কৃষ্ণাবতী,অন্তিম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
কৃষ্ণার আকুতি যেনো দেবব্রতের কান অবধি যাচ্ছে না। গাড়ি থেকে নেমে হাতটা টেনে দেবব্রত হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণাকে। তখনই কৃষ্ণা চিৎকার করে শোয়া থেকে উঠে বসে। মধ্যরাত, কৃষ্ণার কপাল, ঘাড় ঘামে ভিজে রয়েছে। শরীরটা রীতিমতো কাঁপছে। গলা যেনো কাঠ হয়ে আসছে, কত বছর না জানি পানি পিপাসা তার। হাত অজান্তেই পেটের কাছে চলে গেছে। কৃষ্ণার চিৎকারে পাশে শায়িত দেবব্রতের ঘুমও ভেঙ্গে গেছে। উঠেই আগে পাশে থাকা ল্যাম্পটা অন করে দেবব্রত। কৃষ্ণা থরথর করে কাঁপছে। তার কাঁধে হাত দিয়ে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে?
দেবব্রতের কন্ঠে কানে যেতেই ভয়ে আৎকে উঠে কৃষ্ণা। কাঁপা স্বরে বলতে থাকে,
– আমার বাচ্চার কিছু হতে দেবো না। সরে যাও, আমার কাছে আসবে না। আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে তুমি। কাছে আসবে না। আমি হাসপাতালে যাবো না।
কৃষ্ণা রীতিমতো কাঁদছে, অস্পষ্ট স্বরে কথাগুলো বলেই যাচ্ছে এবং দেবব্রতের কাছে থেকে সরে যাচ্ছে। কৃষ্ণার এরুপ আচারণে ব্যাথিত চোখে দেব তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কৃষ্ণার প্রেগন্যান্সির তিন মাস হতে চলেছে। কাল চেকাপ তার। আজকাল কৃষ্ণা সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে।শরীরটাও দূর্বল। বাচ্চাটাকে নিয়ে তার সারাক্ষণ চিন্তা। দেবব্রত এখন আর কৃষ্ণা থেকে দূরে দূরে থাকে না। তবুও কতোটা মানসিক চাপের মাঝে রয়েছে কৃষ্ণা যে এখন সে দেবব্রতকেও ভয় পাচ্ছে। চোখ জোড়া বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিজেকে শান্ত করে দেবব্রত। তারপর হ্যাচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে কৃষ্ণাকে৷ বুকের সাথে শক্ত করে মিশিয়ে বললো,
– কৃষ্ণা শান্ত হো, চোখ মেলে আশে পাশে দেখ। আমরা আমাদের ঘরেই রয়েছি। একটু শান্ত হো।
কৃষ্ণা ভীত চোখে আশেপাশে তাকাতে থাকে। মিনিট বিশেক পর সে শান্ত হয়। সে স্বপ্ন দেখছিলো, চরম দুঃস্বপ্ন। স্বপ্নের দেবব্রত এবং বর্তমানের দেবব্রত এক নয়। এই দেবব্রতের শরীরের উষ্ণতা সে অনুভব করতে পারছে। তার হৃদস্পন্দন স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে। মাথাটা তুলে ধীর কন্ঠে বলে,
– মাষ্টারমশাই, স্বপ্নটা খুব বাজে ছিলো। জানো আমি দেখেছি, তুমি জোর করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছো। বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছো। আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
বাচ্চা মেয়ের মতো দেবব্রতের বুকে গুটি মেরে বসে কথাগুলো বলছিলো কৃষ্ণা। দেবব্রত আলতো হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ধীর কন্ঠে বললো,
– দুঃস্বপ্ন ছিলো, ভুলে যা। আমাদের বাবুর কিছুই হবে না। আমি তোর কিংবা আমাদের বাচ্চার কিছুই হতে দিবো না। আমি কথা দিচ্ছি।
দেবব্রত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো কৃষ্ণাকে। চোখ ছলছল করছে তার। কৃষ্ণাকে নিয়ে তার চিন্তাগুলো মনেই সীমাবদ্ধ রেখেছে দেবব্রত। ভবিষ্যতে যা হবে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে সে কৃষ্ণার সাথে।
সকাল ৯টা,
ডা.নিশাতের চোখ রিপোর্টের দিকে। সামনে দেবব্রত এবং কৃষ্ণা বসা। রিপোর্টগুলো দেখে চোখের চশমাটা খুলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
– আমার চিন্তার অবসান ঘটলো।
– মানে? কৃষ্ণা ভালো আছে তো?
– ডোন্ট ওয়ারি, শি ইজ হেলথি। এন্ড বেবি ইজ এবসুলেটলি ফাইন। কোনো চিন্তা করবেন না। আর কৃষ্ণার দিকে খেয়াল রাখবেন। এই সময়টা মুড সুইং, ক্রেভিং হবে। ক্রিটিকাল সময় পার হয়ে গেছে। বেবির হার্টবিট খুব জোরালো। সো রিলাক্স
ডা. নিশাতের কথায় বেশ নিশ্চিন্ত হলো দেবব্রত। কৃষ্ণার হাতে হাত রেখে চোখ দিয়ে ইশারা করে। আশ্বত করে দেবব্রত তার পাশে রয়েছে। কৃষ্ণা শক্ত করে দেবব্রতের হাতটা ধরে। তাদের সম্পর্কের দূরত্ব কমছে। নতুন সূচনা হচ্ছে তাদের সম্পর্কের_________
২৯.
রাত বারোটা,
আজ অগ্রহায়ণ মাসের পনেরো তারিখ, শীতের আমেজ এখন পুরোপুরি চলে এসেছে। বাংলাদেশে ছয় ঋতু বলা হলেও ঢাকা শহরে শুধু তিনটি ঋতুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অগ্রহায়ণ মাসের এই সময়টা গরমের তাপটা একেবারে কাঠফাটা শীতে পরিণত হয়। এই সময়ে বিয়ের ধুম পড়ে যায় দেশে। ঠিক তেমনই বিয়ের মন্ডবে বসে রয়েছে অন্না এবং অর্জুন। এতোদিনের অপেক্ষার মিষ্টি ফল আজ যেনো তারা পাচ্ছে। লাল বেনারসিতে আজ অন্নাকে কোনো অপ্সরা থেকে কম লাগছে না। অর্জুনের ঠোঁটের কোনে প্রশান্তির হাসি। পন্ডিত মশাই সিঁদুর দানের জন্য বললে, অর্জুন সিঁদুরটা পড়িয়ে দেয় অন্নাকে। নাকের উপর ঝুপ করে খানিকটা সিঁদুর পড়ে তার নাকখানা লাল হয়ে যায়। হিসহিসিয়ে তখন অর্জুন বলে,
– আজ হেমনলিনীকে পুরোপুরি নিজের করে নিলাম আমি। তুমি কেবল আমার হেমনলিনী।
লজ্জায় লাল হয়ে উঠে অন্নার মুখখানা। তার ভালোবাসা তার পাশে বসে রয়েছে। এমনই একটা সময়ে তাদের পরিচয় হয়েছিলো কলেজে বটতলায়। সময়টা পানির স্রোতের মতো কেটে গেছে। আরেকটিবার ওই সময়ে ফেরত গেলে হয়তো মন্দ হতো না।
এদিকে ভারী পেটটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণা। ছয় মাস চলছে তার মাত্ৃত্বের৷ পেট খানা বেশ বড় হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে তার জমজ বাচ্চা হবে। একটা মূহুর্ত দেবব্রত তার হাত ছাড়ে না। চিমচে শরীরে জমজ বাচ্চাকে জন্ম দেওয়াটা চারটে খানি কথা নয়। বিয়ের অনুষ্ঠানের মাজেই অবন্তীকা দেবী তার গুনে গুনে পনেরো বার খোঁজ নিয়েছেন। তার বৌ মার চুলপরিমাণ কষ্ট তার সহ্য হয় না। হঠাৎ কিছু বন্ধুদের নিয়ে তার কাছে আসেন নারায়ন বাবু, সবাইকে বেশ গর্ব সহকারে বলেন,
– এই যে আমার বৌ মা, কৃষ্ণাবতী ভট্টাচার্য। আমার বৌমা আমার মেয়ের মতো। আমার পরে আমার ব্যাবসা আমার বৌ মাই দেখবে। ছেলেকে আমার ভরসা হয় না।
শ্বশুরের মুখে এরুপ কথাটা কৃষ্ণা হা হয়ে যায়। অবাক নয়নে দেবব্রতের দিকে তাকালে দেবব্রত চোখ নিয়ে ইশারা করে কৃষ্ণাকে শান্ত করে। নারায়ন বাবু কিছুদিন পূর্বেই দেবব্রতের সাথে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রেগন্যান্ট অবস্থাতেই কৃষ্ণা তার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিলো, এবং খুব তাদের ব্যাচে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছে। কৃষ্ণার রেজাল্ট শুধু কৃষ্ণাকেই নয় বরং সারা ভট্টাচার্য পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে। সেদিন এই সিদ্ধান্তটি নারায়ন বাবু নেন। কিছুদিন পূর্বে রাতে খাবার পর স্ট্যাডি রুমে দেবব্রতকে তিনি ডেকে পাঠান৷ রুমে প্রবেশ করে দেবব্রত ধীর কন্ঠে বলে,
– বাবা, ডেকেছিলেন?
– আসো দেব, সামনে বসো।
নারায়ন বাবু চুরুটে টান দিতে দিতে তাকে একটি চেয়ার এগিয়ে দেন। দেবব্রত চেয়ারে বসতে বসতে বলেন,
– জ্বী বাবা বলুন
– আমি একখানা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ তোমার সিদ্ধান্তটা পছন্দ নাও হতে পারে তবে আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়
– বলুন বাবা
– আমার বয়স হয়েছে দেব, এবার ষাটের উপরে তো সেই কবেই চলে গিয়েছি। এই ব্যাবসা আমি আর চালাতে পারছি না। মস্তিষ্ক কিংবা শরীর কিছুই আমাকে সহায়তা করছে না। আর আমি জানি তুমি আমার ব্যাবসায় কখনোই নিজেকে জড়াবে না। আমার এতো বড় ব্যাবসাকে তো আর অনিশ্চিতের মাঝে রেখে দেওয়া যায় না। তাই আমি চাচ্ছি কৃষ্ণাবতীকে সমস্ত ব্যাবসার দায়িত্ব আমি বুঝিয়ে দিবো।
– বাবা, এতো বড় সিদ্ধান্ত? হঠাৎ?
– জীবনে কম অন্যায় আমি করি নি। সত্যি বলতে এই ব্যাবসা খানা সোমনাথের ত্যাগের ফসল। আমি এতো বড় অন্যায় করবার পরও কৃষ্ণাবতী আমার পরিবারের চিন্তা সর্বদা করেছে। আর আমার আর কোনো সন্তান ও নেই। কৃষ্ণাবতী ই আছে। সে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ বহুবার আমাকে দিয়েছে। তাই আমার ব্যাবসা আমি তাকে বুঝিয়ে দিয়ে চিন্তা মুক্ত হতে চাই। সামনে তোমাদের বাচ্চা আসছে। চাকরির থেকে আমার ধারণা ব্যাবসাতে থাকাটা তার জন্য খানিকটা হলেও ভালো হবে। তুমি আমাকে ভেবে জানিও।
দেবব্রত মাথা নাড়িয়ে স্ট্যাডি রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সেদিন রাতে সে খুব ভালো করে চিন্তা করে। এবং চিন্তা শেষে এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত প্রকাশ করে।
বর্তমান,
কৃষ্ণার হাত জোড়া ধরে নারায়ন বাবু বলেন,
– মারে বুড়ো বাপটিকে ফিরিয়ে দিস না। জানি এই অবস্থাতে এতো বড় বোঝাটা দেওয়াটা ঠিক হয় নি আমার। তবে তোর সিদ্ধান্ত যা হবে আমি মেনে নিবো।
নারায়ন বাবুর কথা শুনে মৃদু কন্ঠে কৃষ্ণা বলে,
– বাবা, আপনি অনুরোধ নয়, আদেশ করবেন শুধু। আমি আপনার সকল আদেশের পালন করবো।
কৃষ্ণার কথা শুনে প্রশান্তির হাসি হাসলেন নারায়ন বাবু। চোখ ছলছল করছে তার। আজ খুব প্রশান্তি লাগছে। বুকে চাপা গ্লানি আজ যেনো নেমে গেছে। এ যেনো অন্যরকম অনুভূতি। মনে মনে বললেন,
” সোম ক্ষমা করে দিস, শ্যামলী ক্ষমা করে দিস”
রাত ২টা,
বিয়ের কর্ম শেষে এখন বাসরের আয়োজন করা হয়েছে অর্জুন এবং অন্নাকে নিয়ে। অন্নার যত ছোট বোন এবং বান্ধবী আছে তারা ঘেরাও করে বসে রয়েছে তাদের। সেই সুবাদে কৃষ্ণাও সেখানে বসে রয়েছে। দেবের লাখ বলার পরও সে অনড়। বাধ্য হয়ে দেবও তার সাথে বসা সেখানে। সবাই হৈহৈ করছে। কেউ গাম গাইছে তো কেউ কবিতা।কৃষ্ণার গাণের গলা সবসম্য বেশ প্রশংসিত।তাই সকলের অনুরোধে সেও গান গাইলো। হঠাৎ পলা নামের একটি মেয়ে বলে উঠলো,
– সবাই গান গেয়েছে, এবার দেব দায়ের পালা। আজ একটা গান গাইতেই হবে তাকে। বৌদির জন্য গান তাকে গাইতেই হবে।
দেবব্রত প্রথমে বাধা দিলেও কৃষ্ণা মৃদু কন্ঠে বলে,
– গাও না
কৃষ্ণার কথায় আর কিছু বললো না দেব। একটু থেমে গানটা ধরলো,
“ভালোবাসি, ভালোবাসি–
এই সুরে
কাছে দূরে
জলে স্থলে বাজায় বাঁশি॥
আকাশে কার বুকের মাঝে
ব্যথা বাজে,
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি॥
সেই সুরে সাগরকূলে
বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে
অকারণে
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি”
কৃষ্ণা এক নজরে দেবব্রতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বিয়ের ছয় বছর পর আজ যেনো সে সত্যিকার অর্থে কৃষ্ণাবতী সাহা থেকে কৃষ্ণাবতী দেবব্রত ভট্টাচার্য হতে পেরেছে। আজ তার নাম বাড়ির প্রতিটা মানুষের হৃদয়ে খচিত। “কৃষ্ণাবতী”। তার ত্যাগের, ধৈর্য্যের আজ পুরষ্কার পাচ্ছে সে। দেবব্রত গান গাইছে আর অপলক দৃষ্টিতে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আহা! এ দৃষ্টিতে কি মায়া, কি ভালোবাসা!
সমাপ্ত