কৃষ্ণাবতী
পর্ব-২৩,২৪
মুশফিকা রহমান মৈথি
২৩তম_পর্ব
কফি হাতে শুধু উঁকিঝুঁকি করছে সে। কিন্তু সে তো চোর নয়। তবে এতো কিসের দ্বিধা। যদি মাষ্টারমশাই এর মন ভালো না থাকা তবে কাপটা রেখেই চলে আসবে। পা টিপে টিপে ভেতরে গেলে দেখে মাষ্টারমশাই বিছানায় অর্ধশোয়া অবস্থায় বসা। মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুঝে আছে। কৃষ্ণা কোনো কথা না বলে কাপটা রেখে চলে আসতে নিলেই হাতটা টেনে ধরে দেবব্রত। এক হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে সে কৃষ্ণাকে। কৃষ্ণাও টাল সামলাতে না পেরে খাটে বসে পড়ে। পেছন থেকে তার কোমড়টা চেপে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে দেবব্রত। মূহুর্তের জন্য কৃষ্ণা যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার সাথে কি হচ্ছে সেটা বুঝতেও তার মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। দেবব্রতের উষ্ণ নিঃশ্বাসের আভাস খুব ভালো করেই পাচ্ছে কৃষ্ণা। সে এখনো মুখ গুজে রয়েছে কৃষ্ণার ঘাড়ে। খুব করুণ গলায় ধীর স্বরে বলে,
– একটু সময় আমার কাছে বসবি? খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মনটা।
কৃষ্ণার বুঝতে বাকি রইলো না তার মাষ্টারমশাই এর মনটা আজ উদাস হয়ে আছে। কৃষ্ণা কোনো কথা বাড়ালো না, চুপ করে মাষ্টারমশাই এর গায়ের সাথে লেপ্টে রইলো। দেবব্রত আরোও নিবিড়ভাবে কৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরলো। তার বলিষ্ট বুকে কৃষ্ণার পিঠ ঠেকে রয়েছে। কৃষ্ণার দেহ থেকে বেশ সুন্দর মিষ্টি চন্দনের গন্ধ নাকে আসছে দেবব্রতের, এই গন্ধটা প্রায় দেবব্রত পায়। কৃষ্ণার উপস্থিতি তার অশান্ত মনটাকে বেশ শান্ত করে তুলছে। মেয়েটার মাঝে কি যেনো আছে যা দেবব্রতের শীতল হৃদয়ে উষ্ণতার পরশ বুলিয়ে দেয়। শূন্য হৃদয়কেও পরিপূর্ণ করে। কফি ঠান্ডা হয়ে আসছে। কিন্তু সেদিকে যেনো তার খোঁজ নেই। সে কৃষ্ণার কাধে মাথা ঠেকিয়ে বসে রয়েছে। কৃষ্ণা ধীর গলায় বললো,
– শরীরটাকি ভাল লাগছে না?
– শরীর ভালোই আছে শুধু মনটা অসুস্থ।
– এখনো তাকে ভালোবাসেন বুঝি?
– ভালো তো আমরা আমাদের ভালোবন্ধুকেও বাসি। সব ভালোবাসাকে এক কাতারে ফেলাটা বোকামি। আর সবসময় যে ভালোবাসার কারণেই মন অসুস্থ থাকে না কিন্তু নয়। দামিনী আমার খুব ভালো বন্ধু। তার সাথে আমার কাটানো সহস্র মূহুর্ত রয়েছে। তার জন্য আমার মনে একটা আলাদা জায়গা আছে। সে জায়গাটা কোনো মানবমানবীর প্রেমময় ভালোবাসার নয়। সেটা এক অন্যরকম ভালোবাসার জায়গা, বন্ধুত্বের জায়গা।
দেবব্রতের কথাগুলো চুপ করে শুনে কৃষ্ণা। লোকটার কাছ থেকে কতকিছু জানার আছে তার। কৃষ্ণাকে চুপ করে থাকতে দেখে দেবব্রত শান্ত কন্ঠে বলে,
– তুই আমাকে বিশ্বাস করিস?
– নিজের চাইতেও বেশি।
কৃষ্ণা এক মূহুর্ত দেরি করলো না উত্তরটা দিতে। কৃষ্ণার উত্তর শুনে আরোও নিবির ভাবে কৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরলো দেবব্রত। বুকের ভেতরে তাকে সযত্নে রেখে দিলে হয়তো শান্তি লাগতো। যেখানে শুধুমাত্র সেই তাকে পুজবে, ভালোবাসা এমন উম্মাদনাও তৈরি করতে পারে এটা দেবব্রতের জানা ছিলো না। দামিনীর সাথে প্রেম চলাকালীন এরুপ অনুভূতি তার কোনো কালে হয় নি। কিন্তু আজ হচ্ছে, এ যেনো এক অন্যরকম মাদকতা। হঠাৎ কৃষ্ণার কানে মুখ লাগিয়ে দেবব্রত বলে,
– একটা গান ধরতো, তোর কন্ঠের গান আমার মনের প্রসাদ।
– আর আমি?
– তুই আমার মনের খোরাক
দেবব্রতের কথাটা শুনে বেশ লাজে রাঙ্গা হয়ে উঠে কৃষ্ণা। বিয়ের দিন রাতের পর থেকে কখনো তার কাছে এভাবে আবদার করে নি দেবব্রত। এই প্রথম তার কাছে সে কিছু মুখ ফুটে চাইলো। কৃষ্ণা লাজুক কন্ঠে ধীর স্বরে বলে,
– আপনি এভাবে চেয়ে থাকলে আমার তো লজ্জা লাগবে।
– বেশ তাহলে এভাবে চাইবো না।
বলেই পুনরায় কৃষ্ণার ঘাড়ে মুখ গুজে সে। কৃষ্ণার কন্ঠে জড়তা যেনো বেড়েই যায়। কোনো মতে বলে,
– এভাবে আমি গাইতে পারবো না
দেবব্রতের মুখে দুষ্ট হাসি। শাড়ির ফাকে হাতটা গলিয়ে কোমড় খানা চেপে ধরলো দেবব্রত। তারপর কৃষ্ণার ঘাড়ের নজরকাটার মতো গাঢ় তিল খানায় উষ্ণ ঠোঁট বুলিয়ে বেশ জোর করেই বলে,
– এভাবেই তোকে গাইতে হবে। আমার জন্য এটুকুও করবি না বুঝি?
– বড্ড বেহায়া পুরুষমানুষ আপনি। এটাতো আগে জানা ছিলো না
জড়ানো গলায় অস্পষ্ট স্বরে কৃষ্ণা বলে উঠলো। কৃষ্ণার কথায় হো হো করে হেসে উঠলো দেবব্রত। তারপর চোখ টিপ্পনী দিয়ে বললো,
– আমি এর চেয়েও বেশি বেহায়া, প্রমাণ লাগবে
– ইশশ,
বলেই মুখটা হাতজোড়া দিয়ে ডেকে নিলো কৃষ্ণা। দেবব্রতের কাছে এটা যেনো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সময়। সময়টা যদি এখন স্তব্ধ হয়ে যেতো মন্দ হতো না। আরো আহ্লাদি কন্ঠে দেবব্রত বলে উঠলো,
– একটু গানটা ধর, মনটা আজ তোর গান শুনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।
কৃষ্ণা আর কিছু বললো না। তার মাষ্টারমশাই এর জন্য সে সব করতে রাজি, এতো সামান্য গান। ধীর কন্ঠে গানটা ধরে কৃষ্ণা,
“কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা।।“
কৃষ্ণা গানটা গাইছে। আর দেবব্রত চোখ বুঝে তার মাথায় মুখ ঠেকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গানটা শুনছে। দুজনের হাত দুজনের হাতে। বিধাতা ও তাদের দেখে হয়তো উপর থেকে মুচকি হাসি হাসে____________
ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, পড়ার টেবিলে রাখা কফিটা রীতিমতো পানির ন্যায় ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু বিছানায় বসা মানবমানবীর সেদিকে দৃষ্টি নেই। তারা তাদের মত মত্ত রয়েছে। কৃষ্ণা ধীর কন্ঠে বললো,
– মন কি সুস্থ হয়েছে?
– খুব শান্তি লাগছে। আচ্ছা একটা কথা মাথায় ঘুরছে। শুনবি?
– বলুন
– আমার সাথে প্রেম করবি?
দেবব্রতের এমন নির্লিপ্তভাবে করা প্রশ্নে বিষম খাবার জোগাড় কৃষ্ণা। এই উম্মাদ লোক বলে কি? স্বামীর সাথে কি প্রেম করা যায় নাকি? প্রেম তো অবিবাহিত কপোত কপোতী করে। এ কেমন ধারা কথা। দেবব্রতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো লোকটা কি মজা করছে নাকি। অবশ্য দেবব্রতের মানুষ মজা করবে এটা যেনো জেগে জেগে স্বপন দেখার মতো ব্যাপার।
– কি হলো প্রেম করবি?
– স্বামী স্ত্রী বুঝি প্রেম করতে পারে?
– পারবে না কেনো? আর আমাদের বিয়েটাতে তো প্রেম ছিলো না। তাই এখন করলেও খারাপ হবে না। আর তোর বয়সের জন্য এটাই মুক্ষম সময় প্রেম করার।
– এই প্রেম কি করে? আমি কখনো করি নি তো
– খুব সোজা, এই ধর আমরা ঘুরতে যাবো, খেতে যাবো, সিনেমা দেখবো। রাত রাত বসে গল্প করবো। অবশ্য আমি ততটা ভালো প্রেমিক নই। দেখা গেলো আমি কাজের চাপে তোর সাথে ঘুরার কথাটা গুলে মেরে দিলাম।
– সে সব ঠিক আছে কিন্তু প্রেম করতে গেলে যদি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়? তখন? আপনি আমাকে বলেছিলেন, আমাকে খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে।
দেবব্রত হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝে উঠলো না। যদিও কৃষ্ণার কথাটা ভুল নয়, তবুও কথা এখন না বললেও চলতো। দেবব্রত আক্ষেপের স্বরে বললো,
– পরীক্ষার সময় হলে প্রেমে বিরতি দিবো। চলবে?
– হুম খুব চলবে।
কৃষ্ণার মুখে উজ্জ্বল হাসি, কি মায়াবী না লাগছে তার কিশোরী বৌটিকে। দেবব্রত টুপ করে তার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো। আবেশে চোখ বুঝে আসলো কৃষ্ণার। আজ থেকে নতুন সম্পর্কের তরী পা রাখলো দুজন, গন্তব্য একই। এখন শুধু হাতে হাত রেখে গন্তব্যে হেটে যাওয়া_________________
১৯.
ফাগুনের প্রথম দিন,
সারা কলেজ জুড়ে হলুদ রঙ্গের ছড়াছড়ি। সব ছেলেমেয়েরা বসন্তের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে নিজেদের হলুদের আভায় সাজিয়েছে। সেই উছিলায় অন্না এবং কৃষ্ণাও হলুদ শাড়ি পড়েছে। আজকাল ছেলেমেয়েদের সাধারণত শাড়ি পড়ে ক্লাসে আসতে দেখা যায় না। কিন্তু পুরো ক্লাস চুক্তি করে আজ শাড়ি পড়েছে। আর ছেলেরা হলুদ পাঞ্জাবী। অন্নার ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু কৃষ্ণার জোরেই তাকেও শাড়ি পড়তে হয়েছে। খুব সুন্দর করে খোপাও করে দিলো কৃষ্ণা তাকে। নিজেও একটি বাসন্তী রঙ্গের শাড়ি পড়েছে। আজ তাদের দেখলে বলবে একজন রবী ঠাকুরের চারুলতা তো অন্যজন জীবননান্দের বনলতা। কলেজের গেট দিয়ে ঢুকবার সময় খানিকটা অস্বস্তি লাগছিলো অন্নার। সাধারণত তাকে নাচের অনুষ্ঠান ব্যাতীত শাড়ি পড়তে কেউ ই দেখে নি। গোলগোল চশমার ভেতরের একজন মায়াবী কিশোরী লুকায়িত আছে এটা যেনো অনেকের ই অজানা। অন্নার চোখ তার মনমন্দিরের সেই দেবতাকে খানিকক্ষণ খুজলো। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সেই যে সপ্তাহ খানেক আগে তার দর্শন মিলেছিলো আর দেখা পায় নি। লোকটাও কলেজের চৌকাঠে আসে নি। বসন্তের এই দিনে মনেও ফাগুন হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। শুধু মানুষটাই বুঝে না। এ দিকে কৃষ্ণার নতুন প্রেমিক মাষ্টারমশাই আজ তাকে ক্লাস শেষে ঘুরতে নিয়ে যাবার অঙ্গিকার দিয়েছেন। কৃষ্ণার মনটা খানিকটা ভীত। এরকম তার সাথে এই প্রথম হচ্ছে। দুজন রমনী পাশাপাশি হাটছে অথচ তাদের মনের আবহাওয়া ভিন্ন। একজনের মনের বসন্তের রঙ্গের আভা লেগেছে তো অন্যজনের মনে এখনো বসন্তের অপেক্ষা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। ক্লাস, প্রাকটিক্যাল সব শেষ। কৃষ্ণার মনের প্রজাপতি গুলো উড়ছে। মাষ্টারমশাই তাকে নিয়ে আজ সারাদিন ঘুরবে বলেছেন। কলেজ গেটে পৌছাতেই দেখে গেট থেকে অনেক দূরে দেবব্রত গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। অন্নাও জানে আর কৃষ্ণা এবং দেবব্রতের একান্ত সময়। তাই সে একা একা বাড়ি যাবার কথা বলে কৃষ্ণাকে দেবব্রতের কাছে পাঠিয়ে দিলো। কৃষ্ণা যদিও তাকে কম সাধে নি। কিন্তু দাদা, বৌদির মাঝে কাবাবে হাড্ডি হবার ইচ্ছে তার হলো না। গাড়ির কাছে কৃষ্ণা যেতেই দেবব্রত গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো। সাদা, হলুদ মিশ্রিত পাঞ্জাবীতে আজ তাকে বেশ সুন্দর লাগছে। চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে রয়েছে। হাতাগুলো গুটিয়ে রাখায় বলিষ্ঠ হাতের কনুই অবধি দেখা যাচ্ছে। কৃষ্ণাকে দেখে একটু কাছে এগিয়ে যায় সে। গাড়ির দরজাটা নিজ থেকে খুলে দেয়। কৃষ্ণার ভারী লজ্জা লাগছিলো।
– এতো লজ্জা পেলে যে নিজেকে আটকানো দায় হয়ে যাবে।
দেবব্রত খানিকটা ঝুকে কথাটা বলে। কৃষ্ণার লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবার জোগাড় হয়েছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গাড়িতে বসে সে। দেবব্রত গাড়িতে বসে গাড়ি ছোটায়। আজ তাদের হারিয়ে যাবার যেনো নেই মানা_______
অন্না রাস্তার ধার দিয়ে হাটছে। এই পড়ন্ত বিকেলে রিক্সার বেশ অভাব হয়েছে। একটা রিক্সাও তার বাসার কাছে যাবে না। তাই উপায়ন্তর না দেখে হেটে হেটেই যাবার কথা চিন্তা করে সে। অর্জুনের বাসার পাড়া পেরিয়ে তাদের বাসায় যেতে হয়। বেহায়া মনটা ছুক ছুক করছে মানুষটাকে একবার দেখার জন্য। কিন্তু সেই মানুষটা তো জানেও না। হঠাৎ মনে হলো দুজন ছেলে তার পিছু নিয়েছে। অন্না সেদিকে যাচ্ছে ছেলেদুটো সেদিকে যাচ্ছে। ছেলেদুটো অন্নার খুব কাছে চলে আসলেই অন্না হাটার গতি বাড়ায়। কিন্তু মরার শাড়ি পড়ে দ্রুত হাটাও যাচ্ছে না। এদিকে ছেলেগুলো ও নিজেদের গতি বাড়ায়। অন্নার বুকে একরাশ ভয় ভিড় করে। আরো দ্রুত হাটতে গেলে শাড়িতে পা টা আটকে যায়। আর অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে নেয় অন্না। ভেবেছিলো নাক মুখ বোধহয় গেলো, কিন্তু……………
চলবে
#কৃষ্ণাবতী
#২৪তম_পর্ব
হঠাৎ মনে হলো দুজন ছেলে তার পিছু নিয়েছে। অন্না সেদিকে যাচ্ছে ছেলেদুটো সেদিকে যাচ্ছে। ছেলেদুটো অন্নার খুব কাছে চলে আসলেই অন্না হাটার গতি বাড়ায়। কিন্তু মরার শাড়ি পড়ে দ্রুত হাটাও যাচ্ছে না। এদিকে ছেলেগুলো ও নিজেদের গতি বাড়ায়। অন্নার বুকে একরাশ ভয় ভিড় করে। আরো দ্রুত হাটতে গেলে শাড়িতে পা টা আটকে যায়। আর অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে নেয় অন্না। ভেবেছিলো নাক মুখ বোধহয় গেলো, কিন্তু তখনই একজোড়া বলিষ্ট হাত থাকে শক্ত করে ধরে ফেলে। সেকেন্ড পনেরো ব্যাথার অনুভূতি না হলে চোখ পিটপিট করে খোলে অন্না। না হাত মুখ কিছুই ভাঙ্গে নি, বরং খানিকটা শূন্যে ভেসে রয়েছে সে। মাথাটা তুলতেই মনে শীতল প্রবাহ বয়ে যায় অন্নার। আকাশের শুভ্র চাঁদ হাতে পাবার মতো আনন্দ হচ্ছিলো অন্নার। তার মনমন্দিরের ভগবান যেনো পায়ে হেটে তার কাছে এসেছে। এই একটা সপ্তাহ মানুষটাকে একনজর দেখার জন্য মনটা ঝুকে ছিলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নয় বরং তার একান্ত প্রিয় ব্যাক্তি, অর্জুন দা। কালো একটি টিশার্ট, কালো থ্রি- কোয়ার্টার প্যান্ট এবং পায়ে বার্মিজের চটি পড়ে রয়েছে সে। হয়তো পাড়ায় কোনো কাজে বেড়িয়েছিলো। চুল গুলো কপালে এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে। অন্য সময় বেশ কায়দা করে চুলগুলো গুছিয়ে রাখে সে। কিন্তু আজ বড্ড এলোমেলো হয়ে রয়েছে চুল, অবশ্য তাতেও যে কারোর বুকের স্পন্দন বাড়াতে যথেষ্ট। অর্জুন পেছনের উপস্থিত ছেলেগুলোর দিকে কড়া অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগ করলো। এই দৃষ্টিটি অর্জুনদার ব্রহ্মাশ্র। যে কেউ দেখলেই গলা শুকিয়ে ফেলবে। ছেলেগুলোর ও একই অবস্থা হলো। ভো দৌড় দিলো তারা। এতক্ষণ অন্না তার বাহুর আলিঙ্গনে ছিলো। ছেলেগুলো চলে যাবার পর খানিকটা ধাক্কা দিয়েই অন্নাকে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। যেনো কোনো আবর্জনা তার গায়ে লেপ্টে আছে। খুব বিতৃষ্ণার দৃষ্টি প্রয়োগ করে গটগট করে হাটা দেয়। অন্নার মনটা যত তাড়াতাড়ি উচ্ছ্বাসিত হয়েছিলো তত তাড়াতাড়ি মিয়ে গেলো। লোকটা এমন ব্যাবহারটুকু না করলেও পারতো। অন্না তো তার অপরিচিত মানুষ নয়। নিজের উপর ও বেশ রাগ হলো অন্নার। এতো বেহায়া কেনো সে! যে মানুষটার তার অস্তিত্বে কিছুই যায় আসে না। সেই মানুষটাকে নিয়ে সে কাতর হয় কেনো? কেনো এতো ব্যাকুল হয়ে উঠে তার একদর্শনের জন্য! অর্জুন হঠাৎ থেমে ঘাড়টা কাত করে মলিন কন্ঠে বলে,
– নৌকাডুবিতে কবি রমেশের জন্য হেমনলিনীকে অপেক্ষারত রেখেছিলেন। কমলার সাথে বিয়োগের পর ও হেমনলিনীকে রমেশ পেয়েছিলো। কিন্তু আমার জন্য ভগবাণ কোনো হেমনলিনীকে বরাদ্ধ রাখেন নি! তাই আমার যন্ত্রণা কমবার নয়।
বলেই গটগট করে হাটা দেয় অর্জুন। অর্জুনের কথাটা শুনে অন্নার একটা কথাই বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো,
“হেমনলিনী এখনো অপেক্ষারত রয়েছে। কিন্তু আফসোস রমেশের সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই”
চোখগুলো জ্বলছে অন্নার। বোকা মনটা কাঁদতে চাইছে, কেনো! এতো কিসের কষ্ট তার। সে তো আগ থেকেই জানতো এই মানুষটাকে যতই পুজো করো, মানুষটার মনে তার কোনো ঠায় হবে না। তাহলে কেনো! অন্না করুণ চোখে অর্জুনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যতক্ষণ তার অবয়ব দেখা যায় ততক্ষণ। ঐ যে বেহায়া মন!!!
পার্কের বেঞ্চিতে বসে রয়েছে কৃষ্ণা এবং দেবব্রত। পড়ন্ত বিকেলের মৃদু কিরণ আছড়ে পড়ছে কৃষ্ণার মুখে। এই সময়টাকে গোধুলি বলে আক্ষ্যায়িত করা হয়। এই কিরণে সামান্য ধুলিকণাকেও নাকি কাচের কণার মতো লাগে। দেবব্রতের পাশে তো জীবন্ত প্রতিমা বসা। তাকে কোনো অপ্সরার চেয়ে কম লাগছে না। আজকাল দেবব্রতের শুধু কৃষ্ণাকে দেখতে মন চায়। যতই দেখুক না কেনো আরোও দেখতে মনে চায়। কৃষ্ণা আগ্রহী চোখে সামনের উপস্থিত বাচ্চাদের খেলা দেখছে। তার চোখ জোড়া চিকচিক করছে। আর দেবব্রতের চোখ শুধু কৃষ্ণার দিকে। হঠাৎ একটা ছোট মেয়ে এসে বলে,
– সাহেব মালা নিবেন? বেলীফুলের মালা, অনেক গন্ধ
– না নিবো না।
– নেন না সাহেব
দেবব্রত খানিকটা বিরক্ত হলো। তার ফুলের গন্ধে এলার্জি। একদম নিতে পারে না। একটু কড়া কন্ঠে বললো,
– আমাদের লাগবে না, বললাম তো
মেয়েটির মুখটা কালো হয়ে গেলো। কৃষ্ণারও খুব ইচ্ছে ছিলো বেলীফুলের মালা কেনার। তাই ধীর কন্ঠে বললো,
– একটা মালা কিনে নিবেন?
– তোর ভালো লাগে মালাটালা?
– হ্যা, বেলীফুলের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে।
কৃষ্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না দেবব্রত। মেয়েটির হাতে একশত টাকার একখানা নোট ধরিয়ে একটা মালা কিনলো সে। কৃষ্ণা মালাটা হাতে নিয়ে পরম আনন্দে তার গন্ধ নিলো। তার খুব ইচ্ছে ছিলো দেবব্রতের হাতে খোপায় মালাটা পড়বে। কিন্তু তার আগেই দেবব্রত বললো,
– কৃষ্ণা, মালাটা কি ব্যাগে রাখবি একটু। আমার মাথা ব্যাথা করছে। আসলে আমার ফুলের গন্ধে এলার্জি।
দেবব্রতের চোখ লাল হয়ে এসেছে। তার যে খারাপ লাগছে এটা বুঝতে দেরি হলো না কৃষ্ণার। তাই মনের সাধ থাকা স্বত্তেও কোনো কথা বলতে পারে নি সে। মনের কোথাও না কোথাও একটা খারাপ লাগা কাজ করতে লাগলো। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলো না কৃষ্ণা। কৃষ্ণার এই একটা গুণ যা তাকে অনেকের কাছ থেকে তাকে আলাদা করেছে। সে কখনোই নিজের মনের অনুভূতি মুখে প্রকাশ হতে দেয় না। তাই দেবব্রত পাশে থাকা স্বত্তেও বুঝলো না তার কিশোরী বউ এর মনে অজান্তেই খানিকটা চির ধরিয়েছে। জানবেই বা কি করে, এর আগে কখনো প্রেমিকার জন্য বেলীফুলের মালা কিংবা রেশমি চুড়ি কেনা পড়ে নি তার। সৌদামিনীর চাহিদাগুলো এতোটা সাধারণ ছিলো না, এটাই হয়তো ব্যাক্তি বিশেষের পার্থক্য। সূর্যাস্ত হচ্ছে, লাল রক্তিম সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। দেবব্রতের হাতের মুঠোয় কৃষ্ণার ছোট্ট হাতটি। দেবব্রত আগলে রেখেছে হাতটা। কৃষ্ণার ঠোঁটে মায়াবী হাসি। এই হাসি যেনো দেবব্রতের হৃদয়ের তীরের মতো যেয়ে লাগে। সময়টা থেমে গেলে হয়তো মন্দ হতো না।
রাত ৮টা,
ভট্টাচার্য মঞ্জিল,
নারায়ন বাবু তার কাজের টেবিলে বসে রয়েছে। তিনি বেশ বিরক্তির সাথে কাগজ পত্র ঘাটছেন। আজকাল বাসায় সোমনাথের মেয়েকে যে আদিক্ষেতা শুরু হয়েছে সেটা তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু তিনি বলবেন ই বা কাকে! নিজের স্ত্রীকে, বাবাকে নাকি নিজের ছেলেকে। সে তো আবার সেই মেয়েকে সমাজের সামনে দ্বিতীয়বার মেয়েটিকে বিয়ে করবে। তার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বন্ধুদের সামনে নিজের বড়াই করার জায়গাটুকু তিনি খোয়াতে বসেছেন। কি বলবেন তার ছেলের বউ এর না আছে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা আর না আছে কোনো অভিজাত্য বংশ পরিচয়। তিনি তাই আজ ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছেন। দেবব্রতের সাথে সামনাসামনি কথা বলাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ দরজায় কড়া পড়লে ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে নারায়ন বাবুর। তখন শুনতে পান
– বাবা আসবো?
দেবব্রতের প্রশ্নে গলা খাকারি দিয়ে তিনি বলেন,
– আসো, বসো
– আমাকে ডেকেছিলেন? খুব জরুরি কিছু কি?
– শুনলাম তুমি নাকি কৃষ্ণাকে পুনরায় বিয়ে করবে?
– জ্বী ঠিক শুনেছেন। এক বছর পর ও অনার্সে ভর্তি হবে। ভেবেছি এর পর ই বিয়ের আয়োজনটা করবো।
– তুমি কি মেয়েটাকে নিজ স্ত্রী হিসেবে মেনে নিচ্ছো?
নারায়ন বাবুর কথায় খানিকটা নড়ে চড়ে বসে দেব। তার বুঝতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছে বাবার কথার অন্তমর্ম। তাই নম্র কন্ঠে বলে,
– বাবা একটু খোলসা করবেন কি?
– আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিবে কি? একটা গেয়ো মেয়ে কি সত্যি তোমার পাশে যায় দেবব্রত? যদি কেউ কখনো তার বংশ পরিচয় কিংবা বাবা-মার পরিচয় বিয়ে প্রশ্ন করে উত্তর দিতে পারবে তো? এই প্রশ্নের সম্মুখীন তোমাকে বহুবার হতে হবে। তোমার মতো উচ্চশিক্ষিত ছেলের সাথে বা আমাদের পরিবারের সাথে মেয়েটা কি আদৌ ও যায়?
নারায়ন বাবুর প্রশ্নে দেবব্রতের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে যায়। তারপর……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি