কৈশোরে প্রেম
অংশ: ১১,১২
লিখা: বর্ণালি সোহানা
অংশ: ১১
“কথা দিয়ে মানুষ কেন কথা রাখে না?”, দিয়ানের প্রশ্নে কেঁপে উঠে প্রহেলি।
চুপচাপ বসে মোবাইল টিপছিল সে। আচমকা তার কণ্ঠস্বর শুনে ভয় পেয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে নেয়। সাদা একটা পাঞ্জাবির উপর কালো রঙের কটি পরেছে। চোখে কালো ফ্রেমের সাদা চশমা। দাড়ি রাখলে আরো আকর্ষণীয় লাগতো তাকে। এখন তো তাকে নিতান্তই একটা বাচ্চা ছেলে মনে হয় তখন পুরুষ মনে হতো। আশেপাশের অনেক মেয়ে তার দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। বর-কনের ফটোসেশান চলছে অন্য পাশে। ওদিকে কারো কোনো খোঁজ নেই।
প্রহেলি ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল, “আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন। আপনি কি আমাকে কোনোভাবে স্টক করছেন?”
“আপনার এটা মনে হওয়ার কারণ?”
“গতকাল যা করলেন সেগুলোর অর্থ আমি কী ধরে নেবো? একটু বিস্তারিত বললে কী ভালো হতো না? আমার উৎসুক মনটা তো জানতে চায়।”
দিয়ান নিজের পরিচয় দিতে চায় না প্রহেলির সামনে। সে অপেক্ষা করবে মানুষটা তাকে চেনে কী না। কিন্তু এখন তার এই বিষয়টাকে অন্যভাবে সামলাতে হবে।
সে ম্লান হেসে বলল, “মেহরাব ভাইয়ার মুখে শুনেছিলাম আপনার আর নাহিয়ান সাহেবের স্কুল লাইফের ফ্যামাস সেই প্রেমের গল্প। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য যদি কোনোদিন ছোট্ট একটা নাটক করতে হয় তাহলে এই দিয়ান কখনো পিছপা হয় না।”
প্রহেলি অর্থপূর্ণ হাসে। দিয়ানের কথায় যে সে বিশ্বাস করে ফেলেছে এমন নয়। তবু সে তাকে বোঝায় সে বিশ্বাস করেছে।
“আমি ভুল না করলে তুমি সেই দিয়ান, যে চট্টগ্রামে আমাদের বাসার সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলতে।”
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দিয়ান। ঘাড়টা ঈষৎ বাঁকা করে বলল, “জি আমি সেই দিয়ান।”
ক্ষীণ হাসে প্রহেলি। সে যা ভাবছিল আসলেই তা সঠিক।
“শোন, আমি তোমাকে তুমি করে বলব। বয়সে ছোটদের আপনি বলে সম্বোধন আমার ঠিক আসে না। তবে তুমি আমাকে আপনি করেই বলবে। আর হ্যাঁ আমাকে আপু ডাকবে। তোমার থেকে আমি সম্ভবত দুই বছরের সিনিয়র।”
শব্দ করে হেসে দেয় দিয়ান। তার সারা শরীর দুলে উঠে। অদ্ভুত এক রহস্যমাখা সেই হাসি। আশেপাশে অসংখ্য কথার ভীড়ে তার হাসির শব্দ মিলিয়ে যায়। কিন্তু মুগ্ধ হয় প্রহেলি। এই হাসির সাথে সে আগে থেকে পরিচিত। কিন্তু কোথায় তা মনে নেই। দিয়ান যেন কঠিনভাবে কাউকে মনে করিয়ে দিয়ে যাওয়ার খেলায় মেতেছে। অথচ প্রহেলি পারছে না মনে করতে।
তার চোখের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলল, “দুই বছর এক মাস তেরো দিনের বড়।”
প্রহেলির চোখেমুখে অসংখ্য ভাবনার স্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠেছে। এই ছেলে কী লুকোচ্ছে তার থেকে। মাথাটা যেন এলোমেলো করে দিয়েছে তার। উদ্ভট সব চিন্তা এসে ভর করেছে। মেহরাব হাতের ইশারা করে প্রহেলিকে ডাকে। পূজা আর প্রহেলি উঠে যায় ছবি তুলতে। দিয়ান স্থির বসে রয় সেই চেয়ারে। সেই সাথে স্থির তার চোখের মণি। প্রহেলিকে যেন চোখের আড়াল করতে চাচ্ছে না সে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কত কথা ছিল বলবার, অথচ কিছুই বলা হয়ে উঠে না। কেবল সঠিক সময় ও সুযোগের অপেক্ষায়।
প্রহেলি মাকে খুঁজতেই দেখল আরফা খাতুনের পাশ থেকে নাহিয়ান যাচ্ছে। তার মুখে কেমন অদ্ভুত এক হাসি। মানুষ দুঃসাধ্য কোনো জিনিস হাসিল করার পর যে প্রাপ্তির হাসি হাসে সে হাসির থেকেও ভিন্ন এই হাসি৷ মনটা কেমন ভয়ে কাতর হয়ে আসে। বুকের ভেতর চাপা ব্যথা অনুভব করছে প্রহেলি। কেন জানি মনে হচ্ছে খারাপ কোনো কিছু হতে চলেছে তার সাথে!
গায়ে হলুদের মতো বিয়ের দিনও প্রহেলিক্র হুট করেই হারিয়ে ফেলে দিয়ান। যাকে চোখে চোখে রাখতে চায় সেই চোখের পলকে হারায়। পেয়ে হারানোর এক জটিল খেয়াল নেমেছে দু’জন। কখন কে জিতে যায় নিয়তিই জানে। হারানোর তালিকা বিশাল বড় এবার অন্তত প্রপ্তির তালিকা ভারী করতে চায় দিয়ান।
পরদিন বউ ভাতের অনুষ্ঠানে প্রহেলি আর আসে না। তার মা আরফা খাতুন একাই আসেন। দিয়ান বেশ কয়েকবার আশপাশে খুঁজে তাকে পায় না। পূজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এক্সকিউজ মি, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।”
পূজা উৎকণ্ঠা গলায় বলল, “অবশ্যই! কেন নয়! আপনার কোনো কাজে আসতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। তবে তার বিনিময়ে কিন্তু আরো ভালো খেলতে হবে। বলে বলে ছক্কা…।”
দিয়ান পরিমিত হেসে বলল, “আপনার বান্ধবী প্রহেলিকা আজ বউ ভাতে আসলেন না কেন?”
সে ইতস্তত করে বলল, “আসলে তার অনেক জ্বর।”
পূজা কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে৷ তার চেহারাই বলে দিচ্ছে সব কথা। তবু দিয়ান কোনো প্রশ্ন করে না৷ তবে এই মুহূর্তে তার প্রহেলিকে এক পলক না দেখলে শান্তি পাবে না। প্রহেলির মা একা এসেছেন আজ বউ ভাতে। তার ভাই নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে অফিসে থাকবে।
“আমি আপনার বান্ধবীর বাসায় যেতে চাই। এক পলক না দেখলে আমার মনের অসুখ সাড়বে না।”, বলেই কাতর চোখে তাকায় সে।
তার চোখজোড়া যেন প্রিয়জনকে দেখার আশায় বহু বছরের তৃষ্ণার্ত। পূজা কীভাবে এই মানুষটাকে মিথ্যে বলবে বুঝতে পারছে না। তার মন তাকে সায় দিচ্ছে না।
সে ম্লানমুখে বলল, “আমি আপনাকে নিয়ে গেলে তার সমস্যা হতে পারে৷ এমনিতেও সে অনেক বড় বিপদে পড়ে গেছে।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় দিয়ান। পূজা জানায়, গতকাল নাহিয়ান প্রহেলির মায়ের কাছে তাদের সম্পর্কের কথা সবকিছু বলে দেয়৷ প্রান্তের মোবাইল নম্বরে তাদের অন্তরঙ্গ কিছু ছবি পাঠায়। আরফা খাতুনকেও ছবিগুলো দেখায়৷ বাড়িতে যাওয়ার পর প্রান্ত প্রহেলিকে অনেক মেরেছে। ব্যথায় জ্বর এসেছে তার৷ সারারাত জ্বরে কেঁপেছে। ব্যথায় বিছানা থেকে নড়তে পারছে না। সকালে গিয়ে পূজা দেখে এসেছে তাকে। সারা শরীরে মারের ভয়াবহ দাগ বসে গেছে। প্রান্ত খুব শীঘ্রই প্রহেলিকে বিয়ে দিয়ে দেবে। যাও পড়ানোর ইচ্ছে ছিল আর পড়াবে না এখন। আজ থেকে তো তার বাইরে যাওয়াও বন্ধ। পূজার কথা শুনে দিয়ানের মুখ রাগে লাল হয়ে আসে। প্রান্ত যদি প্রহেলির ভাই না হতো তবে আজ তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিত সে। রাগ সামলে নিজেকে শান্ত রাখে। সবরকম পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার অসাধারণ এক ক্ষমতা নিয়ে এসেছে সে।
পূজাকে সাথে নিয়ে প্রহেলিদের বাড়িতে চলে আসে দিয়ান। ঠিক দুপুর বেলা। আকাশে ফকফকা রোদ। এই মুহূর্তে প্রান্ত বাড়িতে নেই৷ অফিসে আছে সে। আরফা খাতুন তো বউ ভাতের অনুষ্ঠানে। তার আসতে অন্তত বিকেল হয়ে যাবে। বাসায় কেবল কাজের মেয়ে।
পূজা দরজায় কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছে। কাজের মেয়ে রুমা এসে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কারে চাইতাছেন আফা?”
“আমি প্রহেলির বান্ধবী পূজা। তার সাথে দেখা করতে এসেছি।”, ইতস্তত করে বলল।
রুমা পূজার পা থেকে মাথা অবধি একবার তাকায়। তারপর বলে, “আফার লগে কেউর দেখা করন মানা আছে। প্রান্ত ভাই জানলে আমার চাকরি নট কইরা দিব।”
“আপনি কী প্রহেলিকে একটুও ভালোবাসেন না? আমি আসলে তার জন্য ডাক্তার সাথে নিয়ে এসেছিলাম। রাত থেকে তার ভীষণ জ্বর। ডাক্তার দেখিয়েই চলে যাব।”
ততক্ষণে দিয়ান এসে তার পাশে দাঁড়ায়। সাদা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা আর হাতে কালো একটা ব্যাগ। এই ছোট ছেলে ডাক্তার হতে পারে এ বিষয়ে সন্দেহাতীত ভাবে রুমা। তার দেখা সব ডাক্তাররা ফরসা একদম দুধের মতো। কিন্তু তাদের পেট মোটা হয়। মাথায় টাক থাকে। আর বয়স চল্লিশোর্ধ্ব হয়। তবু পূজার অনুরোধে ভেতরে ঢুকতে দেয় সে তাদের। কিন্তু সময় কেবল বিশ মিনিট। এর বেশিক্ষণ ট্রিটমেন্ট করা যাবে না। তাড়াতাড়ি দেখে ওষুধ দিয়ে যেতে হবে। তার কথামতো রাজী হয়ে যায় তারা।
দিয়ান প্রহেলির রুমে ঢুকে। পূজা দরজায় দাঁড়িয়ে রুমাকে বলল, “আমার জন্য এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি, ডাক্তার সাহেবের জন্য এক কাপ হট কফি। আর প্রহেলির জন্য নরমাল পানি দিয়ে এক মগ লেবুর শরবত বানিয়ে আনলে খুবই উপকার হতো।”
এসব কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্য যাতে রুমা এখানে উপস্থিত না থাকে। নাহলে সে এখান থেকে এক পা নড়বে না। রুমা রুমের ভেতরে বারবার তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে ফিরে যায়। পূজা দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারাদারি করতে লাগে। দিয়ান বিছানার কাছে এসে শিউরে উঠে৷ একটা মানুষকে কেউ এভাবে জানোয়ারের মতো মারতে পারে! হলুদ ড্রেসে তাকে একদম শর্ষের ফুল মনে হচ্ছে। কিন্তু এই ফুলের গায়ে কতশত আঘাতের চিহ্ন। হাতের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমাট বেধেছে। ঠোঁটের কোণ কেটে গেছে। দিয়ান হাঁটু ভাজ করে তার মাথা বরাবর ফ্লোরে বসে পড়ে। চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ে।
চলবে…
কৈশোরে প্রেম
অংশ: ১২
কপালে কারো শীতল হাতের স্পর্শে চোখ মেলে তাকায় প্রহেলি। দিয়ানকে সামনে দেখে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। সামনে একটা বাটিতে জল রাখা। নিজ হাতে জলপট্টি দিতে লাগে সে। চোখের জল উলটো হাতে মুছছে। নিজেকে আজ অনেক অসহায় লাগছে তার। প্রিয় মানুষটাকে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখার থেকে বড় কষ্ট বোধহয় আর কোনো কিছুতেই নেই। নিজেদের দশটা অসুস্থতা স্বাভাবিকভাবে নেওয়া যায় কিন্তু প্রিয় মানুষের একটা অসুস্থতাও কলিজায় আঘাত দেয়।
“এই ছেলে কেন আমার স্বপ্নে এসেছে! আমি তো স্বপ্নে এখন আমার সেই হাসিখুশি জীবনে ফিরে গিয়েছিলাম।”, বিড়বিড় করে বলল প্রহেলি।
তার ঠোঁটজোড়া কেবল নড়ছে। জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছে। কথার খৈ হারিয়ে ফেলছে। সত্যিটাকেও সে স্বপ্ন ভেবে ধরে নিচ্ছে।
প্রহেলি পাঁচ মিনিটের মাথায় আবার চোখ পিটপিট করে তাকায়। দিয়ানকে আগের জায়গায় বসে থাকতে দেখে ক্ষুদ্র চোখে চেয়ে রয়।
অপ্রস্তুত গলায় বলল, “এই ছেলে তুমি এখানে কীভাবে আসলে?”
এবার প্রহেলি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে। ব্যথায় উঠে বসতে কষ্ট হচ্ছে তার। দিয়ান আলতো করে ধরে তাকে বসতে সাহায্য করে। বালিশে হেলান দিয়ে বসে বলল, “তুমি এখানে কীভাবে এসেছ? প্রান্ত ভাইয়া দেখলে সমস্যা হবে। প্লিজ চলে যাও।”
“এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে বুঝি আমি না এসে পারি?”
“এসব কথার মানে কী? আর তুমি বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন? কী সমস্যা তোমার? রুমা…রুমা…”, কাজের মেয়েকে ডাকতে লাগে প্রহেলি।
দিয়ান তার মুখের উপর হাত চেপে ধরে। চোখ বড় বড় করে তাকায় সে। তৎক্ষনাৎ সে হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, “স্যরি, স্যরি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল করে ফেলেছি। আর এমন হবে না।”
একটা মেয়ে যতই নির্বোধ হোক না কেন কোন ছেলে তাকে পছন্দ করে তা অন্য কেউ বোঝার আগে সে নিজেই বুঝতে পারে। প্রহেলির বেলায় দেরি হলেও সে এখন বুঝে যায়৷ আর বোঝার কিছু বাকি নেই।
মাথাটা ঈষৎ হেলিয়ে বলল, “দেখ দিয়ান তুমি ভুল পথে হাঁটছো। এসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা ছেড়ে দাও। অল্প বয়সে ভুল করেছি আমি। তুমি অন্তত করো না। তোমার এখনো অনেক সুন্দর ভবিষ্যৎ পড়ে আছে।”
“তোমাকে ভালোবাসা কী আমার শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধ?”
“মানে!”
“তাহলে কেন এত বছর ধরে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছ? অনেক তো অপেক্ষা করালে।”
দিয়ানের চোখ লাল হয়ে আছে। চশমা খুলে সাইড টেবিলের উপর রেখে দেয়। প্রহেলির থেকে কিছুটা দূরে সরে বলল, “আমাকে তো তুমি কথা দিয়েছিলে রে, ভুলে গেলে কীভাবে সবকিছু?”
“কথা দিয়েছিলাম মানে?”, ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
দিয়ান ছলছল চোখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমাকে বিয়ে করবা না প্রহু আপু? এখন আর তোমাকে কীভাবে খাওয়াবো তার চিন্তা করতে হবে না। মাস শেষে মোটা অংকের টাকা পায় তোমার ক্ষুদে শিল্পী।”
“শিল্পী তুই!”
এবার কেঁদে দেয় দিয়ান। চোখের জল আর আটকে রাখতে পারে না। প্রহেলির মাথা ঝিম ধরে আছে। চোখ জ্বালা করছে। হাঁটুর উপর ভর দিয়ে দিয়ানের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে। এই সুযোগে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে। প্রহেলির কাঁধ ভিজিয়ে দিচ্ছে। সকল অনুভূতি যেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। এই দিয়ান যে দিব্য কখনো ভাবতেই পারেনি সে। সেই ছোট্ট দিব্য আজ কত বড় হয়ে গেছে! এ জন্যেই তো প্রহেলি তার সাথে এত মিল খুঁজে পাচ্ছিল! আজ সে জানতে পারে দিয়ানের পুরো নাম দিয়ান রহমান দিব্য।
“তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস রে আমার ক্ষুদে শিল্পী! জানিস আমি তো তোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম! তবে যখন তুই স্কুল ছেড়ে চলে গেলি অনেক খুঁজেছিলাম তোকে। কেন সেদিন ওভাবেই চলে গেলি?”, দিয়ানকে ছেড়ে একদম সম্মুখে বসে পড়ে।
কিছুক্ষণ আগেও যে মেয়ে গায়ের ব্যথায় নড়তে পারছিল না এখন সে সোজা হয়ে বসে আছে। হাত বাড়িয়ে দিয়ানের চোখের জল মুছে দেয়। সেদিন যখন দিয়ান পড়ালেখা তাড়াতাড়ি শেষ করে চাকরি ধরে প্রহেলিকে বিয়ে করার কথা তার বাবা সোহেল রহমানকে বলে তখন সবাই তার কথায় হাসলেও তার বাবা তাকে বুঝিয়েছিলেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তবেই সে তার ভালোবাসাকে বিয়ে করতে পারবে৷ সোহেল রহমান তার বেকারত্বের কারণে নিজের প্রেমিকাকে চোখের সামনে দিয়ে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে হতে দেখেছেন। কিন্তু ছেলের সেদিনের নিতান্তই পাগলামোর কথাকে গভীরভাবে নিয়ে নেন তিনি। যতটা না নিজের ভালোবাসাকে দিব্য আগলে রেখেছে তার থেকে বেশি যত্ন করেছেন তার বাবা সোহেল রহমান। দিব্যকে পড়ালেখার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলার জন্য একটা স্বনামধন্য ক্রিকেট ক্লাবে ভর্তি করে দেন তার বাবা। ভালোবাসাকে বুকে লালন করতে হবে এই কথা শিখিয়ে হুট করেই তখন তাকে প্রহেলিকার চোখের আড়ালে নিয়ে গিয়েছিলেন। যখন সে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে পেরেছে তখন তিনি তাকে অনুমতি দিয়েছেন ভালোবাসাকে সফল করে পেতে। এমন বাবা ভাগ্যক্রমেই পাওয়া যায়। দিয়ান তার বাবার কথামতো প্রহেলিকাকে নিজের করে পেতে আবারো তার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে।
দিব্যের মুখে সবকথা শুনে বাকহারা হয়ে পড়ে প্রহেলি। চোখের সামনে কাকে দেখছে সে! সে কী মানুষ নাকি ভালোবাসার কোনো প্রতিমা! যাকে মানুষ স্মরণ রাখবে যুগের পর যুগ। নিজের প্রতি লজ্জা হচ্ছে আজ প্রহেলির৷ চাইলেও আজ সে আগের মতো কোনো কিছু করে দিতে পারবে না৷
প্রহেলি তার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “তুই তো একটা পাগল রে! এখনো সেই ছোটবেলার কথা মনে রেখে বসে আছিস! ওসব কী আর হয় বল!”
“কেন হয় না? কী জন্যে হয় না? তুমি না আমাকে কথা দিয়েছিলে? আমায় ছুঁয়ে কথা দিয়েছিলে।”
“তোর আর আমার মাঝে এসব কোনোদিন সম্ভব না। তখন তো মজার ছলে বলে দিয়েছিলাম।”
“মজার ছলে! সিরিয়াসলি! আমার ভালোবাসা তো মজার ছলে ছিল না। আমার চাওয়াটা তো মজার ছলে ছিল না। তোমাকে পাওয়ার জন্য নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়েছি আমি। একটা লক্ষ্য রেখে এগিয়ে গিয়েছি আর কোনো কিছু নিয়ে ভাবিনি। ভেবেছি কেবল একবার তোমাকে পেয়ে গেলে সব সুখ হয়ে যাবে। আর এখন সেই তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছ! আমার ভালোবাসাকে গুরুত্ব দিচ্ছ না!”
“আরে তুই আমার ছোট ভাইয়ের বয়সী রে পাগল। আমি সেদিন নিতান্তই মজা করে কথাগুলো বলেছিলাম। এর তুই এখনো সেসব ধরে বসে আছিস!”
“আচ্ছা! আমায় ছুঁয়ে বলা যে কথাগুলো তোমার কাছে মজা ছিল, সে কথাগুলো আমার কাছে দলিলে লিখিত সত্য ছিল। যা কেউ চাইলেও খণ্ডাতে পারবে না। আর বয়সটাই জরুরি হয়ে দাঁড়ালো তোমার কাছে? আমার ভালোবাসা কোনো ফ্যাক্ট না? আমার আরো দু’বছর আগে জন্ম হয়নি তাতে কি আমার দোষ? কই আমি তো ছোট ভাইদের মতো কথা বলছি না তাহলে তুমি কেন বড় বোনের মতো কথা বলছো?”
আশ্চর্য ধরে রাখতে পারছে না সে। এই ছেলে কীসব উলটা পালটা কথা বলছে! প্রহেলির ভাবনার বাইরে তার চিন্তাভাবনা! লোকে সাধারণত পান থেকে চুন খসলেই কথা শোনায় আর বয়সে ছোট-বড় বিয়ে শুনলে তো কথা তাদের মুখে তুলে দেওয়া হয়।
দিব্য শান্ত গলায় আবার বলল, “আমি ভালোবাসি তোমায়, পাগলের মতো ভালোবাসি। আমার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। সত্য, সুন্দর স্বচ্ছ ভালোবাসা। তুমি আমাকে ভালোবাসতেই হবে। তোমাকে ভালোবাসিয়েই ছাড়ব আমি।”
নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে প্রহেলি। যাকে সে গতকালও একজন পরিণত বয়সের পরিপক্ব মানুষ ভেবেছে আজ সে বাচ্চা ছেলেদের মতো জেদ ধরে বসে আছে। জ্বর ধরেছে তাকে আর ঘোর হয়েছে দিব্যের। প্রহেলি কিছু বলতে যাবে সেই মুহূর্তে আচমকা দিব্য তার কোলে মাথা রেখে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরে। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে সে। কেন জানি বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে প্রহেলির। এভাবে কোনো ছেলেকে সে কাঁদতে দেখেনি। ধীরেধীরে নিজের হাতটা নিয়ে তার মাথায় রাখে। মাথাভর্তি নরম চুলের ভেতর তার হাতটা হারিয়ে যায়৷ একটা মানুষ তাকে পাগলের মতো ভালোবেসে গেছে আর সে জানতেও পারেনি। কিন্তু সে তো তাকে ভালোবাসতে পারবে না। তার কলঙ্কিত জীবনের সাথে এই নিষ্পাপ মানুষটাকে জড়িয়ে তার জীবনকে নষ্ট করতে পারবে না। নিজের বলতে তো আর কিছুই নেই। ইজ্জতটাকেও হারিয়ে বসেছে। মানুষটাকে কিছুই দেওয়ার আর নেই তার কাছে। কাউকে সে ঠকাতে পারবে না। আজ জীবনের প্রথম নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে তার। কেবল অপরাধী নয় ঘৃণ্যতম এক পাপী। যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ হয়তো সে পাবে না। শাস্তি ভোগ করে যেতে হবে আজীবন। ভালোবাসার মানুষগুলো থেকে দূরে চলে গেলেই ভালো হবে। অন্তত এই মানুষগুলো ভালো থাকবে। নিজের কথা তো অনেক ভাবলো এবার না হয় কাছের মানুষদের কথা একবার ভাবা যাক।
প্রহেলি দিব্যের থেকে সরে যায়। মাথা নিচু করে বলে, “আমি অশুদ্ধ হয়ে গেছি দিব্য৷ কলঙ্কিত এই দেহটাতে অবশিষ্ট কিছুই নেই যা তোকে দান করবো। এই আমি তোর মতো কারো জন্য না। আমি তো কাউকেই বিয়েই করতে পারব না। কেউ একজন আমার সাজানো গোছানো ফুলের বাগান নষ্ট করে দিয়ে গেছে। এই বাগানে আর কোনোদিন ফুল ফুটবে না। চলে যা তুই এখান থেকে, আর কোনোদিন আসিস না। ভালো থাকবি তুই।”
প্রহেলির মনের কথাগুলো জানা হয় না দিব্যের৷ আর প্রহেলি জানতে পারে না দিব্যের সিদ্ধান্ত। তার মাথায় হাত রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে দিব্য৷ সেই রহস্য ঘেরা হাসি। পূজা এসে বসেছে প্রহেলির পাশে। তার চোখে জল। সুখ জিনিসটা কেন চিরস্থায়ী হয় না! একটাই তো জীবন, এই জীবনে মানুষের সব চাওয়া পূরণ হয়ে গেলে খুব একটা মন্দ হয়ে যেত না। পূজা মন থেকে চাচ্ছে প্রহেলি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করুক। কিন্তু সে জানে না শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেবে সে।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা