দিতে। তিনি তাবিজ নিয়ে যেতেই তিথি বড় বড় চোখে তাকাল। সে তাবিজ হাতে দিবে না। মোজাম্মেল সাহেব গিয়ে মেয়ের দুই হাত শক্ত করে ধরে রাখলেন। তাবিজ তাড়াতাড়ি বেঁধে দিলেন মতিন সাহেব। রাফসান উদ্দিন উঠে যাচ্ছিলেন হঠাৎ চোখ পড়েছে পুতুলের দিকে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘এই পুতুল কোত্থেকে এনেছেন?’
মোজাম্মেল হোসেন বললেন,
– ‘জানি না। কাল থেকে দেখছি হাতে।’
রাফসান উদ্দিনের মাথায় খটকা লাগে। তিথিকে বললেন, ‘আপনার পুতুল তো অনেক সুন্দর। একটু দেখি?’
তিথি মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করে। তিথির হাত থেকে টান মেরে পুতুলটা নিয়ে আসলেন। তিথি ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে শুরু করে। পুতুলটার মুখে হাসি লেগে আছে। রাফসান উদ্দিন পুতুলটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন। মাথার একপাশে লম্বা চুল আরেকপাশে খাটো। পুতুলটা সুবিধার মনে হচ না৷ তিনি ব্যাগ থেকে একটা লাইট বের করে জ্বেলে পুরো পুতুল পুনরায় ভালো করে দেখতে লাগলেন। পুতুলের পরনে লাল একটা প্যান্ট। তিনি টেনে প্যান্টটা খুলে ফেললেন। পুতুলকে উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলেন কিছু লেখা আছে কি-না। কিছুই নেই। পুতুলের দুই পা মেলে লাইট মারলেন। হঠাৎ চোখে পড়ে দু’টা চিহ্ন। পুরুষ এবং নারী লিঙ পাশাপাশি আঁকা। তিনি অস্ফুটে বললেন,
– ‘মাই গড।’
এটা তো জাদুর পুতুল। স্বামী-স্ত্রীর দূরত্বের জন্য এই পুতুল ব্যবহার করা হয়েছে। পুতুলের মাথায় চুলও একপাশে লম্বা যার মানে স্ত্রীর চুল। আরেক পাশে খাটো মানে পুরুষের চুল৷ মনে হচ্ছে মেয়েটাকে এখনও পুরোপুরি জাদু করতে পারেনি। কারণ সে পুতুলের জন্য খুব বেশি অস্থির হচ্ছে না। তাবিজও সহজে পরানো গেছে। যারা জাদু করেছে তারা এই মেয়ের তেমন ক্ষতি করতে চাচ্ছে না। ভয় হচ্ছে ছেলেটাকে নিয়ে৷ তাকে মে*রে ফেলতে চাচ্ছে৷ এখন এই পুতুলকে জ্বালিয়ে ফেললে মেয়েটা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে৷ সে তখন স্বামীকে কাছে চাইবে৷ তখন শ*ত্রুরা আরও কঠিন জাদুর পথ খুঁজবে। অবশ্য সবাই সতর্ক থাকলে তারা ব্যর্থ হবে৷ পুতুল জ্বা*লানোর আগে আমি ছেলেটির সাথে কথা বলা দরকার। তিনি সবাইকে আসতে নিষেধ করে হাসিবুরের কাছে গেলেন।
সে বিছানায় শুয়ে আছে। খানিকটা দূর্বল দেখাচ্ছে তাকে। রাফসান উদ্দিন আর হাসিবুর রুমে একা।
– ‘পুতুলটা জ্বালিয়ে দিলে আপনার স্ত্রী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। আপনাকে কাছে চাইবে। মিলন হবে৷ তখন দয়া করে কোনো প্রকার প্রটেকশন ব্যবহার করবেন না।’
হাসিবুর চমকে উঠে বলল,
– ‘মানে?’
রাফসান উদ্দিন মুচকি হেঁসে বললেন,
– ‘উত্তেজিত হবেন না, ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝিয়ে বলি। আমার ধারণা আপনাদেরকে জাদু-টোনা করা হচ্ছে। এসব ব্যাপারে রোগীর আশেপাশের কেউ জড়িত থাকে। আপনাকে যে জাদুটা করা হয়েছে সেখানে আপনার কমপক্ষে একটা কাপড় প্রয়োজন। তারা সেটা পেল কীভাবে? আর এই জাদুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পুরুষের বী*র্য আর নারীর মা*সিকের র*ক্তাক্ত কাপড়। কারণ শ*য়তান জি*নেরা না*পাক জিনিস বেশি পছন্দ করে।’
– ‘কিন্তু আমাদের সাথে কারা এমন করবে?’
– ‘আমার ধারণা আপনাদের বিয়ে কেন্দ্র করে এসব হতে পারে। আপনার বাবার কাছ থেকে আমি বিস্তারিত জেনে নেব। আপনি এখন রেস্ট নিন।’
.
আজমল আর রাফসান উদ্দিন সিটিং রুমে বসে আছেন।
তিথি আর হাসিবুরের বিয়ের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চান রাফসান।
– ‘ওদের বিয়ের ব্যাপারে আপনি একটু সংক্ষেপে বিস্তারিত বলুন আমাকে।’
– ‘বিয়ের ব্যাপারে বলার মতো কিছু নেই। আমার ভাতিজি ইংল্যান্ড ছিলো। তিথি হচ্ছে আমার বড় ভাই মোজাম্মেলের মেয়ে। আমার আরেক ভাই মোসাদ্দেক। দীর্ঘদিন আগে থেকে মোজাম্মেল আর মোসাদ্দেকের মধ্য কথাবার্তা ঠিক ছিলো তিথির সাথে সাহেদের বিয়ে হবে। সাহেদ হচ্ছে মোসাদ্দেকের ছেলে। শুধু তিথি ছাড়া বাকি সবাই জানতো সাহেদের সাথেই বিয়ে হবে৷ তিথিকে বিয়ে করে ম্যারেজ ভিসায় সাহেদ একেবারে ইংল্যান্ড স্যাটেল হবে।
গতমাসে তিথিকে দেশে নিয়ে আসে মোজাম্মেল। এদিকে সাহেদের সাথেও বিয়ের কথাবার্তা পুরোপুরি ঠিকঠাক। তিথি সবসময় বাবার বাধ্যগত মেয়ে। তাই তাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করেনি কেউ। কিন্তু দেশে এসে যখন সাহেদকে বিয়ের কথা বলা হলো সে কোনোভাবেই রাজি হয় না৷ কারণ ওর শৈশবের বন্ধু হাসিবুরকে সে পুরো জীবনের জন্য বন্ধু হিসেবে চায়। ইউরোপে গিয়ে নিজের সুনালী শৈশবকে ভীষণ মিস করেছে সে৷ আর সেই শৈশবের পুরোটা জুড়ে হাসিবুর। আমরা সবাই তাকে বুঝালাম, ‘বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। মেনে নে মা।’
সে আরও বিগড়ে যায়৷ ‘তাকে না জানিয়ে কেন বিয়ে ঠিক করা হলো। দেশে বিয়ে করলে হাসিবুরকেই বিয়ে করবে। বিষ খেয়ে মরে যাবে তবুও ওকে ছাড়া বিয়ে করবে না।’
তাছাড়া অল্প কয়দিনে হাসিবুরের সাথে কেমন ভাবও হয়ে যায় ওর। একপর্যায়ে বড় ভাই হাসিবুরের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলেন। মোসাদ্দেকও হাসি মুখে বড় ভাইয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। তারপর হাসিবুর আর তিথির বিয়ে হলো।’
.
রাফসান উদ্দিন পুরো ব্যাপারটা মনযোগ দিয়ে শুনলেন। এখন আর ধারণা করে কিছু বলতে চাইছেন না।
– ‘চলুন আজমল সাহেব। পুতুলটা জ্বালিয়ে ফেলা যাক।’
পুতুল বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে ছাঁইগুলো মাটিতে পুঁতে দিলেন।
.
পুতুল জ্বালানোর পর থেকেই অস্বাভাবিকভবে হাসিবুরের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে৷ তিথি ভীষণ অস্থির। হাসিবুরের পাশে বসে শুধু কান্নাকাটি করছে।
রাফসান উদ্দিন ভীষণ চিন্তিত। তিনি ঝাড়ফুঁক করে যাচ্ছেন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না৷
তাড়াতাড়ি বাথরুমে যেয়ে অযু করে এলেন। আলাদা রুমে যেয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে চোখ বন্ধ করে খানিক্ষণ বসে রইলেন।
এদিকে হাসিবুর কৈ মাছের মতো ছটফট করছে৷
খানিক বাদে তিনি আজমল সাহেবকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘ওরা অনেক আগে থেকে হাসিবুরের উপর জাদু চালাচ্ছিল। তিথি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাওয়ায় হাসিবুরকে মে*রে ফেলতে চাইছে। তাদের কাছে একটা পুতুল আছে। সেই পুতুলে যখন সুঁই দিয়ে আঘাত করে তখন হাসিবুরের র*ক্তবমি হয়। এখন পুতুলের গলা টি*পে ধরে আছে তাই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
আমি ওই জাদুকরের সাথে যু*দ্ধে নামতে হবে আমার। হাতে সময় নেই। ওরা হাসিবুরের চুল বা কাপড় কিছু একটা দিয়ে জা*দু করে কোথাও পুঁতে রেখেছে৷ এসব যা*দু সাধারণত এভাবেই করা হয়। এবং ওরা রোগীর নাম দিয়ে শয়তানের সাথে চুক্তিনামা তৈরি করে সবকিছু মাটিতে পুঁতে রাখে। এগুলো খুঁজে বের করে শ*য়তান জি*নের সাথে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনতে হবে।
কিন্তু আগেই বলে রাখি। আমি জয়ী হব কি না জানি না। কিন্তু পরাজিত হলে বিরাট মাশুল দিতে হবে। আপনার ছেলে মা*রা যাবে। নববিবাহিতা মিষ্টি মেয়েটি বিধবা হবে।
আজমল সাহেব কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
– ‘হুজুর আমার ছেলেটাকে বাঁচান। আমাকে শুধু কি করতে হবে বলুন।’
– ‘আপনি দ্রুত একটা রুম পরিষ্কার করেন। হাতে সময় নাই। পুরোপুরি পবিত্র হতে হবে কামরা। আর একটা ত*লোয়ারের ব্যবস্থা করেন। অবশ্য গরু কো*রবানির ছু*রি হলেও হবে। শুধু “ওমরের ত*লোয়ার” লেখার মতো জায়গা থাকতে হবে। কারণ শ*য়তান ওমর (রাঃ) কে বেশি ভয় পায়।
.
খুব তাড়াতাড়ি সবকিছুর ব্যবস্থা হয়ে করা হল। হাসিবুরের অবস্থা ভীষণ খারাপ। পুনরায় রক্তবমি করেছে। শ্বাস-কষ্ট বেড়েই চলছে৷ চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। পাশে বসে তিথি কান্নাকাটি করছে।
আলাদা একটা রুমে রাফসান উদ্দিনের সহকারী সাহেল পশ্চিমে সেজদারত। হুজুর তাকে ফুঁ দিচ্ছেন। কামরাজুড়ে অন্ধকার।
হঠাৎ অন্ধকার কামরায় দু’জন সাহেল হয়ে গেল। সেজদারত সাহেল থেকে আরেকজন ছায়ার মতো সাহেল উঠে দাঁড়াল। পাশে রাখা আরবীতে আঁকিবুঁকি করা একটা কাপড় মাথায় বেঁধে ত*লোয়ার হাতে নিল সে। ছোট্ট ত*লোয়ার হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে লম্বা হয়ে গেল। ধা*রালো ঝকঝকে ত*লোয়ার। সে সোজা রুম থেকে বের হয়ে যায়। তার অস্তিত্ব এই জগতের কেউ টের পাচ্ছে না। অদৃশ্য এক সাহেল ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির আশেপাশে ঘুরতে থাকে। তার কেন যেন ইচ্ছে করছে পাশের বাড়িতে যেতে। সেটা মোসাদ্দেক হোসেনের বাড়ি। এই বাড়ির ছেলে সাহেদের সাথে তিথির বিয়ে ঠিক ছিল। সাহেলকে সেদিকে টানছে। খানিক এগুতেই দেখলো তার মাথার উপরে একটা বাদুড়। সাহেল হাতের ত*লোয়ার আরও শক্ত করে ধরে। আকাশের রঙ পলকে বদলে গেছে। নীল আসমান ধূসর কালো হয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। হঠাৎ একটা ধমকা হাওয়া এসে সাহেলকে উড়িয়ে নিয়ে একটা পাহাড়ে ফেলে দিল। সে দেখতে পেলো বি*শ্রী লোক জঙ্গলের ভেতরে হেলে পড়া একটা গাছের ডালে বসে পুতুল হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পুতুলটির গ*লা টিপে ধরা। লোকটি পুরোপুরি উ*লঙ্গ৷ পুরো শরীরের পানার ছোলার মতো কালো লম্বা লোম। হাত-পায়ের নক অসম্ভব লম্বা। প্রচণ্ড ভয় পেল সে৷ কোথায় উড়ে এসে পড়েছে সে? স্থানটি কোথায় সাহেল বুঝতে পারছে না। খুব সম্ভব এই লোকটিই জাদুকর। একে দিয়েই শক্তিশালী জা*দুটি করা হয়েছে। সাহেল লোকটির দিকে এগিয়ে যাবে এমন সময় দেখতে পেলো আশপাশের গাছগুলো ক্রমশই সাপের রূপ ধারণ করছে৷ প্রথমে দৃষ্টিভ্রম ভেবে এগিয়ে পা বাড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে অগণিত সাপ বিভিন্ন গাছগাছালি থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে আসছে। এই অচেনা জায়গায় সে কোনদিকে দৌড়াবে বুঝতে পারছে না। বিশাল বড় বড় সাপ মুখ হা করে তার দিকে চলে আসছে দেখে সে দৌড়ানো শুরু করে। হঠাৎ দেখে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে পাথর। কখন পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে সে পাহাড় থেকে ছিটকে পড়ে যাবে বুঝতে পারছে না। হাতের ত*লোয়ার এখনও শক্ত করে ধরা। দৌড়াতে দৌড়াতে সাহেল একটা লতানো গাছের সাথে পা লেগে পড়ে যায়। আবার উঠতে যেয়ে দেখে মুখের সামনে একটা বিশাল সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সাহেলের হাতে ত*লোয়ারটি নেই। সাপটি ছুবল দিল তাকে। গড়িয়ে সরে গেল সাহেল। সাপের ছুবল লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। হাতের তলোয়ার হঠাৎ চোখে পড়লো তার। তাড়াতাড়ি হাতে নিল। দ্রুত সামনে এসে পথ আঁটকে ফণা তুলে দাঁড়ালো সাপ। সাহেল পলকে ত*লোয়ার চালিয়ে দেয় সাপের মাথায়। দু’ভাগ হয়ে যায় সাপটির দেহ। সে পুনরায় আবার দৌড়ায়। মাথার উপর একটা বাদুড়। পেছনে অনেকগুলো সাপ। সে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ দেখে মাথার উপরে অনেকগুলো পায়রা৷ একটি পায়রার মুখে চিরকুট। সাহেল হাত বাড়ায় পায়রার দিকে। চিরকুট হাতে নিয়ে মেলে দেখে, সেখানে লেখা ‘তুমি এখন আসামে আছো তোমাকে ধমকা বাতাসে আসাম কবিরাজের এলাকায় এনে ফেলেছে৷ মোসাদ্দেকের বাড়ি যাবার পথে বাঁধা দিয়েছে এই কবিরাজ। তারমানে সেখানেই জা*দুর সবকিছু পুঁতে রাখা। হঠাৎ সাহেল দেখতে পায় তার শরীর ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।’
সাহেল সেজদা থেকে উঠে বসে রাফসান উদ্দিনের সামনে। সে হাঁপাচ্ছে। রাফসান উদ্দিন লাল রুমাল দিয়ে নিজের মুখের ঘাম মুছে বললেন, ‘সাহেল, আবার প্রথম থেকে কাজ করতে হবে। তোমাকে আসাম উড়িয়ে নিয়েছিল কবিরাজ। আমি প্রস্তুত ছিলাম না তাই তোমাকে আটকাতে পারিনি। আবার চেষ্টা করে দেখতে হবে হাসিবুরের চাচার বাড়ি যাওয়া যায় কি-না। তোমার পকেটে লাইটার নাও। আবার সেজদা দাও পশ্চিমে।’
তারপর রাফসান উদ্দিন সাহেলের পা বেঁধে নেন একটা গামছা দিয়ে। গামছাটা ধরে রাখেন নিজের হাতে।
তারপর ফঁ দিলেন। খানিক বাদেই সাহেল আগের মতো অন্ধকার কামরা থেকে বের হয়ে যায়। সোজা ত*লোয়ার হাতে হাটঁতে থাকে হাসিবুরের চাচার বাড়ির দিকে। আবার আকাশ কালো রঙ ধারণ করে। তারপর ধমকা হাওয়া। তাকে উড়িয়ে নিচ্ছিল এমন সময় মনে হলো কেউ থাকে পায়ে ধরে টেনে রাখছে। বাতাস তাকে কোনোভাবেই টেনে নিতে পারছে না। হঠাৎ দেখে এখানেও চারদিক থেকে সাপ আসতে শুরু করেছে। সে আর ভয় পায় না৷ ত*লোয়ার হাতে এগিয়ে যায়। অনেকগুলো সাপ চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। সাহেল ত*লোয়ার নিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে যায়। এগিয়ে আসে একটি সাপ। চোখের পলকে ত*লোয়ার চালিয়ে দেয় সাপটির মাথায়। দু*ভাগ হয়ে যায় নিমিষে। ধীরে ধীরে সব সাপ ভয়ে পেছনে যেতে থাকে। সাহেল দৌড়াতে থাকে ওই বাড়ির দিকে। বাড়ির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। খানিক সময় চোখবন্ধ করে থেকে বাড়ির পুকুর পাড়ের দিকে দৌড়ায় সে। হঠাৎ চোখে পড়ে দু’টি বিশাল সাপ ফণা তুলে বসে আছে। মাঝখানে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কোনো কিছু পুঁতে রাখা। সাহেল ছুটে যায় সেদিকে। সাপ দু’টা ফণা তুলে ফুসতে শুরু করছে৷ গর্জন করছে রীতিমতো। হঠাৎ ট্রেনের মতো এঁকেবেঁকে তার দিকে ফণা তুলে আসতে থাকে। সাহেল ত*লোয়ার নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে যায়। সাপ কাছাকাছি আসার পর চালিয়ে দেয় মাথায়। কলা গাছের মতো ফণা তোলা মাথা পড়ে যায় মাটিতে। দ্বিতীয় সাপটি তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে৷ সাহেল বাঁ হাত দিয়ে সাপটির গলা চেপে ধরে। বিশাল সাপটিও সাহেলের পুরো শরীর পেঁচিয়ে নেয়৷ সাহেল আর নড়তে পারে না।
.
হাসিবুরের খুবই ভয়ংকর অবস্থা৷ অনবরত নাক মুখ দিয়ে র*ক্ত বের হচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছে না। কৈ মাছের মতো ছটফট করছে৷ সবাই সামনে গোল হয়ে বসে আছে। যার যে সূরা মুখস্থ পাঠ করছে। তিথি জায়নামাজে সেজদায় পড়ে কান্নাকাটি করছে। একা একটি অন্ধকার রুমে রাফসান উদ্দিন যুদ্ধ করছেন অ*শুভ শক্তির সঙ্গে।
.
সাহেল এক হাতে সাপের গলা এখনও চেপে ধরে আছে। আরেক হাতে ত*লোয়ার। সেই হাতটি সহ সাপ তাকে এমনভাবে পেঁচিয়ে নিয়েছে৷ সে হাত নাড়াতেও পারছে না। কেউ কারও সাথে পেরে উঠছে না। হঠাৎ সাপটি সাহেলকে নিয়ে পুকুরে পড়ে যায়। সাপ আর তার ওজনে নীচের দিকে যেতে থাকে। কিছুদূর গিয়ে সাহেলের আর শ্বাসে কুলোয় না। নাকে-মুখে পানি ঢুকতে শুরু করে৷ তবুও বাঁ হাতে সাপের গলা আর ডান হাতে ত*লোয়ার চেপে ধরা। ডান কোনোভাবে সাপের পেঁচ থেকে বের করতে পারলে হয়। সাহেলের মনে হচ্ছে এবার মরেই যাবে। সে আল্লাহু আকবার বলে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ডান হাত টেনে মুচড়ে বের করা শুরু করল। সাপ আরও শক্ত করে চেপে ধরে তাকে। শরীর যেন এবার শুকনো পাতার মতো মড়মড় করছে৷ সাহেলের মনে হচ্ছে এবার বোধহয় বাঁ হাতও সাপের গলা থেকে ছুটে যাবে। এমন হলে মহাবিপদ৷ খেতে হবে বি*ষাক্ত সাপের ছো*বল। কিন্তু বাঁচারও তার হাতে দ্বিতীয় কোনো পন্থা নেই। সে পুনরায় আল্লাহ আকবার বলে সর্বশক্তি দিয়ে টান মারে। ডান হাত বের হওয়ার সঙ্গে তলোয়ার লেগে যায় সাহেলের নিজের পায়ে। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে সে। কিন্তু থেমে থাকে না সে। খুব কষ্টে সাপের মাথা দূরে ঠেলে ত*লোয়ার চালিয়ে দেয়। সাপটি খসে পড়ে শরীর থেকে। সে লাফিয়ে উঠে পানি থেকে। দৌড়ে গিয়ে ত*রোয়াল দিয়ে মাটি সরায় সে। তারপর দেখতে পায় একটি তাবিজ, অ*ন্তর্বাস, কালো একটি মুরগীর মাথা। সাহেল পকেটে থেকে লাইটার বের করে। আশ্চর্য লাইটার পানিতে ভিজে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সে কী করবে? কোনো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ দেখতে পায় একটি পায়রা মাথার উপরে। ঠোঁটে চিরকুট। সেখানে লেখা তাবিজ আর অ*ন্তর্বাস ত*লোয়ার দিয়ে কেটে ফেলে দাও। আর মুরগীর মাথা পুকুরে। সাহেল তাড়াতাড়ি তাবিজ টুকরো টুকরো করে ফেলে৷ তারপর অ*ন্তর্বাস ত*লোয়ার দিয়ে ফালাফালা পানিতে ফেলে দেয়। মুরগির মাথা ছুড়ে মারে পুকুরের মাঝখানে। হঠাৎ সাহেল দেখে সে ক্রমশই মিলিয়ে যাচ্ছে।
.
হাসিবুর র*ক্তবমি করতে করতে প্রায় মরে যাচ্ছিল। হঠাৎ র*ক্ত বন্ধ হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে সে। রাফসান উদ্দিন তাড়াতাড়ি অন্ধকার রুম থেকে বের হয়ে বলেন, ‘ছেলেটিকে দ্রুত হসপিটাল নিয়ে যান।
.
হাসিবুর হসপিটাল গিয়ে এখন পুরোপুরি সুস্থ। ডাক্তার বলেছে বাড়িতে এসে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে। তিথি ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ছোটবেলার নানান গল্প করে ওর হাসিবুরকে মাতিয়ে রাখছে।
__সমাপ্ত__
লেখা: জবরুল ইসলাম