#কুসুমিত_কামিনী ( ৪)
#রেহানা_পুতুল
সেদিন রাতেই মধুলতার ঘরে আচম্বিতে প্রবেশ করে একজন সুঠামদেহী সুদর্শন পুরুষ। চেনা মুখখানা দেখামাত্রই মধুলতার অধরজুড়ে প্রষ্ফুটিত হলো প্রত্যাশার নির্মল হাসি।
এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি? আপনার কন্যাসন্তান হয়েছে। একবার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি? আপনি বলছেন এরপর আমাকে বিয়ে করবেন। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলবেন। মুক্ত করবেন এই নরকপুরী থেকে। উপহার দিবেন একটি শান্তির জীবন। অনুযোগ নিয়ে একনাগাড়ে মলিনমুখে জিজ্ঞেস করলো মধুলতা।
খালেদ নামের লোকটি একটু চুপ হয়ে রইলো। পরক্ষণেই নিরব কন্ঠে বলল, তোমার কথা অস্বীকার করছিনা। কিন্তু আমি পুত্র সন্তান হলে তোমাকে বিয়ে করতাম। ঘরে তুলে নিতাম। এখনতো আর সম্ভব নয় মধু।
মধুলতা ছ্যানছেনিয়ে উঠলো। অধিকারসুলভ ভঙ্গিতে ক্রোধ নিয়ে বলল,
এটা কি নিষ্ঠুর বিচার!কি নির্দয় আচরণ? মাত্র কন্যা জন্ম হলো বলেই আপনি বেঈমানী করবেন সাথে? আর সেতো আপনারই ঔরসজাত সন্তান। আমার কি অপরাধ? এখন তাকে আমি কিভাবে পালব? আপনিতো বললেন আপনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আর কাউকেই আপনার মনে ধরেনি। কেবল আমাকেই পছন্দ হলো আপনার। আপনার সাথে সম্পর্কের পর কাউকেই আমি বিছানায় আনিনি নানান মিথ্যা অজুহাতে। আপনিতো তখন বললেন,কোন নিয়ম মানতে হবেনা। আমি চাই তোমার গর্ভে আমার একটা সন্তান আসুক। সমস্যা নেই। আমি তোমাকেই বিয়ে করব। কি বলেননি এসব?
আমি তখন আবেগের বশে বলেছি। কিন্তু দেখলাম বাস্তবতা অনেক নির্মম। আমার সমাজ তাহলে আমাকে একঘরে করে দিবে। যদি আমি একজন দেহ পসারিণীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিই। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বাচ্চাটার খরচপাতি সব দিব।
লাগবেনা আপনার করুণা বা দয়া। ওকে যখন পৃথিবীর আলো বাতাস আমিই দেখিয়েছি। তখন তাকে বড় ও করতে পারব আমি। এক্ষুনি চলে যান আমার রুম থেকে। আর কোনদিনও আপনার মুখ দেখতে চাইনা আমি।
বাচ্চা এখন কোথায় মধু?
আমার এক বোনের আশ্রয়ে আছে। আমি চাইনা এই পল্লীতে বড় হয়ে সেও আমার মতো আরেকজন মধুলতা হয়ে উঠুক।
আচ্ছা। বলে খালেদ উঠে চলে যায় কিঞ্চিৎ অনুশোচনার ঝাঁপি মাথায় নিয়ে। কিছু টাকা রেখে যায় টেবিলের উপরে মধুলতার অগোচরে।
মিনারা অপ্সরার মতো দেখতে জান্নাতকে ধর্মীয় অনুশাসনে বড় করতে থাকে। সম্ভবপর পর্দা করার অভ্যাস গড়ে তোলে তার মাঝে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়। তার ও মধুলতার সামর্থ্যনুযায়ী পড়াশোনা করাতে থাকে। জান্নাত বড় হলে তার আসল পরিচয় খুলে বলতে বাধ্য হয়। কারণ জান্নাত প্রায় মিনারাকে প্রশ্ন করতো,
আম্মু তুমি আমাকে যে আন্টির কাছে নিয়ে যাও। উনাকে আমার এত মায়া লাগে কেন? উনার কাছে গেলে আসতেই ইচ্ছে করেনা আমার।
জান্নাত সবকিছু শোনার পর মায়ের মুখোমুখি হয়। মধুলতা তার নষ্ট জীবনের গোড়াপত্তন শোনায় মেয়েকে। শুনে জান্নাতের অন্তরখানি দগ্ধ হয় মায়ের জন্য। মায়ের কাছে খালেদের ছবি দেখতে চায়। মধুলতা তার ফোনের গ্যালারি থেকে খালেদের ছবি দেখায়।
তারপর হতেই রোজ সপ্তাহে জান্নাত বোরকা পরে সন্ধ্যার পর আসল মা মধুলতাকে দেখতে চায়। অপেক্ষায় থাকে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার। তখনি মাকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকবে। মিনারা কতবার বলছে তাদের বাসায় থাকার জন্য। কিন্তু মধুলতা যাবেনা কিছুতেই। মাত্র কয়েক হাত দৈর্ঘ্য প্রস্থের চওড়া খুপরি ঘরটায় থেকেই তার জীবন প্রদ্বীপ নিভিয়ে দিতে চায়।
এই ভিতরেই জান্নাতের বিয়ে হয়ে যায় মাহতিমের সাথে দুই পরিবারের পছন্দে। বিয়ের সময় তার জন্মধাত্রী মধুলতাও ছিল সপ্তাহ জুড়ে মিনারার বাসায়। মিনারা মাহতিমের পরিবারের কাছে জান্নাতের পরিচয় বলছে তাদের পালিতা কন্যা। কিন্তু তার মা যে নিষিদ্ধ পল্লীর একজন মধুলতা বা এখনো জীবীত আছে। এটা গোপন করেছে। আবার জান্নাতকে বলছে কোন সমস্যা হবেনা। সে যা বলার পাত্রপক্ষকে বলে নিয়েছে। মা মিনারাকে জান্নাত নিজের জীবনের মতই ভালোবাসে। নয়তো আজ হয়তো তারও পরিচয় হতো মধুলতার মতো। তাই মিনারার পছন্দ ও কথার বাইরে কোন মত প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করেনি জান্নাত।
রসগোল্লা ভাবি কোথায় তুমি?
রুমে ঢুকে নুপুরের জোর ডাকে জান্নাতের কল্পনার সুতো ছিঁড়ে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
এই এসব কি ঢংয়ের ডাক শুরু করেছিস? চেয়ারে বসা থেকে বিরক্ত স্বরে বলল মাহতিম।
ভাবি দেখতে রসগোল্লার মত নয়?
তোর কল্লা। বলে মাহতিম লাঞ্চ করতে বেরিয়ে যায় নুপুরের পাশ কেটে।
পিছন দিয়ে মাহতিমকে ভেংচি কেটে জান্নাতের গলা পেঁচিয়ে ধরল নুপুর। কি তোমার জামাইকে বশে আনতে পারছ সখী?
চেষ্টা করার সুযোগটুকুও যে পাইনি ননদী।
ওহ আচ্ছা। চলো খাবে।
ডাইনিং টেবিলে বসে নানান গল্প গুজবে সবাই খেয়ে উঠল। শেষ বিকেলে সব নিকটজনেরা চলে গেল। সন্ধ্যায় রবিউল মাহতিম ডেকে আদেশ দিলেন জান্নাতকে নিয়ে তার বাবার বাসায় বেড়াতে যেতে ৷ মাহতিম গাইঁগুই শুরু করলেও ধোপে টিকলনা। বাবার কড়া হুকুমে যেতে বাধ্য হলো।
নুপুরকেও জান্নাত অনেক জোরাজোরি করে নিয়ে গেল।
গাড়ি ড্রাইভ করছে মাহতিম। লুকিং গ্লাসের ভিতরে জান্নাতের ঢাকা দুটি চোখ দেখা যাচ্ছে। দুচোখে কাজল আঁকা রয়েছে। যেটা ছোটবেলা থেকেই জান্নাত দেয়। এই অভ্যাসটা মা মধুলতার কাছ থেকে পেয়েছে। মিনারা যখনি কোলে করে জান্নাতকে নিয়ে যেত তার কাছে। তখনি মধুলতা নিজের হাতে তোলা পাড়া কাজলটা মেয়ের দুচোখে লাগিয়ে দিত।
মাহতিম মনে মনে বলছে,
এত মোহনীয় দুটি আঁখি। অথচ স্বভাবে কি বাজে মেয়েটা ছিহ! জারা আমার কাছে ফিরে আসতে চায় এখনো। স্বামীর সাথে এডজাস্ট হচ্ছেনা বলে ডিভোর্সড নিয়ে নিয়েছে। কোন বেবিও হয়নি। আমিও একে ডিভোর্স দিয়ে প্রাণের জারাকেই বিয়ে করে ফেলব।
পৌঁছে গেল তারা বাসাবোতে জান্নাতদের বাসায়। মিনারা ছুটে এলো মেয়ে ও জামাইকে দেখে। তার অসুস্থ স্বামী পিছনের রুমেই শোয়া ছিল। মাহতিম তাদের সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করল। যদিও মাহতিমের এদের উপর প্রচন্ড আক্রোশ। কেমন মা বাবা। বোরকার আড়ালে মেয়ের দুই নাম্বারি কাজের খবর রাখেনা। মাহতিম রাতে ঘুমানোর জন্য জান্নাতের রুমটাই গুছিয়ে মিনারা ঠিক করেছে। আর নুপুর ঘুমাবে তার সাথে।
রাতে খাওয়ার পর্ব শেষে মাহতিম জান্নাতের রুমেই শুয়ে পড়ল। দরজা বন্ধ। জান্নাত মাহতিমের পাশে শোয়ার জন্য চেষ্টা করলে,
খবরদার বলছি আমার পাশে তোমার স্থান নয়। বেশি সিনক্রিয়েট করলে এখুনি বাসায় চলে যাব।
জান্নাত পরিস্থিতি বুঝে চুপ রইলো। চেয়ারে বসে ওড়নার আঁচলের একপাশকে আঙ্গুলে পেঁচিয়ে মোচড়ামুচড়ি করছে। বারান্দাও নেই যে সেখানে গিয়ে ঘুমাবে। পরে খাটের সামনে কাঁথা বিছিয়ে নিল। বুকের ওড়নাটা একপাশে রেখে একটা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নয়তো মশার জন্য ঘুমাতে পারবেনা। প্রায় শেষরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল মাহতিমের। সবুজ ডিম লাইটের আলোয় টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল।
খাটের উপরে শুয়ে গেল আবার। ঘুমন্ত জান্নাতের মুখের উপর না চাইতেই মাহতিমের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। তার নেশাতুর দৃষ্টিতে বন্ধী হয়ে যাচ্ছে জান্নাতের পা হতে মাথা অবধি। মাহতিম কল্পনার আবেশে তলিয়ে যেতে যেতে,
খোদার কি অপূর্ব সৃষ্টি তুমি। এই প্রথম তোমাকে নিবিড়ভাবে দেখছি। ওড়না না থাকায় মেয়েদের সবচেয়ে আবেদনময়ী অঙ্গ দেখার সৌভাগ্য হলো এখন। এটা এর আগে কখনো উপলব্ধি হয়নি। তিনবছর চুটিয়ে প্রেম করেছি। কিন্তু জারাকে এভাবে দেখার সিচুয়েশন হয়নি। তোমার প্রতি ভাঁজে ভাঁজে অনাবিল মুগ্ধতা। অপার কমনীয়তা।
ঘুমন্ত জান্নাত ওপাশ হতেই জলন্ত কয়েলে পায়ের তালু লেগে গেল। সে আহ! বলে কুঁকিয়ে যেতেই মাহতিম চট করেই নিচে নেমে কয়েল সরিয়ে দিল। জান্নাত জেগে গিয়ে উঠে বসল। ওড়না হাতে নিতেই মাহতিম হ্যাঁচকা টানে ওড়না নিয়ে নিল নিজের হাতে। এখানে শুধু আমিই আছি বলে জান্নাতের পায়ের তালুতে মাহতিম পানি ও ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
তোমাদের ফ্রিজ কোথায়? বরফ বা ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে রাখলে আর ফোসকা পড়বেনা।
আপনার কোন হেল্প বা সহানুভূতি আমি চাইনা। উপরে যান ঘুমিয়ে পড়ুন।
এত তেজ দেখাবানা বলছি আমার সাথে। উপরে আস।ঘুমাবে।
একদম নাহ। মরে গেলেও না। বলে জান্নাত পায়ের গোড়ালি তুলে আইস ট্রে নিয়ে এলো। মাহতিম ট্রে থেকে বরফ টুকরো নিল হাতে। জান্নাতের পা টেনে নিজের উরুর উপর রাখল। বরফ ঘষতে লাগল।
জান্নাত উহু! আহ! বলে কোঁকাচ্ছে আর বলছে আপনি উপরে যান প্লিজ।
যাব। মানবিক দায়িত্ব পালন শেষেই। মনে করনা বউ হিসেবে আদর করে সেবা করছি। তোমাকে উপরে ঘুমাতে দিলে এমন হতনা। সেই অপরাধবোধ থেকেই এমন করছি। ব্যস।
জান্নাত নিচে ঘুমিয়ে রইলো। মাহতিম উপরে উঠে গেলেও তার ভিতরের উম্মাদনা তাকে ঘায়েল করে ফেলছে। না পারছে জান্নাতকে বুকে নিতে না পারছে ছুঁড়ে ফেলে দিতে।
ভোর হতেই টনটন করে মাহতিমের ফোন বেজে উঠল। রিসিভ হতেই,
মাহতিম তোর ফুফা একক্সিডেন্ট করেছে। রক্ত লাগবে। হাসপাতালে যা জলদি।
কোন ফুফা মা?
খালেদ। তোর বড় ফুফা।
চলবেঃ ৪ ( শেয়ার ও মন্তব্য ভালোলাগলে।)