কৃষ্ণাবতী
পর্ব-৩২,৩৩,৩৪
মুশফিকা রহমান মৈথি
৩২তম_পর্ব
দেবব্রত খানিকটা চিৎকার করে উঠে। তার রাগ হচ্ছে কৃষ্ণার প্রতি। এতোবছরে ইচ্ছে আজ পূরণ হচ্ছে তার মনটা এতোক্ষণ খুশিতে আটখানা ছিলো। কিন্তু কৃষ্ণা আবারো জিদ করছে। দেবব্রতের ধমকে কেঁপে উঠে কৃষ্ণা। চোখগুলো আপনাআপনি ভিজে যায়। কিন্তু নিজেকে শক্ত রেখে বলে,
– আমি যাব না মাষ্টারমশাই, আসলে আমি যেতে পারবো না।
– কেনো?
– কারণ আমি প্রেগন্যান্ট।
কথাটা শোনা মাত্র দেবব্রত যেনো আকাশ থেকে পড়ে। নিমিষেই চোখজোড়া রক্তবর্ণ ধারণ করলো। মাথার ডানপাশের শিরাটা দপদপ করে লাফাচ্ছে। রাগটা মাথা জেকে বলেছে। রাগটা কার উপরে হচ্ছে এবং কেনোই বা হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না। সে শুধু এটুকু জানে তার রাগ হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– আমার এখন ফাজলামো করার মতো মন মানসিকতা নেই কৃষ্ণা। এই মজাটা অন্য সময় করলেও আমি মেনে নিতাম।
-………….
– কি হলো চুপ করে আছিস কেনো? প্রেগন্যান্ট মানে টা কি?
দেবব্রতের রাগ সম্পর্কে কৃষ্ণার ধারণা তো ছিলো কিন্তু কখনো সেটার মুখোমুখি হবার মতো পরিস্থিতি হয় নি। কৃষ্ণার হাত অজান্তেই তার পেটে চলে গেলো। তার শরীর কাঁপছে। গলার কাছে মনে হয় কেউ পাথর রেখে দিয়েছে। ঠিকমতো মনের ভাবগুলো প্রকাশ করে উঠতে পারছে না। মানুষের যতগুলো অনুভূতি রয়েছে সব যেন একসাথে ঘেটে ঘ হয়ে আছে কৃষ্ণার ভেতরে৷ চোখ থেকে নোনাজলের স্রোত বইছে। দেবব্রতের অগ্নিদৃষ্টি তাকে ছিন্নভিন্ন করে তুলছে। মাথায় তীব্রভাবে ব্যাথা শুরু হলো, অস্পষ্ট স্বরে বললো,
– আ…আমি মজা করছি না। আমার মাঝে একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে। আমার ভালোবাসা যার উৎস।
এবার যেনো নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না দেবব্রত। তেড়ে এসে কৃষ্ণার বাহুজোড়া শক্ত করে ধরলো সে। কৃষ্ণার হাড় যেনো ভেঙ্গে যাবে, এতোটা জোড়ে সে তার বাহু ধরেছে। বজ্র কন্ঠে বললো,
– এতো জেদ তোর? এতো জেদ? শুধু আমার কথা না শোনার জন্য এতো বড় স্টেপ নিয়ে নিলি? বারবার মানা করেছি। আমাদের অজস্র সময় রয়েছে। তবুও তুই এই কাজটা করলি? আমার ইচ্ছের কোনো দাম নেই তোর কাছে। আমি বারবার বলেছি আমি বাচ্চা চাই না, চাই না বাচ্চা। তবুও তোর সেই জেদ। আজ যখন তোর জীবনে এতো বড় অপরচুনিটি আসছে জাস্ট এই বাচ্চাটার জন্য সব নষ্ট করার ফন্দি করেছিস। আমার এতো কষ্টের কোনো দাম নেই তোর কাছে?
– ক্যারিয়ারটা দুবছর পরেও আমি গড়তে পারবো মাষ্টারমশাই। ক্যারিয়ার গড়ার লোভে আমাদের সংসারটা
– গো টু হেল উইথ ইউর সংসার। তুই তাও এমন চিন্তাধারার মহিলা ছিলি না, যাদের জীবন শুধু বিয়ে, স্বামী সংসারে চলে যাবে। আমি ভেবেছিলাম তোর এম্বিশনগুলো আকাশচুম্বী। আমি সত্যি তোকে চিনতে পারছি না, তুই কি সেই মেয়েটা যাকে আমি ভালোবাসি?
কৃষ্ণা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বুকের মাঝে ভোতা ছুরি দিয়ে কেউ যেনো ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে। চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে। দেবব্রত এবার কৃষ্ণা বাহু ছেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রাগ কমাতে লাগতো। তারপর বরফ ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– এবোর্শন করতে হবে।
– কিহ?? মাথা ঠিক আছে তোমার।
– আমার মাথা ঠিক ই আছে। এখন বাচ্চা নেওয়া মানে তোর ক্যারিয়ারটাকে গলা টিপে মারা।
– এর চেয়ে আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলো তুমি?
কথাটা শুনতেই দেবব্রত থমকে গেলো। অবাক চোখে কৃষ্ণার দিকে তাকালে অনুনয়ের স্বরে বলে সে,
– আমি তৃতীয়বার আমার বাচ্চাকে হারাতে পারবো না। আমি সত্যি মরে যাবো মাষ্টারমশাই। আমি মরে যাবো। এর চেয়ে তুমি আমায় মেরে ফেলো।
– যে বাচ্চা এখনো ধরাতেই আসে নি, তার জন্য এতোবড় কথাটা বলতেও তোর মুখে বাধলো না। এতোটা পাষন্ড ভাবিস আমাকে? এতো? তোর কি মনে গত দুবার শুধু তুই ই কষ্ট পেয়েছিস? আমি ও এই বাচ্চাটার বাবা, আমার ও তোর মতোই কষ্ট হয় কৃষ্ণা। কিন্তু আমি নিজের কষ্টগুলো আমার মাঝে পাথর চাঁপা দিয়ে রেখেছি যাতে তোর জীবনটা সুন্দর হয়। আফসোস তুই আমাকে কখনোই বুঝবি না
– তুমি কি একটাবার আমাকে বুঝার চেষ্টা করেছো মাষ্টারমশাই?
নির্বিকারভাবেই কথাটা বলে উঠে কৃষ্ণা। কৃষ্ণার কথাটা যেনো দেবব্রতের ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে। চোখের কোনে চিকচিক করছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
– আমরা কাল যাচ্ছি হাসপাতালে
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দেবব্রত। কৃষ্ণা সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে, মাথাটা ঘুরোচ্ছে, শরীর কাঁপছে। নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে পায়ের মাটিটা সরে যাচ্ছে, সে অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে______
২৬.
থমথমে পরিবেশ ভট্টাচার্য মঞ্জিলে, দেবব্রত বাসায় নেই। কৃষ্ণার জ্ঞান নেই, মুখটা শুকিয়ে গেছে। আর একটুর জন্য বাচ্চাটা বেঁচে গেছে। একটু আগেই ডাক্তারের মুখে সুখবরের আশ্বাস পেয়ে গদগদ হয়ে উঠেছিলেন অবন্তীকা দেবী এবং রীতা দেবী। কিন্তু যেই ডাক্তার অনিন্দ্য বলল,
– বৌদি, বউ মার অবস্থা ভালো না। প্রচুর মানসিক চাপে রয়েছে। এই রকম চলতে থাকলে বাচ্চাটি টিকবে না। আর বউমার শরীরের অবস্থাটাও খুব ভালো না। এই নয়মাস সে কিভাবে পার করবে এটা নিয়েও আমার প্রশ্ন জন্মাচ্ছে
– কেনো অনিন্দ্য দা?
– বৌমা অনেক দূর্বল। অনেক যত্নের প্রয়োজন। একে ফিনফিনে শরীর। উপরে মানসিক চাপ। কিছু পরীক্ষা করতে হবে, তারপর আমি শিওর হয়ে বলতে পারব।
ডা. অনিন্দ্য নারায়ন বাবুর পুরোনো বন্ধু। একরকম পারিবারিক ডাক্তার ই বলা যায়। তার কথাটা শুনে অবন্তীকা দেবীর মনটা বসে গেলো। ঠাম্মা হবার আনন্দটা একেবারেই ফিকে হয়ে গেলো কৃষ্ণার অবস্থা দেখে। কৃষ্ণার মুখ একেবারেই শুকিয়ে গেছে। চোখের পানিগুলো শুকিয়ে রেখা হয়ে গেছে। বয়সের অভিজ্ঞতাই হোক বা নিজের ছেলের নাড়ী সম্পর্কে অবগত হবার কারণে আন্দাজ করতে পারলেন তাদের মাঝে কোনো সমস্যা উৎপন্ন হয়েছে। মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন তিনি। মুখোমুখি হতেই হবে দেবব্রতের। এবার একটা শেষ দেখেই ক্ষান্ত হবেন তিনি।
রাত ৯টা,
ক্লান্ত শরীরটা চলতে চাচ্ছে না দেবব্রতের। ওভার ব্রীজের উপরে দাঁড়িয়ে আছে সে। কৃষ্ণার শেষ কথাটা মাথায় ঘুরছে। কৃষ্ণা রীতিমতো তাকে কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সে কি সত্যি দোষী! চোখ বুঝতেই পুরোনো স্মৃতিগুলো ক্যামেলার রিলের মতো তার সামনে ভাসছে। দেড় বছর পূর্বে যখন কৃষ্ণা প্রেগন্যান্ট হয়েছিলো, তখন ডা. নিশাত তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছিলো,
– কথাগুলো বলার হয়তো এখন সঠিক সময় নয়। কিন্তু আমি মিথ্যে আশা দিতে চাই না। কৃষ্ণা মা হতে পারবে না এটা ঠিক সঠিক নয়, তবে বাচ্চা নেওয়ার ক্যাপাসিটি ওর বডিতে নেই। সি ইজ নট দ্যাট মাচ ক্যাপাবল অফ বিঙ্গ প্রেগন্যান্ট। নেক্সট টাইম মেক শিওর, যে খুব তাড়াহুড়ো যেনো না হয়৷
কথাটা এখনো দেবব্রতের মাথায় খোদাই হয়ে আছে। একারণেই সে এবোর্শন করাতে চেয়েছিলো। ভগবান সেটার সুযোগ দেন নি। বরং কৃষ্ণার মিসক্যারেজ হয়েগিয়েছিলো। দেবব্রত কৃষ্ণাকে হারাতে চায় না। সেকারণেই সে এই পড়ালেখার জেদ দেখায়। অন্তত পক্ষে কৃষ্ণা যদি তার জীবনে ব্যস্ত হয়ে উঠে তাহলে এই বাচ্চা নেবার জিদ করবে না। দেবব্রত বিশ্বাস করে সবকিছুরই একটা সঠিক সময় আছে, অনুরুপ বাচ্চার ও একটা সঠিক সময় আছে। কিন্তু কৃষ্ণাকে এটা বুঝাতে অপারগ সে। আজ না চাইতেও এতো খারাপ ব্যাবহার করলো কৃষ্ণার সাথে। বাচ্চা মেয়েটা কেনো বুঝে না দেবব্রতের জীবনে তার অস্তিত্ব সব কিছু থেকে অধিক। মেয়েটা তার রক্তে মিশে আছে। এই বাচ্চা নেবার জিদে যদি কৃষ্ণার কিছু হয়ে যায়! কিভাবে থাকবে সে! না কৃষ্ণা যদি তাকে ভুল ও বুঝে তবুও দেবব্রতকে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতেই হবে। থাকতেই হবে______
অর্জুনের সাথে ক্যাফেতে বসে রয়েছে অন্না। তার মনটা ভালো নেই। কফিটা চামচ দিয়ে নাড়িয়ে যাচ্ছে। অন্নাকে অমনোযোগী দেখে অর্জুন ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– মনটা কোথায় ফেলে এসেছো, আমার কিন্তু এখন ঈর্ষা হবে। আফটার অল এতো হ্যান্ডসাম একটা মানুষ তোমার সামনে বসা।
– আচ্ছা বাচ্চা হারানোর কষ্ট কি শুধু মেয়েদের হয়? কোনো ছেলের কেনো সেই কষ্টটা হয় না
অন্নার কথা শুনে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় অর্জুন। অন্নার এই কথাটা তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। প্রশ্নটা সত্যি তার ভেতরটাকে ভাবিয়ে তুললো। সে কখনো বাচ্চা হারানোর কষ্ট অনুভব করে নি, তাই বলতে পারছে না। কিন্তু সত্যি কি ছেলেদের কোনো কষ্ট হয় না!!!
রুমে প্রবেশ করতেই দেবব্রতের চোখ যেনো ছানাবড়া হয়ে গেলো। অবন্তীকা দেবী বেশ স্নেহ করে কৃষ্ণাকে খাওয়িয়ে দিচ্ছেন। আর কৃষ্ণা বাধ্য বাচ্চার মতো শ্বাশুড়ি মায়ের হাতে খেয়ে যাচ্ছে। নিজের মাকে এই রুপে দেখে যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না দেবব্রত। রীতা দেবী সব কাজের মানুষকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। আরোও মিষ্টি অর্ডার করছেন। একটু মাথায় জোর দিতেই দুই আর দুই চার মিলালো দেবব্রত। নতুন সদস্য আসার খুশি পালন করছে তারা। অবন্তীকা দেবী দেবব্রতকে রুমে ঢুকতে দেখেও কিছুই বললেন না। তার মনোযোগ সম্পূর্ণ কৃষ্ণার উপর। হিনহিনে গলায় তখন দেবব্রত বললো,
– এসব আদিক্ষেতা কিসের চলছে?
-………
– কিছু জিজ্ঞেস করছি
– তোমার কথার উত্তর দেওয়া আমি প্রয়োজন বোধ করছি না
– তোমার প্রয়োজন বোধ না করলেও আমার জানার অধিকার আছে, আর যে আসবেই না তার জন্য এতো আনন্দ করার কোনো মানেই হয় না।
– দেবব্রত
– আমি যখন বলেছি এবোর্শন হবে তাহলে হবে
এবার অবন্তীকা দেবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো দেবব্রতের উপর। তারপর হিনহিনে কন্ঠে বললেন,
……….
চলবে
#কৃষ্ণাবতী
#৩৩তম_পর্ব
এবার অবন্তীকা দেবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো দেবব্রতের উপর। তারপর হিনহিনে কন্ঠে বললেন,
– শোনো দেবব্রত, কখনো কিছু বলি নি মানে এটা নয় কিছু কখনোই বলবো না। আমার বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে, আমি চাই না তুমি কোনো ঝামেলা করো। এমতেই আমার বউমার শরীরটা ভালো নেই।
– হিপোক্রেসির একটা লিমিট থাকে মা, আজ কৃষ্ণা প্রেগন্যান্ট বলে তুমি তাকে মাথায় তুলে রেখেছো। এটা তোমার জানারও প্রয়োজনীয়তা নেই কৃষ্ণার এতে কোনো ক্ষতি হবে কি না! বাহ! এতোদিন তুমি কৃষ্ণার সাথে কথাও বলতে চাও নি, কিন্তু যেই দেখলে কৃষ্ণা প্রেগন্যান্ট অমনি তুমি বদলে গেলে। কেনো মা?
দেবব্রতের কথায় যেনো মুখে তালা লেগে গেলো অবন্তীকা দেবীর। নিজের মাকে দুয়েক বাক্যে চুপ করিয়ে দিতে পারবে এটা যেনো বিষ্ময়কর আবিষ্কার। দেবব্রতের কথাটা যে ভুল নয় এই কথাটা খুব ভালো করেই জানেন অবন্তীকা দেবী। ছেলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে কথাটা বুঝিয়ে দেওয়াতে বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেন অবন্তীকা দেবী। দেবব্রত এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– কৃষ্ণার ক্ষতি আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না, তার জন্য যদি আমাকে সন্তানহীন জীবন কাঁটাতে হয় তাতেও আমি রাজী।
– কৃষ্ণার ক্ষতি মানে?
– মানে টা হলো, কৃষ্ণার প্রেগ্ন্যাসিতে ডিফিকাল্টিস আছে। বাচ্চাটা ক্যারি করাটা ওর জন্য রিস্কি হবে।
– এটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। বাচ্চা নেবার জন্য সবারই একটু আকটু সমস্যা থাকেই।
– মা তুমি কি সত্যি ই বুঝতে পারছো না?
– আমি দুনিয়াতে তোমার পরে আসি নি! তুমি হবার সময় ও আমার অনেক ধকল গেছে, এখন এটাকে যদি তুমি ধরে বসে থাকো তবে কেউ ই মা হতে পারবে না।
– মানুষের কথা আমি জানতে চাই না মা। আমার কৃষ্ণার কোনো ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না। তোমার জিদের কারণে তোমার চাপের কারণে আজ কৃষ্ণা নিজের ক্যারিয়ার বলি দিচ্ছে। নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে দিয়ে সে এই বাচ্চাটা রাখতে চাচ্ছে। এই বাচ্চাটার কারণে যদি ওর কোনো ক্ষতি হয় তাহলে কি তুমি সেই দায় নিবে!
এবার যেনো নিজেকে একেবারেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না দেবব্রত। যেই ছেলে কখনো মায়ের সাথে উঁচুগলায় কথা বলে নি সেই ছেলেটা আজ রীতিমতো চিৎকার করছে। মা ছেলের মাঝে এই বিবাদ যেনো একেবারেই মেনে নিতে পারছে না কৃষ্ণা। রীতিমতো কথার কুরক্ষেত্র লেগেছে তাদের মাঝে। তখন কৃষ্ণা ধীর গলায় বলে উঠলো,
– আমি কারোর চাপে সিদ্ধান্ত নেই নি, আমি নিজে মা হতে চাই। আমি বাচ্চাটা রাখতে চাই।
কৃষ্ণার কথায় দেবব্রত চুপ হয়ে যায়। চোখজোড়া সরু করে এক দৃষ্টিতে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে রইলো। অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে কৃষ্ণা তার দিকে তাকিয়ে রইলো। কৃষ্ণার কথায় খানিকটা জোর পেলো অবন্তীকা দেবী। গর্বের স্বরে বললেন,
– শুনে নিয়েছো? এবার যেনো এবোর্শনের উচ্চারণ তোমার মুখে না শুনি।
বলেই হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন অবন্তীকা দেবী। দেবব্রত তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। খুব কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো কৃষ্ণা। ধীর পায়ে হেটে দেবব্রতের সামনে দাঁড়ালো সে৷ অসহায়ের মতো বললো,
– মাষ্টারমশাই, আমরা কি পারি না একটা স্বাভাবিক দম্পতির মতো সংসার করতে! স্বাভাবিকভাবে আমাদের আগত শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে!
– স্বাভাবিক দম্পতির কোনো সিদ্ধান্ত যেকোনো একজন নেয় না কৃষ্ণা। সব সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েই নিয়েছিস তাহলে আমাকে জানানোর কি প্রয়োজন, তোর যেটা ভালো মনে হয় তুই কর। আমাকে কিছু বলতেও আসিস না আবার আমাকে কিছুতে জড়াস ও না।
কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় কৃষ্ণা। চোখ জোড়া আপনা আপনি ছলছল করে উঠে। জীবনের সুখময় অনুভূতিটা যেনো বিষাক্ত কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। দেবব্রত সটান রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। কৃষ্ণা সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। হাতটা আপনা আপনি পেটের কাছে চলে যায়। দু হাতে পেট আকড়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে কৃষ্ণা। কেউ তার অনুভূতিগুলো কেনো বুঝে না, সবাই শুধু নিজেদেরকেই সঠিক প্রমাণে লেগে রয়েছে।
২৭.
সন্ধ্যা ৭টা,
স্থানঃ- গুলশান
বন্ধুদের সাথে বসে রয়েছে দেবব্রত। আজ বহু বছর পর বন্ধুরা একত্রিত হয়েছে। উপলক্ষ্য সৌদামিনী। এই বন্ধুদের সাথে একটা সময় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো, আড্ডা দিতো। আজ যেনো পুরোনো স্মৃতি গুলো তাজা হয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণাকেও নিয়ে এসেছে সে। কৃষ্ণা এক কোনায় চুপ করে বসে রয়েছে। সৌদামিনীর সাথে এখনো কথা হয় নি দেবব্রতের। অনেক বদলে গেছে সৌদামিনী। শ্যামলা বাঙ্গালী মুখটা এখন আর বাঙ্গালী নেই। লম্বা কেশটুকু ও কেটে ফেলেছে সে। এখন আর চোখে কাজল দেয় না সৌদামিনী। মুখের মায়াবী ভাবটাও রুক্ষতায় পরিণত হয়েছে। অনেকটাই পালটে গেছে দামিনী। আড্ডার মাঝেই সৌদামিনী এসে বসলো রবিনের পাশে।
– তোদের কিছু লাগবে?
– নারে, আয় না বস একটু
জোর করে কথাটা বলে রবিন। রবিনের কথা শুনে ঠোঁটের কোনায় হাসি টেনে রবিনের পাশে বসে সৌদামিনী। দেবব্রতের বেশ অন্যরকম লাগছে, খানিকটা অস্বস্তি ও বোধ হচ্ছে তার। কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। তখন রবিন বলে উঠলো,
– আমাদের টিমে সবাই এক থেকে দুই, কেউ কেউ তিন হচ্ছে বা হবে। তোর কথাটা এবার বল দামিনী!
রবিনের কথায় ঠোটের কোনায় একটা ম্লান হাসি দিয়ে দামিনী বললো,
-………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#কৃষ্ণাবতী
#৩৪তম_পর্ব
– আমাদের টিমে সবাই এক থেকে দুই, কেউ কেউ তিন হচ্ছে বা হবে। তোর কথাটা এবার বল দামিনী!
রবিনের কথায় ঠোটের কোনায় একটা ম্লান হাসি দিয়ে দামিনী বললো,
– আমার দুই হওয়া নিয়ে তোরা বেশ চিন্তায় আছিস দেখছি।
– অবশ্যই, তোর বিয়ে খাওয়ার সুযোগ হারাতে চাই না। কবে করছিস বিয়ে?
– তাহলে তোর আশায় গুড়ে বালি
– কেনো?
– কারণ, আমার বিয়ে…..
কথাটা বলার পূর্বেই সৌদামিনীর ফোনে একটি ফোন আসে। ফোনটি রিসিভ করার মিনিট পাঁচেক পর ই একজন পুরুষ তাদের কাছে এসে দাঁড়ায়। লোকটি দেশী মানুষ নয় সেটা চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। শ্বেত বর্ণের একজন পুরুষ, উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট, বাদামী চুল গুলো কপালে পড়ে রয়েছে, চোখ জোড়া ঘোলাটে। লোকটির বয়স দেবব্রতদের কাছাকাছি। সবাই অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে সৌদামিনী ঠোঁটের কোনায় হাসি একে বলে,
– মিট মাই হাসবেন্ড পিটার।
– হাসবেন্ড?
অবাক কন্ঠে রবিন প্রশ্নটা ছুড়ে মারে৷ সৌদামিনী তখন ধীর কন্ঠে বলে,
– তোদের আশায় গুড়ে বালি, আমার বিয়ে তোদের আর খাওয়া হলো না। কয আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
পিটার মুচকি হেসে সবার সাথে হ্যান্ডসেক করে। দেবব্রতের অস্বস্তি বোধটা একটু হলেও কম হয়ে যায়। পিটারের সাথে ঘন্টা খানেক সবার জমিয়ে আড্ডা হয়। পিটারের জন্ম কানাডাতে, সেখানেই সে বড় হয়েছে, তার মা শতাব্দী দেবী বাঙালী যে কারণে তার বাংলাটা বেশ ভালো ভাবেই রপ্ত। বিদেশে থাকাকালীন পিটারের সাথে পরিচয় হয় সৌদামিনীর। বিদেশে বাঙ্গালী হিন্দু পাওয়াটা খুব দুষ্কর ব্যাপার। তাই পিটার তার মার সাথে সৌদামিনীর পরিচয় করিয়ে দেয়। পিটারের বাবা ম্যাথিউ সাহেব মারা গিয়েছিন বছর পাঁচেক হবে তখন। তাই একাকীত্বের মাঝে বেশ সময় কাটানোর সঙী পেয়েছিলেন তিনি। দামিনী এবং পিটারের বন্ধুত্বটা ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে। গভীরত্বকে সম্পর্কের রুপ দিতেই পিটার তাকে তার মনের কথাগুলো বলে। সৌদামিনীও কোথাও না কোথাও পিটারের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে। দুজন ভিন্ন ধর্মের মানুষ, এটাই তাদের সম্পর্কের প্রধান ঝামেলা ছিলো। ঘোর ব্রাক্ষণ হওয়াতে অনুরাগ বাবু তার সম্পর্কের বিরোধিতা করেন। অনেক ঝামেলা হচ্ছিলো বলে দামিনী কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। সবার মতের বিরুদ্ধে পিটারের সাথে সে কোর্ট ম্যারেজ করে। বাংলাদেশে আসার মূল কারণটাই হলো বাবার সাথে বোঝাপড়া। ধর্ম ব্যাপারটা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো খুবই সেন্সিটিভ। তাই হয়তো অনুরাগ বাবু এখনো দামিনীকে মেনে নেন নি। পিটার এবং সৌদামিনী ভালো আছে দেখে দেবব্রতের চোখ আপনা আপনি কৃষ্ণাতে আটকে গেলো। এককোনায় ম্লান হাসি টেনে বসে রয়েছে। কেউ কথা বলতে চাইলে হাসিটা টেনে কথা বলছে। তার দৃষ্টিটা খুব ক্লান্ত। এক সপ্তাহ ধরে কোনো কথা হয় নি কৃষ্ণার সাথে। এই একটা সপ্তাহ না জানি কতটা কষ্ট দিয়েছে সে কৃষ্ণাকে। কথাটা ভাবতেই বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয় দেবব্রতের৷
– কেমন আছিস দেব?
সৌদামিনীর প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে দেবের। মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
– এইতো চলছে
– শুনলাম কৃষ্ণাকে নাকি জাপান থেকে স্টাডির অফার এসেছে?
– তুই কি করে জানলি?
– শুনলাম আর কি, তো কি প্লান? ওকে একাই পাঠাবি?
– ওর যাওয়াটা ক্যান্সেল করে দিয়েছি
– হঠাৎ?
– কৃষ্ণা প্রেগন্যান্ট
কথাটা শোনামাত্র একটু চুপ হয়ে যায় দামিনী। মানুষ খুব অদ্ভুত যতই হোক প্রাক্তনের জন্য কোথাও না কোথাও বুকের মাঝে হাহাকার হবেই, জীবনটা যদি রঙ্গিনও হয়ে যায় তবুও এই ব্যাপারটা হয়৷ দামিনী ম্লান হাসি হেসে বলে,
– বাহ! কংগ্রেচুলেশন
– হুম
– তুই কি ব্যাপারটায় অখুশী
– কেনো বলতো?
– মনে হলো, আসলে মানুষ বাবা হতে যাচ্ছে ব্যাপারটা যেভাবে প্রকাশ করে তুই সেভাবে প্রকাশ করিস নি। তাই বললাম আর কি? সব ঠিক চলছে তো?
– তোর কাছে কেনো যেনো কিছু লুকাতে পারি না। না সব ঠিক চলছে না। আসলে বাচ্চাটাকে নিয়ে আমাদের মাঝে মনোমালিন্য চলছে, কিছু কারণে আমি বাচ্চাটা চাইছি না। কিন্তু কৃষ্ণা তার জিদে বসে রয়েছে। ওর জিদ মেনে নেওয়াটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ওর এই বাচ্চামি
– মাতৃত্ব কখনো বাচ্চামি হয় না দেব। আমি ওর জায়গাতে থাকলেও আমিও একই বাচ্চামি একই জিদ করতাম। আমার এজ হয়েছে, বেবি নিতে অসংখ্য ডিফিকাল্টিস আছে। কিন্তু তবুও আমরা ট্রাই করে যাচ্ছি। আর পিটার আমাকে যথারীতি সাপোর্ট ও করছে। এই সময়টা খুব ক্রুশাল দেব, কৃষ্ণার এখন তোর সাপোর্টের দরকার। ওর মানসিক চাপের জন্য ও কিন্তু ওর হেলথ খারাপ হতে পারে।
সৌদামিনীর কথাটা দেবব্রত চুপ করে শুনলো। সৌদামিনীর কথাটায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কৃষ্ণাকে আজকাল প্রচুর ক্লান্ত লাগে। ওর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থাটা ভালো নয়। এবোর্শনের চাপ দেওয়টাই সকল সমস্যার সমাধান কখনোই হতে পারে না। একজন নারীর মনোবাঞ্চাটা বোঝাটাও একজন স্বামীর জন্য মাঝে মাঝে জরুরী হয়ে পরে। দামিনীর কথাগুলো শুনে দেবব্রতের ভেতরে খানিকটা হলেও গ্লানির উদ্ভব হয়।
রাত দশটা,
রুমে এসে বিছানায় পা মেলে দেয় কৃষ্ণা। পাটা খানিকটা ফুলে গেছে। শরীরটাও দূর্বল লাগছে। আজকাল একা একা থাকতে হয় তাকে। দেবব্রত সেদিনের পর থেকে স্টাডিতে থাকে। মাথায় হাত দিয়ে হেলান দিয়ে বসে ছিলো কৃষ্ণা ঠিক তখনই দেবব্রত ঘরে প্রবেশ করে। কারোর আগমনের অনুভুতি হতেই উঠে বসে কৃষ্ণা। চোখ মেলে দেখে তার সামনে দেবব্রত দাঁড়ানো হাতে গরম পানির গামলা৷
– কিছু লাগবে মাষ্টারমশাই?
কৃষ্ণা তাড়ার কন্ঠে প্রশ্নটা করে৷ কোনো উত্তর না দিয়েই মাটিতে গামলাটা রাখে। অন্যদিকে ফিরে ধীর কন্ঠে বলে,
– গরম লবণ পানিতে পা ভিজিয়ে রাখলে আরাম পাবে। এতে পা টা ফোলাও কমবে আর ক্লান্তিও কাটবে।
দেবব্রতের কথাটা ঝড়ের বেগে বলে বেড়িয়ে গেলো। কৃষ্ণা এক নজরে দেবব্রতের দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটা তার কথা একেবারেই যে ভাবে না না নয়। কিন্তু কোথাও যেনো তাদের সম্পর্কের সুরটা মিলছে না। কৃষ্ণা সেই অমিলটুকু খুজে পাচ্ছে না। হয়তো সেটা সময়ের অপেক্ষা_________
২৮.
ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ। আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘ উড়ছে, আর ঢাকার বাতাসে ধুলো। ভ্যাবসা একটা গরম, সূর্যের তাপে গা পুড়ে যাবার দশা। এর মাঝে গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে দেবব্রত। কপালে চিন্তার ভাজ, চোখ জোড়া বুজে রয়েছে। তার ঠিক পাশেই ফাইল হাতে কৃষ্ণা বসে রয়েছে। কৃষ্ণার মুখে আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ জমেছে। কৃষ্ণার প্রেগ্ন্যাসির তিনমাস হতে চলেছে। কিন্তু বেবীর গ্রোথ কিংবা কৃষ্ণার শারীরিক অবস্থা আশানুরূপ ভালো নয়। কৃষ্ণা পেট আকড়ে বসে রয়েছে। ভয়ে গলা কাঁপছে৷ হঠাৎ দেবব্রত বললো,
– কৃষ্ণা, এবোর্শনটা করে ফেলি। তোর তো কিছুই অজানা নয়! প্লিজ এবার জিদ করিস না। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি মরে যাবো।
– মাষ্টারমশাই তোমার পায়ে পড়ি এমনটা বলো না। ওকে হারালে আমি আর কখনো মা হতে পারবো না। প্লিজ মাষ্টারমশাই
– আমায় ক্ষমা কর, আমি আর পারছি না। তোকে হারালে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। আমাকে এর চেয়ে মেরে ফেল তুই। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। সব ব্যাবস্থা হয়ে গেছে।
– না, মাষ্টারমশাই আমি আমার বাচ্চা হারাতে রাজী নই।
কৃষ্ণার আকুতি যেনো কৃষ্ণার কান অবধি যাচ্ছে না। গাড়ি থেকে নেমে হাতটা টেনে দেবব্রত হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণাকে। তখনই……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি