কুহুকথা,পর্বঃ৭

0
969

কুহুকথা,পর্বঃ৭
নুশরাত_জেরিন

—এইযে শুনছেন?

কুহু থমকে দাড়ালো।কথাটা কি তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে?কিন্তু এমন নামীদামী এলাকায় তাকে চেনার মতো লোক আছে নাকি?
কুহু এসেছে রায়হান নামক লোকটার সাথে দেখা করতে।তবে তার ঠিকানা কিছুতেই খুজে পাচ্ছেনা।এতো এতো বিল্ডিংয়ের মাঝে কোনটা তার অফিস কে জানে?কেউ আশেপাশে নেইও যে তাকে জিজ্ঞেস করবে।
কাগজে যদিও ঠিকানাটা লিখে দিয়েছিলো বাবা,কিন্তু সেটা কুহু হারিয়ে ফেলেছে।
সে পেছন ঘুরে তাকাতেই চোখমুখ কুঁচকে ফেললো।
আবির ততক্ষণে কুহুর পাশে এসে দাড়িয়েছে।
তার ইদানীং অদ্ভুত এক রোগে ধরেছে।অদ্ভুত অনুভূতিরা জেকে বসেছে তার ওপর।এমন অনুভূতির সাথে আবির অপরিচিত।
খেতে গেলে,ঘুমোতে গেলে,যেকোন সময় তার চোখের সামনে একজোড়া মায়াবী মুখ ভেসে ওঠে।কি মাখামাখা চোখ তার!কতো আকুলতায় পরিপূর্ণ!
আবিরের অস্থির লাগে খুব।মায়াবী মুখটার খোঁজে সে প্রায়ই সেই বাসস্টান্ডে এসে দাড়িয়ে থাকে।কিন্তু মায়াবিনীকে পায়না।কষ্ট হয় তখন।বুকটা জ্বলে ওঠে।
মনে হয় কেউ যত্ন করে মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে।
আবিরের সহ্য হয়না পাগলের মতো করে।
তবে বিবেকের কোথাও একটা বাঁধে। সে বিবাহিত। বউ আছে তার।যতোই তাকে মানুক আর না মানুক,বিয়ে করা বউতো।
তার আবর্তমানে অন্য কোন মেয়ের প্রতি দুর্বল হওয়া কি উচিত তার?মেয়েটার প্রতি অন্যায় হবেনা এতে?
কিন্তু মন যে কথা মানেনা।সে মায়াবিনীর সান্নিধ্য পাবার জন্য আকুল হয়ে থাকে।

কুহুর কাছাকাছি দাড়িয়ে সে হাপায়।ওনেক দুর থেকে কুহুকে দেখে দৌড়ে এসেছে সে।
কুহু চোখ কুঁচকে তাকায়।বলে,

—আপনি এখানে?কি চাই?

আবির থতমত খায়।সত্যিই তো কি চাই তার?কেনো পিছু নিয়েছে সে?কি বলবে?বলবে যে আপনাকে না দেখতে পেলে আমার অস্থির লাগে?খাওয়া ঘুম হারাম হয়?
সে আমতাআমতা করে।
কুহু চোখ আরও তীক্ষ্ণ করে।কন্ঠে রাগী ভাব আসে তার।

—সত্যি করে বলুন তো,আমার পিছু নিয়েছেন কেনো আপনি?কি চাই কি আপনার?

—না মানে,আসলে।

কুহু ধমকে ওঠে,

—ফাইজলামি করেন মিয়া?ফাইজলামি? আমাকে কি সস্তা রাস্তার মেয়ে মনে হয়?নজর ঠিক করেন বুঝলেন,সব মেয়েরেই এক নজরে দেখেন কেন?

আবির হতভম্ব হয়। সে কি করলো?কোন নজরে দেখলো?তাছাড়া সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে মেয়েটা তাকে ধমকাচ্ছে?এতোটুকু পিচ্চি মেয়ে আবির হোসেনকে ধমকায়?আবিরের তো রেগে যাওয়া উচিত। কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারা উচিত।
কিন্তু আবির পারছেনা কেনো?তীব্র অনুভূতিরা এসে বাধা দিচ্ছে বুঝি?
সে জোরে নিশ্বাস ফেললো।
কি হচ্ছে আবির বুঝছেনা।শুধু বুঝতে পারছে সে বদলে যাচ্ছে। ভেতরটা পুরো ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।
এইযে মেয়েটা গাঢ বেগুনি জামা পরে ওড়না মাথায় টেনে নিয়েছে।কি স্নিগ্ধ লাগছে তাকে!মনে হচ্ছে টুপ করে….

সে আকুল কন্ঠে বলে ওঠে,

—আমার এমন কেনো হচ্ছে বলুনতো?সব উল্টে পাল্টে যাচ্ছে কেনো?কেনো এতো অস্থিরতা? কেনো ছককষা জিবনে এই এলোমেলো ভাব?কেনো?
আপনি বলতে পারবেন?

কুহু আচমকা চমকে ওঠে। আবিরের এমন আকুতি মেশানো কথাগুলো তার কোথাও লাগলো যেনো?কোথায় লাগলো?এই এখানটায়?বুকের মাঝ বরাবার?গুলির মতো বুকটাকে এফোড় ওফোড় করে দিলো নাতো?সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

—কিসব আবোলতাবোল কথা বলছেন?
আর আপনি সরুন তো,পথ ছাড়ুন,আমার কাজ আছে।

আবির কথা শুনলো কিনা বোঝা গেলো না।
তার কন্ঠে হাজারগুন আকুলতা ভর করলো,

—আমার এই অনুভূতির নাম কি বলতে পারেন?

কুহু জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো।অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তেজি গলায় বললো,

—আপনার লজ্জা করেনা?বউ থাকতে অন্য কোন মেয়েকে অনুভূতি জানাতে এসেছেন?বিবেকে বাঁধে না আপনার?কেমন মানুষ বলুন তো?সামান্য মনুষ্যত্ব নেই?বিয়ে হয়ছে দুসপ্তাহ হলোনা,এর মাঝেই অন্য মেয়ের পিছুপিছু ঘুরছেন?
সেদিন আমি আপনার বাড়ি থেকে চলে এসে ঠিক করেছি,একদম ঠিক কাজ করেছি।
লুচ্চা লোক কোথাকার!

রাগে গজগজ করতে করতে কুহু সামনে পা বাড়ালো।
আবির স্তব্ধ হয়ে রাস্তায়ই বসে পরলো।তার খুব লেগেছে কথাগুলো।সত্যিই কাজটা সে ঠিক করেনি।কিন্তু মনকে কি বেধে রাখা যায়?নাকি ইচ্ছে মতো চালনা করা যায়?
সেকি ইচ্ছে করে…
পরক্ষনেই চমকে উঠে দাড়ালো সে।মুখে ফুটে উঠলো মৃদু হাসির রেখা।
মেয়েটা কিকরে জানলো,আবির বিবাহিত? বিয়ের দুসপ্তাহ হয়েছে?সেতো আর বলেনি?তাছাড়া কথার ফাঁকে সে বলেছে সে চলে এসেছিলো আবিরদের বাড়ি থেকে সেদিন।
আবির নিজের মাথায় গাট্টা মারলো খুব।এইজন্য বুঝি মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছিলো?দাদুর কাছে ছবি চেয়েও তো পেলোনা।দাদুর কাছে নাকি কোন ছবি নেই।আর সে কিনা নিজের বউকে চিনতে পারলোনা?এতোটা গাধা কবে হলো?

,

কুহু রায়হানের চেম্বারে বসে আছে।চারপাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।সামনে বসা লোকটার চোখে চোখ রাখতে কেন যেনো ইচ্ছে করছেনা তার।তার ধারনা লোকটাকে দেখলেই সে কেঁদে ফেলবে।যেনোতেনো কান্না না,হাউমাউ করে কান্না।
না চাইতেও কুহুর ভেতরে ঝড় বইছে।সামনে বসে থাকা মানুষটা তার ভাই?নিজের ভাই?
নিরব পরিবেশে হঠাৎ রায়হান থমথমে গলায় বলে উঠলো,

—আপনার নামই কুহু।

কুহু উত্তর দিতে চাইলেও দিতে পারলোনা।তার গলা আটকে আসছে।কোন কথা মুখ থেকে বের হচ্ছেনা।এমন কেনো হচ্ছে কে জানে?
অথচ কুহু ভেবেছিলো সে কিছুতেই দুর্বল হবেনা।কিছুতেই নিজের দুর্বলতা সামনে আনবেনা।
অবশেষে সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
রায়হান হাতে রাখা কুহুর বায়োডাটা রাখা ফাইলটা টেবিলো রাখলো।
বললো,

—তুমি কি খেয়াল করেছো,তোমার চেহারা অনেকাংশে আমার সাথে মেলে?

কুহু চমকে তাকালো।লোকটা হঠাৎ তুমি বলছে কেনো?এসবই বা কেনো জিজ্ঞেস করছে?
কুহু কঠিন গলায় বললো,

—আমি ব্যক্তিগত কথা বলতে আগ্রহী নই স্যার!

—কিন্তু আমি যে আগ্রহী!

কুহু উঠে দাড়ালো।তার দৃষ্টি কঠোর।নিজের মনকে বুঝ দেওয়ার অলৌকিক ক্ষমতা আছে তার।ভেতরের নরম সত্ত্বাকে লুকিয়ে বাইরে কঠোর থাকতে পারে সে।
বললো,
—তাহলে আমার পক্ষে এ চাকরীটা করা সম্ভব হবেনা।

রায়হানও উঠে দাড়ালো।তার মুখটা ফ্যাকাসে।নরম গলায় বললো,

—কোনো বোন?বাবার করা অপরাধের শাস্তি আমায় কেনো দেবে?
বাবার ভুলের কোন ক্ষমা নেই আমি জানি,কিন্তু আমি,মা, আমরা তো কোন অপরাধ করিনি?করেছি কি?

—আপনি কোথাও ভুল করছেন স্যার,আমি কারো বোন নই।আমি কুহু।
আমরা দুইবোন।বাবা রেজাউল হোসেন।
তাছাড়া আমার কোন পরিচয় নেই।

কুহু গটগট পায়ে অফিসরুম ছেড়ে বেরুলো।চোখের কোনে তার জলের কনা।চোখের পানি এমন বেয়াড়া কেনো কে জানে?মালিকের কথা মোটেও শোনেনা,নিজের মর্জিমতো বেয়ে চলে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here