কৃষ্ণাবতী
পর্ব-২১,২২
মুশফিকা রহমান মৈথি
২১ম_পর্ব
অপরপাশ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে বিরক্তির সাথে পেছনে ফিরে অর্জুন। পেছনে ফিরতেই যা দেখে তাতে বিরক্তি আরো ও বেড়ে যায়। পুনরায় দৃষ্টি বাহিরের দিকে স্থির করে সে। বিদ্রুপের স্বরে বলে,
– কি দেখতে এসেছো এখানে? আমি বেঁচে আছি কি না সেটা নাকি আমি অসহায় অবস্থার মজা দেখতে এসেছো।
– আপনাকে দেখতে এসেছি।
অন্নার উত্তর শুনে কোনো কথা বললো না অর্জুন। শুধু এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে থাকলো। অন্না এখনো দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো। আজ কলেজ ছুটি, সকালে কোচিং ছিলো অন্নার। কোচিং থেকে বাসায় যাবার পথে অর্জুনদাদের বাড়ি পড়ে। উঁচু চারতলা দালান। আজকাল ঢাকায় চারতালা দালান পাওয়াই দুষ্কর। এই দালানটা বেশ পুরোনো। তাই তো নতুনত্বের ছিটাফুটাও নেই। সিড়ি দিয়ে উঠে তিন তলায় অর্জুনের বাসা। অর্জুনের থেকে অনেক ছোট অন্না। মিতালীর উছিলা না পেলে হয়তো অর্জুনদাকে এক নজর দেখাও হতো না। কি করবে লোকটাকে দেখার জন্য মনটা বেহায়া হয়ে উঠেছে। খুব ভালো করে জানে তার উপস্তগিতিতে লোকটা খুশি হবে না। তবুও অন্না এই বেহায়াপনা কাজটা করলো। অর্জুন সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে ঘন ঘন। অন্নার চাহনী যে তাকে আপাদমস্তক দেখছে এটা ভেবে খানিকটা বিরক্ত লাগছে অর্জুনের। দৃষ্টি বাহিরে রেখেই অর্জুন বললো,
– দেখা হয়ে গেলে, প্রস্থান নিতে পারো।
– দেখা হলে আমি নিজেই চলে যাবো।
বলেই এগিয়ে অর্জুনের কাছে এসে দাঁড়ালো অন্না। মেয়েটা দেখতে কৃষ্ণার মতো সুন্দরী নয়। তবে খুবই মায়াবী চেহারা। গোলগাল, চশমা পড়া মেয়েটাকে দেখলেই মন চায় গালটা খানিকটা টেনে দেই। দু পাশে ঘন কেশ দিয়ে ঝুটি করে রেখেছে আরোও মায়াবী এবং কিশোরীসুলভ লাগছে। অর্জুন তাই চেয়েও তাকে বকতে পারছে না। অবশ্য একজনের রাগটা অন্যের উপর দেওয়াটা হয়তো সুপুরুষের কাজ নয়। ঠান্ডা গলায় সে বলে উঠে,
– তোদের কি ভাই বোনের অভ্যাস এটা, একজন আঘাত দেয় তো অন্য জন এসে মলম লাগায়?
– দাদাভাই তোমাকে আঘাত দেয় নি অর্জুনদা, দাদাভাই কি করে জানতো বলো তুমি তার বিবাহিত স্ত্রীর প্রেমে মত্ত হবে। আমিও যে তোমাকে সাবধান করি নি তা কিন্তু নয়।
– ঠিক ই বলেছিলি তুই আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে আজ আগুনেই পুড়ছি আমি।
– একটা উটকো প্রশ্ন করবো?
অন্নার এরুপ প্রশ্নে ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে অর্জুন তার দিকে তাকায়। অর্জুনের চাহনী দেখে ঠোঁট বিস্তৃত করে কোমল হাসি দেয় অন্না। তারপর বলে,
– ভষ্ম করে দিও না, প্রশ্নটা খুব সোজা “নৌকাডুবি” পড়েছো?
– হুম
– আচ্ছা বলতো, কবি কেনো রমেশের সাথে শেষকালে কমলার মিলখানা দেয় নি?
