কৃষ্ণাবতী,পর্ব-২,৩
মুশফিকা রহমান মৈথি
২য়_পর্ব
“আমার দেবের বউ” কথাটা শুনে সৌদামিনীর পাগুলো স্থির হয়ে যায়। দেবব্রত তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন অবন্তীকা দেবী এগিয়ে এসে বজ্র কন্ঠে বললেন,
– কি যা তা বলছেন বাবা? দেবের বউ মানে টা কি?
– মানে টা বাংলা ভাষার মতো স্পষ্ট। দেবব্রত যাকে বিয়ে করেছে সেই তো দেবব্রতের স্ত্রী হবে তাই না? আসো বউ মা বরণ করে নেও কৃষ্ণাকে।
প্রদীপ বাবুর নির্বিকার উত্তরে উপস্থিত সবার মুখ হা হয়ে যায়। অজান্তেই টুপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে যায় সৌদামিনীর। অবন্তীকা দেবী ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। সৌদামিনীর সাথে দেবব্রতের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এ কথা প্রদীপ বাবুর অজানা নয়। তবুও এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে নিলেন। আর দেবব্রত ও তার প্রতিবাদ করলো না। কি মুখ থাকবে তবে সৌদামিনীর কাছে তাদের! সৌদামিনী ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ছুটে ভেতরে চলে গেলো। দেবব্রত ও সৌদামিনীর পিছু নিলো। পিছে রয়ে গেলো গাঁটছড়া এবং কৃষ্ণা। ফ্যালফ্যাল নজরে কৃষ্ণাবতী তাকিয়ে রইলো তার মাষ্টারমশাই এর দিকে। বরণ না করলে ঘরের চৌকাঠ যে পেরোতে পারবে না কৃষ্ণা। প্রদীপ বাবু এবার কড়া কন্ঠে বললো,
– অবন্তীকা, বরণ করছো না কেনো বউ কে। বাড়ির বউ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।
– মাফ করবেন বাবা, কোনো কুলগোত্রহীন, চালচুলোহীন মেয়েকে আমি আমার ঘরের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছি না। আমার বাড়ির বউ সৌদামিনী। আর ওই থাকবে।
অবন্তীকা দেবীর দৃঢ় কন্ঠের জবাবে প্রদীপ বাবুর ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে যায়। তার বউ মা এভাবে তার বিরোধীতা করবে এটা যেনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এবার তিনি হুকুমের স্বরে বললেন,
– এ বাড়িতে কি আমার কথার কোনোই দাম নেই? নাকি বুড়ো হয়েছি বলে আমার কথার গুরুত্ব দেওয়াটা জরুরী নয় নারায়ন? যদি সেটাই হয় তবে আমি আর এক মূহুর্ত এই বাড়িতে থাকবো না।
প্রদীপ বাবুর রাগ সম্পর্কে বাড়িতে এমন কেউ নয় যে অবগত নয়। কিন্তু অবন্তীকা দেবীও তার কথায় অবিচল। সে কৃষ্ণাকে এ বাড়ির বউ হিসেবে একেবারেই মানতে নারাজ। বাবা এবং স্ত্রীর মাঝের এ দ্বিমতের যুদ্ধে নারায়ন বাবু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। উপায়ন্তর না দেখে তিনি দেবব্রতের ছোট কাকীমা রীতা দেবীকে কৃষ্ণাকে বরণ করবার আদেশ দিলেন। নারায়নবাবু মনে মনে কৃষ্ণাকে নিজের পুত্রবধু না মানলেও বাবার উপর তার উচ্যবাচ্য করার অধিকার বা শিক্ষা কোনোটাই নেই। এভাবেই সবার অমতের সত্ত্বেও ভট্টাচার্য মঞ্জিলের বড় পুত্রবধু রুপে গৃহপ্রবেশ হলো কৃষ্ণাবতীর; কিন্তু গৃহপ্রবেশ হলেই কি বাড়ির বউ হওয়া যায়! যে জায়গাটা তার নয় সেখানে উড়ে এসে জুড়ে বসলেই তো আর অধিকার পাওয়া যা না। কিশোরী কৃষ্ণা একটু হলেও এটা বুঝতে পারছে। তার মাষ্টারমশাই এর উপর তার অধিকারটুকু অযাচিত! আসলে সৃষ্টিকর্তার লীলা বুঝা যে ভার; তিনি এই পৃথিবীটাকে একটা রঙ্গমঞ্চ হিসেবে যেখানে সবাই তার লিখিত উপন্যাসের এক একটা চরিত্র। তিনি যার জীবন যেভাবে পরিচালনা করতে চাচ্ছেন ঠিক সেভাবেই তার জীবন পরিচালিত হচ্ছে। নিজেদের জীবনের উপর যে এই চরিত্রদের কোনোই অধিকার নেই। এটা জানা সত্ত্বেও মানুষ নিজদের জীবন নিজেদের মতো করে চালাতে চায়, বারবার লাগাতার_______
২.
সৌদামিনী দৌড়ে দেবব্রতের রুমে এসে দরজা লাগাতে যায়, কিন্তু দেবব্রতের গতির সাথে সে পেরে উঠে না। দেবব্রত তাড়াতাড়ি দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে। সৌদামিনীর চোখজোড়া লাল হয়ে আছে, তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ চোখে স্পষ্ট। গ্লানি, অপরাধে ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে দেবব্রতের। এতোটা অসহায়বোধ সে কখনোই করে নি।
– দামিনী আমার কথাটা
– ওখানেই থেমে যা দেব, আমার দিকে পা বাড়াবার অধিকার তুই হারিয়েছিস।
সৌদামিনীর ঠান্ডা কন্ঠে পা জোড়া স্বয়ংক্রিয় কোনো যন্ত্রের মতো থেমে যায়। ভেতরটা ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে সৌদামিনীর। এই মানুষটার জন্য এতোটা সময় অপেক্ষা করেছিলো সে, কিন্তু তার প্রতিদান যে এমন হবে এটা তার অজানা ছিলো। চোখগুলো জ্বলছে, কিছুতেই পানিধারা আটকে রাখতে পারছে না। ভাঙা কন্ঠে অভিযোগ করে উঠে,
– আমার সাথে এমনটা কেনো হলো দেব? আমি বুঝি খুব পাপী একজন মানুষ? আমার সাথে এমনটা কেনো হলো?
– দামিনী আমাকে ক্ষমা কর, ক্ষমা কর
– ক্ষমা? দুই অক্ষরের এই শব্দটা কি আমার জীবনটাকে পুনরায় সাজিয়ে দিবে দেব?
সৌদামিনীর প্রশ্নের উত্তর দেবব্রতের কাছে নেই। কি উত্তর দিবে সে। সেও যে পরিস্থিতির শিকার ছিলো। সৌদামিনী দৃঢ় কন্ঠে বললো,
– আমি তোর বাগদত্তা ছিলাম দেব। আমাদের আশীর্বাদ হয়েছিলো। কেনো করলে এমন? কেনো?
ছুটে যেয়ে দেবব্রতের পাঞ্জাবীর কলার ধরে জিজ্ঞেস করতে লাগলো সৌদামিনী। সৌদামিনীর চোখের জল দেবব্রতকেও আসক্ত করে ফেললো। পুরুষের কাঁদতে নেই। কিন্তু তার চোখ ও ছলছল করছে। বিনীত গলায় বললো,
– মেয়েটা যে অসহায় ছিলো দামিনী, কি করতাম বল? লগ্নভ্রষ্টা হবার দায়ে তাকে আত্নহত্যার পথ বেছে নিতে হতো, আর কোথাও না কোথাও সেটার দায়ভার আমার উপর ও বর্তাতো। এবোভ অল দাদানের সম্মানের ও একটা প্রেসার ছিলো। সে সবার সামনে বড় গলায় কথাটা বলেছিলো।
– বেশ, এখন তো আর লগ্নভ্রষ্টা নয় সে। তবে কেনো তোর সাথে এ বাড়ি অবধি এলো। রেখে এতি তাকে গ্রামে।
– দামিনীইইইই, কি বলছিস তুই? আমার দায়িত্ব সে।
– আর আমি? আমি বুঝি কিছু নই দেব? তার আর আমার মাঝে পার্থক্য কি দেব? এটুকুই না তার সিঁথিতে তোর নামের সিঁদুর আছে! সে তোর সাথে মন্ত্র পড়ে বিয়ে করেছে! তার হাতে শাখা পলা আছে! এগুলো তো আমার ছিলো দেব। আমার একান্ত, আমার জিনিস অন্যকে দিয়ে দিবো আমি? এসবের জোরেই তো ও তোকে আমার থেকে কেড়ে নিলো, কেঁড়ে নিলো।
বলতে বলতে বসে পড়লো সৌদামিনী। দু হাত দিয়ে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো সে। তার চাপা আর্তনাদ দেবব্রতকে গলাতে যথেষ্ট ছিলো। হাটু গেড়ে বসে আলতো পরশে সৌদামিনীর মুখটা তুলে ধরে দেবব্রত। চোখের অশ্রুগুলো মুছিয়ে শান্ত গলায় বলে,
– এতো সহজ কাউকে কেড়ে নেওয়া? তুই এখনো আমার দামিনী।
– কিন্তু তুই যে আমার দেব নস, তুই আমার দেব নস।
দেবব্রতের বুকে মুখ গুজে কথাগুলো বললো সৌদামিনী। দেবব্রত পারছে না বুকচিরে তাকে আশ্বস্ত করতে। তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে যে শুধুই সৌদামিনী হয়েছে। তার প্রথম ভালোলাগা, প্রথম ভালোবাসা। ঘরের চার দেয়ালের ভেতরের আর্তনাদ, দুঃখবিলাপ কেউ না জানলেও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি ঠিক বুঝতে পারছে। কিশোরী কৃষ্ণা দাদানের কথা মত দেবব্রতের দরজার কাছে তো চলে এসেছে কিন্তু ঘরে ঢোকার সাহস কিংবা অধিকার কিছুই তাকে দেবব্রত দেয় নি। সে এখন সৌদামিনীকে শান্ত করতে ব্যস্ত। বর, স্ত্রী, ঘর সংসার সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলেও মামী তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন সে একজন পোড়াকপালী। যাকে আঁকড়ে ধরতে চাইবে সেটাই তার থেকে দূর হয়ে যাবে। তাই হয়তো মাষ্টারমশাই ও তার একান্ত নয়। তার উপর তার অধিকারে পূর্বে অন্য নারীর অধিকার আছে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কোথায় যাবে বুঝে উঠে না কৃষ্ণা। সেখানে হাটুগেড়ে গুটিশুটি মেরে বসে রয়। ঠান্ডা টাইলস এর ফ্লোরে বসতে প্রথমে বেশ কষ্ট হলেও বেশি বেগ পেতে হয় না তার। কারণ মামীর বাড়িতে ঠান্ডা মাটিতে ঘুমাতে হতো তার। গতকাল থেকে এই অবধি কম ধকল যায় নি মেয়েটির উপর। হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ে তার ঠিক থাকে না কৃষ্ণার।
বেশ কিছুক্ষণ পর সৌদামিনী উঠে দাঁড়ায়। দৃঢ় কন্ঠে বলে,
– আমি সতীনের ঘর করবো না দেব। হয় সে, নয় আমি। একজনকে বেছে নিতে হবে তোর।
– আমি কৃষ্ণাকে ছাড়তে পারবো না দামিনী। সে আমার দায়িত্ব। আমি যে মানুষটা দায়িত্ব কখনোই এড়াই না, কথাটা তোর অজানা নয়। বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়। হোক পরিস্থিতির দায়ে
– তুই আমাকে ছাড়তে পারবি? আমাকে দেয়া কথা ভাঙ্গতে পারবি?
সৌদামিনীর প্রশ্নের উত্তরগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে দেবব্রতের। চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। এরপর শান্ত গলায় বলে,
– ক্ষমা চাওয়ার মুখ হয়তো নেই আমার। তবে পারলে ক্ষমা করে সামনে এগিয়ে যাস। আমাদের রাস্তা এখন রেলগাড়ির লাইনের মতো হয়ে গেছে। একসাথে চলতে পারলেও এক হওয়াটা সম্ভব নয়। কষ্ট হচ্ছে, হবে; কিন্তু তোকে ছাড়া বাঁচবো না এমনটা তো নয়। তবে দায়িত্ব আমি এড়াতে পারবো না। এমন তো কথা নেই দায়িত্বকে ভালোবাসা লাগবে।
দেবব্রতের শান্ত কথাগুলো সৌদামিনীকে আরো দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে ফেলছে। আসলে তার দেব আর তার নয়। এখন সে কৃষ্ণার বর। আর বিয়ে নামক সম্পর্কের পবিত্রতার কাছে ভালোবাসাও মাঝে মাঝে হেরে যায়। সৌদামিনী এক মূহুর্ত আর সেখানে দাঁড়ায় না। নিথর পাগুলো মনের বিরুদ্ধে চালিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। দরজা খুলতেই দেখে দরজার বাহিরে দেবব্রতের নববধু ফ্লোরে গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে। পুতুলের মতো একটি মেয়ে। দূর্গা প্রতিমার মতো মুখের ধরণ, চোখে মুখের তেজ ই আলাদা, কিন্তু নিতান্ত স্নিগ্ধ একটা কিশোরী নিচে বসে রয়েছে। দরজা খুলতেই কৃষ্ণার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কৃষ্ণা অবাক চোখের চাহনী আরোও রাগ ধরিয়ে দেয় সৌদামিনীর মনে। হিংসা, বিদ্বেষ, দুঃখ, প্রতারণায় সে যেনো অন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েটির করুণ মুখ ও তার মনে দয়া জাগাতে পারলো না। তীব্রগতিতে টেনে তুলে ফ্লোর থেকে তাকে। তারপর……………
চলবে
#কৃষ্ণাবতী
#৩য়_পর্ব
হিংসা, বিদ্বেষ, দুঃখ, প্রতারণায় সে যেনো অন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েটির করুণ মুখ ও তার মনে দয়া জাগাতে পারলো না। তীব্রগতিতে টেনে তুলে ফ্লোর থেকে তাকে। তারপর কর্কশ কন্ঠে বলে,
– এই ভালোমানুষি চেহারার ভেতরে এতো ঘৃণ্যতম মানুষ রয়েছে সেটা আমার জানা ছিলো না। এতো ছোট বয়সে পেটে পেটে এতো শয়তানি? এতোটা স্নিগ্ধ চেহারার আড়ালে সর্বগ্রাসী একজন নারী রয়েছে সেটা কেউ না জানলেও আমি জানতে পেরেছি। মানুষকে অসহায়ত্বের দোহায় দিয়ে অন্যের সুখ কাঁড়লে আদৌও সুখী হওয়া যায় তো?
সৌদামিনীর কথাগুলো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে শুনছিলো কৃষ্ণা। তার মনষা কখনোই কারোর সুখ কারা ছিলো না। তবুও সেই দোষের আরপ তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে অসহায় স্বরে সে বললো,
– সত্যি বলছি দিদিমনি আমি কিছু করি নি।
– আমার জীবন নরক বানিয়ে এখন বলছো কিছুই করো নি।
চোয়াল শক্ত করে কথাটা বলে সৌদামিনী। ভালো মন্দের বিচার জ্ঞানটুকু হারিয়েছে সে। কৃষ্ণার বাহু সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেপে ধরলো সে। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো কৃষ্ণা। তবুও দয়া হচ্ছে না সৌদামিনীর। তখনই তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয় দেবব্রত কৃষ্ণাকে। কঠোর কন্ঠ্র বলে,
– আমার রাগ এই অসহায় নির্দোষ মেয়েটাকে কেনো দিচ্ছিস দামিনী? এতোটা নিচ মন-মানসিকতার মানুষ তো তুই ছিলি না?
– এই কালনাগিনীর জন্য আজ আমি নিচু হয়ে গেলাম তোর চোখে দেব?
সৌদামিনীর প্রতিবাদী কন্ঠের প্রশ্ন শুনে ভ্রু যুগল কুচকে গেলো দেবব্রতের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে শান্ত কন্ঠে বললো,
– তুই যা করছিস তা কি আদৌ সুস্থ মানুষের কর্ম? ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলতো দামিনী? একজন শিক্ষিকা এরুপ ব্যাবহার করলে কি তার সম্মান বাড়ে? আমার উপর তোর রাগ, দোষ যদি কারোর থাকে সেটার শতভাগ না হলেও কিছুটা তো আমার। তুই আমাকে যা খুশি বলতে পারিস কিন্তু এই মেয়েটাকে কিছু বলার অধিকার আমি অন্তত দেই নি।
দেবব্রতের কথা শুনে সৌদামিনী থমকে যায়। দেবব্রতের সাথে তার সম্পর্কটা প্রেমের কম বন্ধুত্বের বেশি। সে ছোটবেলা থেকে তাদের এই বন্ধুত্ব। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি পার হলেও এই বন্ধুত্বটা এখনো অটল। সেই সুবাদেই এই ভালোবাসার সূচনা। মনের অজান্তে কবে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে সেটা সৌদামিনী নিজেও জানে না। তার মনে সবসময় দেবব্রতের জায়গাটা বন্ধুত্বের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো। দেবব্রতের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপারটা ঘটেছে। বন্ধুর থেকে ভালো জীবনসাথী আর কেউ হতে পারে না বলে তার ধারণা ছিলো এবং এই বন্ধুত্বটাকে সারাটাজীবন অটল রাখার এর থেকে ভালো উপায় তার জানা ছিলো না। একারণেই এই বন্ধুত্বটাকে ভালোবাসার জায়গা দিয়েছিলো দেবব্রত। সৌদামিনী ব্যাতীত কোনো মেয়েকে নিজের হৃদয়ের ধার ঘেষতে দেয় নি সে। অথচ আজ কৃষ্ণার অপমানের বিরোধীতা করে সেই সৌদামিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দুবার চিন্তা করে নি দেবব্রত। দেবব্রতের পরিবর্তনটুকু যেনো একেবারেই মানতে পারছে না সৌদামিনী। মনে হচ্ছে তার কলিজায় কেউ ভোঁতা ছুরিঘাত করছে। বিদ্রুপের হাসি ঠোঁটে টেনে সৌদামিনী ধীর কন্ঠে বললো,
– বাহ! আমি সত্যি তোর প্রশংসা না করে পারছি না দেব। কতটা বদলে গেছো একটা দিনে। তুই সত্যি আমার দেব আর নও। অভিশাপ আমি তোকে দিবো না। সুখে থাক এই কামনাই করবো। আর তোমাকে বলবো কৃষ্ণা, মাথায় গেথে নাও। মানুষ সেটাই পায় যা তার ভাগ্যে লেখা থাকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধে অন্যের জিনিস কাঁড়লে সেটা ক্ষণিকের জন্য তোমার হলেও সেটা চিরস্থায়ী হয় না। অভিশাপ দিচ্ছি না, বাস্তবতা বলছি। এই সিঁদুর, শাখা পলা আমার ছিলো। তুমি অযাচিত ভাবে তা কেড়েছো। কেড়েছো বললে ভুল হবে, পরিস্থিতি তোমার ভাগ্যে দিয়ে দিয়েছে। সামলে রেখো। এমন না হয়, এই সিঁদুরটুকু তোমার ভাগ্য থেকে অন্যের ভাগ্যে চলে যায়।
সৌদামিনীর কথাগুলোর মর্মার্থ কৃষ্ণা না বুঝলেও দেবব্রতের বুঝতে বাকি রইলো না। সৌদামিনী তাকে কথার ছলে প্রতারক দাবি করেছে, যে শুধু সময়ে সময়ে নারী পরিবর্তন করে। চাইলে কথাটা প্রতিবাদ সে করতেই পারতো কিন্তু করাটা যৌক্তিক মনে হয় নি তার। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো দেবব্রত। কথাটা শেষ হতেই গটগট করে বেরিয়ে গেলো সৌদামিনী। দেবব্রত সৌদামিনীর যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। বুক থেকে হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই। কৃষ্ণা তখন ধীর গলায় বললো,
– দিদিমনি আপনার উপর রাগ করেছেন মাষ্টারমশাই, তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। সাথে আপনিও; আপনি তার রাগ ভাঙ্গাবেন না?
কৃষ্ণার সরল মনের প্রশ্নে স্মিত হাসি ঠোঁটের কোনে টেনে দেবব্রত উত্তর দেয়,
– তার রাগ ভাঙ্গাতে গেলে যে আমাকে পাপ করতে হবে। তা যে আমি করতে পারবো না কৃষ্ণা। সবার ভাগ্যে সব সুখ যে লিখিত থাকে না। তুই নিচে বসেছিলি কেনো?
– দাদান আমাকে আপনার ঘরে যেতে বললেন, তাই সোমা মাসি আমাকে এ ঘর অবধি নিয়ে এলেন। তখন তো দিদিমনির সাথে আপনি একান্ত ব্যাক্তিগত কথা কচ্ছিলেন তাই আর ঘরে ঢুকার সাহস পাই নি। আর পা টা ব্যথা করছিলো তাই এখানেই বসে পড়লাম।
– আমার ঘরে তোর ঠাই যে হবে না কৃষ্ণা।
দেবব্রতের কথার জন্য যেনো আগ থেকেই প্রস্তুত ছিলো সে। তাই জড়তাবিহীন স্বরে বলে উঠলো,
– তাহলে আমি সোমা মাসির সাথে থাকবো?
– সোমা মাসির সাথে থাকতে যাবি কেনো রে?
– সোমা মাসি খুব ভালো, আমাকে এই ঘরে দেবার আগে তিনি বললেন, “যদি বড় বাবুর ঘরে তোমারে ঢুকতি না দেয়; আমার ঘরে চলি আইসো”
কৃষ্ণার সরল মনের হাতছানি দেবব্রতের জটিল আঘাত জর্জরিত মনেও শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। এই মেয়েটার সাথে ভাগ্য থাকে বেঁধে দিয়েছে। এতে কারোর কোনো হাত নেই। ভাগ্যের সাথে যুদ্ধ করার মতো মনোবল বা শক্তি তার নেই, এই বিরুপ পরিস্থিতিতে মেয়েটাকে একা লড়াই করার জন্য ফেলে আসাটা কি কাপুরুষত্ব হতো না? না সে যা করেছে ঠিক করেছে। কেউ না বুঝলেও সে তার কাছে সঠিক। ওই লম্পট, মাতাল, দেহলোভী মানুষটা এই কিশোরী মেয়েটার সরলতা নিজের কুচিন্তার চাপে পিষে ফেলতো। তখন এই ফুলের মতো নিষ্পাপ কৃষ্ণার জীবনটা কর্পুরের মতো উবে যেতো। থাকতো খালি একরাশ কষ্টের ছাই। নিজের মনকে শান্তনা দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমি কেনো আমার ঘরে ঠায় দিচ্ছি না জানিস?
– না
– কারণ তুই এখনো ছোট। তোর সাথে আমার সম্পর্কটা স্বামী স্ত্রীর হলেও কিছু জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তারমধ্যে প্রথম কথা হলো তুই এখনো পূর্ণবয়স্ক নস আর দ্বিতীয় কথা আমার মন থেকে তোকে নিজের স্ত্রী মানতে কষ্ট হচ্ছে। আমাদের বিয়েটা পরিস্থিতির শিকার। পরিস্থিতির তাড়ণায় আমার তোকে বিয়ে করতে হয়েছে। তোর কাছে লুকিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, আমার দামিনীর সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। আজ এই বিয়েটা না হলে কিছুদিন অর দামিনীই আমার স্ত্রী হতো। এখন কথা হচ্ছে আমি তাহলে কেনোই বা তোকে বিয়ে করলাম আর কেনোই বা এই অযাচিত সম্পর্কটাকে নাম দিচ্ছি। বিয়ে করেছিলাম দাদানের ইজ্জতের খাতিরে আর সম্পর্কটাকে বয়ে নিচ্ছি দায়িত্বের খাতিরে। যতদিন না তুই বড় হচ্ছিস কিংবা আমার মতো গড়ে উঠছিস ততোদিন তুই আমার বাড়ি থাকলেও সমাজে আমি এই সম্পর্কের কোনো স্বীকৃতি দিতে পারবো না। আমার কথাগুলো পাষন্ডের মতো লাগছে কিন্তু এটা বাস্তব।
-……
– তোর বয়স এখন পড়ালেখা করার, নিজের এই কাঁদামাটির আদল পরিবর্তন করে সত্যিকারের মানু্ষরুপে গড়ে তোলা। এই সংসারের “স” টুকুও বোঝার ক্ষমতা তোর নেই। এমন ও হতে পারে এই সম্পর্কটা তোর ভবিষ্যতের একটা কাঁটা স্বরুপ হয়ে উঠলো। তাই এই সম্পর্কের স্বীকৃতি না দেওয়া উভয়ের জন্যই যথার্থ। তোর এতে আপত্তি আছে?
কৃষ্ণা মাথা নাড়িয়ে নাবোধক উত্তর দিলো। কিন্তু কোথাও যেনো একটা শূন্যতার বিস্তার ঘটলো, কিশোরী মনে পুনরায় না পাবার হাতছানি দাগ কেটে গেলো। দেবব্রত তখন তার চাচাতো বোন অন্নাকে ডেকে আনে। দেবব্রতের দুটো চাচাতো বোন রয়েছে। স্বর্ণা এবং অন্না। স্বর্ণার বিয়ে হয়ে গিয়েছে এবং অন্না কৃষ্ণার বয়সী। মেয়েটি খুবই মিশুক। অন্না আসলে দেবব্রত বলে,
– বৌদি আজ থেকে তোর কাছে থাকবে। ওর খেয়াল রাখবি।
– ও তো আমার সমান। ওকে আমার বৌদি বলতে হবে কেনো?
– থাপ্পড় খাইছিস? ও তোর ছোট হলেও ও তোর বৌদি।
দেবব্রতের কড়া বাক্যে চুপ মেরে যায় অন্না। তবে মনে মনে নিজের সমবয়সী কাউকে পেয়ে বেশ খুশি খুশি লাগছে আবার। আবার প্রিয় সৌদামিনী দিদিকে আর বৌদি বলা হবে ভেবেও কষ্ট লাগছে। মনের এমন ভিন্ন ভিন্ন ভাবান্তরের জন্য খুবই দ্বিধায় পড়ে গেছে অন্না। এদিকে তার জ্যেষ্ঠীমাও কৃষ্ণাকে এ বাড়ির বউ হিসেবে মানে না, তবুও দাদাভাই এর কঠোর উক্তি মানতে কৃষ্ণাকে তার বৌদি বলেই ডাকতে হবে। কি দোটানা পরিস্থিতি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেচারা মুখে বললো,
– চলো বৌদি, আমার রুমে চলো।
কৃষ্ণা গোবেচারার মতো মাথা নাড়িয়ে অন্নার পিছু নিলেও থেমে যেয়ে পিছন ফিরে বলে,
– আচ্ছা মাষ্টারমশাই কোনোকালে যদি আমি আপনার যোগ্য হয়ে উঠতে পারি তবে কি সমাজের সামনে আমার হাত গর্বের সাথে বলবেন “ও আমার স্ত্রী কৃষ্ণাবতী দেবব্রত ভট্টাচার্য”?
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসু চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। ঠিক কি উত্তর দিবে দেবব্রত বুঝে উঠতে পারছে না। সে কি সত্যি কৃষ্ণাকে নিজের স্ত্রীর জায়গাটা দিতে পারবে!!!
৩.
দরজায় টোকা দিয়ে বিনীত কন্ঠে নারায়ন বাবু বলেন,
– বাবা কি ঘুমোচ্ছেন?
– না ভেতরে আসো নারায়ন।
চাদরটা পেচিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসেন প্রদীপ বাবু। এই সত্তর বছরে এতো ধকলটা শরীর মানতে চাচ্ছে না। নারায়ন বাবু ঘরে প্রবেশ করে তার পাশে বসলেন। মুখে চিন্তার ছাপ। মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু বাবাকে কিভাবে প্রশ্নটা করবে বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। তখন প্রদীপ বাবু ধীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
– প্রশ্ন করতে এই রাতে ছুটে এয়েছো যখন প্রশ্নটা করে ফেলো নারায়ন
– সব জানা সত্ত্বেও কেনো ওই মেয়েকে দেবব্রতের ঘাড়ে উঠালেন বাবা? সৌদামিনীর ব্যাপারটা তো আপনার অজানা নয়। আমি এখন অনুরাগকে কি উত্তর দিবো বলুন বাবা?
নারায়ন বাবুর কথাগুলো চুপ করে শুনলেন প্রদীপ বাবু। এরপর ঠোঁটে হাসি একে বললেন,
– তোমার ঋণ পরিশোধের সময় এসেছে যে নারায়ণ। ভুলে যাচ্ছো কেনো শ্যামলীর কাছে আমরা দায়বদ্ধ…..
চলবে