কুহুকথা,পর্বঃ১১

0
1050

কুহুকথা,পর্বঃ১১
নুশরাত_জেরিন

ড্রয়িংরুমের এই ছোফাটা বেশ নরম,তুলতুলে।বসলেই এক হাত দেবে যায়।কুহু জিবনে কখনো এতো নরম আসবাব ব্যবহার করেছে কিনা সন্দেহ। তার নিজের ঘরের বিছানাটা লোহার মতো শক্ত।এক রাত ঘুমালেই গা হাত পা ব্যাথা হয়ে যায়।নেহাৎ কুহুর অভ্যাস আছে তাই।
সে আশেপাশে বড় বড় চোখ করে তাকালো।এই মুহুর্তে তার কেমন অনুভূতি হচ্ছে সে বুঝতে পারছেনা।
শুধু মনে হচ্ছে এখান থেকে পালাতে হবে।সে চুপচাপ সোফা থেকে উঠে দাড়ালো।
এতোবড় জায়গা জুরে যে একটা রুম হয় কুহু ভাবতেও পারেনি।এতোবড় ড্রয়িং রুমে নির্দিধায় ফুটবল খেলা যাবে,টিম সহ।
পা টিপেটিপে সামনে হাঁটতেই গলা শুকিয়ে এলো।দরজার সামনে ইয়া বড় গোফওয়ালা কয়েকজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে।মুখ গম্ভীর। যেনো এই মাত্র তাদের বউ পালিয়ে গেছে।
কুহু বড় সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সোফায় বসলো।
রুমের কোনায় একটা বড় দেয়াল ঘড়ি ঝুলছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ দামী।কুহু এতে বিশেষ পাত্তা দিলোনা।তার নজর সময়ের কাটাতে আবদ্ধ।
এখানে এসেছে প্রায় দু’ঘন্টা হতে চললো।এতোক্ষণ সে একা একা এই সোফায় বসে আছে আর নানা ধরনের জল্পনা কল্পনা করছে।
তার মাথায় কিছুতেই আসছেনা,আবির হঠাৎ তাকে এখানে কেনো নিয়ে এলো?কি করতে চায় সে?আর আনলোই যদি তাহলে একা এখানে কুহুকে ফেলে নিজে কোথায় গেলো?
কুহু হাসফাস করতে লাগলো।তার মাথা বেথা করছে।অতিরিক্ত চিন্তা করা যায় নাকি?এমনিতেই জিবনে সমস্যার শেষ নেই তারউপর এই ঝামেলা।তাছাড়া নতুন টিউশনিটা শুরু করেছিলো কুহু,দু’দিন যেতে না যেতেই টিউশনি মিস করলে এটা কি আর টিকবে?ছাত্রীর মা এক নিমিষে তাকে বাদ দিয়ে দেবে।তখন আবার কোথায় টিউশনি খুজবে কুহু?এতোসব ভেবে তার কান্না পাচ্ছে।
সে মুখ ফুলিয়ে বসলো।
হঠাৎ পাশে আওয়াজ হতেই চমকে তাকালো।
রুনা বেগম সোফার পাশে গম্ভীর মুখে বসলেন।
তার মুখে রাগী রাগী ভাব স্পষ্ট।
কঠোর দৃষ্টি ফেলে কুহুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে?

কুহু মাথা নাড়লো।

—কেনো পায়নি?সকালে খেয়ে বেড়িয়েছো বলে তো মনে হচ্ছে না?

কুহু চোখ বড়বড় করে কথাগুলো গেলার চেষ্টা করলো।কেউ যে কঠিন মুখে এতো মিষ্টি কথাগুলো বলতে পারে তা এই মহিলাকে না দেখলে বুঝতোই না।
কুহুকে চুপ থাকতে দেখে রুনা বেগম কপাল কুঁচকালেন।

–কথার উত্তর দিচ্ছো না কেনো?
বলো?

—কি বলবো?

—বলো তোমার ক্ষিধে পেয়েছে, খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
তারপর আমি বলবো,কেনো?শশুড়বাড়ি আসতে না আসতে ক্ষিধে পেয়ে গেলো?ছোটলোক মেয়ে!
তখন তুমি কেঁদে কেটে সাড়া করবে।
আমি রাগী দৃষ্টি ফেলবো।
বলবো,এক্ষুনি আমার পা টিপে দাও,ঘাড় মালিশ করো,চা বানাও।

কুহু হা করে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো।তার হঠাৎ মাথা ব্যাথা বাদ দিয়ে মাথা ভনভন করছে কেনো?নাকি কানে উলটো পালটা কিছু শুনছে?
তার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে রুনা বেগম হা হা করে হেসে উঠলেন।
হাসতে হাসতেই বললেন,

–ভয় পাচ্ছো নাকি?আমি তো দজ্জাল শাশুড়ি হতে চাচ্ছিলাম।
কিন্তু মনে হয়না পারবো?দজ্জাল শাশুড়ি হতে গেলে তো মুখও ঝগড়ুটেদের মতো থাকতে হয় তাইনা?আমি কি সেরকম বলো?

কুহু ভ্যাবলা হেসে মাথা নাড়লো।

রুনা বেগম তা দেখে বেশ খুশি হলেন।বউরা কম কথা বলা মানেই ভালো।সংসারে শান্তি থাকে।
পরমুহূর্তেই চমকে দাড়িয়ে পরলেন।

—এই রে,আমি তো আসল কথাটা বলতেই ভুলে গেছি।

—কি কথা?

—তোমাকে আবির ডাকছিলো,ওর ঘরে।

কুহু ফট করে মাথা নামালো।কি নির্লজ্জ ছেলে!মাকে দিয়ে বউকে ঘরে ডাকছে?আবার মা ও বা কেমন?হাসিহাসি মুখে সে কথা বলে বেড়াচ্ছে?
সে মিনমিন করে বললো,

—আমি তার রুম চিনিনা।

রুনা বেগম উৎসাহিত গলায় বললেন,

—আমি বলে দিচ্ছি, কোন ঘরটা আবিরের।

,
,
দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকাটা কেমন বেমানান দেখায়,চোরচোর ফিলিং আসে।কুহুর তার থেকেও খারাপ অনুভূতি হচ্ছে। তার দিনটা এতো খারাপ কাটবে কে জানতো?আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলো সে?কুহু চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো।উহু,মনে পরছেনা।
অতিরিক্ত চিন্তায় মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

দরজার ওপাশ থেকে পুরুষালি ভরাট কন্ঠ ভেসে এলো,

—দরজার ওপাশে দাঁড়িয়েই দিন পার করবে?

কুহু হুড়মুড় করে রুমে ঢুকলো।এবং সাথেসাথেই মহা নির্বুদ্ধিতার কাজ করে বসলো।দরজার ওপাশে দাড়ানো মানুষটার ওপর ধপাস করে পরলো।আবির নিজেও এমন পরিস্থিতির কথা আচ করতে পারেনি।আচমকা ধাক্কা সামলাতে না পেরে মেঝেতে পরলো।
কুহুর হুশ ফিরেছে ততক্ষণে। কি করেছে ভাবতেই নিজের দু গালে সপাটে চড় বসাতে ইচ্ছে করছে তার।নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হলোনা।
আবিরের হাত তখন কুহুর পিঠ আঁকড়ে ধরেছে।
কুহু দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—কি অসভ্যতামো হচ্ছে? ছাড়ুন বলছি?

—কেনো?

—কেনো মানে?ছাড়ুন আমায়,আপনিতো খুব বাজে লোক!

আবির কুহুকে ছেড়ে উঠে দাড়ালো।দুহাতে হাত ঝারতে ঝারতে বললো,

—কেনো?বাজে কেনো?কি করেছি আমি?

—কি করেছেন জানেন না?আমায় আটকে কেনো রেখেছেন?

—কারন তুমি সেচ্ছায় থাকতে চাও না তাই।

কুহু দমলো কিছুটা।এভাবে কঠোর হয়ে কথা বললে যে আবির মানবে না সেটা বুঝতে সময় লাগলো না তার।নরম গলায় বললো,

—প্লিজ, যেতে দিননা আমায়!কেনো এমন করছেন?

আবির তারচেয়েও বেশি নরম গলায় আকুতি মিশিয়ে বললো,

—প্লিজ, ভালো বাসোনা আমায়,কেনো এমন করছো?

—আরে ভালোবাসা কি এতোই সহজ?বললাম আর হয়ে যাবে?মনের উপর জোর করা যায়?
ভালোবাসা বললেই হয়ে যায় নাকি?

আবির চুপচাপ বিছানায় বসলো।কিছুক্ষণ চুপ থেকে দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরলো।
মৃদু গলায় বললো,

—বাড়ি যাও কুহু।

কুহু ঠিক বুঝতে পারলোনা কথাটা।সত্যিই কি আবির তাকে চলে যেতে দিচ্ছে?বাধা দিচ্ছে না?
পুনরায় শোনার জন্য বললো,

—কি বললেন?

আবির মাথা তুলে তাকালো না।

—বলেছি বাড়ি চলে যাও,গার্ডদের আমি বলে দেবো,তারা তোমায় আটকাবে না।

কুহুর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
পেছন না ঘুরেই সে বেড়িয়ে পরলো।
তার এখনো কয়েকটা টিউশনি করানো বাকী।
দু’একটা বাদ পরলেও বাকী গুলোর সময় এখনো শেষ হয়নি।

কুহু চলে যেতেই আবির মুখ তুলে চাইলো।তার চোখগুলো কি পরিমান টকটকে লাল বর্ন ধারন করেছে।বুকের কষ্টগুলো কি চোখ গলে বেরিয়ে আসতে চাইছে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here