কৈশোরে প্রেম অংশ: ০১

0
5401

কৈশোরে প্রেম
অংশ: ০১
লিখা: বর্ণালি সোহানা

“তুমি নিজেকে একবার দেখ আর আমাকে দেখ। বডির সাইজ দেখেছ? বিবাহিত মহিলা টাইপ হয়ে গেছ। মনে হয় এক বাচ্চার মা। এই তোমার সাথে আমার এখন ঠিক যায় না। তুমি তোমার মতো কাউকে খুঁজে নিও।”, নাহিয়ানের পাঠানো শেষ মেসেজটা দেখছিল প্রহেলি।

টানা অনেকদিন কান্না করলেও আজ তার চোখে জল নেই। সব ব্যথা সয়ে গেলেও আজ পরিবারের সামনে বেরুতে লজ্জা পায় সে। দীর্ঘ চার বছর পরিবারকে বোঝাতে বোঝাতে যখন রাজী করালো নাহিয়ান ঠিক তখনই তার সাথে বিচ্ছেদের সমান্তরাল রেখা টেনে দিল। যে রেখার শুরু তো আছে কিন্তু কোনো সমাপ্তি নেই। বিচ্ছেদের কারণ কী ছিল জানেন? তার সাথে প্রহেলিকে মানায় না। বন্ধুমহলে সে লজ্জা পায়। এত মোটা একটা মেয়ে তার মতো সুদর্শন যুবকের প্রেমিকা কীভাবে হয়! আগের মতো তার দৈহিক সৌন্দর্য নেই। শূন্য পকেটে তার সাথে থাকা এই মেয়েকে এখন পূর্ণ পকেটে এসে মানিয়ে নিতে পারছে না। দীর্ঘ ছয় বছরের প্রেম ছিল তাদের। এক বছরের মাথাতেই বাড়িতে ধরা খেয়ে যায় প্রহেলি। কিন্তু তখনো সম্পর্ক ভেঙে যায়নি তাদের। এখন এই ঠুনকো কারণে সম্পর্কটা ভেঙে দিল! নাহিয়ানের সাথে শেষ কথা বলতে চায় সে। রিকশার চাকা ঘুরছে ধীর গতিতে। প্রহেলি নিজের দিকে তাকায় একটা রিকশার বেশ অর্ধেক জায়গা সে জুড়ে নিয়েছে। খানিকটা নয় সে অনেকটাই মুটিয়েছে। আসলেই তো এমন মেয়ের সাথে কে সম্পর্ক রাখতে চাইবে! অথচ সে আগে তো এমন ছিল না! স্কুল, কলেজে থাকতে তার পেছনে ছেলেরা ঘুরঘুর করতো। তখন সে কাউকেই পাত্তা দিত না কেবল নাহিয়ানের কারণে। দিন কত দ্রুত চলে যায়, সেই সাথে বদলে যায় মানুষের মনও। রিকশাটা ছেড়ে দিয়ে ঝিলের পাড়ে বসে পড়ে সে। বিবর্ণ পানির দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। অতীতের স্মৃতিগুলো মনের দরজায় কড়া নাড়ছে৷

তখন সময়টা ২০০৭ সালের এপ্রিল মাস। তখন ক্লাস টেনে পড়ে প্রহেলি। সামনে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। তারা চার বান্ধবীর একটা গ্রুপ। ইলমা, অপি, পূজা আর প্রহেলি। অপি অনেকটা চঞ্চল স্বভাবের। এই বয়সেই সে মাত্রাতিরিক্ত পেকে গেছে। তার মুখে সবসময় অশ্লীল সব কথাবার্তা। আর ইলমা সেসব কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে গিলে। তারা যখন এসব কথা বলে তখন পূজা হাই পাওয়ারের চশমা চোখে দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর বলে, “ছিঃ ছিঃ তোরা এসব অশ্লীল বিষয় নিয়ে কীভাবে আলোচনা করতে পারিস!”

পূজা যথেষ্ট পড়ুয়া স্বভাবের কিন্তু কখনোই পাঁচের ভেতরে রোল আনতে পারে না। পরীক্ষার সময় তার মা তাকে কোনোদিন ডিম খেতে দেন না। ডিম খেলে নাকি সেও ডিম পাবে৷ কত মন্দিরে গিয়ে তার নামে পূজো দেন কিন্তু কোনো কাজে আসে না। অন্যদিকে প্রহেলি একটু আধটু পড়েই কীভাবে যেন এক রোল হয়ে যায়। তাকে অবশ্য এর কারণে একটা কথা প্রায়ই শুনতে হয়, “তোর বাবা শিক্ষক নিশ্চয়ই তিনি তোকে আগেভাগে প্রশ্ন নিয়ে দেন আর তুই সব গিলে পরীক্ষার খাতায় এসে উগলে দিস।”

অথচ এরকমটা কখনোই হয়নি। প্রহেলি যে-কোনো পড়া একবার পড়লেই মনে থাকে।

নাহিয়ান তাদেরই ক্লাসমেট। ক্লাস সিক্স থেকে প্রহেলির রোল সবসময় এক ছিল আর তার রোল দুই। কখনোই সে তাকে পেছনে ফেলতে পারতো না। দশম শ্রেনিতে উঠার পর ‘ক’ শাখাতে প্রহেলির রোল এক হয় আর ‘খ’ শাখাতে গিয়ে তার রোলও হয় এক। তখন একদম বরাবর অবস্থানে ছিল দু’জন। মেহরাব, শুভ্রত আর নাহিয়ান খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

টিফিন পিরিয়ডে প্রহেলি আর তার বান্ধবীরা মাঠে বসে গল্প করছিল। দিব্য তখন প্রহেলির সামনে এসে দাঁড়ায়। সে বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল রহমানের ছেলে। দিব্য অনেক ভালো গান গায়। স্কুলের ক্ষুদে শিল্পী সে। যেখানেই যায় প্রথম প্রাইজটা নিয়ে আসে। পড়ালেখাতেও দারুণ ভালো। ক্লাস এইটের ফার্স্ট বয় সে। প্রহেলির বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এক হাতে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কী রে শিল্পী, কী চাই? কিছু বলবি?”

সবগুলো দাঁত বের করে হেসে দেয় দিব্য৷ হাসলে কী সুন্দর লাগে তাকে। সবগুলো দাঁত আঁকাবাঁকা। একটার উপর দিয়ে আরেকটা উঠে গেছে। এই বয়সেই চশমা পরে৷

“আপু এইটা তোমার জন্য।”

একটা ঠোঙায় করে বাদাম এগিয়ে দেয়। অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। দিব্যের একটা গাল টেনে জিজ্ঞেস করল, “শিল্পী, কে দিয়েছে রে এটা?”

সে কোনো কিছু না বলেই দৌড়ে পালিয়ে যায়। বার কয়েক পেছন থেকে ডাকলো কিন্তু তাকে আর পায় কে! প্রহেলি বাদামগুলো খায় না। ফেলে দিতে চাইলে ইলমা তার হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়।

অপি বলল, “তুই না খেলে কী হলো? আমাদের খেতে সমস্যা নেই।”

বাদামগুলো ঠিকই সবাই ভাগ করে খায় কিন্তু সে ছুঁয়েও দেখে না। ভাবতে থাকে তাকে আবার কে বাদাম দিতে পারে। নাকি দিব্যই দিল!

ছুটির পর যখন গেটে দাঁড়িয়ে ছিল তখন নাহিয়ান এসে জিজ্ঞেস করে, “আমার দেওয়া বাদাম নাকি তুই ফেলে দিতে চেয়েছিস?”

প্রহেলি কিছুটা অবাক হয়। যে ছেলের সাথে আজ অবধি ভালোমতো কথা হয়নি সে কেন তাকে বাদাম পাঠালো!

“তুই কেন আমাকে বাদাম দিলি? আর আমি কেন সেটা খাব?”, বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করে।

সে তার পেছন পেছন সাইকেল নিয়ে আসে। কিছুদূর এসে বলে, “দেখ প্রহেলি আমি তোকে পছন্দ করি, মানে ভালোবাসি।”

আরো একবার ধাক্কা খায়। হাঁটা থামিয়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো গালমন্দ করে সেদিনের মতো চলে যায়। কিন্তু তখনও জানতো না তার পাগলামী কতটা বাড়তে থাকবে। তারপর থেকে সে প্রতিদিন তার পিছুপিছু আসতে লাগে। কখনো বন্ধুবান্ধব নিয়ে, কখনো একা একা। এমনকি ছুটির দিন বিকেল বেলাতেও তাকে তাদের বাড়ির সামনে দেখা যায়। বান্ধবীরা এটা নিয়ে প্রতিদিন মজা করতো। বোর্ডের কোণায় প্রহেলির নামের সাথে প্লাস দিয়ে তার নাম লিখে দিত। যে বেঞ্চে বসতো সেই বেঞ্চেই লিখা থাকতো, “I love you Proheli”, “Proheli+Nahiyan”

একসময় পুরো ক্লাস জেনে যায় নাহিয়ান তাকে ভালোবাসে। তাদের মধ্যে কিছু একটা চলছে। কিন্তু তখনো কিছুই শুরু হয়নি। স্যারের কাছে বিচার দিলে তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করা হয়। সে তখন বলে, “স্যার আমি এসব করিনি। কে বা কারা এসব করছে কিছুই জানি না।”

কোনো বিচার হয় না নাহিয়ানের৷ ক্লাসের সবাইকে সাবধান করে দেওয়া হয়। তারপরেও এসব থেমে থাকে না। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও ধীরে ধীরে তারও এসব ভালো লাগতে শুরু করে। সব বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড আছে কেবল তার নেই। বড় ক্লাসের ছেলেদের সাথে সম্পর্ক একেক জনের। এটা ভাবতেই আরো খারাপ লাগা শুরু করে।

হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে সেও প্রেম করবে। ভয়ে ভয়ে একটা চিরকুট লিখে। চিরকুটে লিখে দেয়, “I love you Nahiyan”

চিরকুট লিখতে দেখে নেয় পূজা। ম্লান গলায় তাকে বলে, “দেখ প্রহেলি তুই অনেক ভালো স্টুডেন্ট। এই বয়সে এসব করিস না। তোর বাবা জানতে পারলে অনেক সমস্যা হবে।”

পূজাকে থামিয়ে দিয়ে ইলমা বলে, “তুই তোর মায়ের খুকি হয়ে আছিস বলে কী সেও থাকবে? একদম বাঁধা দিবি না। তুই গিয়ে ফিডার খা ওর এখন অন্য কিছু খাওয়ার সময় এসে গেছে। প্রহেলি তুই চিরকুট দিয়ে পাঠা। আমরা সাথে আছি।”

পূজার কথায় দ্বিধায় পড়ে গেলেও ইলমার কথায় আবার মনোবল ফিরে পায় সে। এই কাজ অপি ছাড়া কাউকে দিয়ে করাতে পারবে না। চিরকুটটা অপির হাতে ধরিয়ে দেয় নাহিয়ানকে দেওয়ার জন্য। অপি এমনিভাবে তৈরি হয়ে যেন সে কোনো রণক্ষেত্রে যাচ্ছে। ইলমা হাসি আটকানোর যথেষ্ট চেষ্টা করে। অপিকে নাহিয়ানদের ক্লাসের দিকে পাঠিয়ে তারা তিনজন আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগে। প্রহেলির বুক ধড়ফড় করছে। চুপচাপ দাঁত দিয়ে হাতের নখ খুঁটতে লাগল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here