কৈশোরে প্রেম
অংশ: ০৭,০৮ (১৮+সতর্কতা)
লিখা: বর্ণালি সোহানা
অংশ: ০৭
একটা সিগারেট প্রহেলির কোমল ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে পেরে হয়তো সৌভাগ্যবান মনে করছে এখন। নাহিয়ানের হাত থেকে নিয়ে একটা টান দিতেই কাঁশতে লাগে সে। সিগারেট তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে একটানে শেষ করে ফেলে নাহিয়ান। খানিকটা ধোঁয়া উড়ায় তার প্রিয়তমার মুখে। বাকিটা নেশা মেটানো চুম্বনে ঠোঁটের ভাঁজে পুরে দেয়। চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করে প্রহেলি। এত বছর পর প্রথম ছোঁয়া পেয়ে যেন তৃষ্ণা মিটে গেল। মাতোয়ারা হয়ে উঠে প্রতিটা স্পর্শে। নাহিয়ানের ঠোঁটের উষ্ণতায় নিজেকে বারবার হারাচ্ছে। একহাতে প্রহেলির কোমরে চেপে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দেয়। শিউরে উঠছে ভেতরে বাহিরে।
প্রহেলি চোখ খুলে সহসা বলল, “নাহিয়ান তুমি আমাকে আগের মতো ভালোবাসো?”
নাহিয়ান মুখ তুলে না। চুমুর পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেয়। হাত কোমর ছেড়ে পেটের উপর নিয়ে আসে৷ প্রহেলি তাকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে আবার বলে, “থামো, কী পাগলামো করছো। একটু বসে কথা বলো না। কাছে পেলেই তোমার এসব শুরু হয়ে যায়।”
নাহিয়ান প্রহেলির ঠোঁটে চেপে ধরে চুমু খেয়ে বলল, “এসবই করব। একদম খেয়ে ফেলব তোকে। চল বাইরে কোথাও যাই, এখানে জমছে না।”
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি নাহিয়ান। উত্তর দিলে না তো।”
নাহয়ান শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, “আচ্ছা, তুই আমাকে তুমি করে বলছিস কেন? যদিও প্রথম দিন আমিও তোকে তুমি করে বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা তো আর নতুন না। আর নতুন করে কেন এসব প্রশ্ন করছিস?”
“বিয়ে করবি আমায়?”
“চল কালই বিয়ে করব। আর তোর পেটে আমার বাচ্চা দিব। ঠিকাছে তো?”
প্রহেলি প্রতিত্তোরে কিছু বলে না। ঘাসের দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল। মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে এসেছে। তার কেবল মনে হয়, নাহিয়ান তাকে ঠিকমতো বুঝে না। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
“আচ্ছা শোন, অপি, ইলমা, পূজা এদের কী খবর?”
“তুই জানিস না? ওহ তোর তো যোগাযোগই ছিল না কারো সাথে। অপির তো বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সে তার স্বামীর সাথে ডেনমার্ক থাকে। ইলমা ওই যে শফি স্যারের সাথে সম্পর্ক ছিল তার সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। শুনেছি তার ডিভোর্স হয়ে এখন বাড়িতেই আছে৷ আর পূজা তো ডাক্তারি পড়ছে।”
নাহিয়ানের থেকে জানতে পারে অনেকেই ভালো অবস্থানে আছে। এটা জেনে মনটা খুশি হয়ে যায়। অপির সুখের সীমা নেই, একটা বাচ্চাও হয়ে গেছে। তবে ইলমার সাথে খুব খারাপ হয়েছে।
নাহিয়ানের এভাবে খোলামেলা কিছু করতে এখন আর ভালো লাগে না। কেউ দেখে ফেলার ভয় তাড়া করে বেড়ায় সারাক্ষণ। এদিকে প্রহেলি তাকে বিয়ের কথা বলে নিজেই যেন পথ তৈরি করে দিয়ছে। নাহিয়ান তাকে কোর্ট ম্যারেজ করার কথা বলে ফেলে। প্রহেলি ভাবার জন্য কয়টাদিন সময় নেয়।
নাহিয়ানের প্রতিটা ছোঁয়া তাকে পাগল করে দেয়। এখন যেন কেবল চুমুতে মন ভরে না। আরো কাছে পাওয়ার স্পৃহা জাগে মনে। এই আকাঙ্খায় চুড়ান্ত ভুলের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় প্রহেলি। নাহিয়ানের সাথে কোর্ট ম্যারেজ করতে তৈরি হয়ে নেয়। কোর্ট ম্যারেজের পর সোজা তারা রিসোর্ট যাবে। সেখানে একান্তে দুজনে কিছু সময় কাটাবে। তারপর যে যার মতো বাড়ি ফিরে যাবে।
সকাল থেকে ভয়ে ভয়ে আছে প্রহেলি। মায়ের কাছে অ্যাসাইনমেন্ট আছে বলে সেজেগুজে বাড়ি থেকে বের হয়। কাঁধ বিস্তৃত খোলা চুল। মেরুন রঙের সিল্কের শাড়ি। পিঠ উন্মুক্ত করা ব্লাউজ। কানে ছোট ছোট দুইটা দুল। নাকে ছোট্ট একটা নাকফুল। হালকা করে সেজেছে। আজ সে নাহিয়ানের বউ হতে চলেছে। এটুকু তো লাগেই। ভার্সিটির সামনের গেট দিয়ে ঢুকে নাহিয়ানের সাথে পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে যায়। রিকশায় দু’জন কাছাকাছি বসতেই নাহিয়ান সুযোগ নেয়। তার অবাধ্য হাত দুষ্টুমিতে মেতে উঠে। উন্মুক্ত পিঠে আঁকিবুঁকি করছে। নাক ঘষে দিচ্ছে গালে। কানের উপর কামড়ে দিচ্ছে। প্রহেলি সেই স্কুলের সময়টাকে যেন অনুভব করছে। নাহিয়ান আগের মতোই রয়ে গেছে। রিকশায় বেশ কষ্টে নিজেকে সামলে রাখে সে। কোথায় যেন একটা ভয় কাজ করছে৷ কীসের ভয় সেটা জানে না সে।
নাহিয়ানের এক উকিল বন্ধু কোর্ট ম্যারেজের সকল কাগজপত্র তৈরি করে নিয়ে এসেছে। রিসোর্টের রুমে বসে নাহিয়ান প্রহেলিকে জিজ্ঞেস করে, “কাবিনে কী চাই তোর?”
“আমি আমার কাবিনে তোমাকেই চাই, শুধুই তোমাকে। যাতে কখনো আলাদা হতে হলেও আমি যেন তোমাকেই পাই, অন্য কিছু নয়। তোমাকে নিয়েই আমি বাঁচতে চাই।”, কথাটা বলতে গিয়ে প্রহেলির চোখে জলে ভিজে আসে।
জীবনের অদ্ভুত একটা সম্পর্ক বিয়ে। বিয়ে হওয়ার আগেই ছাড়ার পর কী হবে সেটা ভাবতে হয়৷ নাহিয়ান ক্ষীণ হাসার চেষ্টা করে। একবার মনে প্রশ্ন জাগে কোনো ভুল করে ফেলছে না তো সে! পরক্ষণেই আবার প্রহেলিকে কাছে পাওয়ার সাধ জেগে উঠে। আর কোনো চিন্তাভাবনা না করে রিসোর্টে রুমে বসেই দু’জনে পেপারে সাইন করে দেয়৷ বন্ধুটা তাদের অভিনন্দন জানিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। প্রহেলি বিছানায় বসে আছে। নাহিয়ান এসে তার পাশে বসে। কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় তাকে।
অপ্রস্তুত প্রহেলি বলল, “নাহিয়ান, এসব কী ঠিক হচ্ছে?”
