কৃষ্ণচূড়ার দিনে,পর্ব-১
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
ধূসর আকাশের বুকে কৃষ্ণমেঘের হাতছানি। রাশি ভারি মেঘের পাল্লায় পাল্লায় গর্জে উঠছে অলৌকিক আলোটি। দমকা হাওয়াগুলো তীব্র গতিতে আঁচড়ে পড়ছে গাছের আঁকাবাঁকা ডালে। ঝরে পড়ছে দূর্বল পাতাগুলো। রাস্তার ধারে উঁচু প্রাচীরে উপরপ্রান্তে থাকা কদম ফুলের গাছটি নেতিয়ে পড়েছে প্রায়, ঝুঁকে পড়েছে এইদিকটায়। একটু চেষ্টা করলেই হয়তো নাগাল পাওয়া যাবে তার। এমন সুযোগ সচরাচর আসে না বিধায় রুপ তা লুফে নিতে চাইলো। চটজলদি মুঠোফোনটা ব্যাগে পুড়ে নিয়ে হাত বাড়ালো ফুলগুলোর দিকে। বাতাসের গতি তখনও বেশ, বার বার ঝুঁকে পড়ছে ফুলগুলো নিচের দিকে। হয়তো কদমরাজ আজ নিজেও চাইছেন রুপের হাতে ধরা দিতে তাই তো রুপ কয়েক দফা লাফিয়ে উঠতেই তার হাতের এসে ঠেকলো কয়েক জোড়া কদমরাজ। ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থাকা বস্তু আজ তার হাতের মুঠোয় বন্দী, ভাবতেই হাসি ফুটে উঠে তার মুখে। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে শূন্যে উড়িয়ে দেয় তার ওড়নার শেষ ভাগ, অবিন্যস্ত করে দেয় চুলগুলো। রুপ দ্রুত একহাতে সবটা সামলে উঠার বৃথার চেষ্টা করে। মিনিট দুই-এক যেতেই বিস্তৃত আকাশের বুক চিরে নেমে পড়ে এক পশলা বৃষ্টি। ক্ষণেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে খোলা আকাশের নিচে থাকা মানুষজন, ছুট দেয় ছাউনির উদ্দেশ্যে। রুপও দৌড়ে একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে উঠে,
— শালার বৃষ্টি আর নামার সময় পেল না। বাসায় তো যেতে দিতি, তারপর না-হয় নিজের লীলাখেলা দেখাতি।
কথাটা বলেই পায়ের ধারে থাকা ছোট ইটের টুকরাটা পায়ে ঠেলে ছুঁড়ে মারে পিচঢালা রাস্তার উপরে। মুহূর্তেই এক গাড়ি সেই ইটের উপর হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে যায়। রুপ সেইদিকে আর তোয়াক্কা না করে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে বৃষ্টি থামার।
আধা ঘন্টা এই আশাতেই অতিবাহিত করার পরও যখন বৃষ্টি থামার কোন নাম গন্ধ দেখা দিল না, তখন রুপ বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করলো। তার বাসা এইখান থেকে পাঁচ মিনিটের দুরত্বেই, তাই সিদ্ধান্ত নিল এক দৌড়েই সেখানে গিয়ে উঠবে। অন্যথায় এইখানেই রাত পার করতে হবে। ফুলের মুঠোটা শক্ত করে ধরে এক দৌড় দেয় সে বাসার উদ্দেশ্যে। প্রায় এক দৌড়েই এসে সে পৌঁছায় বাসার মেইন গেটের সামনে। গেটের ভিতর ঢুকে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলো সে। তার গা বেয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। সিক্ত চুলগুলো এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে চেহেরায়। রুপ দ্বিতীয় বারের মত বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে উঠে, চুলগুলো আলতো হাতে টেনে কানের কাছে গুঁজে নিয়ে জামা-কাপড় হালকা ঝেড়ে নেয়। গায়ে জড়ানো সাদা এপ্রোণটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে একনজর বাহিরে তাকায়, সময়ে সাথে সাথে বৃষ্টির প্রকট বেড়েই চলেছে। যে অবস্থা, ভোর হওয়া অব্দি থামবে বলে মনে হচ্ছে না।
বাকি আট-দশটা মেয়ের মত, রুপ এতটা বৃষ্টি প্রিয় মানুষ নয়। বরাবরই তার বৃষ্টি অপ্রিয়। তার মতে বৃষ্টি খালি মানুষের জন্য মুসিবতই বয়ে আনে, এইটা কখনোই কারো জন্য সুখকর বস্তু হতে পারে। মানুষ যে কিভাবে বৃষ্টি পছন্দ করতে পারেই তাই বুঝে উঠতে পারে না সে। আরেক দফা বৃষ্টিকে গালমন্দ করে রুপ সিড়ি ভেঙে উপরে যেতে শুরু করে।
দরজার সামনে এসে তাতে তালা ঝুলিয়ে থাকতে দেখে রুপের ভ্রু কুঁচকে আসে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকার পর তার মনে পড়ে, দুপুরের তার মা ফোন জানিয়েছিল সে তার ছোট ভাইকে নিয়ে তারা নানাবাড়ি যাচ্ছে। নানুমা নাকি খুব অসুস্থ, তাই বাসার চাবি পাশের বাসার নিপা আন্টির কাছে রেখে যাচ্ছে। রুপ তখন রওসান স্যারের ক্লাসে ছিল বিধায় কোনমতে হ্যাঁ, হু বলে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। তাই কথাটা একদমই তার মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে, ব্যাগ থেকে মুঠোফোনটা বের করে একবার টাইম দেখলো। ঘড়িতে নয়টা অধিক বাজে। আজ এক্সট্রা কিছু প্রেকটিক্যাল ক্লাস ছিল বিধায় তুলনামূলক বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছে। রুপ মুঠোফোনটা ব্যাগে পুড়ে নিয়ে হাঁটা দেয় পাশের বাসার দিকে৷ দ্রুত গতিতে পরপর তিনবার কলিংবেলটা চেপে ক্ষান্ত হয় সে। ভাব ভঙ্গি দেখে বুঝাই যাচ্ছে, তার তাড়া আছে বেশ। আর হবেই বা না কেন? তার শরীর যে ইতিমধ্যে শিথিল হতে শুরু করে গিয়েছে৷ দাঁড়িয়ে থাকাটাই তো দায় হয়ে এসেছে।
দরজা খুলছে না দেখে রুপ আবার কলিংবেলটা চাপলো। এইবার প্রায় সাথে সাথেই দরজাটা খুলে যায়। রুপ নজর তুলে তাকাতেই দরজার ওপাশে উদোম গায়ে দাঁড়ানো এক কৃষ্ণমানবকে দেখে থমকে দাঁড়ায়৷ গা-টা কেমন শিরশির করে উঠে। কৃষ্ণমানবটি পরিধানে আকাশি কালার শর্টস বাদে কিছুই নেই। গলার দুই ধার দিয়ে ঝুলছে ফিনফিনে এক কালো রঙের ইয়ারফোনটি। মুখে তার খেলা করছে অন্যরকম মাধুর্য। রুপ বার কয়েক পল্লব ফেলে, বিমূঢ় দৃষ্টিতে দেখতে থাকে মানবটিকে। একধ্যানে, একমনে। সামনে দাঁড়ানো এলোকেশী কন্যার এমন দৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে মানবটি একটু বিব্রতবোধ করলো। উপরন্তু, মেয়েটিকে সে আদৌ চিনে বলে মনে করতেও পারছে না। এই বৃষ্টিমুখর দিনে তার দরজায় এসে কি চায় সে? ক্ষণে সে গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনার কি কিছু চাই মিস?
মানবটির অনুরাগহীন কন্ঠটি শুনে রুপের ধ্যান ভাঙ্গলো। সে জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁটযুগল ভিজিয়ে নিয়ে ইতস্তত সুরে বললো,
— না মানে, আন্টি আছে কি?
মানবটি একটু সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো রুপের দিকে। উপর থেকে নিজ পর্যন্ত নজর বুলালো। ভিজে আসার ফলে রুপের কামিজটা প্রায় আঁটসাঁট হয়েই লেপ্টে আছে রুপের গায়ে, রুপ ওড়না দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে ঢেকে নিলেও বেশ কিছু স্থান এখনো স্পষ্ট। হঠাৎ নিষিদ্ধ এক জায়গায় মানবটির চোখ এসে স্থির হতেই দ্রুত সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
— মা, বাসায় নেই। পরে আসেন।
কথাটা বলে দ্রুত দরজা দিতে নিলে রুপ চেঁচিয়ে উঠে,
— আরেহ! আমি বাসায় যাব কিভাবে তাহলে?
কথাটা শুনে মানবটি থমকায়। ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতেই তাকায় রুপের পানে। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করে,
— মানে?
— আমার বাসার চাবি তো আন্টির কাছে। দুপুরে মা গ্রামে যাওয়ার আগে, তালার চাবিটা এইখানে রেখে গিয়েছিল। এখন চাবি ছাড়া আমি বাসায় ঢুকবো কি করে?
এক নিঃশ্বাসেই কথাগুলো বলে দম নিলো রুপ। মানবটি দরজার ধারেই বিরাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। বুঝতে পারলো, মেয়েটি তাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। কিন্তু তারা এইখানে শিফট হলো কবে কে জানে? মানবটির থেকে কোন প্রকার টু শব্দ না পেয়ে রুপ এইবার তার নাম ধরে সম্মোধন করলো,
— তনয় ভাইয়া! শুনছেন?
মানবটি এইবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— মা বিকেলের পর পরই এক আত্মীয় বাসায় গিয়েছে। এশারের আযানের পরপর ফিরার কথা হলেও এখন পর্যন্ত ফিরে নি। কখন ফিরবে আমি জানি না। আর আমাকে সে কোন চাবি-টাবি দিয়ে যায়নি।
রুপ মুখ ছোট করে, ইতস্তত সুরে বলে,
— আন্টি তো মনে হয়-না চাবি নিয়ে গিয়েছে। বাসাতেই থাকার কথা। একবার একটু ফোন করে দেখবেন, চাবিটা সে কোথায় রেখে গিয়েছে।
তনয় প্রত্যুত্তর করে না, আনমনে বলে, “যত মেয়েলীদোষ থেকে দূরে থাকতে চাই, ততই এইটা শনির মত কপালে চেপে বসে৷ মাইরি, কপাল আমার।” বিরাগী নিঃশ্বাদ ফেলে পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে কল দেয় সে তার মায়ের নাম্বারে। কিন্তু ফোন অপরপাশ থেকে সুরেলা কন্ঠে বলা, “আপনি যে নাম্বারে ডায়াল করেছেন তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে” উক্তিটি শুনে তনয়ের চেহেরার আবির্ভাব বদলে যায়। ফ্যাকাশে হয়ে আসে মুখটি। সে পরপর চারবার ফোন দেওয়ার পরও যখন একই ধ্বনি পুনরাবৃত্তি হলো তখন সে রুপের দিকে তাকিয়ে থমথমে মুখে বললো,
— মায়ের ফোন বন্ধ বলছে?
রুপের ইতিমধ্যে কাঁপন ধরতে শুরু করে দিয়েছিল। সে দু’হাত দিয়ে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন অবস্থায়, তনয়ের কথা শুনে রুপ বিবর্ণমুখে তাকালো। বলল,
— এখন?
তনয় কিছুটা গা-ছাড়া ভাব নিয়েই বললো,
— আমি কি জানি?
রুপ এতে একটু অসন্তুষ্ট হলো বটেই, কিন্তু প্রকাশ করলো না। অজানা এক মানবের নিকট কি বাই আশা রাখবে সে? রুপ কোন প্রকার দ্বিরুক্তি না করে, ঘুরে দাঁড়ালো। হাঁটা দিল নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। সেখানেই তাকে বসে অপেক্ষা করতে হবে, এছাড়া উপায় কি? এই বাসায় এসে উঠেছে একমাস হবে বোধহয়। তেমন কারো সাথেই সখ্যতা হয়ে উঠেনি তার, একবারের জন্য যায়ও নি অন্যকোন ফ্ল্যাটে। এক নিপা বেগম তাদের প্রতিবেশি বলেই বার দুয়েক যাওয়া-আসা হয়েছিল। তাই সে যেহেতু নেই, সেহেতু তার যাওয়ার মত কোন জায়গায়ও নেই।
রুপকে এইভাবে যেতে দেখে তনয় কিছুটা সময় ভাবলো। অতঃপর কোন ভূমিকা ছাড়াই গলা উঁচিয়ে বলে উঠে,
— আপনি চাইলে ভিতরে এসে অপেক্ষা করতে পারেন, মিস।
চলবে