কুহুকথা,পর্বঃ৬
নুশরাত_জেরিন
কুহু তার বাবার ঘরের সামনে দাড়িয়ে আছে।বাবা ডেকেছিলো তাকে।কেনো ডেকেছিলো কুহু জানেনা।বাবা সচারাচর তাকে এভাবে ডাকেনা।
কুহুর চিন্তা হতে লাগলো।বাবা তাকে শশুড়বাড়ি ফেরত যেতে বলবে না তো?মনের গহীনে ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করলো।
ধীরপায়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই রেজাউলের হাসিমাখা মুখ চোখে পরলো।
এতক্ষণের ভয়,খারাপ লাগা নিমিষেই দুরে পালালো।
বাবার মুখের এই হাসিমুখটা সে সবসময় দেখতে চায়,সবসময়!
সে মুচকি হেসে পাশের কাঠের চেয়ার টেনে বসলো।
—ডেকেছিলে বাবা?
–হ্যাঁ,তুই টিউশনি একটা নাকি ছেড়ে দিয়েছিস?
—হ্যাঁ।
—চাকরীর কোন খোজ পেলিনা?
কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
—চাকরী কি আর মুখের কথা?
রেজাউল হোসেন হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
—আমার এক ভালো বন্ধু আছে বুঝলি,তার ছেলে তোকে চাকরী দিতে চেয়েছে,করবি?
কুহু চমকে তাকালো।বাবার বড়লোক কোন বন্ধু আছে বলে সে তো জানেনা।
কখনো শোনেও নি। তাহলে?
কুহু হতভম্ব গলায় বললো,
—বড়লোক বন্ধু?
—হ্যাঁ,ধানমণ্ডি বাড়ি।খুব বড়লোক সে।যদিও সে মাসখানেক হলো মারা গেছে।কিন্তু তার ছেলে আছে।সে আমায় কাল চিঠি দিয়েছে জানিস?বলেছে সে তোকে একটা চাকরী দিতে চায়।
—কিন্তু আমি সে চাকরী করবো না বাবা?
—কেনো?
—বড়লোকদের আমার পছন্দ না।তাছাড়া ইদানীং কোন মানুষকেই আমার বিশ্বাস হয়না।এখন হচ্ছে ধোকার যুগ।একজনকে পিষে অন্যজন উপরে ওঠার যুগ।
কেউ এসময় বিনাকারনে তার মৃত বাবার গরীব হতদরিদ্র বন্ধুর মেয়ের চাকরীর জন্য উতলা হয়না।নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কোন কারন আছে।
—কি কারন থাকবে?
—আমি কি করে বলবো বাবা?
রেজাউল হোসেন থামলেন না।তিনি জানেন এর পেছনে অন্য কোন কারন নেই।কিন্তু বোঝাতে পারছেননা।বোঝানো যাবেওনা।সব কথা বোঝানো যায়না।
তিনি আবার বললেন,
—একবার গিয়েই দেখনা।
কুহু সেকথার উত্তর দিলোনা।সে বললো,
—আজ তোমাকে অচেনা লাগছে বাবা।
—অচেনা?
—তুমি তো কখনো কোন বিষয় নিয়ে আমায় জোর করোনি?
–তুইও তো কোনদিন আমার কথার উপর কথা বলিসনি।
কুহু কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলো।
বললো,
—সে কি আমার পরিচয় জেনে আমাকে চাকরী দিতে চাইছে?
রেজাউল হোসেন চমকে উঠলেন।তিনি কাঁপাকাপা গলায় বললেন,
—তুই জানিস?
—না জানার মতো তো কিছু নেই।
রেজাউল হোসেন মাথা নিচু করলেন।তিনি ভেবেছিলেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি কখনো কুহুর জন্মপরিচয় কাউকে জানতে দেবেননা।কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলেন।মেয়েটার চোখের দিকে তাকাতেও তার দ্বীধা হচ্ছে।
কুহু এগিয়ে এসে হাত আঁকড়ে ধরলো।তার চোখে বিন্দু বিন্দু জল।
বললো,
—তুমিই আমার বাবা।আমার আর কাউকে দরকার নেই।আর কেউ নেইও আমার।আমার কাছে রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আত্মার সম্পর্ক বড়।
রেজাউল হোসেন হুহু করে কেঁদে উঠলেন। তিনি কেনো কুহুর মতো মেয়ের বাবা হতে পারলেননা এ আফসোস তার সারাজীবন থেকে যাবে।কেনো নিজামুদ্দিনের মতো ধনী চরত্রহীনের ঔরসে কুহুর মতো পবিত্র মেয়ের জন্ম হলো?কেনো?নিজামুদ্দিনের মতো অসৎ লোক রেজাউল জিবনে দেখেননি।
নিজের স্ত্রী সন্তান থাকার পরও যে কিনা সাধারণ এক গ্রামের মেয়েকে সুখের মিথ্যা সপ্ন দেখিয়েছিলো,তার সর্বস্ব কেড়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো।বোকা মেয়েটা যখন নিজামুদ্দিনের সন্তান কুহুকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলো তখন নিজামুদ্দিন নিজের দোষ গোপন করতে কুহুকে মারতে উদ্যত হয়েছিলো।তবে সফল হয়নি।রেজাউল বাঁচিয়েছিলো তাকে।
পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে কুহু বললো,
—বললে না বাবা?লোকটার ছেলে আমার পরিচয় জানে কিনা?
—হ্যাঁ,জানে।
—কিভাবে?
—সেটা আমি জানিনা।তবে শুনেছি তার মৃত্যুর পূর্বে সে তার স্ত্রী সন্তানের কাছে তোর কথা বলে গেছে।হয়তো শেষ মুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলো।
কুহু আনমনে বললো,
—হয়তো!
,
আবির দাদুর রুমের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে।তার মুখ গম্ভীর। দাদুর তার চেয়েও বেশি গম্ভীর। তিনি রেগে আছেন রুনা বেগমের ওপর।মহিলাটিকে তার সহ্য হচ্ছেনা ইদানীং।
কেমন ছিট গ্রস্ত মনে হয় তাকে।
নয়তো যে মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তার পেছনে এখনো লেগে থাকবে কেনো?
এইতো কিছুক্ষণ আগে সে চা নিয়ে এসেছিলো।তাকে দেখেও আজিজ রহমান টু শব্দটি করেননি।কথা বললেই সে কথা বলার সুযোগ পাবে।
তারচেয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়।কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো চা মুখে নিয়ে।
চিনির জায়গা লবন দিয়েছে রুনা বেগম।কিন্তু কেনো?শত্রুতা করে?আজিজ রহমানের সাথে তার কিসের শত্রুতা?
তারা তো দুই সতীন নয়?প্রতিদন্দি ও নয়।তাহলে?
সে রাগে কটমট করে বলেছিলো,
—চায়ে লবন কেনো দিয়েছো বউমা?
রুনা বেগম কথাটা শুনে বেশ চমকেছিলেন।তিনি চায়ে লবন দিয়েছেন নাকি?ইশ হয়তো ভুল হয়ে গেছে।তবে পরক্ষনেই মত পাল্টালো তার।ভাবলো নিশ্চয়ই তার শশুড় কুহু চলে যাবার রাগ তার উপর ফলাচ্ছে।
তিনিও তেড়ে গিয়ে বললেন,
—লবন কেনো দেবো আব্বা?দেয়নি আমি।
—দিয়েছো।
—না দেয়নি।
পরক্ষনেই কেঁদে ভাসিয়েছিলো সে।
এবং বলেছে কুহুর জন্যই নাকি তিনি রুনা বেগমের উপর বিনা কারনে চোটপাট করছেন।যেখানে তার কোন দোষই নেই।
এসব বিষয় নিয়েই আজিজ রহমান রেগে আছেন।তিনি রুমের একপাশ থেকে অন্যপাশ পায়চারি করতে লাগলেন।
আবির এতোক্ষণ দাদুর হাবভাব বোঝার চেষ্টা করলেও এখন তা আর সম্ভব হলোনা।সে উঠে দাড়িয়ে বলে উঠলো,
—দাদু?
ওই মেয়ের কোন ছবি আছে তোমার কাছে?
আজিজ রহমান চমকে তাকালেন,
—কার ছবি?
আবির আমতাআমতা করলো।
—কুহুর।
,
চলবে….