“আমরা এখন স্বামী স্ত্রী, আমাদের মধ্যে এখন সব ঠিক, কোনো কিছু বেঠিক নেই।”, বলেই প্রহেলির শাড়ির কুচিতে হাত দেয়।
প্রহেলি মৃদুস্বরে বলল, “প্রটেকশন এনেছ তো? পরে আবার কনসিভ হয়ে গেলে সমস্যা।”
বুকের উপর থেকে আঁচলটা সরিয়ে নাহিয়ান বলল, “ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি শুধু আজ আমাকে সুখের সাগরে ভাসাও।”
নাহিয়ান মুখ চেপে ধরে বুকের উপর। কেঁপে উঠে শক্ত হাতে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে প্রহেলি। পেটের মধ্যে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দেয়। দাড়ির খোঁচায় গুঙিয়ে উঠে সে। মাথার চুল খামচে ধরে উলটো দিকে ফিরে যায়। উন্মুক্ত পিঠে চুমুর বর্ষণ করে। প্রহেলিকে পালটে ঠোঁটে স্বাদ নিতে লাগে। অবাধ্য হাত বুকের উপর ছুঁয়ে পেটে নেমে আসছে। ভেতরে বয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার ঝড় আর বাইরে শুরু হয়েছে দৃশ্যমান তুফান। বাইরের সবকিছু চুরমার করে দিচ্ছে। মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়স্থলে ছুটে যাচ্ছে৷ কয়েকটা বড় গাছ উপড়ে ফেলেছে। এটা কেবল তুফান নয় এটা ছিল কঠিন বিপদের পূর্বাভাস যা প্রহেলি বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি।
সেদিনের পর থেকে প্রহেলিকে যখন তখন রিসোর্টে নিয়ে যাওয়া, কখনো কোনো বন্ধুর বাসায় নিয়ে গিয়ে সময় কাটানো নাহিয়ানের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। এসবের ফাঁকে প্রহেলি তার বাবাকে নাহিয়ানের কথা বলে বিয়ের জন্য রাজী করিয়ে নেয়৷ মাকে রাজী করাতে তার কয়েক মাস লেগে যায়। তাদের রাজী করাতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয় তাকে। কিন্তু প্রান্ত কোনোমতেই রাজী হয় না। তবে সে মা-বাবার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয়। তারা যেখানে প্রহেলিকে বিয়ে দিতে চায় সেখানেই সে রাজী। এর বাইরে কিছু বলার নেই।
পরিবারকে রাজী করানোর বিষয়টা নাহিয়ানকে বলায় বিষয়টাকে হেসে উড়িয়ে দেয়। সসময়ের পরিক্রমায় অনেকটা বদলাতে শুরু করে সে। কাছে পেয়েই জড়িয়ে ধরে আদর করার অভ্যাসটাও তার মাঝে আর থাকে না। অন্যদিকে প্রহেলির শারিরীক গঠনে পরিবর্তন দেখা যায়। দিনদিন ওজন বাড়তে লাগে। দেখতে দেখতেই দুই বছরের মধ্যে অনেকখানি মুটিয়ে যায় সে। নাহিয়ানের ডাক ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়৷ তার নতুন নতুন বন্ধু হয়। ভার্সিটি ও ভার্সিটির বাইরে বিভিন্ন মেয়ে বন্ধুর সাথে ঘুরতে দেখা যায়। কখনো কিছু জিজ্ঞেস করলে বাহানা মেরে দেয়। একদিন হুট করেই সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তার সাথে৷ কোনো উপায় না পেয়ে প্রহেলি বিবাহিত স্ত্রীর মর্যাদা পাওয়ার জন্য তার দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে।
বিয়ের কথা শুবে অদ্ভুত স্বরে সে বলল,“বিয়ে! বউ! কীসব বলছো! আমাদের বিয়ে কখন হলো? কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”
“মজা করছো আমার সাথে তাই না? আমরা না কোর্ট ম্যারেজ করলাম!”, প্রহেলি অস্ফুটস্বরে বলল।
“ওইটা কেবল একটা পেপার ছিল তোর সাথে শোয়ার জন্য। এমনিতে বললেও হয়তো আমার সাথে শুয়ে যেতি তুই। তোর এমনিতেও অনেক জ্বালা ছিল আমাকে কাছ্র পাওয়ার।”
প্রহেলির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। মনে হচ্ছে যেন চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে৷ চোখের সামনে ঝাপসা দেখছে। এলোমেলো কদম ফেলে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। চোখের জল মুছে মৃদু হেসে নাহিয়ানের সম্মুখে এসে দাঁতে দাঁত চেপে সজোরে চড় বসিয়ে দেয় তার গালে। কখনো ভাবেনি যাকে ভালোবেসেছে তার গায়ে এভাবে হাত তুলতে হবে। কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে আসে সে। থরথর করে কাঁপছে শরীর। মাঝ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তারপর কীভাবে বাড়ি ফিরেছিল কিছুই মনে নেই।
সেদিনই নাহিয়ান তাকে শেষ মেসেজ পাঠিয়েছিল। অতীতের পাতা পালটে বর্তমানে ফিরে আসে প্রহেলি।
“তুমি নিজেকে একবার দেখ আর আমাকে দেখ। বডির সাইজ দেখেছ? বিবাহিত মহিলা টাইপ হয়ে গেছ। মনে হয় এক বাচ্চার মা। এই তোমার সাথে আমার এখন ঠিক যায় না। তুমি তোমার মতো কাউকে খুঁজে নিও।”, ঝিলের পাড়ে বসে আরো একবার মেসেজটা পড়ে নেয় প্রহেলি।
অতীত যতটা মধুর ছিল ঠিক ততটাই তিক্ততায় ভরা। আজ সে তার অতীতের স্মৃতিকে এই ঝিলে ডুবিয়েই হত্যা করে যাবে। সিমটা খুলে ভেঙে ফেলে দেয় প্রহেলি। সন্ধ্যা নেমে এসেছে সে খেয়াল নেই তার। নাহিয়ানের কাছে আর যাবে না সে। বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। মা-বাবার পছন্দমতোই বিয়ে করবে। সন্ধ্যায় বাড়ি গেলে প্রান্ত রেগে যায়। তড়িঘড়ি করে রিকশা খুঁজতে লাগে। একটা রিকশাও যেতে রাজী হচ্ছে না। মাগরিবের আজান চারদিকে মধুর ধ্বনি তোলে। প্রহেলি মাথায় কাপড় টেনে দেয়। জীবনে যত পাপ করেছে জানে না এই পাপের ক্ষমা কখনো পাবে কী না। তবু এবার খোদার পথে ফিরবে সে। শতবার মাফ চাইবে, কে জানে একবার মাফ পেলে পেতেও পারে।
চলবে…
কৈশোরে প্রেম
অংশ: ০৮
পথটা ভুল জেনেও অনেকে সঠিক করার আকাঙ্খা নিয়ে সে পথে পা বাড়ায়। প্রাপ্তির খাতায় সাময়িক সুখ আর শত আঘাত লিখে যখন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না তখন আবার পুরনো অবস্থানে ফিরে আসতে চায় ঠিক পথে চলার আশায়৷ কিন্তু ততদিনে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলে যা ফিরে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর এই নিয়ে চতুর্থ বারের মতো কনে দেখানো হয় প্রহেলিকে। পাত্রপক্ষ সবদিক পছন্দ করলেও মোটা হওয়ার কারণে বিয়ে পর্যন্ত কথা আর আগায় না। এতবার প্রত্যাখ্যানের পর বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয় সে। নাহিয়ানের সাথে ব্রেকাপ হওয়ার পর এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে অনার্সে ইয়ার ড্রপ দিয়ে পিছিয়ে গিয়েছে। এবার অনার্সটা শেষ করে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দেয়। স্বাস্থ্য কমানোর জন্য প্রথম প্রথম ডায়েট করতো কিন্তু পরবর্তীতে এসব বাদ দিয়ে কেবল সুস্থ থাকার জন্য কিছু শারিরীক ব্যায়াম করে। এই স্বাস্থ্য কমলেও তার কিছু যায় আসে না আর থাকলেও কিছু যায় আসে না। এভাবে তাকে দেখে কেউ বিয়ে করলে করুক, না করলে নেই।
কলিংবেলটা বিরতি টেনে বেজে যাচ্ছে। প্রহেলি এসে দরজা খুলতেই সামনে একজন ভদ্রলোককে দেখা যায়। চেহারাটা পরিচিত মনে হচ্ছে তবু চিনতে পারে না।
কৌতুহল ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলো, “কাকে চাই?”
“তুমি প্রহেলি না?”
ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!”
“আমি মেহরাব। চিনতে পেরেছ?”
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রহেলি। তাকে চোখের সামনে জীবিত অবস্থায় দেখা যেন কল্পনা মনে হচ্ছে। এই মেহরাব যে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সুইসাইড করেছিল। কিন্তু সে কীভাবে বেঁচে আছে এটাই ভাবাচ্ছে তাকে।
“ট্যাবলেট!”, প্রহেলি বেফাঁস বলে ফেলে।
মেহরাব শব্দ করে হেসে বলল, “হ্যাঁ তোমাদের সেই ট্যাবলেট। ভেতরে আসতে বলবা না?”
ভেতরে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসায় তাকে। সেদিনের ট্যাবলেট এখন আর ট্যাবলেটের মতো পিচ্চি নেই। দেখতে কেমন সাহেব সাহেব লাগছে তাকে। প্রহেলি তার সামনের সোফায় বসে পড়ে।
“তোমার মনে নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন তাই না? পরিষ্কার করে দিচ্ছি সব। আসলে আমি সুইসাইড করতে চেষ্টা করেছিলাম সত্যি কিন্তু সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। শরীরের বেশ কয়েকটি হাড়গোড় যদিও ভেঙে গিয়েছিল।”, বলেই আবার হেসে দেয় সে।
আরফা খাতুন আসতেই প্রহেলি তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। তিনি বাঁকা চোখে তাকিয়ে তাদের সাথে বসে পড়েন। মেহরাব মৃদু হেসে বলল, “আসলে আন্টি আমি আমার বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছি। প্রহেলির কারণে আমি আমার দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। তাই তাকে আমার গুরুত্বপূর্ণ দিনটায় সবচাইতে কাছের বন্ধু হিসেবে সবকিছুতে তাকেই চাই।”
তার মেয়ে কীভাবে এই ছেলেকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছে বুঝতে পারেন না আরফা খাতুন। তখন মেহরাব নিজেই বলে এসএসসি পরীক্ষার পেপার যখন রিচেক করানো হয় তখন তার ফেল এসেছিল। পরেরবার আর রিচেক করানোর কোনো মানেই ছিল না। কিন্তু প্রহেলি, পূজা মিলে সোহেল স্যারের সাহায্যে বোর্ড ফিস দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো রিচেক করায় আর তখন তার রেজাল্ট পাস চলে আসে। এ+ পেয়ে পাস করে যায় সে। সেদিন যদি তারা এই সাহায্য না করতো তবে হয়তো আজ সে এই পজিশনে থাকতো না। মেহরাব আজ টেলিভিশনের একজন সংবাদ কর্মী। এটিএন নিউজের নিউজ রিপোর্টার সে। প্রহেলিকে এতদিন অনেক খুঁজেছিল সে কিন্তু কোথাও পায়নি৷ হঠাৎ করে যখন জানতে পারে সে এই শহরেই আছে তখন দেখা করতে চলে আসে৷ আর সুযোগে বিয়ের দাওয়াতটাও নিয়ে আসে। আজ প্রথম বারের মতো মেয়ের উপর গর্ভ হচ্ছে আরফা খাতুনের। চোখেমুখে মিশে আছে অপূর্ব এক হাসি। দাওয়াত গ্রহণ করেন তিনি৷ প্রহেলি যাবে বিয়েতে সাথে তিনিও যাবেন৷ বিয়ের কার্ড খুলে কনের নাম পড়ে আরেকবার চমকে উঠে প্রহেলি। মেহরাব আর কাউকে নয় তার ফুফাতো বোন এলিনাকে বিয়ে করছে! দুইদিন আগে তার ফুফু এসে দাওয়াত দিয়ে গেছেন। একই কনভেনশন সেন্টারে কনে ও বরের একসাথে গায়ে হলুদ, বিয়ে ও রিসিপশনের অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে। যেকোনো একটাতে উপস্থিত থাকা মানে দুইটাতেই উপস্থিত থাকা। তাই প্রহেলিও আর মানা করে না৷
আজ মায়ের সাথে মেহরাবের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাবে প্রহেলি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে নেয়। ৮০ কেজি থেকে ৬৫ কেজিতে নেমে এসেছে ওজন। অতোটাও মোটা লাগছে না তাকে। তবে গালটা একটু ফোলা ফোলা লাগছে। কিন্তু তবুও নিজের কাছেই নিজেকে আজ ভীষণ মায়াবী লাগছে। খুব পছন্দ করে একটা সাদা রঙের শাড়ি পরে নেয়। গায়ে হলুদে এটা খুব অদ্ভুত দেখাতে পারে কিন্তু কেন জানি আজ তার সাদা শাড়িটাই পরতে ইচ্ছে করছিল। মনের ইচ্ছেকে অনেকদিন পর প্রাধান্য দেয়। চুলগুলো কাঁধ ছাড়িয়েছে আবার কেটে কাঁধ পরিমাণ রাখতে চেয়েছিল। ছোট চুল তার পছন্দ। কিন্তু মায়ের বাঁধায় আর চুল কাটে না। হালকা করে সেজেছে। ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে যেতেই নাহিয়ানের কথা মনে পড়ে যায়। স্মতিগুলোকে ঝেড়ে ফেলে কড়া করে লিপস্টিক মেখে নেয়। ঠোঁটজোড়া খয়েরী রঙে রাঙা হয়ে আছে।
বিশাল বড়ো কনভেনশন হলকে লাল আর হলুদ ফুলে সাজানো। এমন এক বিয়ের স্বপ্ন কখনো প্রহেলিও দেখতো। এখন সব শখ মরে গেছে তার। বর-কনেকে দুই মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে স্টেজে একদল তরুণ-তরূণী গানের তালে নাচছে। ছেলেদের পরনে কড়া সবুজ রঙের পাঞ্জাবি আর মেয়েদের পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। বর কনের গায়ে হলুদ মাখানো হচ্ছে। মেহরাব প্রহেলিকে দেখে হাত তোলে ইশারা করে। একটা ছেলেকে ডেকে ফিসফিস করে বলে দেয় তার খাতির যত্নে যেন কোনো কমতি না হয়।
প্রহেলি যে চেয়ারে বসেছে সেই চেয়ারের পাশের চেয়ারে একটা চশমা পরা মেয়ে এসে বসে। একবার তার দিকে তাকিয়ে প্রহেলি আবার চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। মাকে বড়দের আড্ডায় দেখতে পায়। একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না।
পাশের মেয়েটা সহসা বলে উঠে, “আমাকেও চিনতে পারলি না?”
প্রহেলি তার দিকে ফিরে তাকায়। না, তার চিনতে আর সমস্যা হয় না। এটা তার সেই স্কুল জীবনের বান্ধবী পূজা। এতদিন পর তাকে দেখতে পেয়ে চোখে জল এসে যায়৷ পূজা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।
“কেমন আছিস রে?”
“এইতো যেমন ছিলাম।”
“শুনলাম ডাক্তার হয়ে গেছিস তুই!”
“এইতো হলাম বলে। তোর খবর বল। তুই তো অনেক সেক্সি হয়ে গেছিস।”
প্রহেলি একগাল হেসে বলল, “তুই এসব শব্দ কোত্থেকে শিখলি!”
“অনেক কিছুই শিখেছি তোদের সাথে থেকে তবে প্রয়োগ করিনি কখনো। এমন তো কথা নেই যা শিখেছি সব নিজের উপর প্রয়োগ করতে হবে। তবে আজ তোকে সত্যিই এই কথাটা বলতে মন চাইলো তাই বলে দিলাম।”
পূজার কথায় মুখটা মলিন হয়ে আসে। অপি আর ইলমার কথা শুনে যদি সেদিন সে প্রেম নামের অশ্লীলতা নিজের উপর প্রয়োগ না করতো তাহলে হয়তো আজ ভালো থাকতো। সত্যিই তো, জীবনে চলার পথে ভালো খারাপ সবার সাথেই চলতে হয়। নিজের ভালোটা নিজেকে বুঝে খারাপটা এড়িয়ে যেতে পারলেই জীবন সুন্দর। নাহলে সঙ্গ দোষে নিজেকেও দূষিত হতে হয়। নিজেকে দূষিত করে ফেলেছে প্রহেলি। এই দোষ জীবনেও ছাড়াতে পারবে না সে। এমন পাপ করেছে যা শতবার ধুইলেও যাবে না। প্রসঙ্গক্রমে পূজা নাহিয়ানের কথা জিজ্ঞেস করে।
প্রহেলির মুখে সবকিছু শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এটার ভয়ই ছিল আমার। কত করে বুঝিয়েছিলাম, তখন আমার কথা শুনলি না। যাক বাদ দে এসব। মানুষ মাত্রই ভুল। তবে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়াই হলো বড় কথা। তবেই এক ভুল মানুষ বারবার করে না।”
সবকথা নীরবে শুনে যায় সে। আসলেই সেদিন যদি পূজার কথা একবার শুনতো। একটু বোঝার চেষ্টা করতো! অপি এত প্রেম করে এতজনকে ঠকিয়েও কত সুখী। ইলমা যদিও তেমন ভুল করেনি তবুও সে আজ সুখী নয়। পূজা কারো সাথেও ছিল না পাছেও ছিল না সে তার ক্যারিয়ারে ফোকাস করায় আজ একজন সফল মানুষ হতে চলেছে। আর প্রহেলি মাঝ নদীতে বৈঠা ছাড়া নৌকার মতো ভাসছে। কোনো কূল ফিরে পাবে কী না কিছুই জানে না।
মেহরাবের পাশে শুভ্রত বসে আছে। প্রহেলি ভয় পাচ্ছে যদি নাহিয়ান এখানে আসে! বুকটা ধুকপুক করছে। যে মানুষটাকে সে গত দুই বছরে দেখেনি তাকে আর দেখতে চাচ্ছে না সে। সামনে আসলে আবার সব এলোমেলো হয়ে যাবে তার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছে। আর ভেঙে পড়তে চায় না।
এলিনার গায়ে হলুদ লাগাতেই সেও মজা করে তার গালে ও মাথায় একগাদা হলুদ মেখে দেয়। সামান্য বিরক্ত হলেও কিছু করার থাকে না তার। আদরের ছোট বোনের গায়ে হলুদ সে অনেক খুশি এই খুশিতে মন খারাপ করা যাবে না। পরিষ্কার করার জন্য ওয়াশরুমে যায়। তাড়াহুড়োতে জেন্টস ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। আচমকা একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খেয়ে কিছুটা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে মুখটা তুলে তাকায়।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা