গল্পঃ কেউ কথা রাখেনি
পর্বঃ০৫ (শেষ পর্ব-১ম অংশ)
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)
কিছুক্ষন পর নার্স এসে আমাকে ইনজেকশন দেয়।
আস্তে আস্তে আমার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে।
কে জানে এই দুইটি চোখ আর কখনো খুলবে না কিনা?
.
টানা চারঘন্টা মিথিলার অপারেশন চললো। ওটির বাইরে বসে মিথিলার মা কখনো আফরিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আবার কখনো দোয়া-দরুদ পড়ছে। মনে মনে একটাই প্রার্থনা তার মেয়েটা যেন ফিরে আসে।
মিথিলার জীবন অপারেশন থিয়েটারেই
থেমে গিয়েছিল। মিথিলা আর ফিরে আসে নি।
মিথিলার অপারেশন ঠিকঠাকই হয়েছিল কিন্তু
ওর জ্ঞান আর ফিরে নি। একবুক চাপা কষ্ট নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল সকলের কাছ থেকে। মিথিলার ছোট্ট মেয়ে আফরিন হারিয়ে
ছিল ওর পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সম্পদটিকে, আপন মানুষটিকে।
দীর্ঘ তিনবছর পরে আরাফও সেদিন বিদেশ থেকে ফিরে এসেছিল কিন্তু মিথিলাকে আর জীবিত
দেখতে পায় নি। এসেছিল মিথিলার জীবনের শেষ যাত্রায় অংশ নিতে। মিথিলার শেষবারের কথাগুলো মনে করে বারবার আফসোস হচ্ছিল আরাফের।
হয়ত এত অবহেলার কারণে মিথিলাকে হারিয়ে ফেলেছে আরাফ।
যথারীতি মিথিলার দাফনকাজ সম্পন্ন হলো। আরাফ কিছুতেই যেন মিথিলার মৃ*ত্যুকে মেনে নিতে পারছে না। প্রচুর কান্না পাচ্ছে ওর।
মেয়েটা ওকে প্রচন্ড ভালোবেসে পরিবারের অমতে
পালিয়ে এসে বিয়ে করেছিল। তার বিনিময়ে আরাফ
এক বিদেশিনীর প্রেমে মত্ত হয়ে ওর ভালোবাসা, ওর আত্মত্যাগ ভুলে গিয়ে ওকে বড্ড অবহেলা করেছে, ওকে ঠকিয়েছে এ ভুলের কি কোনো ক্ষমা হবে?
.
দুইদিন পরে,
আরাফ আলমারি থেকে মিথির শাড়িগুলো বুকে জড়িয়ে নিরবে কাঁদছিল। হঠাৎ চোখ পড়লো
আলমারিতে রাখা অনেকগুলো ছোট ছোট রঙিন
কাগজের ওপর। হাতে নেওয়ার পর দেখলো সেখানে
সযত্নে অনেক কিছু লিখা। আরাফ চিরকুটগুলো পড়া শুরু করলো,পাশে তারিখও লিখা। সেখানে অনেক অভিমান নিয়ে লেখা,
‘তোমার কি কখনো আমাকে মনে পড়ে না? আমাদের খুনসুটিতে ভরা রঙিন দিনগুলো কি ভুলে গেছো?’
এরপর আরেকটা চিরকুটে লিখা,
‘পহেলা ফাল্গুনে আমারও ভীষণ ইচ্ছে হয় অন্য কাপলদের মতো হলুদপরী সেজে তোমার সাথে ঘুরার? কবে আসবে সেদিন? ‘
‘ জানো আরাফ, তোমাকে যখন খুব মিস করি তখন
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। জানি সেখানে তোমার দেখা পাব না। কিন্তু নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেই যে, দুজন তো একই আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একই আকাশ দেখছি। আচ্ছা, তুমি কি এখন আর আগের মতো আমাকে ভালোবাসো না?
#কেউ_কথা_রাখেনি_ভালোবাসেনি
কেউ চুপিচুপি পায়ে কাছে আসে নি।’
এভাবে আরাফ আরো কয়েকটি চিরকুট পড়লো।
শেষ চিরকুটটা ছিল মিথির অপারেশনের কয়েকদিন আগে লিখা। অনেক বড় ছিল।সেখানে লিখা ছিল-
‘ তুমি যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিলে তুমি শীঘ্রই ফিরে আসবে কিন্তু তুমি আসো নি। আমাকে দেওয়া
কথা রাখো নি। অথচ আমি ঠিকই আমার কথা রাখতে পরিবারের অমতে চলে এসেছিলাম। আমার হাতে সময় খুব কম। এ পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁচব না।
যেদিন চলে যাব সেদিন ঠিকই আমাকে খুঁজবে কিন্তু
আমাকে কোথাও পাবে না,কোথাও না। তোমার কথা মনে পড়লে আমি চিরকুটগুলো লিখি। এখন তো ব্যস্ততার জন্য আমার সাথে ফোনেও ঠিকমত কথা বলো না। তুমি কথা রাখো নি।
#কেউ_কথা_রাখেনি।
.
আরাফ চিরকুটগুলো পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আগে মিথির যতটা কেয়ার করতো, ভালোবাসত বিদেশে যাওয়ার একবছর পরে মিথির কথা ভুলে এক বিদেশিনীর প্রেমে পড়ছিল।
বিদেশিনীর প্রেমে মশগুল হয়ে মিথিকে অবহেলা করেছে। একবছর হয়েছে আরাফ এলিসার সাথে
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। আরাফ কখনোই
মিথিকে ঠকাতে চায় নি, কিন্তু এলিসাকে দেখে
মিথির কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ আরাফ
দেখল মিথি ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ও আরাফকে
বলছে,
— ভালোই হয়েছে আরাফ তোমার কাছ থেকে ঠকার আগেই আমি ম*রে গেছি। না হয় তোমার
দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনলে আমি এমনিই ম*রে যেতাম। কত শতদিন, কত প্রহর তোমার অপেক্ষায় কাটিয়েছি । প্রতিশ্রুতি করে যখন রাখতে পারবে
না,কে বলেছিল তোমায় প্রতিশ্রুতি করতে? ভালোই
যখন বাসতে পারবে না তখন কেন আমাকে বিয়ে করেছিলে? তুমি কথা দিয়ে কথা রাখ নি। হারিয়ে গেলে খুঁজে কি লাভ? যেখানে বেঁচে থাকতে খোঁজ নাও নি।
#কেউ_কথা_রাখেনি_ভালোবাসেনি।
— আ-আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মিথি। আমি না বুঝে ভুল করেছি।
— কিছু ভুলের কোন ক্ষমা হয় না আরাফ।
বলে ধীরে ধীরে মিথিলার অবয়বটি ধীরে ধীরে মুছে
যেতে লাগল।
আরাফ বুঝতে পারলো এতক্ষণ সে
মিথিলাকে নিয়ে কল্পনা করছিল। তবে কল্পনার মিথিলা ঠিকই বলেছে,
‘কিছু ভুলের কোন ক্ষমা হয় না।’
#চলবে