কুহকিনী,পর্ব:১
Tuhina pakira
গাড়ির দরজার তীব্র আওয়াজে রীতিমতো কেঁপে উঠলো কুহকিনী। অহন দরজাটা লাগিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে সামনে খানিকটা এগিয়ে গেলো। কুহকিনী ভ্রু কুঁচকে ওর যাবার দিকে তাকিয়ে রইল।
অহনের যে কেনো তার উপর সবসময় গা ঝাড়া মনোভাব সেটা কুহকিনী বোঝে না। বিয়ের দুই মাস পরেও কোনো কিছু শোধরালো না। এই ছেলের মতিগতি কিছুই বোঝে না কুহকিনী। শুধু কি জোর করে ওর বাবা মা বিয়ে করতে বাধ্য করেছে এটাই কারণ! তাহলে তো কুহকিনী এর ও এই রকম গা ছাড়া ভাব দেখানো উচিত। ওর বাবা – মা ও তো ওকে তাদের পছন্দের বিয়ে দিয়েছে। কোথায় সে তো অহন কে এড়িয়ে চলে না, বরং বিয়ের পর থেকে কীকরে তাঁদের সম্পর্ক শিথিল হবে সেই চেষ্টাই ও করে চলেছে। কিন্তু অপর দিকে অহন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায় না।
দুই বাড়ি সম্বন্ধ করেই কুহকিনী আর অহনের বিয়ে দিয়েছে, সবে দুই মাস হলো বিয়ের। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে অহন। অপরদিকে কুহকিনীও বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। তাই কেউই বিয়েতে না করতে পারে নি। অহনের নিজস্ব বিজনেস, অপরদিকে কুহকিনী একজন গায়নোকলজিস্ট। কেউই কারোর থেকে পিছিয়ে নেই। তাও অহন কুহকিনীকে পাত্তা দেয় না। বিয়ের পর প্রথম পুজো অহন আর কুহকিনীর। তাই সেই সূত্রে অহনদের পৈতৃক বাড়িতে আসা। বাঙালির প্রধান উৎসব মানেই দুর্গাপুজো। আর তা যদি বনেদী বাড়ির পুজো হয়, তাহলে তো কথাই নেই।
নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত করে গাড়ি থেকে নামলো কুহকিনী। পুরোনো আমলের নকশা করা বাড়িটা বেশ লাগছে। তার উপর রাতের বেলা হওয়ায় চারিদিকে ফেয়ারি লাইট জ্বলছে। চারিদিকে চোখ ধাঁধানো একটা পরিস্থিতি। কিন্তু বাড়ির বাইরেটা শান্ত, নির্জীব, মাঝে মাঝে বাড়ির ভিতর থেকে সকলের হাসির আওয়াজ আসছে। কুহকিনীর বেশ অসস্তি লাগছে। এখনকার ও কিছুই চেনে না, তবে বাড়ির লোক গুলোকে ও চেনে। ওদের বিয়েতে সকলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কুহকিনীর এখন খুব রাগ ধরছে, কেনো যে আগে আগে এখানে এলো। এই তো সবে চতুর্থী, শ্বশুর- শাশুড়ি আসবে সেই অষ্টমীতে। তাদের সঙ্গে এলেই ভালো হতো। এই ছেলের সঙ্গে আসা ওর একদম উচিত হয়নি।
বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে অহন ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। কুহকিনী গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে পিছন থেকে শাড়ির আঁচল টা নিয়ে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিলো। আসার সময় তার শাশুড়ি বারবার করে বলে দিয়েছে– মাথায় ঘোমটা না দিলেও চলবে কিন্তু গায়ে আঁচলটা জড়িয়ে রেখো, নতুন বউ বলে কথা।
-” হ্যাঁ মা পৌঁছে গেছি। তুমি কতবার ফোন দিলে বলো তো এই নিয়ে। ”
—-
-” হ্যাঁ তোমার বৌমাকে সাবধানে এনেছি। এখন তবে রাখি। ”
ফোন রেখে অহন একবার কুহকিনী এর দিকে তাকালো। তারপর ও বাড়ির ভিতরে চলে গেল। পিছন পিছন কুহকিনী ও গেলো।
পুরোনো আমলের বাড়ি হওয়ায় দরজা টা এখনকার তুলনায় অনেকটাই বড়ো এবং তার মধ্যে নানান ধরনের নকশি আঁকা। দরজা থেকে সামনেই দেখা যাচ্ছে বাঁধানো উঠোন। কুহকিনী ওর দুই পাশে তাকিয়ে ওর মুখ হাঁ করে ফেললো। অভূতপূর্ব কয়েকটা মূর্তি তার দুই পাশে রাখা, সবই পাথরের। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো। মূর্তি গুলো সময়ের বিবর্তনে কতকটা কালো রঙের আকার ধারণ করেছে। কুহকিনী আস্তে আস্তে সেই গুলো দেখে উঠোনের দিকে এগিয়ে গেলো, কিন্তু তার আগেই ও একটা মূর্তি দেখে থমকে দাঁড়ালো। বহুপুরানো এক দুর্গা মূর্তি। হাতে ত্রিশূল নিয়ে তিনি মহিষাসুরকে বধ করছেন। দেবীর মাথায় সিঁদুর দিয়ে রাঙা। দেবীর এই উগ্র রূপ ও যেনো মোহনীয়।
কুহকিনী কে পিছিয়ে পড়তে দেখে অহন থেমে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো, কিন্তু ওকে ডাকলো না।
কোনো কিছুর প্রতি প্রথমেই যে চমকটা তীব্র ভাবে প্রভাব ফেলে সেটা পরমুহুর্তে আর লাগে না। কুহকিনী এখন খুব মনোযোগ দিয়ে চারিদিকটা দেখছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই জিনিসটা ও হয়তো দেখবে কিন্তু এখনকার মতো চমকটা ও হয়তো আর পাবে না।
এইসব এর মাঝে ততক্ষণে বাড়ির লোকেরা অহন কে দেখতে পেয়েছে। এতক্ষণ তারা দালানের সিঁড়িতে বসে ছিল। অহনের বাবারা তিন ভাই, এক বোন। তবে এখানে কেউই থাকেন না। সবাই যে যার মতো করে শহরে মানিয়ে নিয়েছে। তাদের অবশ্য মাঝে মাঝে হলিডে তে দেখা সাক্ষাৎ হয়। তবে পুজোর সময়টা যে, যে কাজেই থাকুক না কেনো নিজেদের পৈতৃক বাড়িতে ছুটে আসেন। এই টান তারা চাইলেও কাটাতে পারেনি।
অহন ও কুহকিনী গিয়ে অহনের বাবার দুই দাদা, বৌদি ও বোন, ভগ্নিপতিকে প্রণাম করলো। এতদিন পর সকলে একজায়গায় সমবেত হয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লো।
অহনের বড়ো জ্যেঠু বাইরের দিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে বললো, ” অহন তোর বাবা – মা আসবে না?”
অহন তখন ওর দাদার সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে ব্যস্ত। সে শুনলো কিনা কে জানে। কুহকিনী হালকা হেসে বললো, ” বাবা একটু কাজে আটকে পড়েছেন। তবে মা – বাবা অষ্টমীর সকালের মধ্যে চলে আসবে। ”
কুহকিনী এর কথায় সবাই ওর দিকে তাকালো। কুহকিনী এর গলার স্বরে কিছু একটা ব্যাপার আছে, ও যখন থেমে থেমে কথা বলে তখন সবারই বোধহয় ওর কথা শুনতেই মন চায়। এতে অবশ্য অহনও ব্যাতিক্রম নয়। ঔ খুব প্রফুল্লের সহিত ওর গলার স্বর শোনে। ওর বেশ ভালো লাগে। তেমনি এখনও ও ওর বড়ো জ্যেঠুর ছেলে রবির আড়ালে দাঁড়িয়ে কুহকিনীর হাসি মাখা মুখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আর ওর মুখে লেগে রয়েছে এক চিলতে প্রফুল্লতা ময় হাসি।
সবাইকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রীতিমতো ঘাবরে যায় কুহকিনী। অবচেতন মন বারবার বলে চলেছে, ও কী ভুল কিছু বললো। কুহকিনীর ভাবনার মাঝে অহনের পিসি ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর চিবুকে হাত রেখে বলল, ” তোর গলার স্বর এতো সুন্দর মাঝে মাঝে মন চায়, ইশ যদি চুরি করা যেত।
পিসির কথায় কুহকিনী লাজুকতার সহিত মাথা নীচু করে নিলো। সকলে তা দেখে হেসে উঠলো। রবির স্ত্রী দিয়া গিয়ে কুহকিনীর কাঁধে হাত রাখলো, – ” বাবারে তোর এতো লজ্জা! ”
কুহকিনী হালকা হেসে দিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। ওর একমাত্র জা এই দিয়া। বাকি আর তিনটে ননদ অবশ্য আছে। ওদের ভালো নাম থাকলেও বাড়ির সকলে ওদের ডাকে রিনি, জিনি, বিনি। রিনি হলো অহনের বড়ো জ্যেঠুর মেয়ে, মেঝো জ্যেঠুর একমাত্র মেয়ে জিনি। ওদের দু জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। আর বাড়ির আদরের ছোটো মেয়েটি হলো বিনি, অহনের পিসির মেয়ে।
আচমকা বিনি এসে আনন্দে একপ্রকার লাফিয়ে
কুহকিনী কে জড়িয়ে ধরলো। কুহকিনী তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে গেলে অহন এগিয়ে গেলো সামনে, কিন্তু ও পড়তে গিয়েও বেঁচে গেলো।
-” উফফ, ছোটো বৌদি কেমন আছো?”
-” ও ভালো আছে বিনি পয়সা। তবে তুই যা লাফাচ্ছিস তোর ভালো থাকাটা একটু টাফ। দেখা যাবে গতবারের মতো হাত ভেঙে বসে আছিস।”
অহনের কথায় সকলে হেসে দিলো। বাড়ির বড়রা ওদের ফ্রেশ হতে বলে যে যার কাজে চলে গিয়েছে।
-” উফফ, দাদা তুই কিন্তু খুব পাজি। বলেছিনা আমাকে বিনি পয়সা বলবিনা!”
অহন নিজের হাতের ঘড়ি দেখতে দেখতে বললো,
” কবে বললি, আমি শুনিনি তো? এই দাদা তুই শুনেছিস? ”
রবি অহনের কথায় তাল মিলিয়ে বললো, ” হ্যাঁ সত্যিই তো, আমিও তো শুনিনি।”
-” ধুর, তোমরা দুজনেই বাজে, পচা তোমাদের সঙ্গে কথা নেই। ”
-” এই তোমরা দুটোতে আমার ননদিনী কে কেনো রাগাচ্ছো? ”
-” হ্যাঁ বড়ো বৌদি বলো তো কিছু। ”
-” এই তো বলছি, কেউ ওকে কিছু বলবেনা।”
কথাটা বলে দিয়া বাড়ির ভিতরের দিকে যেতে গেলে রবি বললো, ” কোথায় যাচ্ছো?”
-” আরে রাতের খাবার দিচ্ছে বোধহয় মা, কাকিমা। আমি একটু হেল্প করে আসি।”
কুহকিনী দিয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,” দিদি আমিও তোমার সাথে যাবো, চলো।”
-” আরে যাবি পড়ে, আগে ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আজ রাতটা রেস্ট নে। পরশু থেকে তো আর রেস্ট করার সময় পাবি না। ”
কথাটা বলেই দিয়া চলে গেলো।
-” কুহকিনী।”
রবির ডাকে কুহকিনী ওর দিকে তাকালো। রবি হেসে বলল, ” তোমার এতো বড়ো নাম বলতেও কেমন লাগে, কুহকিনী। তবে নামটা ভীষন সুন্দর।”
কুহকিনী লাজুক হাসলো। বিনি ভাবুকের ন্যায় অহনের দিকে তাকালো, ” আচ্ছা দাদা ছোটো বৌদির এতো বড়ো নাম তুই কী করে বলে ডাকিস?”
-” কী করে আবার, হাঁ করে। কেনো তুই ডাকবি?”
অহনের কথায় বিনি ভেংচি কাটলো। অহন
কুহকিনীর দিকে তাকালো। কুহকিনী ও অবশ্য ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। অহন বিড়বিড় করে বললো, ” ওকে আবার কুহকিনী বলে ডাকতে হবে নাকি, ও তো আমার জন্যে কেবল কুহু, কুহুপাখি।” পড়ে নিজেই নিজেকে শাসিয়ে উঠলো অহন, ” কী সব ভাবছিস অহন? প্রেমে পড়লি নাকি? তাও কার? না, নিজের বিয়ে করা বউয়ের। ”
-” অহন তুই কুহকিনী কে নিয়ে নিজের ঘরে যা। রমি কাকা সব গুছিয়ে রেখেছে। আমি একটু আসছি, একটা কল অ্যাটেন্ড করতে হবে। ”
রবি কথাটা বলেই চলে গেল। অহন একটু এগিয়ে গিয়ে বিনির মাথায় গাট্টা মেরে বললো, ” তুইও কী সবার মত আগের সপ্তাহে এসেছিস?”
বিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ” ধুর, খালি মারে। আর আমি আজ বিকেলে তোদের আসার পাঁচ ঘণ্টা আগে এসেছি।”
-” আরে তুমি তো তবে আমাদের সাথেই আসতে পারতে। ”
-” সে তো অবশ্যই পারতাম ছোটো বৌদি। কিন্তু ওই যে, আমি ভাবলাম আমি গেলে তোমাদের পার্সোনাল স্পেসে যদি প্রবলেম হয়। তাই আর এলাম না বুঝলে। ”
-” তোকে তো,,”
অহন বিনিকে মারতে যেতেই বিনি সরে গেলো। কুহকিনী কথা ঘুরিয়ে বললো, ” রিনি দি, জিনি দি এরা আসবে না?”
(চলবে)