কোথাও কেউ ভালো নেই -০৫,০৬

0
1266

কোথাও কেউ ভালো নেই -০৫,০৬
জাহান আরা
০৫

সকাল থেকে ভ্যাপসা গরম পড়ছে।সূর্য উঠেছে,তীব্র রোদে সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। মাথার উপরে ভনভন করে ফ্যান ঘুরছে পূর্ণ গতিতে।তবুও পূরবীর সারা শরীর ঘেমে জবজবে।
বহুদিন পর পূরবী বেলা দশটা পর্যন্ত শান্তিতে ঘুমালো।
একটা হাতপাখা দিয়ে তানভীর পূরবীকে বাতাস করছে আর দেখছে পূরবীর নাকের মুক্তোর মতো ঘাম বিন্দুগুলো।লোকে বলে নাকে ঘাম দেওয়া মেয়েরা স্বামীর খুব ভালোবাসা পায়।সত্য মিথ্যা জানে না তানভীর তবে এটুকু জানে এই মেয়েটাকে সে প্রচুর ভালোবাসবে।

টিস্যু প্যাকেট থেকে টিস্যু নিয়ে পূরবীর নাক মুছে দিলো তানভীর। এই মেয়েটা নিশ্চয় গরম সহ্য করতে পারে না।সাথেসাথে সিদ্ধান্ত নিলো দুটো এসি কিনবে।একটা বাবা মায়ের রুমে লাগাবে আরেকটা নিজেদের রুমে।

টেবিলের ড্রয়ারে পূরবীর জন্য আনা নতুন স্মার্ট ফোন ও এক জোড়া সোনার নুপুর রয়েছে। গতরাতে দিবে ভেবেছে তানভীর কিন্তু দিতে পারে নি নানা ঝামেলায়।
ঠিক করে রাখে ঘুম থেকে উঠলেই দিবে পূরবীকে।

পূরবীর আচমকা ঘুম ভেঙে গেলো। লাফ দিয়ে উঠে বসে পূরবী জিজ্ঞেস করলো,”কয়টা বাজে?সুরভী কই?
আমি কি দেরি করে উঠেছি আজকে?
ছোট মা কি সুরভীকে মেরেছে?”

তানভীরের চোখে জল এলো পূরবীর কথা শুনে।জবাব না দিয়ে পূরবীকে টেনে নিলো।বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,”ভয় পেও না পূরবী।সব ঠিক করে দিবো আমি।আমি আছি তো শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত। ”

পূরবী চুপ করে রইলো। তারপর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে বিছানায় বসে রইলো। পূরবী বুঝতে পারছে না আসলে ওর এখন কি করা উচিত বা কার কাছে যাওয়া উচিত।
তানভীর কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো পূরবীকে।তারপর জিজ্ঞেস করলো,”পূরবী তোমার দাদী,নানী কেউ আছেন বেঁচে?”

পূরবী মাথা নেড়ে বললো,”না,নেই।”

তানভীর বুঝলো এই মেয়েটার সংসার জীবন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই,এমন কি আশেপাশের ভাবীরা কেউও মেয়েটিকে বুঝিয়ে দেয় নি কিছু।
ড্রয়ার থেকে নুপুর বের করে পূরবী পা দুটো নিজের দিকে টেনে নিলো তানভীর। পূরবী ভয়ে আঁতকে উঠলো।

বক্স থেকে নুপুর বের করে পূরবীর দুই পায়ে পরিয়ে দিলো তানভীর। তারপর হাতে একটা চুমু খেয়ে বললো,”আমাকে তুমি নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড ভাবতে পারো পূরবী। যেকোনো সমস্যায় পড়লে আমাকে বলতে পারো,আমি সমাধান করে দিবো।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আগে হচ্ছে বন্ধুত্বের,একে অন্যের কাছে যদি সহজভাবে মনের সব সুখ দুঃখ বলতে না পারে তবে একটা সম্পর্কে থাকে কিভাবে মানুষ? ”

পূরবী তানভীরের মুখের দিকে তাকালো।এই মানুষটিকে প্রথমে যতোটা খারাপ ভেবেছে সে আসলে ততটাও খারাপ না লোকটি।একটু একটু ভরসা করাই যায়।

একটু ভেবে পূরবী জিজ্ঞেস করলো,”আমি এখন কী করবো?”

“তুমি আগে গোসল করবে,তারপর একটা গোলাপি সুতির শাড়ি এনেছি আমি,শাড়িটি পরবে।চুলে এই বেলীফুলের গাজরা দিবে,চোখে মোটা করে কাজল দিবে,তারপর আমার সাথে নাশতা করতে যাবে।সময় মাত্র ৩০ মিনিট,জলদি করো।”
তানভীরের কথামতো পূরবী উঠে গেলো।

রেবেকা পান বানিয়ে তমিজ মিয়া কে দিলেন।তমিজ মিয়া পান খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,”নতুন বউ কই?”

রেবেকা মুখ ঝামটা মেরে বললো,”খুঁজে তো আনছেন একটা বেলাজ ছেড়ি,বিয়ার পরদিন মানুষ এতোক্ষণ শুইয়া থাকে?
বউ কি আরো দুইটা আনি নাই ঘরে?
এরকম বেলাজ তো অরা আছিলো না।”

তমিজ মিয়া স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,”আমার প্রশ্ন তো এতো প্যাচানো আছিলো না রেবেকা।এতো হিস্টোরি তো তোমারে আমি জিগাই নাই।আমার জহুরির চোখ,খাঁটি সোনা চিনতে আমার ভুল অয় নাই।তুমি যেডি আনছো,সবডি অইলো গিয়া গোল্ড পেলেট,সোনার মতো মনে অয় প্রথমে দেখলে।”

রেবেকা স্বামীর সাথে আর কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখেন তানভীর বসে বসে আম কেটে দিচ্ছে পূরবীকে,পূরবী খাচ্ছে।
রেবেকা তাৎক্ষণিক গিয়ে তারিন কে ডেকে এনে দেখালেন।

তারিন অনেকক্ষণ ভেবে বললো,”মা,আমার মনে লয় অরা তাবিজ করছে তানভীরের লাইগ্যা। আমার ভাইতো এমন না মা।কাইলকা বউ আনতে আনতে আইজকা বউরে এমন যত্ন করে কেউ?
কোনো একটা কাহিনি আছে মা।তুমি জোবেদা খালার বাড়িতে যাও।তারে গিয়া সব খুইল্যা কও।যা করার উনি করবো।”

রেবেকা মেয়ের কথায় সায় দিলেন।কাল পরশুরমধ্যে তিনি যাবেন জোবেদা বুজির বাড়িতে।

খাওয়া শেষ হলে তানভীর পূরবীকে বললো,”যাও এবার মায়ের কাছে যাও।ওনার পাশেপাশে থেকো।উনি একটু রেগে আছেন,একটু রেগে কথা বলবে হয়তো রাগ করো না তুমি। সংসারের সব মানুষ তোমার মনের মতো হবে না।তুমি ও সবার মনের মতো হবে না।জগৎ এরকমই। আমি ও দেখো কারো অপছন্দের তালিকায় আছি।আবার আমার অপছন্দের তালিকায় ও অনেকে আছে।
তুমি নিজের ব্যবহার দিয়ে সবাইকে প্রভাবিত করতে পারো যদি তো ভালো। সবাই যার যার ইগো ছেড়ে তোমায় কাছে টেনে নিবে।
আর না পারলেও ক্ষতি নেই পূরবী।তবে তোমাকে তোমার জায়গায় স্বচ্ছ থাকতে হবে।তোমার দোষ ধরার জন্য মানুষের অভাব হবে না।কিন্তু দেখবে তোমার গুণ কারো চোখে পড়বে না।
প্রতিটি মানুষের বিবেক আছে পূরবী। মন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিন্তু বিবেক নেয় না।নিজের বিবেকের কথা শুনো।এই পরিবার এখন তোমার। আমি বলছি না তুমি সেভাবে চলবে যেভাবে আমার মা,বোন,ভাবী,ভাই সবাই বলবে,ওদের কথামতো উঠবে বসবে।তোমার যেভাবে কমপোর্টেবল লাগবে তুমি সেভাবে চলবে।
তবে এমন করে চলাফেরা করো না,কারো সাথে এমন ব্যবহার করো না যাতে কেউ তোমার দিকে আঙুল তাক করতে পারে।
মনে রেখো,পুরো দুনিয়া তোমার বিরুদ্ধে থাকুক,তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিক,আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবো।তোমার চাইতে বড় সত্য আমার কাছে কিছু নেই।

আমার এই বিশ্বাস তুমি ভেঙে দিও না।আমি খুব আবেগী মানুষ পূরবী।বিশ্বাস ভাঙলে আমি বাঁচবো না।আমি তোমার সাথে, তোমার হাত ধরে হাজার বসন্ত কাটাতে চাই।”

পূরবী কি বুঝলো তানভীর জানে না।তবে দেখতে পেলো পূরবীর দুচোখ জলে টইটম্বুর হয়ে গেছে। চোখ মুছে পূরবী বললো,”আমি কখনো কাউকে অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না।তবুও যদি কেউ অভিযোগ করে থাকে আমাকে বলবেন আপনি,আমার দোষ হলে আমি নিজেকে শুধরে নিবো।”

তানভীর হাসলো।পূরবী উঠে চলে গেলো কিচেন রুমের দিকে।

নতুন বউ দেখার জন্য আশেপাশের অনেক মানুষ এসেছে।যেই দেখছে পূরবীকে সে-ই পূরবীর রূপে মুগ্ধ হচ্ছে।সবাই বলছে,তানভীরের বউ পরীর মতো সুন্দরী।

লোকে বলে জা’য়ের শত্রু জা।পূরবীর এতো প্রশংসা আনিকা,মিমের সহ্য হলো না।বিরক্ত হয়ে সরে গেলো দুজন। সকালের নাশতার কাপ,পিরিচ,প্লেট জমেছে সিংকে অনেকগুলো। রেবেকা রান্নাঘরে এসে দেখেন সিংকে সব জমে আছে,কেউ এগুলো পরিষ্কার করে নি।পূরবী একটা মোড়ায় মাথা নিচু করে বসে আছে।

রেবেকা কড়া গলায় পূরবীকে বললেন,”পূরবী,সিংকের প্লেট বাসন সব পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলো তো।”

এই প্রথম রেবেকা পূরবীর সাথে কথা বললেন সুন্দর করে। পূরবী আনন্দিত হলো শাশুড়ি তার সাথে কথা বলায়।
ভিম দিয়ে ধুতে লাগলো সব।মিম এলো রান্নাঘরে কাপ নিতে,চা খাবে মিমের স্বামী তুহিন। পূরবী কাপ ধুয়ে মিমের দিকে দিলো।মিম কাপটা ধরলো না ইচ্ছে করে। ফলাফল কাপ ফ্লোরে পড়ে ভেঙে গেলো।

কাপ ভাঙার শব্দে রেবেকা রুম থেকে দৌড়ে এলো।এসে দেখে তার নতুন ডিনার সেটের সাথের কাপ সেটের একটা কাপ ভেঙে পড়ে আছে নিচে।
রাগ রেবেকার কান লাল হয়ে গেলো।চিৎকার করে বললো,”কালকে আসতে না আসতে আজকেই আমার ঘরের জিনিস ভাঙতে শুরু করেছো?
দেখে শুনে কি অলক্ষ্মী ঘরে আনছি আমি।আমার এতো সুন্দর সেটের কাপ ভেঙে ফেলেছে।বাপের বাড়িতে কি কাম-কাজ কিছু করো নাই না-কি পাড়ায় পাড়ায় টইটই করে ঘুরছো গায়ে বাতাস লাগিয়ে? ”

ভয়ে লজ্জায় পূরবী মাথা নিচু করে রইলো।তানভীর বাবার রুমে বসে সব শুনলো।মায়ের কথা শেষ হলে কিচেনে আসলো।এসে দেখে পূরবী এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাত পা থরথর করে কাঁপছে।তানভীর এগিয়ে গিয়ে পূরবীকে কাছে টেনে নিলো।
তানভীরকে দেখে পূরবী স্বস্তি পেলো কিছুটা। অভিমানে,লজ্জায় কেঁদে দিলো সবার সামনেই তানভীরের বুকের উপর মাথা রেখে।

তানভীর পূরবীর চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললো,”ভয়ের কিছু নেই পূরবী। আমি আছি তো তোমার পাশে।সামান্য একটা কাপ-ই তো ভেঙেছে।এ আর এমন কি ব্যাপার। আমি এনে দিবো এক সেট।ভাঙা কাঁচে যে তোমার হাত পা কাটা যায় নি এই তো আমার জন্য ঢের।
যাও তুমি রুমে যাও।”

পূরবী চলে যেতেই তানভীর জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে এখানে,কেউ দেখেছেন?”

নতুন বউ দেখতে আসা একটা ৯-১০ বছরের মেয়ে বললো,”কাকা আমি দেখেছি।নতুন কাকী মেজো কাকীকে কাপ দিচ্ছিলো। কিন্তু মেজো কাকী ইচ্ছে করেই কাপ ধরেন নি,তাই পড়ে ভেঙে গেছে। ”

মিম ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তানভীর মিম কে কিছু বললো না। মা’কে বললো,”মা,পূরবীর বয়স কতোই আর বলো?
১৫-১৬ বছর। এই বয়সে তো তুমি আপাকে নিজের হাতে ধরে ভাত খাইয়েছো।আপার জামা কাপড় নিজে ধুয়ে দিয়েছ।আপার শ্বশুর বাড়িতে কাজ করতে হবে বলে আপাকে ওই বাড়িতেও যেতে দাও না।

পূরবী ও তো কারো এরকম আদরের মেয়ে ছিলো।ওর মা বেঁচে থাকলে হয়তো এতো অল্প বয়সে ওকে বিয়ে দিতো না।ওর তো এখনো মায়ের কোলে খেলার বয়স।ভাগ্যের ফেরে ও এখন এই বাড়ির বউ।এই বয়সী মেয়েরা কাঁদা মাটির মতো মা।যেমন খুশি তেমন আকৃতিতে এদের গড়ে নেওয়া যায়।
তুমি ওকে ভালোবেসে যদি আপন করে নাও,ও সেই ভালোবাসা তোমাকে দশগুণ ফেরত দিবে।তুমি ওর জন্য এক হাঁটু জলে নামলে ও তোমার জন্য এক বুক জলে নামবে।আরো ওর মা নেই।তোমাকে ও মায়ের আসনে বসাবে।শুধু যদি একটু ভালোবাসা দাও তুমি।একটা কাপ ভেঙেছে বলে এতো কথা বললে তুমি ওকে।আমি চাইলে ওর সামনে বলতে পারতাম যে এই ঘরের সব জিনিসপত্র তুমি আমার টাকায় গড়েছ।তাই আমার বউ সব ভেঙে ফেললেও কারো কোনো কথা বলার অধিকার নাই।

কিন্তু আমি বলি নি।তোমাকে ছোট করা হবে তাহলে। আজ আমি বললে পরেরবার পূরবী বলবে।আমি চাই না পূরবী তোমার সাথে বেয়াদবি করার সুযোগ পাক।

আমি জানি আমার বউ তোমার পছন্দের না।তাই বলে আজকেই ওকে এভাবে অপমান না করলেও পারতে।এক জীবনে মানুষ কতো অপ্রিয় কাজই তো করে,অপ্রিয় কে প্রিয় করে নেয়।
প্রিয় না কর,অন্তুত পূরবীকে এভাবে অপমান করে কথা বলো না।পূরবী হয়তো তোমাদের ভয়ে সব সহ্য করে যাবে কিন্তু আমি?
আমাকে তুমি ভলো করে জানো মা।
এরপর থেকে পূরবীর কোনো ভুল হলে আমাকে বলবে।কেউ আর কোনোদিন পূরবীকে একটা কথাও বলবে না।

বিনাদোষে পূরবীকে কেউ অপমান অপদস্ত করলে,হেয় করলে,আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না।কে ভাই, কে বোন,কে ভাবী আমি কিছুই মাথায় রাখবো না।”

চলবে…..

লিখা: জাহান আরা

কোথাও কেউ ভালো নেই -০৬

একা ঘরে পূরবী বসে বসে কাঁদতে লাগলো। ঘটনাটা মনে পড়লেই বুক কেঁপে উঠে পূরবীর। এতোগুলো মানুষের সামনে কিভাবে এরকম একটা কাজ সে করলো ভেবে পাচ্ছে না।সে তো ঠিকমতই কাপ দিয়েছিলো ভাবীকে,তবুও কেনো পড়ে গেলো।
এসব ভাবতে ভাবতে পূরবীর চোখ থেকে জলধারা বইতে লাগলো।

তানভীর রুমে এসে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর পূরবীকে টেনে নিয়ে নিজের কোলের উপরে শুইয়ে দিয়ে পূরবীর চুলে বিলি কাটতে লাগলো।
তানভীরের আদরে পূরবী ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। বারবার মনে হতে লাগলো তার ভাগ্য আসলেই খারাপ।

তানভীর পূরবীর কপালে একটা চুমু খেলো।তারপর ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে পূরবীকে বললো,”বক্সটা খোলো পূরবী তোমার জন্য একটা গিফট আছে।”
শোয়া থেকে উঠে বসলো পূরবী।তারপর ফোনের বাক্সটা খুললো।ভিতর থেকে বের হয়ে এলো একটা স্মার্টফোন।
আনন্দে পূরবী যেনো মূক হয়ে গেলো।
একটা ফোন ছুঁয়ে দেখার কতো ইচ্ছে ছিলো তাদের দুই বোনের তা কেবল অসহায় দুই বোন জানে।
হঠাৎ করেই পূরবীর মনে হলো সে আসলে ভীষণ সুখী একটা মেয়ে।আল্লাহ তাকে এরকম একটা স্বামী দিয়েছে যে না বলতেই তার মনের কথা বুঝে যায়।

পূরবীর মা বেঁচে থাকতে একটা বাটন ফোন ব্যবহার করতো।আশেপাশের অনেকেই স্মার্টফোন ব্যবহার করলেও ফয়েজ আহমেদ স্ত্রীর জন্য আনেন নি এরকম কোনো ফোন।
পূরবীর বান্ধবীরা সবাই বলতো মায়ের মোবাইলে তারা নাটক,সিনেমা,কার্টুন কতো কিছু দেখে ইউটিউব থেকে।সেজেগুজে ছবি তোলে।
শুনে শুনে পূরবী স্বপ্ন দেখতো তার মায়ের ও এরকম একটা ফোন হবে। তারপর তারা দুই বোন মিলে ছবি তুলবে।রাতে পড়া শেষ হলে কার্টুন দেখবে।

কিন্তু সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয় নি।পারভীন বেঁচে থাকতে এরকম ফোন ব্যবহার করার সুযোগ পায় নি।তবে সালমা পেয়েছে। ফয়েজ আহমেদ নিজের অল্পবয়সী সুন্দরী বউয়ের জন্য দেশে আসার সময় একটা স্মার্টফোন নিয়ে আসেন।
ফোন দেখে দুই বোন অঝোরে কেঁদেছিলো।না,নতুন মা’কে ফোন দেয়ায় তাদের কোনো হিংসে হয় নি।তবে কষ্ট হয়েছে এটা ভেবে যে তাদের মা এরকম একটা ফোন ব্যবহার করতে পারে নি।
কে জানে,সবসময় অসুস্থ থাকা মায়ের প্রতি হয়তো বাবার সেই ভালোবাসা ছিলো না।
অথচ ফয়েজ আহমেদ পারভীন বেগমকে বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে।
প্রথম বার পারভীন বেগমকে দেখেছন ফয়েজ আহমেদ কলেজে।একই কলেজে পড়তেন দুজনে।পারভীনের রূপে মুগ্ধ হয়ে ফয়েজ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিদেশ চলে যায়।
দুই বছর পর যখন দেশে ফিরে তখন জানতে পারে পারভীনের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে।
হাতে বিষের শিশি নিয়ে পারভীনের সাথে দেখা করতে যান ফয়েজ।বিষ খাওয়ার ভয় দেখিয়ে পারভীনকে রাজি করান যাতে এই সম্বন্ধে রাজি না হয়।

দুদিন পরেই বাবা মা’কে নিয়ে যান বিয়ের জন্য।সেদিন পারভীনের বাবা মা সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে ফয়েজের পাগলামি দেখে।বাধ্য হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দিতে।তাছাড়া অমত করার ও উপায় ছিলো না।ছেলে বিদেশে থাকে,ভালো কামাই করে।তখনকার সময়ে এরকম পাত্র ক’জনা ছিলো!

সেই ভালোবাসার পাত্রে কবে যে ফুটো হয়ে গেছে পারভীন টের পায় নি।হাঁফানিতে ভোগা পারভীন বুঝতে পারে নি যে মানুষটা মুগ্ধ হয়ে তাকাতো তার দিকে,তার তাকানোর মাঝে এখন প্রবল বিতৃষ্ণা রয়েছে।
কে বলেছে ভালোবাসা বদলায় না?
সময় বদলায়,মানুষ বদলায়,মানুষের মন বদলায়,সাথে ভালোবাসা ও বদলে যায়।
একই ছাদের নিচে থাকা,একই পরিণয়সূত্রে বাঁধা মানুষটির সাথে কথা হয় হয়তো,খোঁজ নেওয়া হয়,কিন্তু মুগ্ধতা কেটে গেলে মনের খোঁজ আর কেউ নেয় না।একটা সময় যার কাছে এলে স্বস্তি মিলতো তাকেই একটা সময় ভীষণ অস্বস্তিকর লাগে।
মনের দূরত্ব বেড়ে যায়,সম্পর্কের রঙ বদলে যায়।

রুক্ষ চেহারার,লাবন্য হারানো মুখের দিকে তাকালে ফয়েজ আর মুগ্ধ হতো না।তাছাড়া বিয়ের ১২ বছর পর দুটো মেয়ের জন্ম হলো,একটা ছেলে হলো না বলেও ফয়েজের মানসিকতা বদলে গেলো।
চোয়াল ভেঙে পড়া মানুষটাকে অসহ্য লাগতো।সে জন্যই হয়তো তাকে মুক্তি দিতে আল্লাহ পারভীনকে নিয়ে গেলেন।
নতুন বউয়ের বয়স ২৭-২৮,ফয়েজের এখন ৪৫-৪৬ বছর। তাই বউয়ের মন রাখার জন্য অনেক কিছুই করে সে।

এসব পূরবী জানে।মা কতোদিন৷ কাতরে কাতরে পূরবীর কাছে নিজের বুকের জমানো সব কথা বলে গেছে।নতুন মায়ের প্রতি বাবার এখনকার ব্যবহার আর পূরবীর মায়ের সাথে করা ব্যবহার দুটোর পার্থক্য কি পূরবীর চোখে পড়ে নি?
পড়েছে,কিন্তু অভিযোগ করবে কার কাছে!
আল্লাহ ছাড়া কাউকে বলে নি পূরবী।

এসব ভাবতে ভাবতে পূরবী কাঁদলো।তানভীরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদলো।কাঁদতে কাঁদতে সব কথা বললো।
তানভীরের ভীষণ মায়া হলো।
আহা বেচারা!
ভাগ্য তাকে নিয়ে কেনো এরকম খেলেছে তানভীরের জানা নেই।পূরবীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তানভীর বললো,”আমি কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না পূরবী। সবাই তো এক রকম হয় না।কেউ কেউ কথা রাখতে জানে।”

নির্ভার হয়ে পূরবী তানভীরকে ছেড়ে দিলো।একটু লজ্জিত ও হলো নিজে থেকে এভাবে তানভীর কে জড়িয়ে ধরায়।
তানভীর বুঝতে পেরে বললো,”আমি ঠিক করেছি সুরভীকে এখানে নিয়ে আসবো।এই বাড়িতে থাকবে সুরভী তোমার সাথে। ওখানে ও কেমন থাকবে সেটা আমার চাইতে তুমি ভালো করে জানো।
এখন তুমি নেই,ওর উপর দিয়ে কখন কোন ঝড় যাবে কেউ জানবে না।
তার চাইতে ভালো এখানে নিয়ে আসি।”

পূরবী প্রথমে ভীষণ খুশি হলো।কিন্তু পর মুহুর্তে সমস্ত খুশি কর্পূরের মতো উবে গেলো।

তানভীর হেসে বললো,”ভয়ের কিছু নেই।আমি সব ম্যানেজ করে নিবো।”

পূরবী তবুও শঙ্কিত হলো।বোনের শ্বশুর বাড়িতে সুরভী থাকলে লোকে নানান কথা বলবে।আর তানভীর চলে গেলে সবাই কেমন ব্যবহার করবে তা নিয়ে ও পূরবী চিন্তিত হলো।
পূরবী মাথা নেড়ে বললো,”না লাগবে না।এটা কেউ ভালো চোখে দেখবে না।”

তানভীর এক মুহুর্ত ভেবে বললো,”তাহলে এক কাজ করি।সুরভীকে একটা লেডিস হোষ্টেলে দিয়ে দিই।সব খরচ আমি দিবো।তবুও তো তোমার ছোট মায়ের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবে।প্রতি সপ্তাহে না হয় একবার আসবে আমাদের বাসায়।বৃহস্পতিবার এসে শনিবার সকালে চলে যাবে।”

এই প্ল্যান পূরবীর পছন্দ হলো।মাথা নেড়ে সায় দিলো পূরবী। তারপর একটু ভেবে বললো,”আপনি কেনো এতোকিছু করবেন আমার বোনের জন্য?”

তানভীর হেসে বললো,”এখন তো আমি আর তুমি আলাদা কেউ না।তোমার চিন্তা আমার ঘুম নষ্ট করার কারণ। তোমার কপালের চিন্তার ভাঁজ আমার মাথা ব্যথার কারণ। আমি চাই তুমি খুশি থাকো।তুমি খুশি থাকলে আমার দুনিয়া খুশি থাকবে।
তোমার যতো না পাওয়া ছিলো আমি তা প্রাপ্তিতে ভরিয়ে দিবো পূরবী।কখনো যেনো তোমার মনে না হয় তোমার জীবন আজীবন কষ্টে কেটেছে।”

পূরবীর ভীষণ ভয় হলো তানভীরের কথা শুনে।নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো,”যেই মানুষটা আমাকে এভাবে রক্ষা করছে আমি পারব কি তার বিশ্বাস রাখতে সারাজীবন?
আল্লাহ,আমার কোনো কাজ যেনো এই মানুষটার কষ্টের কারণ না হয়।”

তানভীর মৃদু স্বরে পূরবীকে ডাকলো।তারপর উঠে গিয়ে আলমারির নিচ থেকে দলা মোচড়া করে রাখা একটা পুরনো শার্ট বের করলো।
শার্টের ভিতর থেকে দেনমোহরের নগদ চার লক্ষ টাকা বের করে পূরবীর হাতে দিয়ে বললো,”এই টাকা তোমার। দেনমোহরের চার লক্ষ টাকা আছে এতে।এই টাকার উপর আমার কোনো অধিকার নেই।তোমার যা খুশি তা করতে পারো তুমি এই টাকা দিয়ে। আমি কখনো এটা নিয়ে তোমাকে প্রশ্ন করবো না।কালকে রাতেই দেওয়ার ছিলো,কিন্তু দেওয়া হয় নি।”

এতো টাকা পূরবী কি করবে ভেবে পেলো না।কেনো-ই বা দিলো এতো টাকা তাকে তাও বুঝতে পারলো না।
পূরবীর শরীর কাঁপতে লাগলো একসাথে এতো টাকা দেখে।
পূরবী বললো,”আমার লাগবে না এতো টাকা।আপনার কাছে রেখে দিন আপনি। ”

তানভীর হাসলো শুনে।তারপর বললো,”অবশ্যই লাগবে।আমি আরো এক লক্ষ টাকা দিয়ে পাঁচ লক্ষ মিলিয়ে তোমার নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিবো দশ বছরের জন্য।”

পূরবী এসবের কোনো মানে বুঝলো না।তবে এটুকু বুঝলো,সামনে বসে থাকা মানুষটার মন একেবারে স্বচ্ছ। এই মানুষটা তাকে সবচেয়ে বেশি ভালো রাখবে।এই মানুষটার কাছে সে সবচেয়ে দামী। এই মানুষটা শুধু মানুষ না।এক অমূল্য রত্ন তার জন্য।এর কোনো অবমূল্যায়ন সে করবে না কখনো।

পূরবীদের বাড়ি থেকে মেহমান এলো তিরিশ জনের মতো। সালমা প্রথমে বাড়ির সামনে নেমে হতভম্ব হলো!
এ কোথায় সে পূরবীকে বিয়ে দিয়েছে!
এতো ভালো জায়গায় পূরবীকে বিয়ে দিয়েছে সালমার বিশ্বাস হলো না।নিজের উপর নিজের প্রচন্ড রাগ হলো কেনো বিয়ের আগে খোঁজ খবর নেয় নি।তাহলে তো পূরবীকে না দিয়ে ঘরে থাকা নিজের অবিবাহিত বোনকে বিয়ে দিতো তানভীরের সাথে।

নিজের বোকামির জন্য নিজের গালে নিজে থাপ্পড় মারলো সালমা।ভিতরে গিয়ে পূরবীকে দেখে সালমার বুকে চিনচিনে ব্যথা হতে লাগলো।
গতকাল এরা তেমন কোনো গহনা দেয় নি পূরবীকে।কিন্তু এখন দেখছে পূরবীকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে তানভীর। কানে দুল,গলায় দুটো হার,হাতে মোটা চুড়ি,কপালে টিকলি,পায়ে সোনার নুপুর।
এ যেনো মোমের পুতুল বসে আছে সালমার সামনে। রূপ যেনো ঠিকরে বের হচ্ছে এই মেয়ের শরীর থেকে।
সবুজ রঙের কাতান শাড়ি পরা পূরবীকে দেখে সালমার মনে হলো রূপকথার রানী।সাদা পাঞ্জাবি পরে হাস্যমুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা যেনো রাজার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।

সালমার ভীষণ আফসোস হলো।সেই সাথে আফসোস হলো রেবেকার ও।ভেবেছিলো গহনাগাঁটি সব নিজের একমাত্র মেয়ে তারিনকে দিবে।কিন্তু কে জানতো তানভীর যে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সব বের করে নিবে পূরবীর জন্য।রেবেকা ভেবেছিলেন সব গহনার কথা তানভীরের মনে নেই।কিন্তু ভুল ভাঙলো তখন, যখন দেখলো তানভীর জিজ্ঞেস করছে,বিয়ের জন্য এনে রাখা সোনার ব্রেসলেট নেই কেনো?

রেবেকা থমথমে গলায় জবাব দিলো,”ওটা তোর আপা নিয়েছে।ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে ওটা।”

তানভীর ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমিও আমার বউয়ের জন্য পছন্দ করেই কিনেছি মা একটা একটা করে।তাছাড়া আপাকে আমি নিজেই পাঁচ ভরি সোনার হার আর কানের দুল দিয়েছি।তোমাকে পাঁচ ভরি দিয়ে হার আর কানের দুল দিয়েছি।তোমাদের দেয়ার পরে আমি আমার বউয়ের জন্য কিনেছি যাতে তোমরা কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করতে না পারো যে তোমাদের না দিয়ে নিজের বউয়ের জন্য কেনা শুরু করেছি।তবে কেনো তুমি আপাকে দিলে ব্রেসলেট?
এখনই আপার থেকে নিয়ে দিবে তুমি।”

তারিন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনলো।রাগে জিদে তারিন ঠিক করলো মেহমান আসলে সবার সামনেই সে সিনক্রিয়েট করবে।রাস্তার ভিখিরিকে তার ভাই রানী বানাতে চাচ্ছে,এটা তারিনের হজম হলো না।তেমনই হজম হলো না রেবেকার,আর তার মতো সালমার ও হজম হলো না পূরবীর এই সুখ।তিনটি ঈর্ষান্বিত মন ছক কষতে লাগলো একটা অসহায় মেয়ের বিরুদ্ধে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here