কিসসাপূরণ,পর্ব_১

0
1941

কিসসাপূরণ,পর্ব_১
আভা_ইসলাম_রাত্রি

(১)
— আমার শাড়ীর আঁচল ছাড়ুন, আহনাফ ভাই। এটা কি ধরনের অসভ্যতা। আমি কিন্তু এবার চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবো।

আভার কথা শুনে আহনাফের মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেলো না। সে দিব্যি আভার শাড়ির আঁচল নিজের বলিষ্ট হাতে পেঁচিয়ে আভাকে নিজের দিকে টানতে লাগলো। আভার খুব ভয় করছে। কেউ দেখে নিলে অলুক্ষণে কাণ্ড ঘটে যাবে। আভা চারপাশটা সচেতন দৃষ্টিতে পরখ করে নিলো। নাহ, এদিকটায় বেশ নীরব। মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। কিন্তু মিনহাজ ভাই? উনি আহনাফকে ভাইকে খুঁজতে এখানে চলে এলে, তখন? মিনহাজ ভাইতো আভাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। কিন্তু এই আহনাফ নামের রাক্ষস এটা কি আদৌ বুঝবে? ভয়ে আভার শিরদাঁড়ায় এক ভয়ানক কম্পন বয়ে গেলো। আভা এবার রাগ সামলে যতটুকু সম্ভব নরম গলায় বললো,
— দেখুন, আপনি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছেন। মিনহাজ ভাই চলে এলে কলঙ্ক হয়ে যাবে। প্লিজ, ছাড়ুন।

আহনাফ ইতিমধ্যে আভাকে নিজের কাছে বেশ টেনে এনেছে। দুজনের মধ্যিখানে আর মাত্র তিন ইঞ্চি দুরত্ব। ভয়ের চোটে আভা চোখদুটো খিঁচে রেখেছে। মনেমনে, বিড়বিড় করে কি একটা ক্রমাগত জপ করছে। হয়তো আল্লাহর নাম। আহনাফ কিছুক্ষণ আভার চোখের দিকে চেয়ে রইলো। কিন্তু পরক্ষনেই কি মনে করে চোখ সরিয়ে ফেললো ও। কন্ঠে বেশ রাগ নিয়ে বললো,
— তুই সেই কালো শাড়িটা পড়িস নি কেনো?

আহনাফের কথা শুনে আভার খিঁচে রাখা চোখ আপনা আপনি খুলে গেলো। সে কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
— কোন কালো শাড়ি?
— বিয়ের শপিং এর দিন মিনহাজ যে কালো শাড়িটা দিয়েছিল, সেটা।

আভার এবার ধীরে ধীরে মনে পড়লো সব। ধারার বিয়ের শপিংয়ের দিন মিনহাজ ভাই আভাকে একটা কালো শাড়ি দিয়েছিল। আভা সেটা সাবধানে আলমারিতে তুলে রেখেছে। কিন্তু আহনাফ এই শাড়ীর কথা কেনো জিজ্ঞেস করছে?
— কি হলো, চুপ কেন? উত্তর দে।

আহনাফের কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট। যেনো যেকোনো মুহূর্তেই সে তার রাগ দিয়ে আভাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে। তবে, আহনাফের এহেন রাগেও আভা দমে গেল না। সে নিজেও বেশ রাগ নিয়ে বললো,
— আপনার চয়েস খুব জঘন্য, আহনাফ ভাই। বিয়ের দিন কালো রঙের শাড়ি কে পড়ে?
— কে কি পড়লো সেটা আমার দেখার বিষয় না। তুই কি পড়েছিস সেটাই আমার কাছে মুখ্য। বুঝেছিস? আর আমার চয়েজ খারাপ, না? সময় এলে তুই এই কথার জন্যে খুব পস্তাবি, মিলিয়ে নিস।

আহনাফ আভার শাড়ীর আঁচল ছেড়ে দিলো। আভা আহনাফের থেকে রেহায় পাওয়ায় দ্রুত দু হাত সরে দাঁড়ালো। শাড়ীর আঁচল ঠিকঠাক করে নিল দ্রুত। বুকটা এখনোও ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। মানুষটার এত কাছে ছিল, ভাবতেই এক সুখের শিহরণ লাগছে মনে। আহনাফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। রাগে নাকের ডগা লাল টকটকে হয়ে গেছে তার। আভার ভয়ার্ত চেহারার দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে সে নিজের রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলো। অতি নরম কণ্ঠে সুধালো,
— বিয়ের দিন ওই কালো শাড়িটা একটু পড়বি, আভা? প্লীজ?

এই প্রথম আহনাফের কণ্ঠে অনুনয়। আভার রাগ এই অনুনয়ের কাছে মুহূর্তেই ফিকে পড়ে গেলো। সে নরম হয়ে গেলো, দ্রবীভূত হয়ে গেলো। মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো নিজের প্রেমিক পুরুষের পানে। মাথা হেলিয়ে মিহি সুরে বললো,
— আমি চেষ্টা করবো।

— আহনাফ,তুই এখানে কি করছিস?
হঠাৎ করে মিনহাজের কথা শুনে আভা তটস্থ হয়ে গেলো। নিমিষেই নাকে কপালে ঘাম জমে গেলো। আহনাফের দিকে একনজর চেয়ে দৌঁড় দিয়ে সে জায়গা প্রস্থান করলো আভা। আভা পিলারের পেছনে থাকায় মিনহাজ তাকে লক্ষ্য করেনি। সে আহনাফের কাঁধে হাত রাখলো। আহনাফ তখনো আভার পথের পানে চেয়ে। মেয়েটার গায়ের গন্ধ জায়গাটা এখনো মোহিত হয়ে আছে। মিনহাজ আহনাফকে অন্যমনস্ক দেখে তার পেটে ঘুষি দিলো। আহনাফ চমকে উঠলো। মিনহাজ হেসে বললো,
— কি মামা, কিসের এত ধ্যানে মগ্ন আছো? আমাকে বলো, আমরাও শুনি একটু।

আহনাফ মেকি হাসলো। বললো,
— আরে, কিছুনা।
— আচ্ছা, সাব্বিররা এসেছে। ওদের সাথে মিট করবি চল।
______________________________
— আহনাফ ভাই আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি, আপু। সে
সবসময় আমাকে শুধুমাত্র বন্ধুর বোনের নজরে দেখে এসেছে। তাই তার কাছে আমার অনুভূতির কথা বলা মানে নিজের আত্মসম্মানে আঘাত হানা। আর আমি মরে গেলেও আমার আত্মসম্মানে একটা সূঁচের আঘাত ও সহ্য করবো না, আপু।

আভার এহেন গুরুগম্ভীর কথা শুনে ধারার মুখের কথা আপনা আপনি কেটে গেলো। গলার মধ্যে জমে থাকা কথার দলা হাওয়ায় মিঠাইর মত উবে গেলো। সে নিস্তব্দ হয়ে চেয়ে রইলো আভার মুখটির পানে। আভা খুব ছোট এক মেয়ে। বয়স বলতে গেলে, ওই ১৫ কিংবা ১৬ বছর হবে। এই এতটুকু মেয়ের বুদ্ধি আর বিচক্ষণতা ধারাকে ক্রমশ অবাক হতে বাধ্য করছে। আভার চোখে জল টলমল করছে। যেকোনো মুহূর্তেই তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়বে টসটসে জলের রেখা। আভা নিজের অশ্রুকে আটকাতে জোরদার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গলার মাংসপিন্ড থরোথরো করে কাঁপছে। ইশ, মেয়েটার কষ্ট আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। ধারার নিজেও খুব কষ্ট পেলো। ফুস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়লো ও। আভাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে তার চুলে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে লাগলো,
— সব ঠিক হয়ে যাবে আভা। তুই খামোকা চিন্তা করছিস। আহনাফ তোকে ভালোবাসে। আমি নিজে ওর চোখে তোর জন্যে ভালোবাসা দেখেছি।

কান্নার প্রকোপে আভা এবার ফুঁপাতে লাগলো। কিন্তু ধারার কথার বিপরীতে নিজে একটা টু শব্দ অব্দি করলো না। আর কেউ জানুক বা না জানুক, আভা জানে! আহনাফ কখনোই আভাকে ভালোবাসবে না। এই স্বান্তনা বাণী আভার কানে জ্বলন্ত বিষের মত ঠেকছে। সে চুপটি করে ধারার বুকের সাথে মিশে রইলো। আচ্ছা, আভাকে একটুখানি ভালোবাসলে কি হয়? সে কি জানে না, আভা তার একটুখানি ভালোবাসার জন্য মরার মত তড়পাচ্ছে? হয়তো সে সব জানে। জানে বলেই আভাকে এতটা জ্বালাচ্ছে। ইশ, কি পাষাণ সে!
_________________________
আজ ধারার বিয়ে উপলক্ষে আভার পুরো পরিবার তার চাচার বাসায় এসেছে। শুধু মিনহাজ এখনো আসে নি। ভার্সিটির কি কাজে যেনো আটকে গেছে।
আজ ধারাকে সাজিয়ে দেওয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্ত্ব সঁপা হয়েছে আভার ঘাড়ে। আভার মেকআপ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকায় ও ধারাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। নতুন বধূ বলে কথা!

খানিক মুহূর্ত পর, আভার চাচী এ ঘরে এলেন। ধারার দিকে এলপল চেয়ে তার কপালে চুমু আঁকলেন। ছলছল চোখে মুচকি হেসে বললেন,
— বাহ, খুব সুন্দর লাগছে তো আমার মেয়েকে!

ধারা লজ্জায় যেনো গুটিয়ে যেতে চাইলো। মায়ের বুকে মিশে গিয়ে নিজের লাল রঙা মুখ লুকিয়ে ফেললো।
আভা জানালার পাশে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে কি হচ্ছে, কে যাচ্ছে, কে আসছে, তার সেখানে কোনো মন নেই। তার কিশোরী মন যে একজনাতে আটকে আছে। সেই একজন কোন বুঝবে তা? এই পৃথিবীতে যদি এক তরফা ভালোবাসা না থাকতো, পৃথিবীটা তখন বোধহয় খুব বেশি সুন্দর হতো। না পাওয়ার আফসোসে আভার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here