কুহুকথা,পর্বঃ৩

0
976

কুহুকথা,পর্বঃ৩
নুশরাত_জেরিন

—নিজের কপালটা এভাবে পুড়ালি কুহু?

—কিভাবে মা?

কুহুর নির্লিপ্ত কন্ঠ শুনে আসমা বেগম চোখ কুঁচকে ফেললেন।তার মাথায় আসেনা, মেয়েটা কি সত্যিই বুঝতে পারছেনা সে কেমন করে কপাল পুড়িয়েছে? নাকি না বোঝার ভান করছে?

—তুই জানিসনা?

—নাতো?

আসমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।মেয়েটা অদ্ভুত, বড্ড অদ্ভুত! এতো অদ্ভুত মানুষ সে জিবনে কখনো দেখেননি।তবে এই অদ্ভুত মেয়েটাকে তিনি খুব ভালবাসেন এবং এটাও জানেন কুহু ও তাদের ভালবাসে।তার ভালবাসার পরিমান সমুদ্রসমান,হয়তো তারচেয়েও বেশি।শুধু সে কখনো প্রকাশ করেনা এই যা! সে মমতাভরা চোখে কুহুর দিকে তাকালেন।
কুহু প্লেটে ভাত তুলে নিয়ে তরকারির খোজ করছে।অথচ আজ বাড়িতে কোন তরকারি রান্না হয়নি।
চালের ড্রামের তলানিতে সামান্য চাল অবশিষ্ট ছিলো তাই রান্না করা হয়েছে আজ।
কুহু তরকারি খুজে না পেয়ে লবন দিয়েই ভাত মাখাতে শুরু করলো।
একবার জিজ্ঞেসও করলোনা, মা তরকারি কোথায়?
অথচ কুহুর জায়গায় পিহু থাকলে বাড়িতে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাতো।
চিৎকার চেচামেচি করে একাকার করতো।
পিহুর কথা ভাবতেই আসমা বেগমের মুখ কঠোর হয়ে উঠলো।মেয়েটা ভরা মজলিসে তাদের মান ডুবিয়েছে।লোকমুখে শোনা গেছে সে নাকি এই পাড়ারই এক বখাটে ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে।
তিনি বলে উঠলেন,

–হ্যা রে মা,ও বাড়ি ছেড়ে চলে এলি কেনো বললি না?

কুহু ভাত চিবাতে চিবাতে তার মায়ের চোখে চোখ রাখলো।কি মমতাভরা দৃষ্টি নিয়ে তার মা তাকিয়ে আছেন।বুকটা কেঁপে উঠলো কুহুর।এই মানুষগুলোর জন্য সে সব ছাড়তে রাজি,সব!নিজের সংসার ছাড়তেও।তবে মনের মনোভাব মুখে প্রকাশ করলোনা।মুখটা নির্জিব রেখেই বললো,

–তোমাকে তো বলেছি মা।

—তাই বলে নিজের সংসার ছেড়ে এভাবে চলে আসবি?ছেলেটা তোকে কি খারাপ কথা বলেছে?নাকি খারাপ ব্যবহার করেছে?
এমন ভাবে বিয়ে হলে মেনে নিতে তো একটু সময় লাগবেই।

—সময়ই তো দিয়ে এলাম মা।

—তাই বলে এভাবে?

কুহু জবাব দিলোনা।সে প্লেটের অর্ধেক ভাত খেয়ে পাশের বাটিতে হাত ধুয়ে ফেললো।আসমা বেগম উৎকন্ঠিত হয়ে বললেন,

—এ কি করলি?ভাত অর্ধেক রেখে উঠে গেলি কেনো?

—আর খেতে ইচ্ছে করছেনা মা,ওটুকু বরং তুমি খেয়ে নাও।

—কিন্তু আমি যে তুই আসার আগেই খেয়েছি।

—তাতে কি হয়েছে?এতটুকু খেলে কিচ্ছু হবেনা।

আসমা বেগম সন্তপর্ণে চোখের কোনের জল মুছলেন।চোখটাও হয়েছে বড্ড বেয়াড়া। একেবারেই কথা শোনেনা।
যখন তখন জলে ভরে ওঠে।
কুহু সেদিকে একপলক দেখে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
পথিমধ্যে থেমে পেছন না ঘুরেই বললো,

—তুমি খুব বাজে অভিনেতা মা!

আসমা বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
মেয়েটা তাকে বোঝে,পুরোপুরি বোঝে!
নয়তো কিকরে বুঝলো যে ঘরে আর কোন খাবার নেই?দুজনের খাওয়ার মতো ভাত রান্না হয়েছিলো আজ?

,

কুহু নিজের ঘরে যেতে গিয়েও ফিরে এলো।আজ বাবার সাথে কথা বলা হয়নি।প্রত্যেকটা বিষয়ে সে বাবার কথার মর্যাদা দেয়।তার এক কথায় পিহুর জায়গা নিজেকে কনে রুপে সাজিয়েছিলো কুহু।
তবে কাল সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছে।বাবার সাথে আলোচনা করা তো দুর তার সামনাসামনি পর্যন্ত আসেনি কুহু।
কেমন একটা অসস্থি হচ্ছে ভেতরে।বাবার সম্মান সে কোন ভাবে ডুবিয়ে ফেললো নাতো?সে ও কি পিহুর মতো কাজ করলো?বাবা কি তার উপর রেগে আছে?কোনভাবে কষ্ট পেয়েছে?নয়তো কুহু বাড়ি ফিরেছে জেনেও তাকে একবার ডাকলো না কেনো? বিবেকের দংশনে কুহুর নাজেহাল অবস্থা।
ঠিক ভুলের হিসাব সে জানেনা।শুধু জানে সে ওই বাড়িতে থাকতে পারবেনা।
দরজায় টোকা দেওয়ার আগেই রেজাউল হোসেন বলে উঠলেন,

—ভেতরে আয় মা,বাইরে কেনো দাড়িয়ে আছিস?

কুহু ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকলো।এক পায়া ভাঙা খাটের মলিন বিছানার উপর জীর্নশীর্ন মানুষটাকে দেখেই কুহুর বুক মোচড় দিয়ে উঠলো।
রেজাউল হোসেন শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলেন।তবে পারলেননা।একহাতে বিশেষ জোর পাওয়া যায়না।
কুহু এগিয়ে তাকে সাহায্য করলো।পুনরায় আগের অবস্থানে ফিরে মাথা নিচু করে বসলো।
রেজাউল হোসেন সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
বললেন,

—পিহুর কোন খোজ পেলি?

—না।

রেজাউল হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
মেয়েটাকে তিনি মানুষ করতে পারলেননা।এই আফসোসটা তার সারাজিবন রয়ে যাবে।তাছাড়া শুনেছে কোন বখাটে ছেলের সাথে পালিয়েছে সে।
ছেলেটা ভাল না।গুন্ডা মাস্তান ধরনের।
ওই রকম একটা ছেলের সাথে কি পিহু ভালো থাকতে পারবে?কিছুক্ষণ নিরব থেকে তিনি আবার বললেন,

–শুনলাম তুই নাকি আর পড়াশোনা করবি না?

—কে বলেছে? মা?

—তাছাড়া আর কে বলবে?
আমার প্রশ্নের উত্তর দিলিনা?

—হ্যাঁ।

—কেনো?

কথাটা বলেই রেজাউল হোসেন চুপচাপ মাথা দোলালেন।কারনটা হয়তো তিনি জানেন।
সংসারের এমন দশায় কোন ছেলেমেয়ের আর যাই হোক পড়াশোনা করার মতো মন থাকেনা।তবে তিনি জানেন কুহু পড়াশোনায় খুব ভালো।আবিরের সাথে বিয়ের পূর্ব মুহূর্তে তিনি আজিজ হোসেনের সাথে এ বিষয়ে কথাও বলেছিলেন।
তারা জানিয়েছিল তারা কুহুর পড়াশোনা বন্ধ করবেনা।বরংচ তার উচ্চতর শিক্ষার জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করবে।
কিন্তু মেয়েটা সেখানে থাকলো না।কেন কে জানে?জিজ্ঞেস করতে মোটেও ইচ্ছে হলোনা তার।
ছেলেমেয়ে বড় হলে তাদের নিজেদের জিবনের সিদ্ধান্ত নিজেদের নিতে দেওয়া উচিত।

—এখন তাহলে কি করবি?

—চাকরী খুজছি বাবা,টিউশনি সব ছেড়ে দেবো ভাবছি।

রেজাউল হোসেন আফসোস করলেন,

—আজ যদি আমি সুস্থ থাকতাম!তাহলে হয়তো তোকে পড়াশোনা বন্ধ করে চাকরীর জন্য পথে পথে ঘুরতে হতো না!

–আহ,ওভাবে বলছো কেনো বাবা?

—নিজের উপর মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় জানিস?জিবনটাকে আবর্জনার মতো মনে হয়।গন্ধযুক্ত নিক্রিষ্ট আবর্জনা।
যেখানে এখন তোর নিশ্চিন্ত মনে আর পাঁচটা মেয়ের মতো জিবন কাটানো উচিৎ সেখানে তোকে সংসার চালানোর জন্য টাকা রোজগার করার চিন্তা করতে হচ্ছে।
নিজেকে কি যে ছোট মনে হয় আমার!

কুহু এগিয়ে গিয়ে রেজাউলের পাশে বসলো।খাটটা বেশ পুরোনো।
বসতেই কেমন মড়মড় করে উঠলো যেনো এক্ষুনি ভেঙে পরবে।
তার শীর্ন হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভেজা গলায় বললো,

—এভাবে বলোনা বাবা,খারাপ লাগে।

রেজাউল হোসেন হাসলেন।কুহুর মাথায় হাত রেখে মন ভরে আশীর্বাদ করলেন।
কুহু স্নিগ্ধ নয়নে তাকালো।
খুব ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলতে,
তুমি এতো ভালো কেনো বাবা?এতোটা কেনো ভালবাসো আমায়?কই পিহু আপাকে তো এতোটা ভালবাসো না?তবে আমাকেই কেনো?পরের মেয়েকে বুঝি এতোটা ভালবাসা যায়?
তবে বলা হলোনা।
সবকথা বলা যায়না।বুকের ভেতর দাফন দিতে হয়।
এইযে কুহু ছোটবেলা থেকে যাদের বাবা মা বলে জেনে এসেছে,তারা তার কেউ না একথা সে জেনেছে কিছুদিন আগে।
পিহুর কাছ থেকে।
পিহুর সাথে কুহুর খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিলোনা কখনোই।
কথাবার্তাও বলা হতোনা প্রায়।তবে পিহুর একটা খয়েরী রঙের ডায়েরী আছে।তার ভেতরেই সে মনের কথা লিখে।মুলত একথাই বলতো পিহু।
তবে কখনো তার কোন মনের কথা এর ভেতরে পায়নি কুহু।এখানে সে সেসব কথাই লিখতো যা কুহুকে বলা দরকার।
এই যেমন কিছুদিন আগে কুহু টিউশনিতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিল তখনই পিহু তার সামনে এসে খাটের উপর ঠাস করে ডায়েরীটা রেখে হনহন করে চলে গিয়েছিলো।
কুহু বোঝে পিহু তার পড়ার জন্যই ডায়েরী এখানে এনেছে।সে পাত উল্টাতেই দেখলো সেখানে লেখা,

“আমার একটা লাল লিপস্টিকের খুব শখ।আমার সব বান্ধবীদের দামী দামী মেকআপ আছে।আমার তো তাও নেই।ওদের সাথে চলতে গেলে আমার যে কি লজ্জায় পরতে হয়।যদি আমায় কেউ ৫০০ টাকা দিতো তবে আমি কিছু সাজগোজের জিনিস কিনতে পারতাম।”

কুহু সেদিন বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলো।তার পায়ে তখন ছিলো ছেড়া চটি।মুচির দোকানে যেতে যেতে চটির নাজেহাল অবস্থা। ভেবেছিলো এবার একটা নতুন চটি কিনবে,কিন্তু তা আর হলো কই?
সে তৎক্ষনাৎ কিছু টাকা ডায়েরীর ফাঁকে রেখে ঘর ছেরে বেরিয়েছিলো।

ঠিক এভাবেই একদিন তার জন্মের ইতিহাস ও জেনেছিলো।
পিহু খুব ছোট থাকতে নাকি রেজাউল হোসেন কোথা থেকে কুহুকে নিয়ে এসেছিলো।

কুহুর কান্না পেলো খুব।এসব কথা সে ভাবতে চায়না।সে মনে প্রানে এদেরকেই মা বাবা মানে।
রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আত্মার সম্পর্ক বড় নয়?এদের সাথে যে তার আত্মার সম্পর্ক!

,

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here