– কারণ রমেশ হেমনলিনীকে ভালোবাসতো, আর কমলা তো তার স্ত্রী নয়।
– প্রথমটি ঠিক নয়, দ্বিতীয়তটি ঠিক। রমেশ কমলাকে নিজের মনে ঠিক ঠায় দিয়েছিলো। কিন্তু ওইযে কমলা নলিনাক্ষের স্ত্রী ছিলো। চাইলে হয়তো তাকে নিজ স্ত্রী হিসেবে রেখে দেওয়া যেত। কিন্তু সেটা ধর্মে সইতো না। তোমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই, তুমি কৃষ্ণাকে ভালোবাসলেও বিয়েটা তার দাদাভাই এর সাথে হয়ে গিয়েছে। তাদের বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মতো নয়, তবুও বিয়েটা হয়েছে।
– দেবদা তো তাকে ভালোবাসে না, শুধু বিয়ের মিথ্যে জালে আটকে রেখেছে!
অর্জুনের কথায় অন্না হি হি করে হেসে দেয়। অন্নার হাসির ঝলকানি সারা ঘরে গুঞ্জছে। অবাক দৃষ্টিতে অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার মৃদু কন্ঠে সে বলে,
– ভুল জানো তুমি, দাদাভাই মনের এক কোনায় কৃষ্ণাবতীর মূর্তি স্থাপন করেছে। প্রতি সময়ে সেই মূর্তিকে পূজে সে। আর কৃষ্ণা সে তো তার মাষ্টারমশাই বলতে অজ্ঞান। তুমি তাদের মাঝে কেবলই তৃতীয় ব্যক্তি। অনেকটা সৌদামিনীর মতো। তার অবস্থা আরোও খারাপ৷ তাই আমি চাই তাদের মাঝে তৃতীয় জন হয় নিজেকে আর জ্বালিয়ো না।
– এই সব যুক্তি যে মন মানতে চায় না অন্না।
অর্জুনের স্বর কাঁপছে, কষ্ট হচ্ছে তার। এ যেনো অসহ্য যন্ত্রণা। পুরুষের কাঁদতে নেই, মেয়েদের সামনে তো নাই। তাই সে জলের স্রোত আটকে রাখছে। কিন্তু গলায় কষ্টগুলো কুন্ডলি পাকাচ্ছে। অন্না মলিন কন্ঠে বলে,
– জানি মন কোনো যুক্তি ই মানে না। বড্ড বেহায়া। তবে ক্ষতিটা কিন্তু আমার। আজ এখানে কৃষ্ণা আসতে চেয়েছিলো। তার মনে অপরাধবোধ কাজ করছে। প্রতিনিয়ত এই অপরাধবোধের খোঁচায় খোঁচায় মেয়েটা নাজেহাল। ও চেয়েছিলো তোমার কাছে এসে তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইবে। তোমার মনের কষ্ট না কি তার জীবনে অভিশাপের মতো কাজ করবে। আমি তাকে সেই কাজটা করতে দেই নি। আমার মনে হয়েছে এই কাজটা ভালো হবে না। শুধু শুধু তোমার ঘা তাজা হবে।
– তাই তার বদলে তুই এসেছিস আমার ঘা য়ে মলম দিতে?
– তোমার ঘায়ে মলম দেবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। শুধু কথা কইতে এসেছি। কথা শেষে চলে যাবো। আর সত্যি বলতে আমিও চাই না তুমি কষ্ট পাও৷ তার দুটো কারণ রয়েছে। এক, আমি চাই কৃষ্ণা সুখী হোক। কম কষ্ট মেয়েটা এই সতেরো বছরে৷ তোমার কষ্টটা তার জীবনে অভিশাপ না হোক। আর দুই, সেটা তোমার না জানলেও হবে।
কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অন্না। এই দীর্ঘশ্বাসে আক্ষেপের প্রবল ছাপ রয়েছে। মনটা যে তারও বেহায়া। অর্জুনের মূর্তি সেও যে একটা কোনায় স্থাপন করেছে। প্রতিনিয়ত তাকে পূজে সে। এটা বয়েসের দোষ নাকি, কবি সাহিত্যিকের মতে ভালোবাসা সেটা জানার ইচ্ছে এই বেহায়া মনটার নেই। সে শুধু পাগলের মতো অর্জুনকে সুখী দেখতে চায়। হঠাৎ অর্জুনের প্রশ্নে স্বম্বিত ফিরে অন্নার।
– বয়স কত রে তোর?
– আগামী মাসে আঠারো হবে, কেনো বলতো?
অর্জুনের ঠোঁটের কোনায় একটা ভুবনভুলানো হাসি ফুটে উঠে। এই হাসিতেই তোর বারংবার নিজেকে ধ্বংস হতে দেখে অন্না। মৃদু কন্ঠে তখন অর্জুন বলে উঠে,
– তোকে দেখলে আগে মনে হতো খুব ছেলেমানুষ তুই, এই বাচ্চা মেয়েটাকে গাল টেনে দিয়ে যদি একটা চকলেট ধরিয়ে না হয় তবে কেঁদে ভাষাবে। কিন্তু আজ আমার সব ধারণায় পানি ফেলে দিলি। এতো বুঝদার মানুষ করে হলি তুই? আমার অনুভূতিগুলোর সকল ব্যাখ্যা যেনো তোর কাছে আছে। কারণটা কি জানতে পারি?
অর্জুনের প্রশ্নে শুধু ম্লান হাসি হাসে অন্না। উদাসীন কন্ঠে বলে,
– কারণটা অহেতুক। শুধু এটুকু বলবো, তোমার জ্বালায় আমিও জ্বলছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। শুধু শুধু বাক্য নষ্ট হবে।
অর্জুন অবাক দৃষ্টিতে অন্নার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে কখনোই বুঝতে পারে না সে। দেবদার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকাকালীন প্রায় ভট্টাচার্য মঞ্জিলে তার যাওয়া পড়তো। তখন এই মেয়েটাকে দেখতো। গোলগোল চোখে সবসময় তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। ছোট বলে কখনো ততটা গুরুত্ব দেয় নি অর্জুন। কিন্তু মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে তাই না! হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। শীতের এই সময়ে বৃষ্টি যেনো দূর্লভ বস্তু। অন্নার শান্ত দৃষ্টি এখনো বৃষ্টির দিকে স্থির। আর অর্জুনের দৃষ্টি তার দিকে৷ ল্যাপটপে এখনো গাণ চলছে। একের পর এক গাণ। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবেই আবহাওয়ার সাথে গাণটি মিলে গেছে।
“শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে।
কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।
উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
দমকত বিদ্যুত, পথতরু লুন্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ
ঘন ঘন রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ বরখত নীরদপুঞ্জ।
শাল-পিয়ালে তাল-তমালে নিবিড়তিমিরময় কুঞ্জ।
কহ রে সজনী, এ দুরুযোগে কুঞ্জে নিরদয় কান
দারুণ বাঁশী কাহ বজায়ত সকরুণ রাধা নাম।
মোতিম হারে বেশ বনা দে, সীঁথি লগা দে ভালে।
উরহি বিলুন্ঠিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পকমালে।
গহন রয়নমে ন যাও, বালা, নওলকিশোরক পাশ।
গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব, কহে ভানু তব দাস।”
অর্জুনের দৃষ্টি এখনো অন্নার দিকে। আর অন্না সে হাত বাড়িয়ে বছরে প্রথম বৃষ্টিতে আলিঙ্গন করতে ব্যাস্ত_________
এক সপ্তাহ পর,
সকাল ১১টা,
হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে রান্নাঘর থেকে ছুটে যায় কৃষ্ণা। আজ ছুটির দিন, এই সকালে ঘরের চার ব্যাটা গিয়েছে বাজারে। খুব জোরদার খাবার দাবারের আয়োজন করা হবে আজ। সকাল থেকে ঘরের তিন রমনী হেসেলে নিজেদের দান করেছেন। ছেলেরা বাজার করে ক্লান্ত শরীরে দাঁড়িয়ে থাকবে। তাই ছুটে দরজা খুলতে গেলো কৃষ্ণা। কিন্তু দরজা খুলতেই পা জোড়া স্থির হয়ে গেলো। কারণ দরজার ওপারে সৌদামিনী দাঁড়িয়ে আছে। সৌদামিনী এই সকালে কেনো এসছে এইটা কৃষ্ণার জানা নেই। তবে মনের কোনে ক্ষীণ ঝড় উঠতে লাগলো। তার মাষ্টারমশাই এই দিদিমনীকে ভালোবাসতেন। এই কথাটা জানার পরে হয়তো কোনো স্ত্রীর পক্ষে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেওয়াটা সম্ভব নয়।
– আমায় ভেতরে ঢুকতে দিবে না?
কথাটা শুনে দরজাটা ছেড়ে দেয় কৃষ্ণা। মৃদু কন্ঠে বলে,
– মাষ্টারমশাই ঘরে নেই।
– কিন্তু আমিতো তোমার কাছে এসেছি। হ্যা দেবের সাথেও কথা আছে, তবে সাথে কথা বলাটাই আমার আসার উদ্দেশ্য।
বুকে কামড় পড়ে কৃষ্ণার। সৌদামিনী কি তবে দেবব্রতকে চাইতে এসেছে কৃষ্ণার কাছে! তখন সৌদামিনী বলে,
……………….
চলবে
#কৃষ্ণাবতী
#২২তম_পর্ব
– কিন্তু আমিতো তোমার কাছে এসেছি। হ্যা দেবের সাথেও কথা আছে, তবে সাথে কথা বলাটাই আমার আসার উদ্দেশ্য।
বুকে কামড় পড়ে কৃষ্ণার। সৌদামিনী কি তবে দেবব্রতকে চাইতে এসেছে কৃষ্ণার কাছে! তখন সৌদামিনী বলে,
– ভয় পেও না, তোমার মাষ্টারমশাইকে কেড়ে নিতে আসি নি। এবার কি আমার সাথে কথা বলা যাবে?
সৌদামিনীর ঠোঁটে বিষাদের হাসি। এই হাসিটার মাঝে কত সহস্র চাঁপা কষ্ট রয়েছে তা খুলে না বললেও কৃষ্ণার বুঝতে দেরি হলো না। কৃষ্ণা কোনো কথা কইলো না। রান্নাঘর থেকে অবন্তীকা দেবী হাক দিলেন,
– কে এসেছে রে কৃষ্ণা?
কৃষ্ণা কিছু বলার আগেই সৌদামিনী বলে উঠলো,
– আন্টি আমি এসেছি।
সৌদামিনীর কন্ঠ কর্ণপাত হতেই অবন্তীকা দেবী রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন। যেদিন কৃষ্ণা বধুরুপে এ বাড়িতে প্রবেশ করেছিলো তারপর থেকে মেয়েটা এ বাড়ির চৌকাঠ পার হয় নি। অবন্তীকা দেবীও বউ মা পেয়ে সৌদামিনীর খোঁজ ও নেন নি। অথচ তিনি বেশি সৌদামিনীকে স্নেহ করতেন। মুখে বিব্রতকর হাসি টেনে খানিকটা ইতস্ততভাবেই বলেন তিনি,
– কেমন আছো মিনী মা?
– দূর্গা মা যেভাবে রেখেছেন। আপনার শরীর কেমন আন্টি?
– আছি গোপালের কৃপায় ভালোই আছি। দেব তো বাড়ি নেই। তুমি একটু বস। কৃষ্ণা, মিনীকে জল খাবার দে। আজ কিন্তু খেয়ে যেতে হবে তোমায়।
– ব্যস্ত হবেন না আন্টি। আমি আছি। দেব আসলেই যাবো। ততক্ষণ না হয় কৃষ্ণার সাথে গল্প করি।
অবন্তীকা দেবী মুখে মেকি হাসি এঁকে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। মেয়েটার শেষ কথাটা তাকে বেশ ভাবাচ্ছে। কৃষ্ণা এবং দেবব্রতের সংসারে কেবল ঘাটনি করা হচ্ছে। এর আগেই যদি তা ভেঙ্গে যায় তবে কেউ ই সুখী হবে না। মায়ের মন সর্বদা চায় যাতে সন্তান সুখী থাকে।
অবন্তীকা দেবী চলে যাবার পর কৃষ্ণা সৌদামিনীকে নিয়ে তার এবং অন্নার ঘরে নিয়ে যায়। সৌদামিনী এক পলকে রুমটা দেখে নিলো। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি এ রুমে থাকো?
– হ্যা
– দেবের রুমে কেনো থাকো না?
– ও ঘরে এখনো আমার ঠায় হয় নি। মাষ্টারমশাই বলেছেন একেবারে নতুনবধুর মতো ওই ঘরে আমায় তুলবেন। আমিও জিদ করি নি, যেদিন আমাদের সত্যিকারের ফুলসজ্জা হবে সেদিন ই নাহয় ওঘরে যাবো। ততদিন না হয় আমাদের কালরাত্রী চলুক।
সৌদামিনী অবাক নয়নে কৃষ্ণা নামক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। কি গুছিয়ে কথাটা বললো, কেনো কৃষ্ণা ওই ঘরে থাকে না এই কারণটা তার অজানা নয়। কিন্তু তবুও প্রশ্নটা করলো। ম্লান হাসি দিয়ে সৌদামিনী বললো,
– তা তোমার মাষ্টারমশাই কবে তোমায় পুনরায় নববধু করবেন?
– সেটা সময়ের অপেক্ষা। আপনার আমার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল, এগুলোই কি সেই জরুরি কথা
– না, এগুলো সূচনার কথা। বলতে পারো আমার কৌতুহল। বিরক্ত করেছি কি প্রশ্নগুলো করে?
– না না তা কেনো হবে! আমি বিরক্ত হই নি।
হাসিমুখেই কথাটা বলে কৃষ্ণা। সৌদামিনীর ঠোঁটে এখনো সেই বিষাদময়ী হাসি। কৃষ্ণাকে নম্র ভাবেই বলে,
– এক কাপ কফি হবে কি? কফি খেতে খেতেই না হয় কথাগুলো বলতাম।
– এখনি আনছি।
বলেই কৃষ্ণা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সৌদামিনী কৃষ্ণা যেতেই চোখের জলটুকু মুছে নিলো। একদিকে ভালোই হয়েছে, দেবব্রতের ঘরে থাকলে হয়তো অনুভূতির জোয়ারটা আরোও প্রবল হতো। আজ ই তার এই বাড়িতে হয়তো শেষ আসা। সৌদামিনী ধীর পায়ে হেটে বারান্দায় দাঁড়ালো। বুক থেকে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো। একটা চাঁপা ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু ওই যে, সে হেরে গেছে। মিনিট পনেরো পরে কৃষ্ণা ঘরে আসে। সৌদামিনীকে কোথাও দেখতে না পেয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায় সে। বারান্দায় যেতেই দেখে উদাসচোখে সৌদামিনী বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিষাদের রেখা ঠোঁট ছেড়ে চোখে মুখেও পৌছেছে।
– আপনার কফি দিদিমনি।
– থ্যাংক্স, কষ্ট দেবার জন্য সরি। তোমাকে আমার কখনোই ভালোলাগে না জানো?
– জ্বী, জানি।
– কিভাবে জানো?
– আপনার চাহনীতে বোঝা যায়।
– খুব বুদ্ধিমতী তুমি। বয়সে তুমি আমার থেকে অনেক ছোট। কিন্তু তবুও আমি তোমার কাছে হেরে গেছি। হয়তো বিধাতা এটাই লিখেছিলেন আমার ভাগ্যে। আমি আর লড়াই করবো না তোমার সাথে। অবশ্য এখন লড়াই করার মানুষটিকেই তুমি জয় করে ফেলেছো। আর দেবব্রত কোনো বস্তু নয় যে তাকে লড়াই করলেই জিতে নেওয়া যাবে। সে তোমাতে মত্ত হয়েছে। তাই কেবল তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে তোমাদের মাঝে থাকার মানেই হয় না।
সৌদামিনীর গলা ধরে এসেছে৷ চাপা কষ্ট গুলো বিদ্রোহ করছে। চোখে এসে সব জমা হচ্ছে। এই বুঝি চোখজোড়াকে মুক্তি দিয়ে গড়িয়ে পড়বে অশ্রুরুপে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কৃষ্ণা অপরাধী কন্ঠে বলে,
– মানুষের সাথে লড়াই করা যায় দিদিমনি, নিয়তির সাথে নয়। আমি কখনোই ইচ্ছে করে আপনার অধিকারগুলো নেই নি।
– আমি জানি, তোমার শুভ্রমনের কাছেই তো আমি হেরে গেছি। দেবকে দেখে রেখো। শুধু প্রেমিক বলে বলছি না, ছেলেটা খুব ভালো। আমি চলে গেলে ওর একজন ভালো বন্ধু চলে যাবে। যদিও আমি খুবই খারাপ একজন মানুষ। যত তাড়াতাড়ি তোমাদের মাঝ থেকে চলে যাবো ততই মঙ্গল৷
– কোথায় যাবেন দিদিমনি?
– অনেক দূর। যেখানে আমার ছায়াও তোমাদের আশেপাশে ঘিরবে না। আমি আমার দেবকে তোমায় সপে যাচ্ছি। শুধু ওর অর্ধাঙ্গিনী নয় বন্ধু হয়েও ওর পাশে থেকো প্লিজ
সৌদামিনীর গলা ধরে এসেছে। চোখ আর বাধ মানছে না। কৃষ্ণাকে জড়িয়ে অশ্রু ছেড়ে দিলো। কৃষ্ণার ও কান্না পাচ্ছে। অশ্রু খুব ছোয়াচে একটা রোগ। কারণবিহীন একজন থেকে অপরজনে চলে যায়_____
বিকেল ৫টা,
দেবব্রতের ছাঁদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সৌদামিনী। অবন্তীকা দেবী জোর করে তাকে দুপুর অবধি বেধে রাখলেন। অবশ্য এখনো দেবব্রতের সাথে কথা হয় নি। দেবের সাথে কথা না বলে দামিনীর যেতে ইচ্ছে করছে না। এইটা তাদের শেষ কথোপকথন হবে। কিছু দুঃখ বিলাস করবে, নয়ত চাপা কষ্টগুলো সারাটাজীবন কষ্টই দিবে। পড়ন্ত বিকেলের এই সময়টা সৌদামিনীর খুব ভালো লাগে। সূর্য পুরোপুরি পশ্চিমে হেলে পড়েছে। কিরণে একেবারেই তেজ নেই। ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে সূর্যটা। এমন পড়ন্ত বিকেলে রমনা পার্কে কত সময় পার করেছিলো সে এবং দেবব্রত তার কোনো হিসেব নেই। অতীত এখন কেবলই সুন্দর কিছু মূহুর্ত রুপে মনে দাগ কেটে আছে। সৌদামিনী প্রকৃতি দেখতে এতোটাই ব্যস্ত যে কখন যে একটা মানুষ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এটাই বুঝতে পারে নি সে।
– কফি চলবে?
দেবব্রতের কন্ঠে ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে তার। ঠোঁটের কোনায় মলিন হাসি একে বলে,
– কখন এসেছিস তুই?
– যখন তুমি প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত ছিলি, কি দেখিস এতো আকাশের দিকে তাকিয়ে?
– আকাশের বিস্তৃত। কতো প্রশস্থ। ইশ, মানুষের মনটাও যদি এরুপ প্রশস্থ হতো। সংকীর্ণতার কারণে কতোটা নিচ কাজ ই না করে মানুষ। এই আমাকেই দেখ না, একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে হিংসে করে অহেতুক লড়তে গিয়েছিলাম।
– কেনো নিজেকে এতো ছোট করছিস?
– আমি এতোটাই সংকীর্ণমনা। আমি জানি তোর বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে সত্যি আমি কৃষ্ণার সাথে হিংসে করতাম। অহেতুক নিজের সাথে বাধতে চেয়েছিলাম। কখনো বন্ধুত্বের উছিলায় কখনো সমবেদনা পাবার উছিলায়। ভেবেছিলাম তুই হয়তো এই দায়িত্বের বিয়েটাকে ভালোবাসবি না। বিভিন্ন ছুতো খুজেছি তোকে তার থেকে কেড়ে নিজের করতে। কিন্তু ফলাফল যে শূন্য। কৃষ্ণার শুভ্র মনের কাছে হেরে গেলাম। যখন অর্জুন কৃষ্ণার জন্য ব্যাকুল ছিলো, আমি ভেবেছিলাম ভালোই হলো। এবার হয়তো তুই এই দায়িত্বের সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাবি। আমার তো জানাই ছিলো না তোর মনের মন্দিরে এখন অন্য দেবীর পূজো হয়।
সৌদামিনীর কথা যে মিথ্যা নয় দেবব্রত তা খুব ভালো করেই জানে। অর্জুনের মনে কৃষ্ণার প্রতি অনুভূতির খোঁজ তাকে সৌদামিনী ই দিয়েছিলো। সৌদামিনীর কন্ঠে একরাশ আক্ষেপ এবং গ্লানি। দেবব্রতের তাকে এভাবে দেখতে একেবারেই ভালো লাগছে না। প্রানোচ্ছ্বল মেয়েটার কোনো রেশ ই নেই সৌদামিনীর মাঝে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবব্রত জিজ্ঞেস করে,
– শুনলাম তুই নাকি চলে যাচ্ছিস?
– হুম, আজ রাতেই ফ্লাইট। ভিসাটা আমার হয়ে গেছে
– একবার জানালিও না?
– জানিয়ে তো লাভ হতো না। অহেতুক টান বাড়ানো। একটা কথা বলি?
– হুম শুনছি
– কৃষ্ণা মেয়েটা অনেক ভালো, ওকে আর অপেক্ষা করাস না। অনেক তো সময় পার হলো। এবার অন্তত তোর ঘরে ঠায় দিস।
– যেখানে মনেই তাকে ঠায় দিলাম, ঘর তো শুধু ইট পাথরের চার দেওয়াল।
– ঠিক। দূর্গা মা ঠিক তোদের সুখে রাখবে দেখিস
– আর তুই?
দেবব্রতের প্রশ্নে খানিকটা চুপ মেরে যায় সৌদামিনী। তার জীবনের স্রোত যে কোনদিকে তাকে নিয়ে যাবে সেটা তার নিজেরো অজানা। তবুও ঠোঁটের কোনায় ম্লান হাসি টেনে বলে,
– ওই যে উপরে যে ছড়ি ঘুরাচ্ছেন আমি তার হাতেই ছেড়ে দিয়েছি। সে যা ঠিক করবে সেটাই সই। এতোটাও তো পাপী নই যে আমার ভাগ্যে সে শুধুই কষ্টই রাখবে। নিশ্চয়ই আমার জীবনও একদিন সেজে উঠবে দেখবি।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে। সৌদামিনী এবং দেবব্রতের দৃষ্টি ডুবন্ত রক্তিম সূর্যের দিকে। পাখিরা যে যার বাড়ি ফিরছে। দেবব্রত ফিরবে কৃষ্ণার কাছে। আর সৌদামিনী যাবে তার গন্তব্যে। আজ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক পথে পারি দিবে এই দুই মানব মানবী। প্রকৃতিতে আধার নেমে আসছে। কি মনোরম দৃশ্য!!!
১৮.
কৃষ্ণা ঘরের বাহিরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। দিদিমনি যাবার পর থেকে মাষ্টারমশাই এর মনটা খানিকটা উদাসীনতায় ঘিরে গিয়েছে। কৃষ্ণা বুঝে উঠছে না এখন কি তার এই ঘরে যাওয়াটা ঠিক হবে কি না! কফি হাতে শুধু উঁকিঝুঁকি করছে সে। কিন্তু সে তো চোর নয়। তবে এতো কিসের দ্বিধা। যেই মাষ্টারমশাই এর মন ভালো না থাকা তবে কাপটা রেখেই চলে আসবে। পা টিপে টিপে ভেতরে গেলে দেখে মাষ্টারমশাই বিছানায় অর্ধশোয়া অবস্থায় বসা। মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুঝে আছে। কৃষ্ণা কোনো কথা না বলে কাপটা রেখে চলে আসতে নিলেই………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি