কৃষ্ণাবতী
সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১.
“নাকের উপর সিঁদুর পড়লে বরেরা খুব সোহাগ করে” – কথাটা ঠাম্মা, দিদিমাদের কাছে বেশ প্রচলিত। কিন্তু যে মানুষটার সারাটা হৃদয় জুড়ে অন্যনারীর বাস, তার কাছ থেকে সোহাগ পাবার আশা করাটাও বৃথা কৃষ্ণার জন্য। সিথি ভর্তি সিঁদুর নিয়ে মন্ডবে বসে রয়েছে কৃষ্ণা, তার পাশে তার মাষ্টারমশাই আর সামনে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড যাকে কেন্দ্র করে সাত পাক ঘুরে নিজের সিঁথিতে মাষ্টারমশাই এর নামের সিঁদুর পড়েছে সে। দেবব্রত এক দৃষ্টিতে অগ্নিকুন্ডের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অগ্নিকুন্ডের জ্বলন্ত আগুনের ন্যায় তার হৃদয় ও দাওদাও করে জ্বলছে। কিন্তু দাদানের কথার উপর কথা বলার সাধ্যি তার নেই। আচ্ছা কারোর হিত করতে যেয়ে যে নিজের ই অহিত হয়ে যাবে তা কি সে জানতো! সেতো ওয়াদা বদ্ধ, কাউকে কথা দিয়েছিলো সে। সেই কথা যে আজ রাখতে পারলো না দেবব্রত। পাশ ফিরে মেয়েটার দিকে একটাবার দৃষ্টি দিলো সে। মাথাটা নিচু করে অসহায় মুখে বসে রয়েছে সে। কৃষ্ণার নিয়তির হাতে যে তার ও হাত নেই।
কৃষ্ণাবতী সাহা, মেয়েটির বয়স কেবল সতেরো। শ্যামলী দেবী অর্থাৎ তার মার মৃত্যুর পর তার মামা রিপন বাবুই তার দায়িত্ব নিয়েছিলো। কৃষ্ণার জন্মের পর থেকে বাবার মুখ দেখে নি। মা কষ্ট পাবে বলে কৃষ্ণাও জিজ্ঞেস করে নি কখনো। দেবব্রত এর সাথে তার পরিচয় এক মাস হয়েছে। দেবব্রত ভট্টাচার্য এগ্রামে এসেছে তার দাদানের সুবাদে। তার দাদান প্রদীপ ভট্টাচার্য গ্রামের মোড়লদের একজন। প্রদীপ বাবু গ্রামের উন্নয়নের জন্য একটি কলেজ তৈরি করেছেন। সেখানের সাহায্য করবার জন্য তিনি দেবব্রতকে তিনি ডেকেছেন। দেবব্রত পেশায় কলেজের শিক্ষক, তাই দাদুকে সহায়তা করতেও সে ছুটে গিয়েছে। সেখানেই শিক্ষক হিসেবে কৃষ্ণার সাথে দেবব্রতের পরিচয়। কৃষ্ণার মামী সুলক্ষণা দেবী, নিজের মাতাল ভাই সুদীপের সাথে কৃষ্ণার বিয়ে ঠিক করেন। সুদীপ বাবুর বয়স এখন চল্লিশে ঠেকেছে। কয়েকমাস আগে তার বউ মারা গিয়েছে, তখন থেকে কৃষ্ণার প্রতি লোভ তার। কচি মেয়েকে নিজের হাতে পাওয়ার ছক কষেছে সুলক্ষণা দেবীর সাথে। রিপন বাবু তার বিরোধীতা করতে গেলে চরমভাবে হেনস্তা করেছেন সুলক্ষণা দেবী। কৃষ্ণার অমত সত্ত্বেও ওই পাষন্ড সুদীপ বাবুর সাথে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় তাকে। তখনই তাতে বাধ সাধে দেবব্রত। কৃষ্ণার বান্ধবীরা যখন দেবব্রতকে ব্যপারটি জানায় তখন ই সে এই বিয়েতে বাধা দিবে বলে মনোস্থির করে সে। কৃষ্ণার মতো ছাত্রীর সাথে এমন অন্যায় হতে দেখেও চুপ থাকলে নিজেকেই যে আর শিক্ষক হ্লবলে দাবি করতে পারবে না সে। প্রদীপ বাবুর সহায়তায় ওই মাতালকে বিতারিত করে সে। তখন ই হিনহিনে গলায় সুলক্ষণা দেবী বলে উঠেন,
– হায় হায় মাইয়াটা আমার লগ্নভ্রষ্টা হলো রে। এখন এই মেয়েরে কার সাথে বিয়ে দিমু আমি। কৃষ্ণা মুখিপুড়ি তোর দ্বারা এটাই সম্ভব। বাপ তো কে তার নেই ঠিক, মাটাকেও খেয়েছিস। এখন লগ্নভ্রষ্ট হয়ে মামার ঘাড়ে বসে রইবি। হায় হায়
– থামো না সুলক্ষণা
– কি থামো, আমার ও দুটো মেয়ে আছে। এই মুখপুড়ির জন্য তাদের কপালটাও পুড়লো। শহরের বাবুর কি আসে যায়, তিনি তো আমার ভাইটারে পিটিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছেন। এখন মেয়ের কপাল পুড়লো সেটার কি হবে।
সুলক্ষণা দেবীর মরা কান্নায় প্রদীপ বাবুও চিন্তায় পড়ে যান। দেবব্রত চাইলেও কাউকে বুঝাতে পারছে না এটা কিছুই নয়। এই বিয়ে হলে বরং কৃষ্ণার অহিত হতো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রদীপ বাবু একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন,
– কৃষ্ণা লগ্নভ্রষ্ট হবে না। এই মন্ডলে এই সময়েই কৃষ্ণার বিয়ে হবে।
– কিন্তু এতো জলদি বর পাবেন কথায় মোড়লবাবু?
গ্রামের এক মহিলা বলে উঠলেন। প্রদীপবাবু তখন ধীর গলায় বললেন,
– কেনো আমার নাতি তো আছে। দেব বিয়ে করবে ওকে।
প্রদীপ বাবুর কথায় মাথায় যেনো বাজ পড়ে দেবব্রতের। এমন তো কথা ছিলোনা। সে তো এই বিয়ে করতে পারবে না। তার জন্য তো অন্য কেউ অপেক্ষা করছে। সেটার কি হবে! ফ্যালফ্যালিয়ে প্রদীপ বাবুর দিকে তাকালো দেবব্রত। প্রদীপ বাবু মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি অনড়, তার চিন্তা পরিবর্তন হবে না। দাদানের মুখ রক্ষার্থে এই বিয়েটা তাকে করতেই হলো।
সিঁদুর মাথায় কৃষ্ণা বসে রয়েছে, আজ এ বাড়িতে থাকার নিয়ম। তাই দেবব্রতের ও বাধ্য হয়ে এখানেই বসতে হয়েছে। বেশ কিছু মেয়ে-ছেলে এখানে আয়োজন করেছেন সারা রাত আড্ডা দিবে তাই। দেবব্রতের ইচ্ছে হয়ে সব ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে। কিন্তু সে অপারগ।
– জামাই বাবু আমাদের কৃষ্ণা কিন্তু খুব ভালো গান গায়। এই কৃষ্ণা আমাদের জামাইবাবুকেও তোর গুণের একটা ঝলক দেখা।
কৃষ্ণার মামাতো বোন শিপ্রা কথাটা বলে উঠে। মুখে খুব কষ্ট করে একটা হাসি টেনে দেবব্রত বলে,
– আমার বলায় কি আসে যায়!
– আরে জামাইবাবু আপনার বলাতেই তো আসে যায়। আমরা তো এখন পর হয়ে গেছি, আপনি তো এখন ওর পরম আপনজন বলে কথা।
কথাটা বলেই সবাই হাসতে থাকে। কৃষ্ণার মুখে লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। আড়চোখে তার বরটাকে এক নজর দেখে নেয় সে। দেবব্রত দেখতে খুবই সুদর্শন একটি পুরুষ। ছাব্বিশ বছরের যুবক সে, যেমন লম্বা তেমন দেহের গড়ণ। ফর্সা কপালে চুলগুলো পড়ে রয়েছে। মাতাল করা চোখের চাহনী। টোপর মাথায় মাষ্টারমশাইকে এতো সুন্দর লাগছে যে বেহায়া চোখজোড়াকে সরাতে পারছে না কৃষ্ণা। হঠাৎ দেবব্রত তার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো তাদের। কৃষ্ণা তড়িৎগতিতে চোখ সরিয়ে নিলো। দেবব্রত ঠান্ডা গলায় বললো,
– গাও তাহলে একটা গাণ, শুনি। যদি মনটা ঠান্ডা হয়।
দেবব্রতের কথাটা যেনো বুকে যেয়ে লাগে কৃষ্ণার। এতো অসহায় চাহনী যেনো সে যুদ্ধে ক্লান্ত সৈনিক। সত্যিই মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে দেবব্রত। কৃষ্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুর তুলে,
“আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও
তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চায় গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়”
অবাক নয়নে দেবব্রত কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে রইলো। এতো মধুর কন্ঠে কেউ গান গাইতে পারে এটা যেনো তার জানা ছিলো না। কৃষ্ণার কন্ঠে গান শুনে মনের মাঝে শীতল পরশ যেনো বয়ে গেলো। হুট করেই মনটা ঠান্ডা হয়ে গেলো। সারারাত গান আড্ডায় কাটলো তাদের। এক পর্যায় কৃষ্ণা ঘুমের ঘোরে দেবব্রতের কাধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেলো। দেবব্রতের রাতটাই শুধু নির্ঘুম কাটলো। তার শহরে যাবার দিন যে ঘনিয়ে আসছে। কি করবে সে!
সকাল এগারোটা,
মুখোমুখি বসে রয়েছে প্রদীপ বাবু এবং দেবব্রত। দেবব্রত আজই ঢাকা যাবে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে আজ সকালেই ফিরেছে সে৷ ঘরে ঢুকতেই কৃষ্ণার গাঁটছড়া তার হাতেই ধরিয়ে হাটা দিলো দেবব্রত। একজন কাজের মহিলা সীতা মাসি কৃষ্ণাকে বরণ করে ঘরে নিয়ে যান। কৃষ্ণাও বাধ্য বাচ্চার মতো তার পিছু পিছু যায়।
– দাদান আমি ঢাকা যেতে চাচ্ছি। এবং সেটা আজ ই
ভনীতা ব্যতীত দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো দেবব্রত। প্রদীপ বাবুও শান্ত গলায় বললেন,
– বেশ তো কৃষ্ণাকে নিয়ে যাও।
– দাদান তোমার কাছে তো কিছুই অজানা নয়। তবে কেনো আমাকে এইভাবে একটা সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করলে যেখানে আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। সম্পর্কটা আমার গলার কাঁটা স্বরুপ বিধে আছে দাদান! আমি যে অপারগ।
– দাদুভাই, মেয়েটা অসহায়। শ্যামলীর মৃত্যুর পর থেকে কতটা বঞ্চনার শিকার হয়েছে মেয়েটা তোমার ধারণার বাহিরে। এমন অবস্থায় তুমি ও তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে এটা আমি কখনোই আশা করি নি দাদুভাই। তুমি তো দায়িত্বজ্ঞানহীন নও। মেয়েটাকে বিধি মেনে বিয়ে করেছো তুমি৷ ও তোমার দায়িত্ব তোমার স্ত্রী সে। তুমি যেখানে যাবে কৃষ্ণাবতীও তোমার সাথে যাবে। এ নিয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাইছি না।
বলে প্রদীপ বাবু উঠে দাঁড়ালেন। দেবব্রত এমন একটি দ্বন্দের মুখোমুখি হয়েছে যেখানে এক পাশে তার দায়িত্ব তো অন্য পাশে তার ভালোবাসা। দায়িত্ব সে এড়াতে অপারগ আর ভালোবাসা সেটাকে এড়ালে যে নিজ স্বত্ত্বাকে মেরে ফেলতে হয়। মাথার রগ ফুলে উঠছে তার। সব ভেঙ্গে তছনছ করে ফেললে হয়তো রাগটা কমতো, দুহাতে মাথা চেপে বসে রইলো দেবব্রত। ভবিষ্যতের আভাস পেতেই বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হতে লাগলো, এ ব্যাথা যে অসহ্যকর যন্ত্রণা____
ভট্টাচার্য মঞ্জিল,
রাত আটটা,
আজ দেবব্রত ফিরবে জানিয়েছে। দেবব্রতের মা অবন্তীকা দেবী তার ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করেছেন। একটা মাস পর বাড়ি ফিরছে গ্রাম থেকে। এদিকে তার স্বামী নারায়ণবাবু তার বন্ধুর মেয়ে সৌদামিনীকে বাসায় ডেকেছেন। এ বাড়ির হবু বৌ সে, দেবব্রতের সাথে রীতিমতো আশীর্বাদ হয়ে গেছে। এক কথায় বলা যায় এ বাড়ির বৌ ই সে। বিগত একটা মাস দেবব্রতের সাথে কথা হয় নি তার। দেবব্রত নামক মানুষটাকে যে এক মাসে কতোটা মিস করেছে তা হয়তো বলে বুঝানো যাবে না। তাই নারায়নবাবুর কথায় সকাল থেকেই এখানে এসে পড়েছে সে। আজ যেনো সময় কাটতেই চাচ্ছে না সৌদামিনীর। অপেক্ষা শুধু দেবব্রতের ঘরে ফিরার। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে অপেক্ষার প্রহরের অন্ত ঘটলো সৌদামিনীর। দরজা খুলতেই দেখলো প্রদীপ বাবু এবং দেবব্রত। চোখে মুখে ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠলো সৌদামিনীর। দেবব্রতের দিকে এগিয়ে আসতেই, দেবব্রতের পেছন থেকে লাল বেনারসি পরিহিত একজন মেয়ে সামনে এলো। সিঁথি ভর্তি সিঁদুর, হাতভর্তি শাখা পলা, গাঁটছড়া আর সিঁদুরের কৌটা শক্ত করে ধরে রেখেছে মেয়েটি। সৌদামিনী যেনো কিছুই বুঝে উঠছে না। তখনই প্রদীপবাবু হাক দিয়ে বললেন,
– কই তোমরা নতুন বউ ঘরে এসেছে বরণ করবে না। আমার দেবের বউ এসেছে।
“আমার দেবের বউ” কথাটা শুনে সৌদামিনীর পাগুলো স্থির হয়ে যায়। দেবব্রত তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন…..
চলবে