কোথাও কেউ ভালো নেই-০৩,০৪
লিখা: জাহান আরা
০৩
মেহমান বিদায় নেয়ার সাথে সাথে সালমা এসে খপ করে ধরলো পূরবীকে।খামে কতো টাকা আছে তা দেখার জন্য।পূরবী মুচকি হেসে খাম বের করে দিলো।
ভালো করে ঘুরিয়ে দেখলো সালমা খাম খোলা হয়েছে কি-না। তারপর খামটি খুললো।
ভিতরে ১০০ টাকার ৫ টা নোট শুধু।বিড়বিড় করে সালমা বললো,”আস্ত ছোটলোক তো এরা!৫০০ টাকা দিয়ে গেলো!তাও আবার খামে পুরে!”
সালমা ভেবেছিলো ২-৩ হাজার টাকা থাকবে হয়তো ভিতরে। তা দিয়ে নিজে একটা শাড়ি কিনে নিবে।এখন ৫০০ টাকা দেখে বিরক্তিতে মুখ বাঁকালো।
টাকাগুলো ছুঁড়ে মারলো পূরবীর মুখে।
সালমা যাবার পর পূরবী হাসতে হাসতে উঠে রুমের দরজা লাগালো।
তারপর সুরভীকে জড়িয়ে ধরলো।
সুরভী কিছুই বুঝতে পারছে না।পূরবী হাসি থামিয়ে আরেকটা ছেঁড়া খাম দিলো সুরভীকে।সুরভী দেখলো খামের উল্টো পিঠে ছোট ছোট অক্ষরে লিখা আছে,”আম্মা গো,আমি ও তোমার মতো মা হারিয়েছে অল্প বয়সে।সৎ মায়ের অত্যাচার আমিও সহ্য করেছি।এই খামে দশ হাজার টাকা আছে তোমার জন্য,ভিতরে আরেকটা খাম আছে সেই খামে ৫০০ টাকা আছে।তোমার মা কে তুমি ভিতরের খামটা দিও যখন উনি চাইবে।এই টাকাগুলো তোমাদের দুই বোনের জন্য।পছন্দসই কিছু কিনে নিও।”
চিঠিটা পূরবী যত্ন করে লুকিয়ে রাখলো নিজের বইয়ের ভাঁজে।এই মানুষটাকে সে আজীবনের জন্য বাবার স্থানে বসিয়েছে। আজীবন তাকে সেই সম্মান পূরবী দিবে।
————–
আজকে পূরবীর বিয়ে।সকাল থেকে পূরবীর ভীষণ পেটে ব্যথা করছে।আজ একদিকে রেজাল্টের টেনশন অন্যদিকে বিয়ের টেনশন,অন্যদিকে আজ পূরবীর মেয়েলি সমস্যা দেখা দিয়েছে। তলপেট ব্যথায় ফেটে যাবার যোগাড়।
সুরভী কিছুক্ষণ পর পর পূরবীর কাছে এসে পূরবীকে দেখছে।তার বুবু এমনিতেই সুন্দর কিন্তু আজকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে বুবুকে।সুরভী ভাবছে তার বিয়ের দিন কি তাকেও এরকম সুন্দর লাগবে?
তানভীর কল দিলো সকাল বেলা।পূরবীর পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো তানভীরের কল দেখে।
এই লোকটির সাথে পূরবীর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেমন যেনো বাজে কথা বলে লোকটা।
দেশে আসার আগের দিন একবার কল দিয়েছিলো তানভীর।পূরবীর সাথে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার পর তানভীর জিজ্ঞেস করলো তোমার ইনারের মাপ কতো পূরবী।
তানভীরের কাছে এই প্রশ্ন যৌক্তিক মনে হলেও পূরবীর কাছে মনে হলো খুবই নোংরা একটা প্রশ্ন।দাঁত কিড়মিড়িয়ে পূরবী বললো,”আপনি একজন নোংরা লোক।”
তারপর কল কেটে দিলো। পূরবী কল কেটে দিয়ে কাঁদলো কিছুক্ষণ।১৫ বছরের একটা মেয়ের কাছে এরকম একটা প্রশ্ন যথেষ্ট সেনসেটিভ।
তানভীর ভেবেছিলো মালয়েশিয়া থেকেই বউয়ের জন্য ইনার,নাইট ড্রেস,মেয়েলি অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসবে।রুমের অন্যান্য বন্ধুদের দেখেছে বিয়ে করতে দেশে যাবার আগে সব এখান থেকেই নিয়ে গেছে।সবাই হবু বউয়ের থেকেই সব জেনেছে কল দিয়ে।অথচ কারো বউ এরকম রিয়েক্ট করে নি।
সেই হিসেবে সে পূরবীকে জিজ্ঞেস করেছে।কিন্ত পূরবী এভাবে তাকে খারাপ ভাববে তা তানভীর বুঝে নি।
এখন আবার তানভীরের কল দেখে পূরবীর গলা শুকিয়ে গেলো। নানী,দাদী কেউ না থাকায় পূরবীকে কেউ বুঝিয়ে দেয় নি স্বামী মানে কী,স্বামীর সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে।১৫ বছর বয়সী একটা মেয়ের কাছে স্বামী,সংসার,শ্বশুরবাড়ি যথেষ্ট আতংকের ব্যাপার,আর তার মধ্যে যদি মেয়েটি হয় মা হারা,তবে আর কথাই নেই।
সালমা কল রিসিভ করে পূরবীকে দিলো।পূরবীর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো তানভীরের হ্যালো শোনার পর।
তানভীর বুঝতে পেরে কল কেটে দিলো। ভিতরে ভিতরে ভীষণ বিরক্ত হলো।
ভেবেছিলো পূরবীকে বলবে পার্লারে গিয়ে সাজতে,কিন্তু কথা-ই তো হলো না।আর কি করার!
দুপুরের কাঠফাটা রোদের মধ্যে বরপক্ষ এলো।যেহেতু কোনো গেইট দেওয়া হয় নি তাই বিয়েতে গেইট ধরা হলো না।তানভীর অবশ্য ভেবেছিলো গেইট ধরা হবে,সেখানে টাকা লাগবে।আবার বরের হাত ধোঁয়াতে এলে টাকা দিতে হয়,জুতা চুরি করলে টাকা দিয়ে জুতা নিতে হয়।
এসব ভেবে পকেটে করে তিরিশ হাজার টাকা নিয়ে এলো।কিন্তু বিয়ে বাড়ির চেহারা দেখেই তানভীর বুঝলো এই বাড়িতে যে মেয়েটা থাকে সে ভালো নেই।পূরবীর উপর হওয়া রাগ চলে গেলো তানভীরের।
গরমে ঘেমে সবার অবস্থা খারাপ তখন।সুরভী গেলো সবার জন্য শরবত নিয়ে।তানভীরকে শরবত দিতে গিয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো সুরভী। তানভীর হাসলো দেখে।তারপর সুরভীকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,”ভাই’কে কি কেউ লজ্জা পায় বলো?
আমি তো আজ থেকে তোমার ভাই।”
মুহুর্তেই সুরভীর সব জড়তা কেটে গেলো।
লাল বেনারসি শাড়িতে সাজিয়ে যখন পূরবীকে উঠানে করা স্টেজে আনা হলো,তানভীর এক নজর দেখেই চোখ নামিয়ে ফেললো।এক নজরেই তানভীরের মনে হলো তার চোখ জলসে গেছে।
বন্ধুরা ফিসফিস করে বললো,”দোস্ত,ভাবী তো আগুন সুন্দরী। ”
তৌসিফ মুগ্ধ হয়ে তাকালো ভাবীর দিকে।মা,বোন,ভাবীদের কাছে যতো নিন্দেমন্দ শুনেছে এই মেয়ের নামে সব কিছু মিথ্যে মনে হলো তৌসিফের কাছে।
এক মুহুর্তের জন্য হিংসে হলো তৌসিফের নিজের ভাইয়ের ভাগ্যকে।
দুপুর দুইটা পাঁচ মিনিটে বিয়ে হলো। পূরবী শক্ত করে সুরভীকে জড়িয়ে ধরলো। এই বিশাল পৃথিবীতে এই একটা মানুষই আছে পূরবীর।যার জন্য পিছুটান রয়ে যাবে এই বাড়িতে। যার চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হবে পূরবীর।দেহটা থেকে প্রাণটা আলাদা করে এই ১২ বছরের মেয়ের কাছে রেখে পূরবী তার নতুন বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
একটা অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়ালো পূরবী।
কে জানে ভাগ্য সেই জীবনে তার সাথে কি খেলা করে!
অথবা প্রাণ সঁপে দেওয়া ছোট মেয়েটাকে নিয়েই ভাগ্য কি করে তার কথা কে বলতে পারে!
————–
গাড়ি থেকে নামার পর তানভীর পূরবীকে কোলে তুলে নিলো।হালকা পাতলা মানুষটাকে এক টানেই তুলে ফেললো তানভীর।
লজ্জায়,ভয়ে পূরবী খামছে ধরলো তানভীরের ঘাড়।
পূরবীর নখ লেগে তানভীরের ঘাড় জ্বলে উঠলো। পূরবীর কানের কাছে মুখ এনে তানভীর ফিসফিস করে বললো,”খামচানোর জন্য পুরো রাত পড়ে আছে,এখন ছাড়ো।”
পূরবী বুঝলো না তানভীরের কথার মানে,পড়ে যাবার ভয়ে বরং আরো জোরে ধরলো।
ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলো একটা ডিশে করে মহিলারা পানি এনে রেখেছে।
তারিন বললো,”মান দিবেন না-কি ঠ্যাং দিবেন?”
পূরবী বুঝলো না কি করতে হবে এখন।তানভীর পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে সবার অলক্ষ্যে পূরবীর হাতে ধরিয়ে দিলো।
পূরবী হাত বাড়াতেই তানভীরের দুই ভাবী টাকা কেড়ে নিয়ে ছুটে চলে গেলো।
তাদের পিছনে পিছনে গেলো তারিন।
রেবেকা গম্ভীরমুখে বললো,”পা দিয়া আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে ডিশের পানি ফেলে দাও।তারপর ঘরে ঢুকে রুমালে বাঁধা ধান ছাদের দিকে ছুড়ে মারো।”
পূরবী তাই করলো।ছোট পাখির ছানার মতো শরীরটা তিরতির কাঁপতে থাকলো এসব করতে গিয়ে।
৮ বেডরুমের বিশাল এই বাড়িটি পূরবীর কাছে ছোটখাটো রাজবাড়ির মতো মনে হচ্ছে।এতো বড় বাড়িতে বিয়ে হয়েছে তার ভাবতেই পূরবীর কাছে তা অবিশ্বাস্য লাগছে।
তেমনি অন্যদিকে এক অজানা ভয় ও পেয়ে বসেছে পূরবীকে।
চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে সব অচেনা মুখ।নিজেকে মনে হচ্ছে নীড় হারা পাখি।
পূরবীর ওয়াশরুমে যেতে হবে।কাকে বলবে পূরবী ওয়াশরুমে নিয়ে যেতে।আশেপাশে চেনা কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না।
হন্তদন্ত হয়ে তানভীর পূরবীর কাছে এলো একটা ঠান্ডা পেপসি নিয়ে।একটা গ্লাসে ঢেলে পূরবীর মুখের সামনে ধরলো।
আশেপাশের সবাই হাসতে লাগলো তানভীরের কাজ দেখে।কেউ কেউ টিপ্পনী কেটে বললো,”এখন থেকেই এতো খেয়াল!”
তানভীর নির্বিকার রইলো।
পূরবী খেতে চাইলো না,গ্লাস সরিয়ে রাখলো।কিন্তু তানভীর জোর করে খাইয়ে দিলো।
পূরবীর তলপেটে ব্যথা আরো বেড়ে গেলো। লজ্জায় তানভীরকে বলতেও পারলো না ওয়াশরুমের কথা।
তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”কোনো সমস্যা? ”
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে পূরবী বলেই দিলো।শুনে তানভীর হাত ধরে নিয়ে গেলো রুমের দিকে।
ওয়াশরুমে যেতে যেতে তানভীর জিজ্ঞেস করলো পূরবীর রোল রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার কতো।
পূরবীর হঠাৎ করে মনে পড়লো আজকে রেজাল্ট দিবে।ভয়ে ভয়ে পূরবী বললো।
রেজাল্ট দেখে তানভীর গমগমে স্বরে বললো,”পূরবী…..!”
ভয়ে পূরবীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।
হাহা করে হেসে তানভীর বললো,”ভয় পাচ্ছো কেনো?
তোমার রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে।গোল্ডেন এ প্লাস এসেছে তোমার। তুমি এতো ভালো ছাত্রী আগে তো জানতাম না।
আমি তো টেনেটুনে ইন্টার পাশ করেছি।”
চলবে……..?
লিখা: জাহান আরা
কোথাও কেউ ভালো নেই-০৪
ওয়াশরুমে গিয়ে পূরবী থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। কান্না করবে না করবে না করেও কান্না করে দিলো।পূরবীর একটা ন্যাপকিন দরকার,কিন্তু কোথায় পাবে এখন ন্যাপকিন?
কাকে বলবে সে ন্যাপকিন দিতে?
বাহিরে তানভীর আছে,এই লোকটা কে কিভাবে বলবে সে?
লজ্জায় পূরবী লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে গেলো।সেই সাথে তীব্র পেটব্যথা পূরবীকে কুঁকড়ে দিলো।তানভীর অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে,পূরবীর বের হবার কোনো লক্ষণ না দেখে জিজ্ঞেস করলো,”১ নাম্বারের জন্য এসে এতোক্ষণ সময় লাগছে তোমার,২ নাম্বার হলে তো আজকে সারাদিন যাবে।”
তানভীরের ফাজলামি করে বলা কথা পূরবী বুঝলো না।পূরবীর মনে হলো পূরবীকে লজ্জা দেয়ার জন্য তানভীর এটা বলছে।ফর্সা মুখখানা আষাঢ়ের আকাশের মতো কালো হয়ে গেলো অপমানে এবং পেটব্যথায়।
টিস্যু হোল্ডার থেকে অনেকটা টিস্যু ছিঁড়ে নিলো পূরবী। কিন্তু আরেক বিপত্তি দেখা দিলো।টিস্যু নেয়ার মতো কিছু নেই পূরবীর কাছে।
ভয়ে পূরবী কেঁদে উঠলো। নিজেকে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মেয়ে।
ভিতর থেকে কান্নার মৃদু শব্দ পেয়ে তানভীর ভড়কে গেলো।দরজায় নক করে বললো,”কি হয়েছে পূরবী?
আমাকে বলো?”
পূরবী বললো না,বরং কান্নার তোড় আরো বাড়লো।তানভীর বাহিরে থেকে আরো কয়েকবার ডাকলো কিন্তু জবাব এলো না।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তানভীরের। এই মেয়ে এতো ন্যাকা কেনো!
তারিন কে ডেকে নিলো তানভীর। তারপর বললো,”আপা দেখ তো এই মেয়েটা কাঁদছে কেনো এরকম করে? আমি কি ওকে কামড়েছি না-কি? ”
তারিন এসে ডাকতেই পূরবী দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে তারিনকে আস্তে করে কিছু বললো।শুনে তারিন ভাইকে বললো,”লাগেজটা এখানে দিয়ে তুই যা এখান থেকে।”
মেজাজ খারাপ করে তানভীর লাগেজ দিয়ে গেলো।যাবার সময় বললো,”আজব মেয়েমানুষ তো!আমাকে এতোক্ষণ বললে কি হতো লাগেজের জন্য কান্নাকাটি করছে,তাহলে আমি কি না এনে দিতাম?
আরো দশটা লাগেজ এনে দিতাম দরকার হলে।ওয়াশরুমে গেছে ভাইরে ভাই,ওখান থেকে বের হতে হলেও কি সাজগোজ করে,মেকাপ করে বের হতে হবে?
এইরকম নখরা কেমনে যে করে এরা!”
তারিন চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো,”ভাগ এখান থেকে।”
তানভীর যেতেই তারিন দ্রুত হাতে প্যাকেট খুলে ন্যাপকিন বের করে দিলো পূরবীকে।
ন্যাপকিন নিয়ে বের হলো পূরবী।এতোক্ষণে স্বস্তি পাচ্ছে সে।
তারিন আর কথা না বলে চলে গেলো।পূরবী আগের জায়গায় গিয়ে বসে রইলো।সন্ধ্যা থেকে রাতের ১১ টা পর্যন্ত একই জায়গায় বসে রইলো পূরবী। বসে থাকতে থাকতে কোমর ব্যথা বেড়ে গেলো।
তানভীর এসে একবার ডাকলো খেতে যাবার জন্য,পূরবী নড়লো না।কথাও বললো না।
রেগেমেগে তানভীর চলে গেলো।তারপর গিয়ে মা,বোন,ভাবীদের বললো,পূরবীকে খেতে ডাকতে। বাড়ির মহিলারা কেউই খেতে ডাকে নি পূরবীকে।পূরবী কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারলো এই বাড়ির মহিলারা কেউই ওকে তেমন একটা পছন্দ করছে না।
মনে মনে আল্লাহকে ডেকে বললো,”অভাগা যেদিকে যায়,সাগর সেদিকে না শুকালেই কি নয়?
একটু তো রহম করো আমায়।এতিমের আর্তনাদ কি তোমার আরশ পর্যন্ত পৌছায় না আল্লাহ?
সাত আসমানের উপরের আরশে বসে কি তুমি দেখতে পাও না এই এতিমের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ?
আর কতো পুড়বো আল্লাহ? ”
১২টার সময় পূরবীকে রুমে নেওয়া হলো।ক্ষিধেয় ততক্ষণে পূরবীর পুরো শরীর কাঁপছে। গতকাল বিকেলে দুই বোন মিলে ভাত খেয়েছে,তারপর আর খায় নি।দুপুরে ও খায় নি পূরবী।
এখন ক্ষিধে পেয়েছে কিন্তু কেউ ডাকছে না ওকে।নিরুপায় হয়ে পূরবী গুটিসুটি মেরে বসে রইলো।
তানভীর রুমে এলো যখন তখন রাত সাড়ে বারোটা। এসে দেখে পূরবী হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে গেছে।
পুতুলের মতো মুখটি ঘামে ভিজে আছে।
তানভীরের মনে হলো এসব যেনো শিশির বিন্দু।
আলতো করে পূরবীর হাত ছুঁতেই পূরবী জেগে উঠলো। তানভীরকে এতো কাছে বসে থাকতে দেখতে বুক ধড়ফড় করে উঠলো পূরবীর।
একটু দূরে সরে বসে তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”খেয়েছ তুমি?”
পূরবী মাথা নাড়িয়ে জানালো খায় নি।
তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”মা ডাকে নি খেতে যেতে?”
পূরবী বুঝতে পারছে না কি বলবে এই প্রশ্নের জবাবে।
তানভীরের রাগ হলো ভীষণ। এই একটা বাজে স্বভাব তার।অল্পতেই মাথা গরম হয়ে যায়।রেগে গিয়ে রুম থেকে বের হয়ে মায়ের রুমের সামনে গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো।
রেবেকা তখন সবে মাত্র বিছানায় পিঠ লাগিয়েছেন।ছেলের এরকম গলা ফাটানো চিৎকারে হন্তদন্ত হয়ে উঠে গেলেন।আনিকা,মিম,তারিন ও ছুটে এলো চিৎকারে।
তারিন জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে তোর,এমন হেড়ে গলায় চেচাচ্ছিস কেনো?”
তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”তোমাদের সবার রাতের খাবার হয়েছে?”
রেবেকা বললো,”হ্যাঁ হয়েছে তো।কেনো?”
দরজার পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ভাসটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরে তানভীর বললো,”সবার খাওয়া হলে আমার বউয়ের খাওয়া হয় নি কেনো?
এতোগুলা মানুষ তোমরা কেউ একবার ডাকো নি কেনো ওকে?
দুপুরে তো তোমরাই দেখেছো ও এক দানা ভাত ও মুখে দেয় নি।
সবাই সবার খাবার ঠিকমতো খেয়ে নিয়েছে,আমার বউকে রেখে!
কিসের এতো অবহেলা আমার বউকে?
তোমাদের পছন্দ মতো হয় নি বলে? ”
আচমকা এতোগুলো প্রশ্ন শুনে রেবেকা থতমত খেলেন।ঝড়ের মতো তানভীর রান্নাঘরে ঢুকে গেলো।নিজের হাতে পেঁয়াজ,কাঁচামরিচ কেটে ডিম ভাজি করলো।
এক চুলায় ভাত গরম করে নিয়ে,ধোঁয়া উঠা গরম ভাতের সাথে পিরিচে করে ডিম ভাজা,এক বাটিতে ভাজা ইলিশ মাছ নিয়ে রুমের দিকে গেলো।
বিদেশে নিজের রান্না নিজেই করে বিধায় সব কাজই তানভীরের জানা।রুমে ঢুকে সবার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো।
সবাই সবটা দেখলো।মিম আনিকার হাতে চাপ দিয়ে বললো,”দেখলেন ভাবী,আজ বিয়ে হয়েছে অথচ আজকেই বউয়ের গোলাম হয়ে গেছে।”
আনিকা ক্রুর হেসে বললো,”সবই ধলা চামড়ার খেলা রে মিম।”
পূরবী রুমে বসে তানভীরের চেচামেচি শুনলো সবটা।শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। অজানা এক অপরাধবোধে ভুগতে লাগলো। যদি পূরবী মিথ্যা করে বলতো যে খেতে ডেকেছে তাহলে তো এতো কথা হতো না।
তানভীর পুরবীর সামনে বসে ভাত মাখতে মাখতে বললো,”জানো পূরবী, আমি তো সারাজীবন দেশে থাকবো না।আমি তাই সবসময় ভাবতাম আমার বিয়ের পর আমি আমার বউয়ের এতো যত্ন নিবো,এতো এতো এতো যত্ন নিবো যে আশেপাশের যতো ভাবীরা আছে সবাই যাতে আমার বউকে হিংসে করে। আমার বউ যাতে আফসোস করার সুযোগ না পায় আমি তার পছন্দসই না বলে।
লোকে বলে প্রবাসীদের বউরা বেশিরভাগই পরকীয়া করে।আমি এতো ভালোবাসবো আমার বউকে যে আমার বউ যাতে কখনো ভাবতেই না পারে পৃথিবীতে তার স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষ আছে তাকে ভালোবাসার জন্য।
আমার পাগলের মতো ভালোবাসাই আমার বউকে আমার করে রাখবে।
এবার হা করো,আমি তোমাকে খাইয়ে দিবো সবসময়। যতোদিন দেশে আছি,আমি তোমার সব কাজে হেল্প করবো।তুমি কখনো আমাকে ভয় পেও না।মনে রেখ,এই পৃথিবীতে তোমার একান্ত আপন মানুষ শুধু আমিই আছি।”
তানভীরের কথায় পূরবী কিছুটা স্বস্তি পেলো। লজ্জা না পেয়ে খেয়ে নিলো।
খাবার পর তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে পূরবী?
তোমার মুখে কেমন ব্যথার ছাপ।”
পূরবী ভাবলো বলবে কি-না। তারপর ভাবলো,একে ছাড়া আর কাকে বলবো।কেউ তো নেই আর।
ভেবেচিন্তে বলেই দিলো,একটা বোতলে করে ওর গরম পানি লাগবে।ভীষণ পেটে ব্যথা,কোমরে ব্যথা হচ্ছে।
শুনে তানভীর থমকে দাঁড়ালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,”তোমার কি পিরিয়ড চলছে? ”
লজ্জায় মাথা নিচু করে পূরবী বললো,”হ্যাঁ। ”
আবারও রেগে গেলো তানভীর। চেয়ারে লাথি মেরে বললো,”মানে কি এসবের?
আজকে বিয়ে হয়েছে,কোথায় বাসর হবে তা না তোমার এসব হলো কেনো?
আমি কতো প্ল্যানিং করে রেখেছিলাম,কতো এক্সাইটেড ছিলাম।আমার সব প্ল্যানে তুমি জল ঢেলে দিলে।
ভাল্লাগেনা এখন আমার।”
পূরবী বুঝতে পারলো না এই লোকের সমস্যা কোথায়।এরকম হুটহাট রেগে যায় কেনো।পিরিয়ড তো প্রতিমাসেই হয় তাতে সমস্যা কি এর?
দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো তানভীর। রেবেকার রুমের সামনে গিয়ে আবারও ডাকতে লাগলো। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো রেবেকার ছেলের ডাক শুনে।বিরক্তি চেপে রেখে বললো,”কি হয়েছে আবার?
এখন কি তোর বউয়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে না-কি? ”
তানভীর ভ্রু কুঁচকে বললো,”হট ওয়াটার ব্যাগটা দাও,পূরবী অসুস্থ ওর লাগবে।আর শুনো মা,এতিমের মাথায় হাত বুলালে আল্লাহ খুশি হয়।পূরবীকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা করো।”
রেবেকা ওয়াটার ব্যাগ এনে দিতেই তানভীর চলে গেলো।
রুমে গিয়ে নিজেই বসে ব্যাগে চার্জ দিয়ে ব্যাগ গরম করলো।তারপর পূরবীর কোমরে সেঁক দিলো।আরামে পূরবীর দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো।
এক সময় ঘুমিয়ে গেলো পূরবী।
বাকী রাত তানভীরের কাটলো বউয়ের কোমরে আর পেটে গরম সেঁক দিতে দিতে।
পূরবীর কপালে চুমু খেয়ে বললো, “রেগে যাই বলে আমায় খারাপ ভেবো না বউ।যতোটা রাগ করতে জানি তার চাইতে হাজার গুণ বেশি ভালোবাসতে ও জানি।”
চলবে….?