কৈশোরে প্রেম
অংশ: ১৮,১৯
লিখা: বর্ণালি সোহানা
অংশ: ১৮
“এত ভালোবেসেও আমার আর তোমাকে পাওয়া হলো না চন্দ্রমল্লিকা…”, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্ষীণ গলায় বলল দিব্য। যাতে কেউ শুনতে না পায়।
প্রহেলিকে সম্পূর্ণ ঘর খুঁজে পাওয়া যায় না। পূজা রুমটা তন্নতন্ন করে খুঁজলো কিন্তু পেলো না। প্রহেলির মা, বাবা আর ভাই অপরাধীর মতো বসে আছে। কোনো জবাব নেই তাদের কাছে। দিব্যের মা চেঁচিয়ে বললেন, “আমি কত করে না করেছিলাম করিস না বিয়ে এই মেয়েকে। তখন আমার কথা শুনলি না। এখন দেখ সবার মুখে চুনকালি দিয়ে মেয়েটা পালিয়ে গেল তো! ওই ছেলেটা সত্যিই বলছিল। তুই তোর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলি।”
দিব্য কারো কথাই কানে নিচ্ছে না। সে বিশ্বাস করতে পারছে না তার ভালোবাসা যে হেরে যাচ্ছে। নিচের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ ঘরে নীরবতা ছেয়ে যায়। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। দিব্যের নীরবতাকে সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে স্কুল জীবনের সুন্দর স্মৃতিগুলো মনে করছে। সেই ছোট্ট প্রহেলির কথা ভাবছে। দুষ্টুমি করে বেড়ানো মেয়েটা কেমন নীরব হয়ে গেছে। আগের সেই চঞ্চল স্বভাবের মেয়েটাকে সে ভীষণ করে ভালোবাসে। চোখ খুলে পায়েলের শব্দে। দিব্যের ঠোঁটের কোণে হাসি। চোখ খুলে দরজার দিকে তাকাতেই প্রহেলিকে দেখলো দু’হাতে বিয়ের লেহেঙ্গা পা থেকে কিছুটা উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা পেরিয়ে লেহেঙ্গা ছেড়ে দেয়। ওমনি মেঝে ছুঁয়ে যায় সেটা। কী সুন্দর সাজিয়েছে নিজেকে! নাকের বড় নথটা আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এত সুন্দর মেয়েকে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
পূজা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় গিয়েছিলি তুই? সবাই তোকে খুঁজে খুঁজে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।”
প্রহেলি দিব্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে গিয়েছিলাম। নতুন জীবনের শুরু কোনো পিছুটান রেখে করতে চাই না আমি।”
পূজা আর কোনো প্রশ্ন করে না। দিব্যের মা কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে সে বলে, “তাকে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না। যা জানার আমি জেনে নেব। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।”
কবুল বলে বিয়ের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নেয় তারা। প্রহেলি জানে না তার জন্য সামনে কী আছে কিন্তু সে নাহিয়ানকে পেছনে ফেলে এসেছে৷ আর তাকে সামনে টেনে নিয়ে যেতে চায় না। যে মানুষ একবার ঠকাতে পারে সে আরেকবার ঠকাবে না তার কোনো ঠিক নেই। নাহিয়ান তো তাকে ভালোইবাসেনি। এখন আবার ভালোবাসার দাবী করছে। প্রহেলি তার সামনে তার দেওয়া সব চিঠি পুড়িয়ে এসেছে। বলে এসেছে আর কোনোদিন যাতে তার সামনে না আসে। নাহিয়ান তাকে সহজে ছেড়ে যাবে কী না সেটা জানে না কিন্তু সে তাকে ছেড়ে এসেছে।
সারাটা দিন নাহিয়ান ঘর থেকে বেরোয় না। ঘরের ভেতর জিনিসপত্র ভাংচুর করে। প্রহেলির উপর যতটা রাগ হচ্ছে তার থেকে বেশি রাগ হচ্ছে নিজের উপর। প্রহেলিকে হারানোর পর বুঝতে পেরেছে সে তাকে কতটা ভালোবেসেছিল। কিন্তু তার ভালোবাসাটা বোঝাতে পারেনি। মানুষ বারবার বিশ্বাস করে না। একবার ঠকে গেলে সেখান থেকে বিশ্বাস সহজেই উঠে যায়। নাহিয়ানও নিজের বিশ্বাস হারিয়েছে। হাজার চাইলেও সে আর প্রহেলিকে পাবে না।
দিব্যের বাড়িতে ঢুকে চমকে উঠে প্রহেলি। কোনো বাগানবাড়িতে এসে গেছে মনে হচ্ছে। রাজপ্রাসাদের থেকে কম সুন্দর নয় এই বাড়ি। সরু পাকা ছোট্ট একটা রাস্তা। তার দু’পাশে সবুজ ঘাস। রাস্তাটা ঘরের প্রবেশদ্বারের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তার এক প্রান্তে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান আর কিছু চেয়ার টেবিল সাজানো। অন্য প্রান্তে গাড়ি দাঁড় করানো। গাড়ি গিয়ে একদম ঘরের প্রবেশদ্বারের কাছে থামে। প্রহেলির লেহেঙ্গা দু’দিকে তুলে ধরে সামনে পা বাড়াতেই দিব্য তাকে কোলে তুলে নেয়। হঠাৎ পরিস্থিতি বুঝে উঠতে না পেরে ভয় পেয়ে যায় সে। দিব্যের কাঁধে হাত রেখে শক্ত করে শেরওয়ানি ধরে।
খালি গলায় ঢোক গিলে বলল, “এসব কী হচ্ছে! সবাই দেখছে। খারাপ লাগছে বিষয়টা।”
দিব্য ক্ষীণ হেসে চোখ মেরে বলল, “বলেছিলাম না, কোলে করে নিয়ে যাব? সেটাই তো করছি। তাছাড়া তোমাকে কোলে নিয়ে মনে হচ্ছে এবার চলতে আনন্দ পাবো। এতদিন জীবনটা বেশ হালকা ছিল এখন ভরে উঠেছে।”
ঘরের ভেতর মেহমান গিজগিজ করছে। সবার মাঝখানে এভাবেই তাকে নিয়ে নিজের রুমের ভেতর যায়। একসাথে সকলে করতালি দিয়ে উঠে। লজ্জায় তাকাতে পারছে না প্রহেলি। দিব্য মাঝপথে আর কোথাও থামে না। একদম নিজের রুমে গিয়ে থামে। চারদিকে বকুল ফুলে সাজানো বিছানায় তাকে বসিয়ে দেয়। চারপাশে কেবল মোমবাতি জ্বলছে। আর কোনো আলো নেই। নড়েচড়ে বসে প্রহেলি। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে তার। দিব্য মেঝেতে তার পায়ের কাছে বসে বলল, “অবশেষে তুমি আমার!”
তার চোখে জল। প্রহেলি তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে৷ এই মানুষটার ভালোবাসার মূল্য সে কী কোনোদিন দিতে পারবে।
দিব্য তার পায়ের উপর দু’হাত রেখে কাছে গিয়ে বলল, “আমাকে একটু চিমটি কাটো না। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রহেলি। এমন আবদার সে কোনোদিন শুনেনি।
“প্লিজ প্লিজ কাটো না চিমটি।”
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাও, “সত্যি চিমটি কাটবো?”
দিব্য উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, “হ্যাঁ প্লিজ। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, যে চাঁদকে এতদিন দূর থেকেই দেখে এসেছি সে চাঁদ আজ আমার ঘর আলোকিত করতে নিচে নেমে এসেছে।”
প্রহেলি ভয়ে ভয়ে দিব্যের গালে চিমটি কাটে। “আউ!”, বলে মৃদুস্বরে শব্দ করে উঠে দিব্য। অবশেষে তার বিশ্বাস হয়েছে। আসলেই তার চন্দ্রমল্লিকা তার কাছেই আছে।
দোলা এসে সোজা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। প্রহেলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। লজ্জার উপর লজ্জা পাচ্ছে সে।
দোলা দিব্যকে মেঝে থেকে টেনে তুলে বলল, “এসব প্রেম, সোহাগ পরে হবে আগে চলো এখনো সবার সাথে পরিচয় এবং ছবি তোলা বাকি। সাংবাদিকেরাও এসে ভিড় করেছে। বাগানে বসিয়েছি তাদের।”
“তুই তো বেশি পেকে গিয়েছিস!”, বলেই কান মলে দিল দোলার।
“আহ! ভাইয়া ব্যথা পাচ্ছি। আর পাকার সময়ই এখন, তো পাকবো না?”
তাদের কথা শেষ না হতেই ঘরের ভেতর হুড়মুড়িয়ে কিছু ছেলে-মেয়ে ঢুকে পড়ে। ভাবি ভাবি ডেকে কয়েকজন সেল্ফি তুলে নেয়। দোলা তাদেরকে থামিয়ে সাংবাদিকদের সামনে কনফারেন্সে নিয়ে যায়৷ দিব্য প্রহেলির একটা হাত নিজের হাতে নেয়। অন্য হাতে তার লেহেঙ্গা ধরে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ ফটোসেশান শেষে তাকে চেয়ার টেনে বসায়। সাংবাদিকরা একের পর এক ছবি ক্লিক করে যাচ্ছে। সেই সাথে দিব্যকে করছে অজস্র প্রশ্ন। প্রহেলি নীরবে বসে আছে৷ এসব কিছু তার জন্য নতুন। মনে হচ্ছে যেন কোনো চিড়িয়াখানায় বসে আছে সে। আর তাকে দেখতে পর্যটক ভিড় জমিয়েছে। তার মাথায় এসব কিছুই ঢুকছে না। মাঝেমধ্যে দু’একটা কথা তাকেও বলতে হয়। যদিও বেশ অগোছালোভাবে কথা বলেছে সে তবু দিব্য সবকিছু সামলে নিয়েছে।
সবার সাথে পরিচয় শেষে একগাদা উপহার নিয়ে রুমে ফিরে আসে প্রহেলি। রাতে কনের জন্য খাবার নিয়ে মেয়ে বাড়ি থেকে কেউ আসতে হয়। প্রান্ত টিফিন নিয়ে এসেছে। এমনকি সকালের নাস্তার জন্য বিভিন্ন জিনিস এনে দিয়ে চলে গেছে সে। ক্ষুধায় পেট গুড়গুড় শব্দ করছে প্রহেলির। সারাদিনে কিছুই খায়নি। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না সে। তখনই দিব্য রুমের ভেতর এসে ঢুকে। প্রহেলি এখনো লেহেঙ্গা পরে বিছানার কোনায় বসে আছে। দিব্যকে দেখতেই তার ভেতরটা কেঁপে উঠে। এই ছেলেকে সে বিয়ে তো করে নিলো এখন বাসর সে কীভাবে করবে! এই কথা তো আগে ভাবেনি সে। ভয়ে গলার পানি শুকিয়ে এসেছে তার।
চলবে…
কৈশোরে প্রেম
অংশ: ১৯
দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনতেই ভয়ে আৎকে উঠে প্রহেলি। দিব্য ধীর পায়ে তার কাছে এগিয়ে আসে। হাতে খাবারের প্লেট। প্রহেলি নিজের জায়গাতেই বসে রয়। টি-টেবিল টেনে তার উপর প্লেট রেখে বলল, “অনেক ক্ষুধা লেগেছে তাই না? স্যরি আমার খেয়াল করা উচিত ছিল সারাদিনে কিছু খেতে পারোনি তুমি। চলো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
সেই ছোট বেলায় মায়ের হাতে খেয়েছিল সে। আজ অবধি নিজের হাতেই খেয়ে আসছে। এভাবে হুট করে কারো হাতে খেতে হবে ভাবতেও কেমন জানি লাগছে তার।
ইতস্তত করে বলল, “আমি কারো হাতে খেতে পারি না।”
“কোনো সমস্যা নেই তাহলে নিজের হাতে খেয়ে নাও। আমি তোমার পাশেই বসছি।”
একবার ভেবে ওয়াশরুমে যায় প্রহেলি। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসে। দিব্য এখনো সেই আগের জায়গাতেই বসে আছে। দিব্যের চোখ তার উপর পড়তেই থমকে যায়। নীল, সাদার মধ্যে একটা ড্রেস পরে এসেছে সে। কিন্তু সে তাকে লেহেঙ্গাতেই দেখতে চেয়েছিল রাতভর।
ভারাক্রান্ত মনে বলল, “ইশ! লেহেঙ্গা খুললে কেন?”
“মানে!”
“আমার অনেক ইচ্ছে ছিল…”, বলতে বলতে থেমে যায় সে।
কিছুটা মন খারাপ হয় তার। তবু নিজেকে সামলে মৃদু হাসে। আজ মন খারাপ করা চলবে না। তার ইচ্ছেটা না হয় ইচ্ছেতেই সীমাবদ্ধ রইল। সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হয় না। তাছাড়া প্রহেলিকে নিজের করে পেয়ে গেছে এর থেকে বড় আর কিছুই নয় তার কাছে।
প্রহেলি তার সামনে বসে খাচ্ছে। আর সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বিষয়টা বেশ অদ্ভুত বটে। কেউ একজন খাচ্ছে আর কেউ তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখছে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায় না। প্রহেলিও তেমন খেতে পারলো না। প্লেটটা রেখে পানি ঢালতেই যাচ্ছিল দিব্য তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। এঁটো খাবারটা সে নিজে খেতে শুরু করে।
ভ্রুজোড়া ঈষৎ কুঁচকে বলল, “আরেহ! কী করছিস এসব!”
দিব্য খাওয়া থামিয়ে বলল, “আমাকে কী তুই করেই বলবা?”
“তুই যে আমাকে বড় আপু থেকে বউ করে নিবি তা কী আমি জানতাম? ছোট ভাই মনে করে তুই তুই করেই বলতাম এখন কীভাবে তুমি আসবে!”, অদ্ভুত গলায় বলল।
দিব্য ভাবনায় পড়ে যায়। সবার সামনে যদি প্রহেলি তাকে তুই করে বলে তাহলে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে। খাওয়া শেষ করে বলল, “তুমি বরং আমাকে তুইও বলিও না, তুমিও বলিও না।”
ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কী আপনি বলব?”
“আরে না, এমনভাবে কথা বলিও যাতে তুই বা তুমি কোনোটাই না আসে।”
ক্ষণকাল ভেবে বলল, “আচ্ছা চেষ্টা করব।”
“তুমি করে বলার?”
“না, তুই বা তুমি কোনোটাই না বলার।”
প্রহেলির পায়ের কাছে গিয়ে বসে দিব্য। তার কোলে মাথা রেখে দু’হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে। সম্পূর্ণ শরীর দুলে উঠে। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে যায় প্রহেলি। কেমন একটা ভয় ঘর করে আছে তার মনে। কয়েকটা নীরব মূহুর্ত কেটে যায় তাদের মধ্যে। দিব্য মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে?”
আচমকা এমন আবদারে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় সে। কোমল চুলের রাজ্যে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কতক্ষণ যাওয়ার পর মাথা থেকে হাতটা নিজের হাতে নিয়ে দিব্য অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল, “খুব কষ্ট পেয়েছি আমি৷ প্রতিটা মূহুর্তে কষ্ট পেয়েছি যখন তোমাকে ওই নাহিয়ানের সাথে দেখেছি। এখনো কষ্ট পাই এটা ভেবে, যে শরীরের প্রথম ছোঁয়া আমি পেয়েছিলাম সে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অন্য কেউ সুখ খুঁজে পেয়েছে। মনে আছে আমার গাল টেনে দেওয়া? আমাকে করা সেই প্রথম চুম্বন? আমি আজও সেই স্বাদ ভুলিনি। আমাকে একটা চুমু দেবে? শুধু একটা, এর বেশি কিছুই চাই না।”
প্রহেলি শক্ত হয়ে বসে আছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে দিব্যের চাওয়াটাও বেরিয়ে আসে। কেউই চাইবে না বিয়ে করে বউ সাজিয়ে রাখুক। দিব্যের চাওয়াটাও অনর্থক নয়। তবু প্রহেলির মন আগাচ্ছে না। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। সমস্ত দেহ কুঁচকে একটুখানি হয়ে আসে তার। কম্পিত কণ্ঠে বলল, “আমি এখনই এসবের জন্য প্রস্তুত নই। কয়টা দিন সময় দেওয়া যায় না?”
দিব্য ফ্লোর থেকে উঠে প্রহেলির পাশে বসে। মোমের আলোয় তার মুখের রঙ রক্তবর্ণ দেখাচ্ছে। দু’হাত তার দু’গালে রেখে একদম কাছে এসে বলল, “সাতটা বছর অপেক্ষা করেছি। তুমি চাইলে আরো সাত বছর অপেক্ষা করব। আমার এই একটা আবদার কী তুমি রাখতে পারো না?”
ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে আছে দিব্য। প্রহেলির চোখ নিচের দিকে। লজ্জা আর ভয়ের অপূর্ব এক মিশ্রণ এসে ভর করেছে তার মাঝে। মুখটা আরক্ত হয়ে আসে।
মৃদুস্বরে বলল, “চোখ বন্ধ কর।”
আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আসে দিব্যের মুখ। চোখে যেন সুখের কান্না নেমে আসতে চাচ্ছে। তবু এই সময়টাতে আটকে রেখেছে সে। দ্রুত চোখ বন্ধ করে বসে রয়। প্রহেলি একটু একটু করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দিব্যের কাঁধে একটা হাত রাখে। উষ্ণ নিশ্বাস এসে তার গাল ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে আটকে রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার। অন্য হাত তার একটা গালে রেখে অন্য গালে আলতো করে চুমু এঁকে দেয়। সাথে সাথে দিব্য তাকে শক্ত করে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে। সবচেয়ে বড় পাওয়াটা যেন সে আজ পেয়ে গেছে।
“ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমাকে ছাড়া আমার প্রতিটা ক্ষণ একেক যুগের মতন। আমাকে ছেড়ে যেও না কখনো। তোমাকে ছাড়া নিজেকে ভাবতেও কষ্ট হয়। তুমি আমার, শুধুই আমার।”, বলতে বলতে তার চোখে জল এসে যায়। প্রহেলির নজরে সেই জল পড়ে না।
দিব্যের প্রতি প্রহেলির মনটা কোমল হয়ে এসেছে। গতকালও এই মানুষটার জন্য তার কোনো অনুভূতি ছিল না। আজ হঠাৎ কী এমন হলো যে তার এমন ছোট ছোট কান্ডে একটুও মন ভারি হচ্ছে না। কিংবা তার স্পর্শগুলোও খারাপ লাগছে না। যেভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছে মনে হচ্ছে যেন কোনো বাচ্চা তাকে বুকে টেনে নিয়েছে। চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসে তার।
সকালবেলা চোখ খুলতেই দিব্যকে চোখের সামনে পেয়ে আৎকে উঠে। একটা হাতের উপর মাথা রেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ কচলে সে বলল, “আমি কখন ঘুমালাম?”
“আমার বুকে তুমি এতটাই শান্তি খুঁজে পেয়েছ যে ক্ষণকালের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছ। তোমাকে আর জাগাইনি আমি। শুইয়ে দিয়ে আমিও পাশে শুয়ে পড়লাম।”
দিব্যের চোখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি। প্রহেলি আগ্রহ ধরে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “তুই কী সারারাত ঘুমাসনি?”
সে কিছুক্ষণ ভেবে তার মুখের উপর মুখ এনে ফিসফিস করে উত্তর দিল, “উম… ঘুমিয়েছি দুই ঘন্টা। সারারাত তোমাকে দেখেই কেটে গেছে আমার।”
দিব্য একটা হাতে প্রহেলির চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। খালি গলায় ঢোক গিলে সে। এই সাত সকালে আবার কী করতে যাচ্ছে কে জানে। দিব্য মুখটা তার কাছে নিয়ে যায়। ওমনি সে চোখ বন্ধ করে দু’হাতে তাকে ঠেলে ধরে। দূরে সরানোর চেষ্টা করছে।
সে মৃদু হেসে বলল, “আমার দলিল করা বউ তুমি। তোমাকে আমি খুব জ্বালাবো। কারণে অকারণে জ্বালাবো। তুমি যতটুকু পারো আটকিও আমায়।”
প্রহেলির কপালে গভীর চুমু খেয়ে আবারো বলল, “আজকের জন্য এটুকু। উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
দিব্য উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। ধীরে ধীরে প্রহেলির হৃদস্পন্দনের গতি কমতে থাকে। সে কাছে আসলেই স্পন্দন দ্রুত গতিতে বেড়ে যায়। নিশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হয়। দিব্যের এত ভালোবাসা দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে বারবার। তাকেই তো ভালোবাসা উচিত ছিল। অথচ সে অপাত্রে ভালোবাসা দান করে বসলো। এমনকি যেটুকু সামলে রাখার ছিল তাও বিলিয়ে দিল। দিব্যকে সে কি-ই বা দেবে! চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কেন সে আগে বুঝলো না! এতটা অবুঝ কেউ কীভাবে হতে পারে। যখন বুঝলো তখন নিজের সর্বস্ব হারিয়ে বসেছে। দিব্যের বলা কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে তার। আসলেই তো তার শরীরটার ভাঁজে ভাঁজে অন্য কারো ছোঁয়া রয়েছে৷ এদিকে দিব্য কাউকে ভালো না বেসে এতটা বছর কেবল তার জন্যেই অপেক্ষা করেছে। কী দাম দিবে সে এই অপেক্ষার! তার সুইসাইড করাই উচিত ছিল। তাহলে সব ঝামেলা মিটে যেত৷ দিব্য কী পারবে পুরনো কথা ভুলে যেতে! প্রহেলিকে যে কথা কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে দিব্যকেও হয়তো কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু মানুষটা মুখ খুলে বলতে পারছে না। ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে তাকে।
দিব্য বেরিয়ে এসে দেখলো প্রহেলি এখনো আগের মতোই শুয়ে আছে।
“কী হলো এখনো উঠোনি যে? ঘুম পাচ্ছে আরো? ঘুম পেলে আরেকটু ঘুমিয়ে থাক।”
কোনো জবাব দেয় না সে। শোয়া থেকে উঠে বসে। চোখের জলে বালিশ ভিজে গেছে। অনুশোচনায় ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তার। যন্ত্রণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। দিব্যের দিকে এক দৃষ্টিতে খানিক্ষন তাকিয়ে ভাবে, নাহিয়ানের আগে কেন দিব্য আসলো না তার জীবনে! তাহলে হয়তো এই ভুলটা তার হতো না। দিব্য তাকে বাঁচিয়ে নিতো।
দিব্য আবার জিজ্ঞেস করলো৷ “ঘুম ছেড়েছে? ওয়াশরুম যাবে?”
প্রহেলি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। সে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “এভাবে যে আমাকে কোলে তুলে নিস, আমার তো তোর থেকেও ওজন বেশি। কষ্ট হয় না?”
শব্দ করে হেসে ফেলে দিব্য। তাকে কোল থেকে ভেতরে নামিয়ে বলে, “তোমার যতই ওজন হোক না কেন আমার শক্তির কাছে ওসব কিছুই না। মেপে দেখ আমার ওজন হয়তো আরো বেশিও হতে পারে।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রহেলি। বিড়বিড় করে বলে, “মাথামোটা ছেলে!”
“কিছু বললে?”, দিব্য জিজ্ঞেস করে।
“উঁহু কিছু না।”
দিব্য তার হাতের স্পর্শে কপাল থেকে গাল ছুঁয়ে থুতনিতে এসে থামে। কিছু ইচ্ছে মনের ভেতর চেপে বেরিয়ে আসে। দিব্য বেরিয়ে যেতেই প্রহেলি দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ভাবে, এই মানুষটাকে সে ভালোবাসতে চায়। মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে চায়। ভালোবাসাটা হয়ে যাক তার, খুব দ্রুত হয়ে যাক।
রান্নাঘরে যেতেই এক পনেরো-ষোলো বয়সী মেয়ে এসে বলল, “ঘুম হলো আপা? ভালো আছেন তো? আপনার সাথে কথা বলার অপেক্ষায় আছিলাম সেই রাইত থেইকা। চিনছেন আমারে?”
অবাক চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “চিনলাম না তো…””
“আমি ওই যে তুলি। বকুল ফুলের মালা বিক্রি করতাম। আপনে প্রত্যেকদিন আমার থেইকা ফুল কিইনা নিতেন। দিব্য ভাইজান আমারে নিজের বোন বানাই নিয়া আসছে ঘরে৷ আমারে স্কুলে পাঠায়। এই পরিবারের সকলে অনেক ভালোবাসে আমারে। সব আপনের জন্য আপা। আপনি যদি আমার কথা না ভাবতেন তাইলে আমি আইজ এত ভালো একটা পরিবার পাইতাম না।”, বলতে বলতেই কেঁদে দেয় তুলি।
প্রহেলিকে এমন একটা বিস্ময়কর ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে কল্পনাও করেনি। কোনো মানুষ এতটা ভালো কীভাবে হয়! কাউকে এভাবে পাগলের মতো ভালোবেসে গিয়েছে আর সে জানতেও পারেনি। না জানি আরো কতকিছু অজানা রয়ে গেছে।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা