কৈশোরে প্রেম অংশ: ০৯,১০

0
2276

কৈশোরে প্রেম
অংশ: ০৯,১০
লিখা: বর্ণালি সোহানা
অংশ: ০৯

সাদা টি-শার্টের উপর কালো জ্যাকেট পরা সদ্য যৌবনে পা দেওয়া সুবোধ চেহারার অপরিচিত এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে প্রহেলির সামনে। মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল। ছেলেদের এমন ঝাকড়া চুল খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। প্রহেলির কাছে এই ছেলেকে কিছুটা সেই কলেজ জীবনে দেখা দিয়ানের মতো লাগছে। ছেলেটা তার দিকে তখন থেকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সৌজন্য মূলক একটা স্যরিও বলছে না। প্রহেলির হঠাৎ খেয়াল হয় মেয়েদের ওয়াশরুমে এই ছেলে কী করছে!

গর্জে উঠে বলল, “মেয়েদের ওয়াশরুমে ঢুকে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করতে চাচ্ছেন তাই না? আপনার মতো কিছু ছেলেরা এমনই হয়। যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই লুইচ্চামি করে বেড়ায়।”

জ্যাকেট ঠিক করতে করতে সে বলল, “এক্সকিউজ মি! আমি জেন্টস ওয়াশরুমেই আছি। আপনিই ভুলক্রমে…হয়তো ভুলক্রমেই এসেছেন।”

প্রহেলি ক্ষুদ্র চোখে তাকায় তার দিকে। ছেলেটা তার এলোমেলো দাঁতগুলো বের করে হাসছে! কার যেন ঠিক এমনই দাঁত দেখেছিল মনে করতে পারে না সে। এসব ভাবনা বাদ দিয়ে চট করে বাইরে গিয়ে দেখল আসলেই এটা জেন্টস ওয়াশরুম! চোখ বন্ধ করে রাগটা নিজের উপরই ঝাড়ে। ইচ্ছে করছে এখন নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়ে ফেলতে। এভাবে লজ্জায় পড়তে হলো তাকে। ছেলেটা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে একবার তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। তারপর সোজা হেঁটে চলে যায়। তার এই অদ্ভুত হাসির অর্থ খুঁজে পায় না সে।

প্রহেলি মুখ থেকে হলুদ ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে বেরিয়ে আসে। সাজগোছ নষ্ট হয়ে গেছে। হলরুমে আসতেই দেখে অনেকে ওই ঝাকড়া চুলের ছেলের সাথে ছবি তুলছে। কেউ কেউ এসে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। প্রহেলি পূজার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো, “কে রে এই ছেলে? এভাবে লোকজন তার সাথে ছবি তুলছে কেন?”

পূজা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ও মা! তুই তাকে চিনিস না?”

“না, কেন? সে কী কোনো সেলিব্রিটি?”

“সেলিব্রিটিই তো। নাম দিয়ান রহমান, জাতীয় দলের ক্রিকেট প্লেয়ার। তবে মেহরাবের হলুদে কীভাবে এলো সেটা জানি না। মেহরাবকে জিজ্ঞেস করতে হবে। জানিস দিয়ান অনেক ভালো গানও গায়। চল না একটা সেল্ফি তুলে আসি।”

“তুই গেলে যা, গিয়ে সেল্ফি তুলে আয়। আমার এত শখ নেই।”

প্রহেলি এবার নিশ্চিত হয়ে নেয়, এই দিয়ানই সেই দিয়ান। যার সাথে তার চট্টগ্রামে দেখা হয়েছিল। পাড়ার মাঠে তাকে কত খেলতে দেখেছে অথচ টিভির পর্দায় কখনো দেখা হয়নি৷ মোবাইলের দিকে দৃষ্টি নামায় সে। দিয়ান রহমান লিখে গুগলে সার্চ করে। পূজা ততক্ষণে সেল্ফি তুলতে চলে গিয়েছে। দিয়ান আঁড়চোখে বারবার তার দিকেই তাকাচ্ছে। মোবাইল থেকে চোখ তুলতেই হাত-পা কাঁপতে লাগে প্রহেলির। তার সামনে নাহিয়ান একটা মেয়ের পিঠে হাত রেখে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলছে। সুন্দরী, আকর্ষণীয় শরীরের গঠন, অল্প বয়সী মেয়ে। হলুদাভ শাড়ি পরেছে। তার সামনে নিজেকে পান্তাভাত মনে হচ্ছে। অথচ সে নিজেও একসময় এমনই ছিল। সময়ের সাথে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়, নষ্ট হয় না তো কেবল মন। কিন্তু সেই মনের প্রাধান্য কেউ দেয় না, শরীরের প্রাধান্যই বেশি। হ্যান্ড ব্যাগের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রহেলি। চেয়ারে বসে একনাগাড়ে পা ঝাঁকাচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চিন্তায় গলা শুকিয়ে এসেছে তার। এখানে আর থাকতে পারছে না। মনে হচ্ছে এখান থেকে দূরে কোথাও চলে গেলে তবেই ভালো হবে। আরফা খাতুন সেই দূরে বসে গল্প করছেন। মায়ের কাছে যেতে হলে নাহিয়ানের সামনে দিয়ে যেতে হবে। কেন যে সে তার সামনে যেতে ভয় পাচ্ছে, নিজেও জানে না৷ হয়তো তার সাথের সুন্দরী মেয়ের সামনে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করতে লজ্জা লাগছে। তড়িঘড়ি করে কনভেনশন হল থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে আসে। একদম ডান প্রান্তে গাড়ির পাশে সিঁড়িতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ে। বুকভরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মাথার চুল দু’হাতে খামচে ধরে দাঁত চেপে কান্না করছে। চোখ বেয়ে জল পড়ছে অবিরাম অন্তহীন। মাথাটা হাঁটুর উপর রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।

“কেন নায়িহান! কেন! কেন এমন করলে আমার সাথে! আমার ভালোবাসার একটু দাম দিলে কী এমন হয়ে যেত তোমার! একদিন হয়তো তুমি বুঝবে কিন্তু সেদিন আমি অনেক দূরে চলে যাব। একদম তোমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।”, বলেই সে কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

নাহিয়ান অন্য সম্পর্কে কীভাবে জড়িয়ে গেল! তাদের এতশত স্মৃতি কীভাবে সে ভুলতে পারলো! কই সে তো কিছুই ভুলেনি। বিয়েটা কী আসলেই মিথ্যে ছিল তার কাছে! এসব ভাবনা তার মাথা ব্যথা শুরু করে দিয়েছে।

“কেক খাবেন? আপনার জন্য এক পিস কেক চুরি করে এনেছি।”

মুখ তুলে তাকায় প্রহেলি। চোখেমুখে অপূর্ব এক বিস্ময়! এই ছেলে তার জন্য কেন কেক এনেছে! তাও আবার চুরি করে! একজন জাতীয় দলের ক্রিকেটার, যার কাছে সকলে যায় আর সে কি-না তার কাছে এসেছে তাও কেক হাতে! প্রহেলির চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। গালদুটো জলে ভিজে একাকার।

দু’হাতে চোখ মুছে বলল, “আপনি! আপনি কেন এখানে এসেছেন? আমার পিছু নিয়েছেন?”

“ভুল বোঝা কী আপনার অভ্যাস?”

কথাটা বেশ গায়ে লাগে প্রহেলির। কোনো উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। দিয়ান চামচ দিয়ে একটু কেক বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই যে শুনুন, এদিকে নেন। মনে করুন এটা আমার দুঃখিতনামা।”

মনটা এমনিতেও খারাপ তার৷ এখন আবার এই ছেলে এসে ছ্যাঁচড়ামি করছে। এত অভিনয় এখন আর তার ভালো লাগে না। একজন তো এতটা বছর নিখুঁত অভিনয় করে জিতে গেল। আর কাউকে সে জিততে দেবে না। একজন সেলিব্রিটিকে কী এভাবে মানায়! তারা কী এমন হয়? কে জানে হলে হতেও পারে। তারাও তো আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই।

দিয়ান আবার বলল, “আপনি আমাকে হয়তো চেনেন না। কিন্তু আপনি, আপনি আমার অনেক বছরের চেনা। আর সেজন্যেই আমি এখানে বসে৷ একটু কেক খেয়েই দেখুন ভালো লাগবে।”

কেকের সাথে কিছু মিশিয়ে দিল না তো সেই ভয়টা পাচ্ছে এখন। এতবার জোর করার মানে কী! প্রহেলি তার দিকে এক পলক তাকায়। দিয়ান ক্ষীণ হেসে একটু কেক নিজের মুখে পুরে দেয়। তারপর আরেকটু কেক নিয়ে প্রহেলির মুখের সামনে ধরে। চকলেট কেক দেখে লোভ সামলাতে পারছে না সে৷ এদিকে বেশ ক্ষুধাও লেগেছে। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে প্লেটের পুরো কেক সে একাই সাবাড় করে নেয়। ঠোঁটের আশেপাশে কেক লেগে আছে। এমন বাচ্চাদের মতো কেক খাওয়া দেখে হেসে দেয় দিয়ান। প্রহেলি জিভ দিয়ে ঠোঁটের আশেপাশের কেক চেটে খায়। দিয়ানের চোখের মণি স্থির নিষ্পলক তার উপর। কী এক তন্ময়তায় আছন্ন হয়ে আছে। সারামুখে অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি ছড়িয়েছে। ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে চোখের নিচে লেপ্টে থাকা কাজল মুছে দিতে। কিন্তু সেই সৌভাগ্য বা অনুমতি কোনোটাই তার নেই।

অপূর্ব শান্ত গলায় বলল, “আপনি অনেক সুন্দর! ঠিক যেন গোলাপি বর্ণের কোনো চন্দ্রমল্লিকা ফুল। ফুলের রাণী গোলাপ হলেও চন্দমল্লিকা আমার খুবই পছন্দ।”

চোখ উলটে তাকায় প্রহেলি। এমন অদ্ভুত কথা আজ অবধি কোনো ছেলে তাকে বলেনি৷ বলবেই বা কে! কোনো ছেলের সাথে মিশেইনি। তার পৃথিবী বলতে তো কেবল নাহিয়ান ছিল। নাহিয়ানের কারণে তাকে এতটা বছর মা ও ভাইয়ের নজর বন্দী থাকতে হয়েছে। যেখানে কোনো মেয়ে বন্ধুই হয়ে উঠেনি সেখানে ছেলে বন্ধু তো অনেক দূরের কথা। মনটা যেন আকাশের মতো হয়ে গেছে। এই কালো মেঘ এই ফকফকা পরিষ্কার।

“সত্যি করে বলুন তো, আপনি আমার পেছন পেছন কেন এসেছেন? কেউ দেখলে সমস্যা হবে।”, প্রহেলি দৃঢ় কণ্ঠে বলল।

দিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আজীবন মেয়েরা কী এই এক ভয় পেয়েই যাবে? তারা কী আর মন থেকে স্বাধীন হবে না? মুখেই কেবল তাদের স্বাধীনতার বাণী।”

“বলছিলাম যে, সমস্যা যতটা না আমার হবে তার থেকে দ্বিগুণ সমস্যা আপনার হবে। আগামীকাল টেলিভিশনের হেডলাইন এবং পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে আপনার ছবিসহ ছাপা হবে, ‘ক্রিকেটার দিয়ানকে দেখা গেল গাড়ির চিপায় অচেনা এক মেয়ের সাথে।’ তখন বিপদটা আপনারই হবে।”, বলেই মিহি কণ্ঠে হেসে দিল সে।

দিয়ান পরিমিত হেসে বলে, “আপনি আমায় নিয়ে বেশ ভাবছেন দেখা যাচ্ছে! এত চিন্তা! হোক না একটু গুঞ্জন। ক্ষতি কী যদি একটু বদনাম হয়ে চন্দ্রমল্লিকাকে পাওয়া যায়!”

চোখের মণিজোড়া বড় তীক্ষ্ণ হয়ে এসেছে প্রহেলির। দিয়ানের চেহারায় কিছু একটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে। এত রহস্য রেখে কেন কথা বলছে ছেলেটা!

“কিসব আজগুবি কথাবার্তা! ক্রিকেটার নাকি কোনো কবি হ্যাঁ? এই ছেলে শোন, সেলিব্রিটি হয়ে গেছ মানে এই নয় যে যাচ্ছে তাই বলবে। তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট। তাই ভেবেচিন্তে কথা বলবে।”

হো হো শব্দে হেসে দিল সে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। মাথাটা একটুখানি হেলিয়ে বলল, “বাহ! আপনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন দেখছি! তা বয়সে ছোট হলেই ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয় এটা কোন ডিকশনারীতে লিখা আছে? বয়সে ছোট হলেও আমার জ্ঞান কিন্তু অনেক প্রখর। তাছাড়া আমি কোনো সেলিব্রিটি নই।”

প্রহেলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এর সাথে আর ক্যাচাল পাড়ার সময় কই তার! দ্রুত পা বাড়ায় হল রুমের দিকে। দিয়ান গলা ছেড়ে গান ধরে,

“চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো?
এখন আর কেউ আটকাতে পারবেনা
সম্বন্ধটা এই বার তুমি ভেস্তে দিতে পারো
মা কে বলে দাও বিয়ে তুমি করছো না…”

এত সাবলীল, গভীরতর, বলিষ্ঠ গানের সুর প্রহেলির কানে এসে মোহময় লাগছে। হৃদয় ঈষৎ স্পন্দিত করে। পা জোড়া ধীর গতিক হয়ে আসে৷ মন চাইছে মানুষটা আরো গান গেয়ে যাক আর সে নীরবে বসে শুনতে থাকুক। কাউকে মুগ্ধ করতে হলে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। সুন্দর কণ্ঠে গান গেয়েই তাকে মুগ্ধ করে নিজের ভক্ত করা যায়।

উপরে উঠার সিঁড়িতে আসতেই নাহিয়ানকে চোখের সামনে দেখতে পায়। সেই সুন্দরী মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে…

কৈশোরে প্রেম
অংশ: ১০

নাহিয়ান মেয়েটাকে সিঁড়ির রেলিঙের সাথে ঠেকিয়ে গলায় মুখ গুঁজে দিয়েছে। চুমুর বর্ষণে শিহরিত হয়ে চোখ বন্ধ করছে। অপূর্ব এক হাসি লেগে আছে মেয়েটার মুখে। এই হাসিটা সুখ প্রাপ্তির। যে সুখ প্রাপ্তিতে এক সময় প্রহেলিও শিউরে উঠেছে। তার অবাধ্য হাত শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নিজের অবস্থান খুঁজে নিচ্ছে। প্রহেলির পা কাঁপছে। চোখজোড়া ছলছল করছে। হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। তার পা সামনে এগোচ্ছে না। আচমকা নিজের কোমরে কারো হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করে। পাশ ফিরে তাকাতেই দিয়ানকে দেখতে পায়৷ ইচ্ছে করছিল এখনই তার হাতটা ছিটকে ফেলে দিতে। কিন্তু পরক্ষণেই মনের উপর কেমন অদ্ভুত একটা বল অনুভব করে সে।

তার সামনে রুমালটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “চোখের নিচে কাজল লেপ্টে আছে মুছে নিন।”

সে কোনো উত্তর দেয় না। নীরবে মুছে নেয়। মোছা শেষে রুমালটা তার হাত থেকে নিয়ে নিজের পকেটে ভরে রাখে। লম্বা একটা নিশ্বাস ছাড়ে প্রহেলি। দিয়ান তাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কোমরে রাখা হাতটার দিকে এক পলক তাকায় সে। এই হাতটা যেন ভরসার হাত। যার ছোঁয়ায় কোনো পাপ নেই।

নাহিয়ানের কাছে এসে দিয়ান থমকে দাঁড়ায়। প্রহেলির বুক ধুকপুক করছে। খালি গলায় ঢোক গিলে। এই ছেলে কী করতে যাচ্ছে! দিয়ান গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “এক্সকিউজমি…”

নাহিয়ান আর মেয়েটা দ্রুত একে অন্যকে ছেড়ে দাঁড়ায়। প্রহেলিকে সে খেয়ালই করেনি। আচমকা চোখের সামনে দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না। তাও আবার দিয়ানের সাথে দাঁড়িয়ে আছে! অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সে।

নাহিয়ানের সাথের মেয়েটা উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, “ওহ মাই গড! এ যে দিয়ান রহমান! আমি কী সত্যিই আপনাকে দেখছি। আমার নাম রাইমা। আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান প্লিজ একটা সেল্ফি আর একটা অটোগ্রাফ।”

প্রহেলি দিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। নাহিয়ানের দিকেও তাকাচ্ছে না সে। সেদিকে যেন তার নজরই যাচ্ছে না। এই ছেলেটা তাকে বারবার অবাক করছে। কী এক অদ্ভুত রহস্য রয়েছে তার মাঝে।

দিয়ান মৃদু হেসে বলল, “একচুয়েলি এখন নো সেল্ফি, নো অটোগ্রাফ। কারণ এখন আপনার সাথে সেল্ফি তুলতে হলে এই যে আমার পাশের মহারাণীকে দেখছেন তাকে ছাড়তে হবে। কিন্তু আমি তাকে ছাড়তে চাচ্ছি না। এভাবেই আজীবন ধরে রাখতে চাই।”

“কোনো সমস্যা নেই। ম্যাম আপনার সাথেই থাকবে, জাস্ট একটা সেল্ফি প্লিজ।”

নাহিয়ান প্রহেলির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে কিছুটা সরে দাঁড়ায়। রাইমাকে আপত্তি জানিয়ে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে। একটা লজ্জা এসে ভর করেছে তার মাঝে। রাইমা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে দিয়ানকে আবারো মিনতি করে। কোনো উপায় না দেখে ছবি তোলার জন্য নিজের সম্মতি জানায় সে। কিন্তু পরক্ষণেই সে যা করে তা কেবল নাহিয়ানকে নয় প্রহেলিকেও অসম্ভব অবাক করে।

“চন্দ্রমল্লিকা, একটা ছবি তোলার অনুমতি কী আপনার এই সেবক পাবে?”, বলেই হাসিমুখে প্রহেলির দিকে তাকায়।

সে আশ্চর্য ধরে রাখতে পারছে না। তৎক্ষনাৎ হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকায়। এই মুহূর্তে তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। হৃদপিণ্ডটা যেন গলার কাছে এসে ঠেকেছে। দিয়ান প্রহেলির একটা হাত নিজের দু’চোখে লাগিয়ে আলতো ঠোঁটের স্পর্শ করিয়ে বলে, “যথা আজ্ঞা আমার মহারাণী।”

প্রহেলিকে পাশে রেখেই দিয়ান একটা সেল্ফি উঠে নেয়৷ রাইমা নাহিয়ানকে বলল, “আসো না ছবি তুলি। তুমিও তো দিয়ানের ভক্ত। আর এখন এমন চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছ! কিছু বললছোও না!”

নাহিয়ানকে টেনে নিয়ে গ্রুপ ছবি তুলে নেয় রাইমা। দিয়ান একটা হাত বাড়িয়ে প্রহেলিকে বলল, “এবার তাহলে যাওয়া যাক রাণী সাহেবা?”

সে মৃদু হাসার চেষ্টা করে। তার চোখেমুখে হাজারো প্রশ্ন। দু’জনে হলরুমে চলে যায়। রাইমা এখনো দিয়ানের গুণগান করে যাচ্ছে। ছবিগুলো বারবার দেখছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেইসবুকে আপলোড করে দেবে। নাহিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে মাথাটা যেন ভনভন করছে তার। মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে।

বিড়বিড় করে বলল, “এই ক্ষেত মেয়ে প্রহেলি কীভাবে দিয়ানের মতো ছেলে পেলো!”

রাইমা মোবাইল থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু বললে তুমি?”

নাহিয়ান প্রতিত্তোরে কিছুই বলে না। ভেতরে কী যেন একটা অশান্তি করছে। অস্থিরতা বেড়ে গেছে। রাইমাকে সেখানে রেখেই হল রুমের দিকে এগিয়ে যায়। রাইমা তাকে আওয়াজ দিতে দিতে পেছনে ছুটে যায়৷ হুট করে এই ছেলের কী হলো কিছুই বুঝছে না সে।

প্রহেলি কোনো কিছু বলার আগেই দিয়ান হাত সরিয়ে নেয়। তার মনে এখন হাজারো প্রশ্ন। এই মানুষটা এসব কেন করলো! চেনাজানা কিছুই নেই অথচ মনে হচ্ছে অনেক দিনের পরিচয়। তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। কী প্রশ্ন করবে, কিছুই জানে না৷ ভাবছিল কীভাবে শুরু করা যায়।

সহসা সে বলে উঠলো, “পরজীবি শহরের গানটা শুনেছেন?”

প্রহেলি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, “না! কেন?”

“শিল্পী মাশা ইসলামের নতুন একটা গান। গানটা না শুনলেও শিল্পীকে এক পলক দেখে নেবেন।”

“কেন বলুন তো!”

“মাশা ইসলামকে দেখার পর আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে, আপনাকে ছোট চুলে কতটা বেশি সুন্দর লাগে।”

প্রহেলির চুল কাঁধ পেরিয়ে গেছে৷ দিয়ান কলেজ জীবনের সেই প্রহেলির কথা বলছে যখন তার সৌন্দর্যের বাঁধাধরা ছিল না। অনেক ছেলেই তখন মোহিত হতো তাকে এক পলক দেখে। দিয়ান তার কাছ থেকে সরে গিয়ে মেহরাবের কাছে যায়। প্রহেলির আর তাকে প্রশ্ন করা হয়ে উঠে না। জানাও হয় না দিয়ান কেন এমন করলো! কথার বলার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কেবল। মেহরাবের কানে কিছু বলে স্টেজে গান গাওয়ার জন্য উঠে। নাহিয়ান এসে অন্যপাশে দাঁড়ায়। তার চোখ তাদের দু’জনের উপর। প্রহেলি দিয়ানের বরাবর বসে আছে। নজর চুরি করার চেষ্টা করছে সে। যখনই তাকাচ্ছে তখনই চোখে চোখ পড়ে যায়। দিয়ানের দৃষ্টি যেন তার উপরই স্থির। আশেপাশের কারো কোনো খোঁজ নেই। পাশের চেয়ারে পূজা বসে আছে। বিষয়টা বেশ ভালো করে তার নজরে পড়ছে। তার অজান্তে কিছু একটা ঘটছে আঁচ করতে পারে সে।

দিয়ান গিটারর টুংটাং আওয়াজ তুলে ভারী আবেগী স্বরে বলল,
“তুমি শীতল নদী মুহুরি,
আমি শুভ্র ক্ষুধার্ত এক পানকৌড়ি।
টুপটুপ দিয়ে ডুব, জল গভীরে,
হৃদয় শিকার করে, আসব ফিরে নদীর তীরে।”

তারপর গান ধরে…!

“তোমার জন্য নীলচে তারার একটু খানি আলো
ভোরের রঙ রাতের মিশকালো
কাঠগোলাপের সাদার মায়া মিশিয়ে দিয়ে ভাবি
আবছা নীল তোমার লাগে ভালো।”

তার চারপাশে অনেকেই ভীড় জমায়। একদিকে গানের আসর জমেছে অন্য দিকে আরফা খাতুন এসে প্রহেলিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। প্রহেলি এত দ্রত আসতে চাচ্ছিলো না দিয়ানের সাথে তার কথা রয়ে গেছে। কিন্তু মাকে বলার সাথে সাথে নিয়ে গিয়েছেন এখন জোর করে সেখানে থাকতেও পারবে না। পূজা আর মেহরাবের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। গান শেষ করে দিয়ান তাকে অনেক খুঁজে কিন্তু কোথাও পায় না।

পূজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “আপনার বান্ধবী কি চলে গেছেন?”

আচমকা কারো কথা শুনে পাশ ফিরে তাকায় পূজা। দিয়ানের এমন প্রশ্ন করতে দেখে মনের সন্দেহটা আরো প্রখর গাঢ় হয়। ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল, “কেন? থাকার কি কোনো কথা ছিল?”

কথাটা শুনে সে অর্থপূর্ণ হাসে। মাথা চুলকে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বর কনেকে মেহেদী পরানো শুরু হয়েছে। এখানে আর থাকতে ভালো লাগছে না তার। যেখানে চন্দ্রমল্লিকা নেই সেখানে থাকার কোনো মানে নেই।

“আপনি মনে হয় এখন চলে যাবেন!”, বলেই পূজা তার দিকে তাকায়।

সে ক্ষীণ হেসে বলল, “তাই নাকি! তা আপনার কেন মনে হলো এটা?”

“যেখানে আমার বান্ধবী নেই, সেখানে আপনিও থাকতে চাইবেন না নিশ্চয়ই। আমি ভুল না করলে আপনি খুব জোর এখানে আর দশ মিনিট থাকবেন।”

দিয়ান শব্দ করে হেসে দেয়৷ পূজা তার মনের রোগ ধরতে পেরেছে। কোনো কথা না বলে সে নীরব হয়ে থাকে।

“আসি তাহলে, কাল দেখা হচ্ছে।”

“আমার সাথে নাকি বান্ধবীর সাথে?”

“যা শুনলে আপনি খুশি হবেন, উত্তরটা তাই ভেবে নিন।”

দিয়ান ফেরার পথে পা বাড়ায়। পূজা তাকে পেছন থেকে ডেকে বলল, “সাবধানে পা ফেলবেন। সে পথ অনেক কাঁটায় ভরা। পথ পাড়ি দিতে পারলে গন্তব্য খুব কাছেই। কিন্তু সেই গন্তব্যে পাবেন একদম মরে যাওয়া একটা গাছ। আর আপনি সেই গাছকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে কতটুকু সফল হবেন তা নির্ভর করবে আপনার যত্নের উপর।”

দিয়ান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ক্ষুদ্র চোখে তাকায়। মাথা খানিকটা হেলিয়ে বলে, “পথটা বহু আগেই পাড়ি দিয়েছি। আর গাছটা আমারই ছিল। মাঝখানে কোনো এক ছাগল এসে খানিকটা নষ্ট করে দিয়েছে। আমার খেয়ালের অভাবে যা এখন নেতিয়ে গিয়েছে। কঠিন যত্ন করতে হবে। সবটুকু যত্ন দিয়ে আবার সেই গাছে ফুল ফোটাবো। চন্দ্রমল্লিকা ফুল।”

দিয়ান চলে যাচ্ছে। পূজার চোখে আনন্দের অশ্রু। এই ছেলেটাই প্রহেলির জন্য। তাদের একত্র করতে যা যা করা লাগে সে সবকিছু করবে। কিছু সীমা লঙ্ঘন করে যদি দু’টো মানুষকে সুখের গন্তব্যে পৌঁছানো যায় তাহলে সেটা যতই কঠিন হোক তা সে করবে। নিজের সাথে নিজের একটা প্রতিজ্ঞা তার।

নাহিয়ান গতকালের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। তার চোখ সারাক্ষণ দিয়ান আর প্রহেলির উপরই ছিল। তাদের চোখে চোখে এভাবে তাকানো যেন অন্তর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। তার মাথায় এখন একটাই ভাবনা এই মেয়েকে একটা কঠিন শিক্ষা দিতে হবে। নাহিয়ানকে পাত্তা দেয়নি এই মেয়ে কতবড় সাহস! স্কুলে প্রহেলির জন্য কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে তাকে। সে স্যার-ম্যাডামদের প্রিয় ছিল সবসময়। ক্লাসের মূল আকর্ষণ তার উপর ছিল। বাবা-মায়ের কাছে কত কথা শুনতে হতো। একটা মেয়ের রোল এক হয় আর সে ছেলে হয়ে এক হতে পারে না! তাকে তো কখনো কোনো কিছু কম দেওয়া হয়নি। তবু সে আগাতে পারছিল না। মেয়েদের এত বাড় বাড়তে নেই৷ মেয়ে জাতিটা যত নিচু হয়ে থাকবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল। আর প্রহেলিকে নিচে নামানোর জন্যই এতকিছু করেছে সে। সবসময় দাবিয়ে রেখেছে। কোনো মেয়ে নাহিয়ানের থেকে উপরে উঠে যাবে এটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব! সে খেয়ে ফেলে দেওয়া মেয়ে তার চাইতে ভালো কেউ পাবে এটা কখনোই হতে পারে না। প্রহেলি তার কাছে এখন উচ্ছিষ্ট খাবার হয়ে গেছে। মেয়ে জাতকে কখনো লাই দিয়ে মাথায় তুলতে হয় না। এদের স্থান পায়ের নিচের জুতোর মতো। যতদিন প্রয়োজন ততদিন প্রিয়, প্রয়োজন ফুরালেই ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। যত্ন করে রাখা বোকামি। শুয়ে শুয়ে ফন্দি আঁটতে থাকে নাহিয়ান। কীভাবে প্রহেলিকে আবার ভেঙে দেওয়া যায়।

বিয়ের দিন আসতে চাচ্ছিল না প্রহেলি। পূজা তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কোনো উপায় না দেখে একটা সাধারণ ড্রেস পরে তৈরি হয়ে নেয়৷ নিজেকে আয়নাতে দেখে। আসলেই তাকে ছোট চুলেই বেশি সুন্দর লাগে। বিয়েতে এসে একটা কোণে চেয়ারে বসে থাকে। বসে বসে মোবাইল টিপা ছাড়া কিছু করার নেই। কিন্তু তার উপর কারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। যে আড়াল থেকে তার প্রতিটা চাহনিকেও লক্ষ্য করছে।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here