কৈশোরে প্রেম অংশ: ১৪,১৫

0
2070

কৈশোরে প্রেম
অংশ: ১৪,১৫
লিখা: বর্ণালি সোহানা
অংশ: ১৪

প্রহেলির হাত দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ব্লেড দিয়ে কেটে অন্য হাতে চেপে ধরে আছে। দিব্যের হাত থেকে ব্যাগটা মেঝেতে পড়ে যায়। দৌড়ে এসে প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে পেচিয়ে বেঁধে দেয় তার হাত। প্রহেলির সাহস হয়নি খুব বেশি জোরে ব্লেডের আঘাত করতে। একটু চামড়া কাটতেই ভয়ে একাকার অবস্থা। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। কেবল প্রহেলির নয় দিব্যেরও।

“এসব কী করেছ তুমি! জীবন কী এতই সস্তা হয়ে গেল তোমার কাছে! এতবড় পদক্ষেপ কীভাবে নিতে পারলে! একবার পরিবারের কথা ভাবলে না? একবার নিজের স্বপ্নের কথা ভাবলে না? আমার কথা না হয় নাই ভাবলে কিন্তু একবার তো নিজেকে পরিবর্তন করার কথা ভাবতে পারতে। যে নাহিয়ান তোমাকে ছেড়ে গিয়েছে তাকে কী তোমার জবাব দেওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। ঘুরে দাঁড়ানোটা কী জরুরি মনে হলো না তোমার? এত ভেঙে পড়লে কীভাবে? তুমি তো এমন ছিলে না রে! চলো, এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে চলো।”

প্রহেলি উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, “শিল্পী! তুই এখানে কীভাবে এলি? ভাইয়া দেখলে তোর কপালে খারাপ আছে। তুই তাকে একটুও চিনিস না।”

রাগান্বিত হয়ে সে বলল, “বেশি কথা বলবে না, চুপচাপ ডাক্তারের কাছে চলো।”

“শোন, আমার সাথে এত ভাব দেখাবি না। আর আমার বেশি কিছু হয়নি। যাব না আমি। আম্মু ভাইয়া যদি জানে আমি সুইসাইড করার চেষ্টা করেছি তারা না জানি কীভাবে রিয়েক্ট করবে। মা তো কেঁদেকুটে পাগল হয়ে যাবে। আমার সাহস নেই তাদের সামনে যাওয়ার।”

“ঠিকাছে তোমার কিছুই করতে হবে না, যা করার আমি করবো।”, বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

প্রহেলি পেছন থেকে বারবার ডাকে তকে কিন্তু কে শুনে কার কথা! আরফা খাতুনের সামনে এসে ইতস্তত করে বলল, “আন্টি, আমার মা কল দিয়েছিল। ব্লাউজের মাপ দিতে আপনার মেয়েকে একটু আধাঘন্টার জন্য নিয়ে যেতে হবে। যদি আপনি অনুমতি দেন তবেই নিয়ে যাব।”

আরফা খাতুন কিছু বলার আগেই প্রান্ত এগিয়ে এসে বলল, “আরে এখানে অনুমতির কী আছে! তো সে তোমারই হবু বউ। যখন তখন নিয়ে যেতে পারো।”

আরফা খাতুন চাচ্ছিলেন না এই রাতে মেয়েকে বাইরে যেতে দিতে। কিন্তু ছেলে এভাবে তার মুখের উপর অনুমতি দিয়ে দিল তিনি হ্যাঁ বা না কিছুই বলতে পারলেন না।। দিব্য প্রহেলি রুমে এসে তার একটা হাত ধরে ওভাবেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রহেলি ভ্রু কুঁচকে বলে, “কী করছিস তুই? এভাবে টানছিস কেন? শিল্পী থাম বলতেছি।”

দিব্য তার কোনো কথাতেই কান দেয় না। প্রান্ত আর আরফা খাতুনের সামনে দিয়ে প্রহেলিকে নিয়ে গাড়িতে তুলে। সে কেবল চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়। মা, ভাই কিছুই বলছে না। আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে উঠে গেছে। এই ছেলে কী এমন কথার যাদুতে ভুলিয়েছে তাদেরকে! প্রহেলিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পরিচিত ডাক্তারকে কল করে তার চেম্বারে নিয়ে যায়।

ডাক্তার হাতের ক্ষত দেখে বলল, “একটুর জন্য বেঁচে গেছেন। বেশ গভীরে যায়নি ব্লেডটা। শিরা কেটে গেলে এতক্ষণে হয়তো অনেক রক্ত ঝরেই মারা যেতেন তিনি। লাকী গার্ল!”

ব্যান্ডেজ লাগিয়ে কয়টা ওষুধ লিখে দেন তিনি। দিব্য প্রহেলিকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে ফার্মেসি থেকে ওষুধগুলো নিয়ে আসে। বেশকিছু ফলমূল আর স্যালাইনও নিয়ে আসে। গাড়িতে ঢুকে পেছনের সিটে সব রেখে চুপচাপ বসে থাকে। প্রহেলি কিছু বলার বা জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। দিব্যকে অনেক অনেক বিষন্ন লাগছে। এখন কিছু বললে হয়তো তাকে কথা শুনতে হতে পারে। চুপ করে বসে আছে তাই। দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটছে। দিব্য কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে কষে একটা থাপ্পড় মারতে কিন্তু সে তা পারবে না। রাগটা তাকে দিয়ে হয় না। যতটুকু রাগ আসে তাও কয়েক মিনিটে হারিয়ে যায়।

“ভাইয়া আর আম্মুকে কীভাবে ম্যানেজ করলি তুই?”

“তুমি আমাকে তুই করে বলা বন্ধ করবে না কোনোদিন?”

“এটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর না। আগে উত্তর দে।”

দিব্য গাড়ির জানালায় চেয়ে থাকে। আজ যদি আসলেই প্রহেলি কিছু করে ফেলতো তবে তার কী হতো! চোখ ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু এখন সে কাঁদতে চাচ্ছে না। নিজেকে শক্ত করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। প্রহেলি আবার জিজ্ঞেস করে, “বলবি না?”

দিব্য সামনের দিকে তাকিয়েই বলল, “কাল টের পেয়ে যাবে।”

মনের মধ্যে সন্দেহ জাগে প্রহেলির। ভ্রু কুঁচকে ভাবনায় পড়ে যায়। কাল কী এমন হবে যে টের পেয়ে যাবে!

“শুনলাম বিয়ে করছিস! তা বউটা কে রে? দেখালিও না! ছবি অন্তত দেখা।”

“এখন চুপচাপ বসে থাকো। কাল তোমার সামনে নিয়ে আসবো তাকে। ছবিতে দেখে কী করবে। সরাসরি দেখে নিও। তার সৌন্দর্য ছবির চেয়ে বাস্তবে বেশি।”

প্রহেলি অবাক হয়! না জানি কত সুন্দর মেয়েটা! একটা সময় সেও কত সুন্দর ছিল! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। শরীরের যে সৌন্দর্য নিয়ে মানুষ বড়াই করে সেটা ছিনিয়ে নিতে উপরওয়ালার জন্য দুই মিনিট যথেষ্ট। অথচ মানুষ এই সৌন্দর্য নিয়েই কতই না অহংকার করে! দিব্য ফাঁকা রাস্তায় এসে জানালার কাঁচ খুলে দেয়। প্রহেলি মাথাটা এলিয়ে দেয় জানালার উপর। দমকা বাতাস এসে তার মুখমণ্ডল ছুঁয়ে দিচ্ছে। চোখ খুলে রাখা মুশকিল। ক্ষুদ্র চোখে রাতের প্রকৃতি দেখছে সে। কী সুন্দর এই রাত! কত শান্ত! এই না রাতের শহরে, কেউ ঘুমাচ্ছে আর কেউবা নির্ঘুম কাটিয়ে দিবে সারা রাত। মাঝপিঠ বিস্তৃত খোলা চুলগুলো হাতাসে উড়ছে। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে দিব্য। এই পরিটাকে কাল অর্ধেকটা নিজের করে পাবে সে। পুরোটা পাওয়ার জন্য একটা সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। তবে এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে নিতে হবে।

হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষে দিব্য। ঘুমুঘুমু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রহেলি, “আমরা কী এসে পড়েছি?”

“হ্যাঁ, নামো তুমি।”

প্রহেলি নেমে যায়। কিন্তু গাড়ি তার ঘর থেকে অনেকটা দূরে দাঁড় করিয়েছে দিব্য। অথচ ভেতরেও নিতে পারতো সে। কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করে, “এতদূরে কেন থামালি গাড়ি? ঘরের সামনেও তো রাখতে পারতি।”

দিব্য তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমার সাথে এই চাঁদনী রাতে কিছু দূর হাঁটতে চাই। এটুকু খুব বেশি চাওয়া? আমার আরেকটা চাওয়া আছে। চলতে চলতে যদি আমি তোমার হাতটা ধরি, তুমি ছেড়ে দিও না প্লিজ। ভালো নাই বাসো, বন্ধু হিসেবে এটুকু অন্তত করতেই পারো।”

দিব্যের এই চাহনি ঘায়েল করার কতো। মাথাটা ঈষৎ হেলিয়ে ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে কথা বলে সে। কোনো মানুষকে কথা বলার সময় এতটা আকর্ষণীয় লাগে বলে জানা নেই প্রহেলির। তার সবকিছুতেই যেন একটা আকর্ষণ লুকিয়ে আছে। এই যেমন কথা শেষে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা টেনে দেওয়া। তারপর মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়া। পকেটে হাত রেখে কোনো কিছুতে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। কিছুক্ষণ পরপর বৃদ্ধাঙুলি উল্টোপাশের সাহায্যে নিচের ঠোঁট চুলকানো। কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলা। আবার মুহূর্তেই ভ্রুজোড়া প্রশস্ত করা। বৃথা চুলগুলোকে উপরের দিকে উলটে দেওয়া। কারণ পরক্ষণেই তা আবারো তার কপাল জুড়ে বসে। বেশিরভাগই শার্টের উপর জ্যাকেট পরে, হাত ফোল্ড করে রাখে। এর থেকেও হয়তো বেশি কিছু। যা প্রহেলির চোখে পড়েনি এখনো।

দু’জনে হাঁটছে সরু রাস্তায়। রাস্তাটা একটু ভেতরের দিক হওয়ায় এই সময় একদম ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দুই-একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। রাস্তায় কিছুটা দূরে দূরে কুকুর শুয়ে আছে। মাঝেমধ্যে বিড়াল ছুটে যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় প্রহেলির মুখ আরো রাঙা হয়ে আসে। চোখের নিচ কালো হয়ে এসেছে তার। সামনের ছোট ছোট চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে হাত খোঁপা করে নিয়েছে। কাঁচা হলুদ রঙের ড্রেসে কী যে অসাধারণ লাগছে তাকে। দিব্য আরেকবার তার প্রেমে পড়ে যায়। এই প্রথম সে তার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছে। ছোটবেলায় তার আদরের প্রেমে পড়েছিল। প্রহেলি যখন কলেজের প্রথম বর্ষে সেদিন সে দ্বিতীয়বারের মতো তার ভালো ব্যবহারের প্রেমে পড়েছিল। দিব্যের এখনো মনে আছে, প্রহেলি নিজের টিফিন না খেয়ে সেই টাকা দিয়ে ছোট্ট মেয়েটার থেকে কয়েকটা বকুল ফুলের মালা কিনেছিল কেবল মেয়েটাকে একটু সাহায্য করার জন্য।

চলবে…

কৈশোরে প্রেম
অংশ: ১৫

বেশ কিছুদিন প্রহেলি সেই মেয়েটিকে খুঁজেছিল টিফিনের টাকা দিয়ে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু তাকে আর সে খুঁজে পায়নি। সেদিন থেকে বকুল ফুলের মালা দিব্যের খুব প্রিয়৷ ফুল বিক্রি করা মেয়েটিকে প্রহেলি খুব বেশি সাহায্য করতে না পারলেও দিব্য ঠিকই করেছিল।

হাতের উলটো পাশে দিব্যের হাতের ঘষা লাগতেই কেমন চমকে উঠে প্রহেলি। ভেতরটা ভয়ে শিউরে উঠে। কারো ছোঁয়া এখন আর তার ভালো লাগে না। কিসের একটা ঘৃণা হয়। যে ঘৃণার জন্ম নাহিয়ান দিয়ে গেছে। দিব্য তার একটা হাত ধরে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। আঁড়চোখে তাকাচ্ছে প্রহেলি। দিব্যের চুলগুলো মৃদু আলোয় চিকচিক করছে। এই চুলের কারণে দিব্যকে যেমন অনেকের কাছে হাসির পাত্র হতে হয়েছে আবার অনেকের কাছ থেকে প্রশংসাও শুনেছে।

স্কুলে তাকে পাখির বাসা বলে ডাকতো। মৃদু হেসে সামনের দিকে তাকায় সে। তবে দিব্য তার হাত ধরে না। ধরলেও প্রহেলি বাঁধা দিত না। কিন্তু সে চায় না তার মনের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করুক। ভালোবাসা হুট করব হয়ে উঠে না, সময় লাগে। বন্ধুত্ব ছাড়া ভালোবাসা সম্ভব না। যেখানে বন্ধুত্ব নেই সেই ভালোবাসার মধ্যে একটা দেয়াক থাকে। লুকোচুরির দেয়াল। দিব্য চায় না তাদের ভালোবাসায় কোনো লুকোচুরির দেয়াল তৈরি হোক।

কাটা হাতটা লুকিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে প্রহেলি। দিব্য আর ভেতরে যায় না। পেছন থেকেই গায়েব হয়ে যায়। প্রান্ত বের হয়ে খুঁজে কিন্তু পায় না তাকে। কাপড়ের ব্যাগগুলো আলমারিতে তুলে রেখেছেন আরফা খাতুন। প্রহেলিকে এখন বিয়ের কথা জানালে হয়তো উলটাপালটা কিছু করতে পারে উপস্থিত সময়ে জানালে কিছুই বলতে পারবে না।

পরিকল্পনামত সকাল হতে বাড়িতে রান্নার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে প্রহেলি বিশাল সারপ্রাইজ হিসেবে বাবাকে চোখের সামনে পায়। এতদিন পর শামসুল গাজীকে পেয়ে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। চোখের জল ফেলছে। বাবা থাকলে এতকিছু হতো না তার সাথে। ঠিক সেই ছোট্টবেলার মতো মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেন তিনি।

“আব্বু, এতদিন কেন আসোনি? আমার খুব কষ্ট হয়েছে তোমাকে ছাড়া। তোমাকে অনেক কথা বলার আছে আব্বু।”

“পাগলী মেয়ে আমার! এভাবে কাঁদে? বাবা তো তোমার পাশেই ছিলাম। প্রতিদিনই কথা হয়। আমার মামণির সব কথা শুনবো আমি। আগে কিছু খাও। ঘুম থেকেই তো মাত্র উঠলে।”, বলে মুখটা ধরে কপালে চুমু এঁকে দেন।

কান্না থামিয়ে সে রান্নাঘরে যায় চা করতে। দিব্যের কথা খুব মনে পড়ছে তার। ছেলেটা কেমন পাখির মতো এসে আবার উড়ে গেল। আরফা খাতুন তাকে কিছুই করতে দেন না। কাজের মেয়ে রেখেছেন সে সব কাজে সাহায্য করছে তাকে। বাড়ির হাবভাব ভালো ঠেকছে না প্রহেলির। পরক্ষণে আবার ভাবে হয়তো তার বাবা আসায় এত আয়োজন। তবুও মনে একটা সন্দেহ রয়েই যায়। বেলা এগারোটার দিকে আরফা খাতুন একটা শাড়ি নিয়ে আসেন প্রহেলির কাছে।

“নাও, গোসল করে এটা পরে একটুখানি সেজে নাও।”

প্রহেলির বুকটা কেঁপে উঠে। সন্দেহ যা করেছিল মনে হচ্ছে তাই সত্যি হতে চলেছে। সম্ভবত তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে আজ। কিন্তু সে বিয়ে করতে চায় না। বিয়ে মানুষের একবারই হয়। তারও হয়ে গেছে। আর কোনোদিন কাউকে বিয়ে করতে পারবে না সে।

কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, “এসব কী মা? আমি কেন শাড়ি পরব?”

আরফা খাতুন বিছানায় তার গালে হাত রেখে দিয়ে বললেন, “দেখ, জীবনে অনেক ভুল করেছিস। আমাদের মান-সম্মান সব ডুবিয়েছিস। তোর বাবা এখনো কিছুই জানে না। তিনি খুব ধুমধাম করে তোর বিয়ে দিতে চান। জানিস তো তিনি তোকে কতটুকু বিশ্বাস করেন। একবার যদি জানেন তার মেয়ে কেমন ছেলের সাথে বিয়ে করে কী কী করে বেরিয়েছে তাহলে তার যত্নের উপর প্রশ্ন আসবে। মানুষটা হয়তো স্টক করে মারা যাবে। তাকে অন্তত কষ্ট দিস না তুই।”

“কিন্তু মা আমি পারব না বিয়ে করতে। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। নাহিয়ানের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। তালাকটাও হয়নি। আমি কীভাবে অন্য কাউকে ঠকাবো?”

“ওসব তোর ভাবতে হবে না। আমার বা প্রান্তের কথা ভাবলি না কখনোই। তোর বাবার জন্য যদি মনের মধ্যে একটুও ভালোবাসা থাকে, সম্মানবোধ থাকে তাহলে তুই বিয়ে করতে রাজী হবি। বারোটার দিকে আসবে পাত্রপক্ষ। আশা করছি, শাড়িটা পরে তৈরি হয়ে নিবি তুই।”, বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যান তিনি।

প্রহেলির চোখজোড়া ভিজে গেছে। কেবল নিজের কথা ভেবে ভেবে মা আর ভাইকে অনেক কষ্ট দিয়েছে সে। এবার অন্তত বাবাকে কষ্ট দিতে চায় না। মানুষগুলো তো কোনো দোষ করেনি তাহলে তাদেরকে কেন শাস্তি পেতে হবে! তবে মিথ্যের আশ্রয় নেবে না সে। কিংবা লুকোচুরিও করবে না কোনো রকম। বাবাকে বলার সাহস নেই কিন্তু যার সাথে বিয়ে ঠিক হচ্ছে তাকে আড়ালে রাখবে না। বিয়ে হলে হোক, না হলে না হোক। তবুও কাউকে সে ধোঁকা দিবে না।

হালকা গোলাপী রঙের কাতান শাড়িটা পরে তৈরি হয়ে নেয় সে৷ নিজেকে খুব বাজে লাগছে না। একটুখানি সাজগোজ করেছে। নাহিয়ান এর থেকেও সুন্দরী মেয়ে পেয়েছে। তাতে কী তার মতো করে ভালোবাসার মানুষ কী পেয়েছে! কে জানে পেলে পেতেও পারে৷

নাহিয়ান রাইমার সাথে ব্রেকাপ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এসেছে। মেয়েটার সবকিছুতেই ধরাবাধা। একটু কাছে গেলেও সমস্যা। বাইরে যেতে চাইলেও যায় না। কথায় কথায় বিয়ের কথা তোলে। এমন মেয়ে তার একদম পছন্দ না। টং দোকানে বসে চা খেয়ে মাথাটা ঠান্ডা করছিল। শুভ্রতের কল এসেছে তার ফোনে।

একরাশ বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করে বলল, “এখন কেন কল দিছিস শালা?”

শুভ্রত ওপর পাশ থেকে বলল, “আরে শালা, তোর জন্য ভালো খবর আছে। মেহরাবের থেকে খবর পেয়েছি প্রহেলির আংটি বদলের অনুষ্ঠান আজ। তুই অবশেষে এই মেয়ের থেকে রক্ষা পাচ্ছিস।”

নাহিয়ান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। প্রহেলির বিয়ে সে যেন মানতে পারছে না। হাত-পা কাঁপছে তার। কষ্ট হচ্ছে কেন কিছুই বুঝতে পারছে না। তার তো খুশি হওয়ার কথা ছিল। তবে কেন এত অশান্তি লাগছে মনে! চায়ের বিল মিটিয়ে দিয়ে বন্ধুর বাসার উদ্দেশ্যে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে৷

দিব্যের বাবা-মা আর ছোট বোন বসে আছেন ড্রয়িংরুমে। আরফা খাতুন আর শামসুল গাজীর সাথে কথা বলছেন। দিব্যের একটা জরুরি কাজ তাই আসতে একটু দেরি হবে। একটা আংটি সোহেল রহমান তার ছেলের বউকে পরাবেন। দিব্য তার আংটি নিয়ে নিজে আসবে। প্রহেলিকে ডেকে তাদের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়। মাথাটা নিচের দিকে দিয়ে বসে আছে সে। কারো দিকে মুখ তুলে তাকানোর সাহস হচ্ছে না। জীবনের প্রথম তাকে কনে দেখা হচ্ছে৷ বুকের ভেতরটা ধুকপুক শব্দ করছে। খালি গলায় ঢোক গিলছে। সোহেল রহমান আচমকা তার হাতটা টেনে নিয়ে আংটি পরিয়ে দিলেন। সাথে সাথে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। প্রহেলি এই মূহুর্তটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। হঠাৎ করে কী থেকে কী হয়ে গেল! তার মতামতটাও জিজ্ঞেস করা হলো না। পাত্র কে তাও জানে না সে। সবকিছু কেনন ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে। ভেবেছিল কেবল কনে দেখতে আসবে অথচ এখন তাকে আংটি পরিয়ে নিয়েছে! মাথাটা তোলা দিয়ে দেখল তার বাবা বরের বাবার সাথে কোলাকুলি করছেন। সবাই মিষ্টিমুখ করছে। জীবনের এতবড় একটা সময় অথচ সে নির্বিকার বসে আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সামনে দিয়ে দিব্য এসে ঢুকে। প্রহেলি তাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। বসা থেকেই চট করে উঠে দাঁড়ায়। হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেছে। দ্রুত ধুকপুক আওয়াজ করছে। এই ছেলে এখানে কোনো সমস্যা করলে তার বাবার নাক কাটা যাবে। একবার না বুঝে, আবেগে ভেসে একটা ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকেছে সে। পরিবারের সম্মানে আঘাত করেছে। এখন আর সে এমন কিছুই করবে না যার জন্যে তার পরিবার কষ্ট পায়।

প্রান্তকে খুঁজতে তার চোখ চারদিকে ঘুরায়। সবার মিষ্টিমুখ করাচ্ছে সে। তার দিকে যেন কারো কোনো খেয়াল নেই। দিব্য হুট করে তার সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ে। পকেট থেকে আংটি বের করে বলে, “আমার ঘরের চাঁদ হয়ে আসবে? আমার বাগানে চন্দ্রমল্লিকা হয়ে ফুটবে?”

নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে প্রহেলি। পা কাঁপতে শুরু করেছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আশেপাশে সবার দিকে তাকায়। অথচ সবার মুখে আনন্দের হাসি। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। দিব্যের বোন দোলা এসে বলল, “এত ভাবছ কেন ভাবি? ভাইয়ার কথার উত্তর দিয়ে দাও। সবাই অপেক্ষা করছে।”

এবার তার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে আসে। দিব্যের বাবার দিকে ভালো করে তাকায়। দাড়ি রাখার কারণে তাকে চিনতে পারেনি প্রহেলি। কিন্তু এখন আর সোহেল স্যারকে চিনতে তার তেমন সমস্যা হচ্ছে না। তার মানে দিব্য তার পরিবারের সবাইকে রাজী করিয়ে ফেলেছে। যেখানে প্রহেলি নাহিয়ানকে পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন লড়াই করে পরিবারকে রাজী করিয়েছিল দেখানে দিব্য তাকে না জানিয়েই সবাইকে রাজী করিয়ে নিয়েছে। কেমন অদ্ভুত এই ছেলে। দিব্যকে সে কীভাবে ঠকাবে! কিছু বলতে যাবে তখনই দরজায় চোখ যায় তার। দোরগোড়ায় নাহিয়ান তার বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে। হাতে কিছু কাগজ। প্রহেলির চোখ অস্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে আসে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। একটা ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আরেকটা এসে উপরে পড়েছে। একদিনে কতটা সামলাবে সে। দিব্য প্রহেলির চাহনি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকায়। নাহিয়ানকে দেখে সে উঠে প্রহেলির পাশে দাঁড়ায়।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here