কুহুকথা,পর্বঃ২

0
1135

কুহুকথা,পর্বঃ২
নুশরাত_জেরিন

—কে ওখানে?

—আমি।
আজিজ হোসেন ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে আধশোয়া হয়ে ছিলেন।কুহুকে দরজার কাছে দাড়ানো অবস্থায় দেখে সোজা হয়ে বসলেন।
বললেন,

—এসো।ভেতরে এসো।

লাল বেনারসি পরনে ক্লান্ত কুহুকে দেখতে মোটেও মনে হচ্ছে না সে আবিরের অযোগ্য। বরং তার মুখ থেকে এক উজ্জ্বল এক দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আজিজ রহমান সস্নিগ্ধ নয়নে কুহুকে দেখলেন।মেয়েটার চেহারার সাথে মোটেও পিহু অথবা তার বাবার মিল নেই।
রেজাউলের সাথে পিহুর চেহারার অনেকটা মিল।সেই সুবাদে আজিজ রহমান ভেবেছিলেন পিহু চরিত্রের দিক দিয়েও তার বাবারই মতো।অথচ তিনি কতোটা ভুল ছিলেন তা এখন বুঝতে পারছেন।

তিনি বললেন,

—এতো রাতে এখনো জেগে আছো কেনো?ঘুমাওনি?

কথাটা বলেই তিনি বুঝতে পারলেন কথাটা ভুল বলেছেন।আবির কুহুকে নিজের রুমে জায়গা দেবেনা বলেছে তাহলে মেয়েটা যাবে কোথায়?মেয়েটার জন্য হঠাৎ তার মায়া হলো খুব!এতো ভালো মেয়েকে কিনা আবির বুঝলো না?
তিনি আবার বললেন,

—তুমি বরং পাশের গেস্টরুমে ঘুমাও আজ!

—আমি ঘুমাবোনা দাদু!

—ঘুমাবে না কেনো?

—আমি বাড়ি যাবো।এখনই!

আজিজ রহমান চমকে উঠলেন।বিয়ের রাতে কনে বাড়ি যেতে চাইছে এটা মোটেও কোন ভালো খবর না।তবে যেতে চাওয়ার কারনটা কি?

—কারনটা জানতে পারি?

—আপনার তো অজানা নয়!

আজিজ রহমান বড় করে নিশ্বাস ছাড়লেন।মেয়েটা বুদ্ধিমতি!বেশ বুদ্ধিমতি!গরীব ঘরের মেয়েরা সাধারণত বুদ্ধিমতীই হয়।তাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাদের বুদ্ধিমতী হতে বাধ্য করে।জিবনের প্রতিটি পদে পদে তাদের বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে হয়।কম বুদ্ধি থাকে বড়লোকের আদুরে মেয়েদের।তারা সারাজিবন একটা আলাদা জগতে বাস করে।যেখানে চাওয়ার সাথে সাথে সব হাতের নাগালে পাওয়া যায়।
তবে কুহু মেয়েটা তার ভাবনার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমতি বলে মনে হচ্ছে।
বললেন,

—তোমার জায়গা পিহু থাকলে হয়তো আবির এমন ব্যবহার করতোনা।সে বিয়ের প্রতি অনিহা প্রকাশ করছিলো প্রথম থেকেই,তারপরও আমার কথায় পিহুকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো।বিয়ের দিনের ঘটনা তো তোমার অজানা নয়।এমন একটা অপমানের জন্যই আবিরের পক্ষে তোমায় মেনে নেওয়াটা একটু কষ্টকর হচ্ছে।
কিন্তু আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে,দেখো?আবির মোটেও খারাপ ছেলে না,তার মনটাও খুবই ভালো।

কুহু ধীরপায়ে আজিজ রহমানের পাশে গিয়ে হাটু মুড়ে বসলো।
শান্ত গলায় বললো,

—আমি ধৈর্যশীল নই দাদু,আমার ধৈর্য খুব কম।ভবিষ্যতে আপনার নাতির মত পরিবর্তন হতে পারে এই আশায় আমি বর্তমানে অপমানিত হতে পারবোনা।

—আবির তোমাকে অপমান করেছে?

—করেনি?নিজের বউকে ঘরে জায়গা দিতে অস্বীকৃতি জানানো কি অপমান নয়?

—রেজাউলের কাছে আমি যে ছোট হয়ে যাবো,কতো বড় মুখ করে তার মেয়েকে আমার ঘরে নিয়ে এসেছিলাম।

—আমার এ বাড়িতে অপমান হলেও তো আপনার মুখ থাকবে না।

আজিজ হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন।তার দৃষ্টি প্রখর।তার সামনে দাড়িয়ে থাকা পুচকে মেয়ে,অথচ তার আত্মসম্মানবোধ কতোটা প্রবল?আজিজ রহমানের মতো মানুষকেও নাড়িয়ে দিচ্ছে এ ভাবনা?সে কি রেজাউলেরই ফটোকপি? রেজাউলের আত্মসম্মান ও তো এমন।
অফিসে চাকরীরত অবস্থায় একবার তার প্রমান পেয়েছিলো আজিজ হোসেন।
তিনি শক্ত গলায় বললেন,

—তুমি সত্যিই চলে যেতে চাও?

কুহু দৃঢভাবে উত্তর দিলো,

—হ্যাঁ।

—ঠিক আছে যাও,আমি তোমায় বাধা দেবোনা।তবে আবির যদি কখনো সেচ্ছায় তোমায় ফিরিয়ে আনতে চায় তখন কি তুমি ফিরবেে?

—অবশ্যই।

–কথা দিচ্ছো তো?

কুহু জবাব দিলোনা।তার দৃষ্টি অস্থির।
আজিজ রহমান দরজা বরাবর ইশারা করলেন।কুহু নিঃশব্দে বেরুলো ঘর থেকে।
কুহু বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় ঘন্টাখানেক যেতে না যেতেই রুনা বেগম হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলেন।
চোখমুখে তার খুশির ঝিলিক।অতিরিক্ত আনন্দে তার কথা আটকে আসছে।
সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললেন,

—আব্বা, মেয়েটা কি সত্যিই চলে গেছে আব্বা? তাকে কি আপনি চলে যেতে বলেছেন?
এতোদিন পর আমার কথার মর্ম আপনি বুঝতে পেরেছেন?আপনি সত্যিই আমার কথা শুনেছেন আব্বা?

—ঘর থেকে বের হও!

রুনা বেগম হকচকিয়ে উঠলেন।চোখ বড় করে কথাটা বোঝার প্রয়াস চালালেন।তার কথার বিপরীতে এমন কথা আজিজ রহমান বলতে পারেন এ ভাবনা তার মাথায়ই আসেনি।
নিজের হাত দিয়ে কান ঝাঁকালেন।
হয়তো অতিরিক্ত খুশিতে ভুলভাল কথা শুনতে শুরু করেছেন।শিউর হওয়ার জন্য বললেন,

—কি বললেন আব্বা?

আজিজ রহমান ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন,

—এ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি।

—কেনো?

—কারো রুমে ঢুকতে গেলে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হয় বউমা,এই সামান্য কথাটা তুমি জানোনা?না জানলে জেনে নাও এবং শিখেও নাও।
এই মুহুর্তে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে দাড়াও,পুনরায় নক করে অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢোকো।

রুনা বেগম আর্তনাদ করে উঠলেন।

—আপনি আমাকে অপমান করতে পারলেন আব্বা? তাও আবার ওই দু’টাকার মেয়েটার জন্য?

—কোন মেয়ে?

—আপনার আদরের নাত বউ,যে কিনা বাড়ি ছেড়ে একটু আগেই বেড়িয়ে গেলো।

—সে দু’টাকার মেয়ে?তুমি জানলে কিভাবে?তুমি কি তাকে দু’টাকা দিয়ে কিনেছো?

রুনা বেগম হকচকিয়ে উঠলেন।আমতাআমতা করে বললেন,

—তাকে আমি কিনতে যাবো কেনো আব্বা? গরীব ঘরের মেয়েদের দুটাকার মেয়ে বলে,ওই যে যাদের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায়!

—তাহলে তুমিও তো সে পর্যায়েই পরো,তোমার বাপের বাড়িতেও তো আগে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো বউমা।

রুনা বেগম আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকলেন।এই মুহুর্তে তার কান্না পাচ্ছে না।অথচ আজিজ রহমানের এমন ভয়ংকর কথায় তার কান্না করা উচিৎ। হাউমাউ করে কান্না উচিত।
তার শশুড় কিনা তাকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে দু’টাকার মেয়ে বললো?এমন কথাও কিনা শেষ মেষ শুনতে হলো তাকে?যার স্বামী-শশুড়ের অঢেল সম্পদ এখানে সেখানে গড়াগড়ি খায়,যার ছেলে নামীদামী ডাক্তার হয়ে রোগীর সেবা করে,তাকে কিনা দু’টাকার মেয়ে বলা?

,
আবির ল্যপটপ নিয়ে বসেছে।তার মন আজ বিক্ষিপ্ত। নানারকম ভাবনা মনটাকে উলটেপালটে দিচ্ছে।
পিহু নামক মেয়েটাকে সে দেখেছিলো।বিয়ের কিছুদিন আগে মা তার ছবি এনেছিলো।মেয়েটা সুন্দরী, বেশ সুন্দরী।
এক দেখায় পছন্দ করার মতো।
দাদুর কথায় বিয়ের পিড়িতে বসতে চাইলেও সেদিন পিহুর ছবি দেখে নিজের মনেও বিয়ের প্রতি ইচ্ছে পোষণ করেছিলো।
সুন্দরকে বরাবরই মানুষ পছন্দ করে,তার প্রতি আকর্ষিত হয়।আবিরও তার ব্যতিক্রম নয়।তবে কেনো হলো এমন ওলটপালট?
পিহু তো আগে বলতে পারতো? কেনো বিয়ের মুহূর্তে আবিরকে এ অপদস্ত করা হলো?
আবিরের কপালের রগ ফুলে উঠলো।এই মুহূর্তে তার রাগ হচ্ছে। তবে রাগটা কার উপর সে জানেনা।
রাগ অথবা অস্থিরতা কমানোর জন্যই এ ল্যাপটপ নিয়ে বসা।কাজের ভেতর নিজেকে ব্যস্ত রেখে আজকের ঘটনাগুলো ভুলার এক প্রয়াস।

রুনা বেগম হুড়মুড় করে রুমে ঢুকলেন।দরজা খোলাই ছিলো।আবির সাধারন দরজা লক করেনা।
রুনা বেগম কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললেন,

—বাবু,শোন,তোর দাদু আমায় কি বলেছে জানিস?

আবির ল্যাপটপ থেকে মুখ সরালো না।তার মায়ের স্বভাব সম্পর্কে সে অবগত।
বিরস মুখে বললো,

—কতোবার বলেছি মা,আমাকে বাবু ডাকবেনা।

—কেনো ডাকবোনা,কেনো?তুই যতোই বড় হোস না কেনো,আমার কাছে তো তুই বাবুই।

—তাই বলে এসব আজেবাজে নামে ডাকবে?

রুনা বেগম আর্তনাদ করে উঠলেন।

—আজেবাজে নাম?তুই আমার দেওয়া ভালবাসার নামকে আজেবাজে নাম বললি?দশমাস দশদিন তোকে গর্ভে ধরেছি?তোকে পেটে রেখে জানিস আমি একটা দানাও মুখে নিতে পারতাম না?ছোটবেলায় তোর পেসাব পায়খানা এই নিজ হাতে ধরেছি?আর সেই তুই কিনা?

আবির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
সে তার মাকে চেনে।মুহুর্তে কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে সাথেসাথে হুহা করে হাসার ক্ষমতা আছে তার।

—তুমি কিন্তু ভুল বুঝছো মা,কথাটা আমি ওভাবে বলতে চাইনি।

—আমি ঠিকই বুঝেছি,ঠিকই!তুই আর তোর বাপ দাদা মিলে আমার পেছনে লেগেছিস। আমি বুঝিনা ভেবেছিস?
আমিও কম না?তোদের তিনজনের বিরুদ্ধে আমি একাই একশো!

—আমরা তিনজন মিলে তো তিনশো হবো মা!

–তাহলে আমি একাই চারশো!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here