কৈশোরে প্রেম
অংশ: ০৫,০৬
লিখা: বর্ণালি সোহানা
অংশ: ০৫
“পনেরো বছরের ধাড়ি কুলাঙ্গার হয়ে কীভাবে মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল করলি তুই? পড়ালেখায় কী মন ছিল? থাকলে তো ফেল করতি না। বদমাইশ ছেলেপেলের সঙ্গ ধরে নষ্ট হয়েছিস। আমার মান সম্মান আর কিছুই বাকি রাখিসনি। এত টাকা আমি তোর পেছনে খরচ করে আজ কী পেলাম? আর পরীক্ষা দেওয়াবো না তোকে। রমিজের ওয়ার্কশপে গিয়ে কাজ শিখ। দু’টাকা রোজগার করলে বুঝবি বাপের টাকা কেমনে উড়াইছিস।”, বাবার বলা কথাগুলো বারবার মেহরাবের কানে বাজছে।
ছাদের উপর দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। জীবনটাকে বড় মূল্যহীন মনে হচ্ছে তার। পাখির মতো উড়াল দিলেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে। মা-বাবার মান সম্মান আর টাকা খরচ নিয়েও ভাবতে হবে না। পৃথিবীর মানুষ তাকে ভালোবাসে না। মা-বাবা ভালোবাসে না তাকে। ইলমাও ভালোবাসে না। ভালোবাসা এক মহামূল্যবান জিনিস যা সবার কপালে জুটে না। যার ফলস্বরূপ কেউ কেউ মরে গিয়ে বেঁচে যায় আর কেউ কেউ বেঁচে থেকেও প্রতিদিন অগণিতবার মরে। মেহরাব মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আকাশে মুক্ত পংখী হয়ে উড়াল দিল। কিন্তু তার গন্তব্য আকাশে নিয়ে গেল না বরং মাটিতে আছড়ে ফেললো।
সবাই যে যার পছন্দের ভালো কলেজে ভর্তি হয়। ব্যাঘাত ঘটান প্রহেলির বাবা। শামসুল গাজী নিজ শহর ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরের একটা স্কুলে হেডমাস্টার হয়ে যোগদান করেন। পরিবারকে এই শহরে একা রেখে যাওয়া অনুচিত মনে হয় তার কাছে। কিছুদিনের মধ্যে পরিবারকেও নিয়ে যেতে চান তিনি। প্রহেলিকে সেখানের একটা কলেজে ইন্টার ভর্তি করে দেবেন। শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে নাহিয়ানের সাথে দেখা করতে চায়। মায়ের মোবাইল এনে কয়েকবার কল দেওয়ার পর রিসিভ করে নাহিয়ান।
নাহিয়ান কল রিসিভ করে তিক্ত কণ্ঠে বলল, “এতবার কল দেওয়ার কী আছে? আমি সমস্যায় থাকতে পারি না? একটু তো ধৈর্য রাখা উচিত। সময় পেলে কল দিতাম আমি।”
তড়িঘড়ি করে সে বলল, “নাহিয়ান, আমি অনেক ভয় পাচ্ছি। তুই কই? বাবা হুট করে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না। প্লিজ কিছু একটা কর। না-হয় আমায় নিয়ে পালিয়ে যা।”
আচমকা মোবাইলটা কান থেকে টান মেরে নিয়ে নেন আরফা খাতুন। প্রহেলির কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। বিছানায় ছিটকে গিয়ে পড়ে। কখন গালে চড় পড়েছে বলতেই পারেনি। এত জোড়ে চড় সে তার এই বয়সে কখনোই খায়নি। কিছু বলার আগেই চুল ধরে টেনে তুলেন আরফা খাতুন।
গাল চেপে ধরে বললেন, “ঘর ছেড়ে পালিয়ে আমাদের মান ইজ্জত নষ্ট করবি তুই! এতবড় সাহস কী করে হলো তোর? তোর মতো নষ্ট মেয়েকে আমি কীভাবে আমার গর্ভে ধরলাম!”
কপালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে যান। মেয়ে এমন কাজের কথা কখনো ভাববে তিনি কল্পনাও করেননি। নাক টেনে টেনে কাঁদছে প্রহেলি। চোখের জল গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে বারংবার। হেঁচকি তুলছে থেমে থেমে। আরফা খাতুনের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। একমাত্র মেয়েটা তাদের মান ইজ্জত ডুবাতে লেগেছে। মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনে ততক্ষণে প্রহেলির বড় ভাই প্রান্ত ছুটে আসে।
আরফা খাতুন একা একাই বলছেন, “হায় আল্লাহ! কী পাপ করছিলাম যে এমন করলা আমার সাথে! এই বয়সেই যদি এমন করিস তাহলে আরেকটু বড় হলে তো তুই না জানি কী করবি! তোর বাপ শুনলে হার্ট অ্যাটাক করে মরবে। এমন কুলক্ষণা মেয়ে কেন জন্ম দিলাম খোদা!”
প্রান্ত মায়ের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আম্মু? কী করেছে প্রহেলি? এমন বলতেছ কেন?”
“তোর আদরের বোন কোন বদমাইশ ছেলের সাথে পালিয়ে যেতে চায়।”
“মা, নাহিয়ান মোটেও বদমাশ ছেলে নয়।”, প্রহেলি কথাটা বলে থামার আগেই প্রান্ত আরেকটা চড় বসিয়ে দেয়।
“মায়ের সামনে নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে কথা বলছিস কীভাবে তুই? বেয়াদব কোথাকার! আর একটা কথা বললে টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিব।”
কপট রাগে মায়ের সামনে এসে বলল, “আজই কাপড় গুছাও। বিকেলের ট্রেনে আমরা চট্টগ্রাম যাচ্ছি।”
“কিন্তু বাবা তোর ভার্সিটি!”
“আমি টিসি নিয়ে নিব এসে। তুমি ওসবের চিন্তা করো না।”
প্রহেলির কান্নার শব্দ বেড়ে যায়। প্রান্তের পা ধরে ফ্লোরে বসে বলল, “ভাইয়া এমন করিস না। নাহিয়ানকে অনেক ভালোবাসি। আমি পালিয়ে যাব না কথা দিচ্ছি। আমাকে যাওয়ার আগে শেষবার দেখা করতে দে। প্লিজ ভাইয়া তোর পা ধরছি।”
প্রান্ত একটা ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পেছন পেছন ছুটে যেতে চাইলে আরফা খাতুন তার হাত ধরে বললেন, “আর এই রুম থেকে এক কদমও বের হতে পারবি না তুই। জিনিসপত্র গুছিয়ে নে। না গুছালে সব আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে যাব।”
বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে যান। মায়ের কাছে অনুনয় বিনয় করে কিন্তু কোনো কাজ হয় মা। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে নিচে শুয়ে পড়ে প্রহেলি। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলও যেন শুকিয়ে এসেছে। দরজা একটু ফাঁক করে একটা প্লেটে দুপুরের খাবার আর পানি দিয়ে যান আরফা খাতুন। বিকেল তিনটার ট্রেনে বের হবেন। তৈরি হওয়ার জন্য বলে যান।
খাবারের দিকে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ। খুব ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু খাবার গলা দিয়ে নামবে না তার। মনের ক্ষুধার কাছে পেটের ক্ষুধা হার মানে। পানি খেয়ে সোজা হয়ে বসে কাপড় গুছাতে লেগে যায়৷ নাহিয়ানের জন্য একটা চিঠি লিখে যাওয়ার সময় অপির হাতে দিয়ে যায়।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড শহর পেরিয়ে কিছুটা দূরে ছোট্ট একটা দুইতলা বাসার উপরতলা ভাড়া নেন শামসুল গাজী। ওখানের একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন প্রহেলিকে। প্রান্ত কিছুদিন পর তাদের রেখে ঢাকা থেকে টিসি নিয়ে চলে আসে এখানেরই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একা বন্দী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে প্রহেলি। নাহিয়ানের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ হয় না তার। অপির সাথে মাঝেমধ্যে কথা হলে একফাঁকে নাহিয়ানের সাথে লুকিয়ে কথা বলে নিতো। কলেজে প্রতিদিন প্রান্ত দিয়ে আসে আবার নিয়েও আসে। চোখেচোখে রাখা হয় তাকে। তবুও চুরি করে কথা হতে থাকে তাদের। কখনো সপ্তাহ, পনেরো দিন বা মাসও চলে যায় কথা না বলে। তবু প্রহেলির ভালোবাসায় কোনো কমতি আসে না। কিন্তু নাহিয়ানকে সে আগের মতো পায় না। নাহিয়ান কলেজ জীবন নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে উঠে। তার জন্য যেন কোনো টানই নেই। অপি একদিন জানায় নাহিয়ান নতুন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। বিশ্বাস করে না প্রহেলি। সম্পর্কটা যেন নেই আবার না থেকেও যেন কিছু একটা আছে।
বছর চলে যায় সময়ের গতি ধরে। রোজকার রুটিনে বিকেলের সময়টা ছাদের কোণে কাটে প্রহেলির। সামনের প্রশস্ত মাঠে ছেলেপেলেদের খেলা দেখতে বেশ ভালো লাগে। চিল্লাপাল্লা, হাঁক, হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে বিকেলটা বেশ ভালো কাটে। নাহিয়ানের সাথে সেই আগের মতোই। তবে আগের থেকে যোগাযোগটা আরো কমেছে। কলেজের বাইরে রাসেলের দোকানে গিয়ে দৈনিক একবার কল দেওয়া অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। কল দিলে নাহিয়ান প্রায়ই রিসিভ করে না। কখনো কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে কল দেয় প্রহেলি। দোকানী রাসেলও বিরক্ত হয়ে যায় তার কাণ্ডে। তবে ধীরেধীরে এসব দেখতে দেখতে মায়া হয়ে যায় তারও। মাঝেমধ্যে কথা হয়ে উঠলে তার চেহারায় উজ্জ্বলতা বেড়ে যায়। সেদিন আর রাসেল তার থেকে ফোন বিল নেয় না।
খানিকটা হেসে বলে, “আপা, আজ আপনি অনেক খুশি লাগছে। এই হাসিখুশি মুখটাই রাখেন সবসময়। আজ আপনার থেকে বিল নিবো না।”
প্রহেলি তখন জোর করে টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়। তবে অনেকবার টাকা দিতে বিফল হয়েছে সে। রাসেল প্রহেলিকে বোনের মতো আদর করে।
নাহিয়ান বলেছে কলেজ পাস করার পর ভার্সিটিতে ভর্তি হলেই সে এখানে চলে আসবে। প্রহেলি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার। ছাদের ফুল বাগানে ছোট-বড় ফুল ফুটেছে। হঠাৎ করে একটা বল এসে প্রহেলির গায়ের উপর পড়ে। বলটা হাতে নিয়ে নিচে তাকাতেই দেখে একটা ছেলে ব্যাট হাতে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথাভর্তি একঝাঁক এলোমেলো চুল। পরনে নীল রঙের জার্সি।
“বল দেখে মারতে পারো না?”
ছেলেটা কিছুই বলে কেবল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। প্রহেলি দ্রুত নিচে নেমে নিজের রুমে গিয়ে এক টুকরো কাগজে লিখে দেয়, “আর কোনোদিন বল এসে পড়লে কেটে রেখে দিব।”
ছাদে এসে চিরকুট পেচিয়ে বলটা নিচের দিকে ছুঁড়ে মারে। বল হাতে নিয়ে ছেলেটা চিরকুটটা পড়ে পকেটে ভরে রাখে। প্রহেলি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। মাঠে ফিরে যাওয়ার সময় বারবার পেছন ফিরে তাকায়।
চলবে…
কৈশোরে প্রেম
অংশ: ০৬
প্রেম একেক বয়সে একেক রকম প্রভাব ফেলে। কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া প্রহেলির মাঝে অনেক পরিবর্তন আসে। শরীরের সৌন্দর্যের বৃদ্ধি পায় তার। এই সৌন্দর্যে যে-কোনো ছেলে নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে চাইবে। ঠিক তেমনটাই হতে যাচ্ছিল দিয়ানের বেলাতেও।
নিয়ম করে বিকেল বেলায় প্রহেলিদের ছাদে বল এসে পড়তে লাগে। ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা প্রতিদিন বল নিতে নিচে এসে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সে প্রথম ভেবেছিল বল ফেরত দেবে না। কিন্তু ছেলেটার মুখ দেখে কেমন মায়া হয় তাই না দিয়ে পারে না। অবাক করা বিষয় হলেও কোনোদিন খেলা না থাকলেও ছেলেটাকে মাঠের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। রোদ বৃষ্টি কিছুই মানে না।
মোবাইলের অভাবে বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় প্রহেলির। প্রথম প্রথম মাঝেমধ্যে কথা হলেও এখন আর একেবারেই কথা হয় না। যে বান্ধবীদের ছাড়া এক মুহূর্ত চলতো না তারাই আজ কে কোথায় আছে কিছুই জানে না সে। লুকিয়ে যাও একবার মোবাইল হাতে পায় তখন কোনোরকম নাহিয়ানের সাথে কথা বলে নেয়। এরই মধ্যে নিচের তলার বাড়িওয়ালার মেয়ে ত্রয়ীর সাথে প্রহেলির বেশ ভাব জমে যায়। ত্রয়ী যদিও তার থেকে তিন বছরের ছোট। ত্রয়ীর সাথে বিকেলে ছাদে বসার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে মাঠের পাশ ধরে হেঁটে বেড়ায়। আজও রাস্তায় হাঁটছে দু’জনে। আরফা খাতুন যদিও বের হতে দিতে চাচ্ছিলেন না তবু অনেক কষ্টে বের হয়েছে। ঘরে বসে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগে না তার। একমাস বাকি প্রহেলির এইচএসসি পরীক্ষার আর সে এভাবে বিকেলে হেঁটে গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়াচ্ছে এটা তার মায়ের সহ্য হয় না। তার কথামতে, এখন সারাক্ষণ টেবিলের সাথে লেগে থাকতে হবে।
রাস্তার পাশ ধরে গাছের ছায়ায় হাঁটছে তারা। মাঠের মধ্যে ছেলেরা ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত৷ ছোট বড় অনেকেই খেলা দেখছে দাঁড়িয়ে। যেন কোনো ওয়ার্ল্ডকাপ চলছে। ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ফিল্ডিং করছিল। প্রহেলিকে চোখে পড়তেই খেলা ছেড়ে তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। সে যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই ঘুরে দেখছে। লম্বা চুলগুলো দু’হাতে পেছনে ঠেলে দেয়। মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ে সম্পূর্ণ মুখে।
প্রহেলি চোখ ফেরায় অন্যদিকে। এই ছেলের এমন চাহনি তার ভালো ঠেকে না। কৌতুহল বশত সে ত্রয়ীকে জিজ্ঞেস করল, “ওই ছেলেটা কে রে?”
“কোন ছেলে?”
“ওই যে ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা। যে প্রতিদিন বল মারে ছাদের উপর আবার নিতেও আসে।”
“ওহ! দিয়ান ভাইয়া? সে মাঠের ওই পাশের হোস্টেলে থাকে। এখানের সব ছেলেরাই স্কুল হোস্টেলের। দিয়ান ভাইয়া অনেক ভালো। ঢাকা থেকে এসেছে দুই বছর হলো। সেই লেভেলের ভালো ক্রিকেট খেলে। আর কী সুন্দর গান গায়। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিছে। আমার ক্রাশ সে। যদিও ভাইয়া মেয়েদের দিকে তেমন একটা ঘেঁষে না। শুনেছি আন্ডার নাইনটিনে ক্রিকেট খেলতে যাবে। সুযোগ হয়ে গেলে বাংলাদেশ দলের একজন ক্রিকেটার হয়ে যাবে ভাবতে পারো! ইশ যদি প্রেমটা হয়ে যেত তার সাথে।”
প্রহেলি আরেকবার তাকায় দিয়ানের দিকে। কেন জানি ছেলেটাকে তার অনেক পরিচিত মনে হয়। মনে হয় কোথায় যেন দেখেছে এই চেহারা। কিন্তু মেলাতে পারে না সে।
এইচএসসিতে এ+ পাওয়ায় প্রহেলির পরিবারের সবাই খুশি হয়ে যায়। এবার একটু ভালো করে পড়ে ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলেই হয়ে যাবে। প্রহেলিও খুব করে চাচ্ছে নাহিয়ান যে ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেবে সেও সেটাতে যাতে চান্স পেয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে ভালো রেজাল্ট করে একই চান্স পেয়ে যায় দু’জন।
চট্টগ্রাম থেকে আবারো ঢাকা ফিরে আসে তারা। প্রান্ত ঢাকায় ভালো একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। আগে থেকেই সে এখানে থাকে। প্রথমে ঢাকায় তাদের নিতে নারাজ হলেও বাবার কথা অমান্য করতে পারে না। প্রহেলিকে ভর্তি করে দেয়। মায়ের উপর দায়িত্ব দেয় যাতে খেয়াল রাখে। প্রান্তের কাছে একটা মোবাইল চাইলে সে তাকে বলে দেয় যে কোনো মোবাইল দেওয়া হবে না। ভার্সিটি পড়ুয়া সে হয়তো প্রথম মেয়ে যার কোনো ব্যক্তিগত মোবাইল নেই। কিন্তু এই দুঃখটা ঘুচে যায় তার বাবার কারণে। শামসুল গাজী তাকে নতুন একটা ফোন কিনে দেন।
ফোন হাতে দিয়ে বলেন, “আমার লক্ষ্মী মামণিটাকে তার ভালো ফলাফলের উপহার দিলাম। আশা করি সে আমার বিশ্বাস ভাঙবে না।”
প্রহেলি কেবল মাথা ঝাঁকায়। কিন্তু মনে মনে ভয় পাচ্ছে। সে তার বাবার বিশ্বাস ঠিকই ভাঙতে চলেছে।
দিয়ান ওখানেরই একটা কলেজে ভর্তি হয়। প্রতিদিন মাঠে যায় প্রহেলির অপেক্ষা করে একবার হলেও ছাদে দেখতে পাবে কিন্তু দেখা আর পায় না। কিছুদিন অপেক্ষার পর ত্রয়ীকে একদিন রাস্তায় দেখতে পায়। দ্রুত তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ত্রয়ী, তোমার সাথে যে একটা মেয়ে প্রতিদিন ছাদে আসতো তাকে আজকাল দেখা যায় না কেন?”
ত্রয়ী প্রথমে খুশি হয় দিয়ান তার সাথে কথা বলতে এসেছে ভেবে কিন্তু পরক্ষণেই প্রহেলির কথা জিজ্ঞেস করাতে কিছুটা মন খারাপ হয়। মলিন মুখে বলল, “প্রহেলিকা আপুরা তো ঢাকা চলে গিয়েছেন। আপু ওখানে ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছেন তো তাই।”
“ওহ! আচ্ছা!”, বলেই দিয়ান চলে যায়।
সেদিনের পরেও প্রায়শই দিয়ান প্রহেলিদের বাড়ির সামনে আসতো কখনো যদি দেখা পেয়ে যায় এই ভেবে। কিন্তু প্রতিবারই তার আশায় পানি পড়ে যায়। তবু সে আশাহত হয় না। অপেক্ষায় থাকে একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে।
প্রথম দিন ভার্সিটিতে যাচ্ছে প্রহেলি। ভার্সিটিতে যাওয়ার খুশির চাইতে নাহিয়ানের সাথে দুই বছর পর দেখা হবে এটা ভেবেই খুশি আটকে রাখতে পারছে না সে। প্রিয় মানুষের সাথে এতদিন পর দেখা করতে যাবে কিছু একটা উপহার নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তার কাছে তো তেমন টাকা নেই। মাটির ব্যাংকে যাতায়াত খরচ আর টিফিনের টাকা থেকে কিছু করে জমিয়েছিল। গুনে দেখল সেখানে পাঁচশো পঁচিশ টাকা হয়েছে। এই টাকায় নাহিয়ানের জন্য কী উপহার কেনা যায় তাই ভেবে পায় না। অবশেষে ভাবলো একটা ভালো দেখে টি-শার্ট কেনা যাবে।
একটা সাদা টি-শার্ট কিনে মায়ের চোখের আড়ালে ব্যাগে ভরে নেয়। ভার্সিটিতে আসতেই দেখল নবীন বরণ অনুষ্ঠান চলছে। এত মানুষের ভীড়ে সে নাহিয়ানকে কোথায় খুঁজে পাবে! মোবাইলটা বের করে নাহিয়ানের নম্বরে কল দেয়। নাহিয়ান তাকে বটতলায় বসতে বলে। সে ওখানেই আসবে তার সাথে দেখা করতে। প্রহেলির চোখ জ্বলে যাচ্ছে ভালোবাসার মানুষটাকে দেখার জন্য।
দূর থেকে নাহিয়ানকে চিনতে খানিকটা সমস্যা হয় প্রহেলির। দুই বছরে মানুষ কতটা বদলে যায়৷ আগের থেকে আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে সে। কাপড়-চোপড়ে এসেছে অনেক বড় পরিবর্তন। প্রহেলিকা একবার নিজের দিকে তাকায়। পরিবর্তন তো তার মাঝেও এসেছে। তবে অতিরিক্ত নয়। সাধারণ একটা থ্রিপিস পরেছে। হালকা মেকাপ করেছে। তবে চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। নাহিয়ান কাছে আসতেই বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। ইচ্ছে করছিল তার বুকে ঝাপিয়ে পড়তে। কিন্তু কেন জানি একটা লজ্জাবোধ হচ্ছে তার। বেশ দূরত্ব এসেছে তাদের মধ্যে। নাহিয়ান আগের থেকে অনেক লম্বা হয়ে গেছে। নিজেকে কেমন বেমানান লাগছে তার পাশে।
“তুমি তো খানিকটা মুটিয়ে গেছ প্রহেলি।”, নাহিয়ানের প্রথম কথা এটাই ছিল।
প্রহেলি মৃদু হেসে চোখ নিচে নামায়। কী বলবে ভেবে পায় না। নাহিয়ানই আবার বলল, “তবে তোমাকে এখন বেশি হট লাগছে।”
লজ্জায় মুখ খানিকটা আরক্ত হয় তার। সমস্ত দেহ কুঁচকে একটুখানি হয়ে আসে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তুমি আগের থেকে বেশি সুন্দর হয়ে গেছ।”
শব্দ করে হেসে দেয় নাহিয়ান। প্রহেলির চেহারায় উজ্জ্বলতা বেড়েছে আগের থেকে। স্কুলের সেই মেয়েটা আর নেই। শরীরের এই খানিকটা পরিবর্তনে রূপ যেন উতলে পড়ছে। সাধারণ একটা ড্রেসেই তাকে অসাধারণ সুন্দর করে তুলেছে। আশেপাশের অনেক ছেলেই তার দিকে তাকাচ্ছে। আচমকা নাহিয়ান প্রহেলিকে জড়িয়ে ধরে। সে দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকে। কেন জানি দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। এই বাহুডোরে নিজেকে রাখতে চাচ্ছে না। অস্বস্তি অনুভব করছে। নাহিয়ান তার অস্বস্তি কিছুটা বুঝতে পারে।
“স্যরি, এভাবে হুট করে জড়িয়ে ধরায় মাইন্ড করোনি তো? আসলে আগের অভ্যাসটা রয়ে গেছে। তোমাকে দেখে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। আর কখনো তুমি না চাইলে এমন করবো না।”
নাহিয়ানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রহেলি তাকে জড়িয়ে ধরে। চেনা মানুষটাকে কেন তার অচেনা লাগছে জানে না! কিন্তু সে চায় না এই অচেনা ভাবটা ধরে রাখতে। নিজেকে এভাবে গুটিয়ে নিলে সম্পর্কে আরো দূরত্ব আসতে পারে। এটা কোনোভাবেই হতে দিবে না। নাহিয়ান তাকে যেভাবে চায় সেভাবেই তার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করবে।
ভার্সিটিতে এসে তাদের প্রেম আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। যা না হওয়ার তাও হতে শুরু করে। বটতলা তাদের প্রেমের জায়গা হয়ে দাঁড়ায়৷ প্রহেলি কখনো বাঁধা দিতে পারে না তাকে। সে কল্পনাও করতে পারেনি তার জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে। কতটা চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে নাহিয়ানের কাজ তা ভেবে উঠতে পারেনি।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা