কোথাও কেউ ভালো নেই -০৯,১০
জাহান আরা
০৯
তানভীরদের বাড়িতে গিয়েছে পূরবী দুই দিন হলো।বাবার বাড়িতে দুদিন থেকেই চলে এসেছে তানভীদের বাড়িতে। এখানে এসে পূরবীর মনে হলো কিছুটা যেনো স্বস্তি পাচ্ছে এবার সে।
অন্তত তানভীরকে ছোট হতে হচ্ছে না। বাবার বাড়িতে যেই দুদিন ছিলো পূরবীর ভীষণ লজ্জা লাগছিলো।তানভীর নিজে বাজার করেছে,পূরবী রান্নাবান্না করেছে।সালমা একবারও ডেকে কথা বলে নি।
পূরবী মনে মনে চেয়েছে যাতে তাড়াতাড়ি চলে আসে এই বাড়িতে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নামাজ পড়ে পূরবী বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দিলো। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি বসিয়ে দিলো।
একটা বিষয় দেখে পূরবী কিছুটা অবাক হলো। এই বাড়িতে কেউ-ই খুব একটা নামাজ কুরআন পড়ে না।শুধু তমিজ মিয়া আর তানভীর মসজিদে যায় ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে।পূরবী পড়ে নেয় নিজের রুমে।
বাড়ির মহিলারা কেউই সকালে উঠে না।সবাই ৮ টা বাজলে ঘুম থেকে উঠে। সবার রুটিন একটাই,ঘুম,খাওয়া আর সিরিয়াল দেখা।
পূরবী চা বসিয়ে আরেক চুলায় আটার কাই করে নিলো।তাহেরা এসে আলু,গাজর কুঁচিয়ে দিলো।পূরবী রুটি বানালো,ভাজি বসয়ে দিলো।
তাহেরা দুপুরের রান্নার জন্য মাছ তরকারি কাটতে বসলো। পূরবী এই দুই দিন ধরে সব কাজ করা শুরু করেছে।তানভীরের প্রবল আপত্তি পূরবী অগ্রাহ্য করে কাজ কর্ম করতে লাগলো ঘরের।
পূরবীর রুটি বানানোর মাঝখানে তানভীর ডাক দিলো পূরবীকে চা দেয়ার জন্য।
তানভীরের ডাক শুনে পূরবী আড়ষ্ট হয়ে গেলো।
পূরবী জানে এই লোকটা বাহানা খুঁজছে পূরবীকে রুমে নেয়ার জন্য।
পূরবী তাহেরা কে বললো,”আপা,আপনি আপনার ভাইকে এক কাপ চা দিয়ে আসেন,আমি গিয়ে আব্বাকে দিয়ে আসি।”
তাহেরা পূরবীর কথামতো চা নিয়ে গেলো তানভীরের রুমে।তাহেরাকে দেখে তানভীর রেগে গেলো ভীষণ পূরবীর উপর।
তাহেরাকে জিজ্ঞেস করলো,”পূরবী কি করছে আপা,ওকে বলো আসতে রুমে।আমার ওয়ালেট খুঁজে পাচ্ছি না।”
তাহেরা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,”কি কন ভাইজান,ওই যে দুই বালিশের মাঝখানে আপনের ওয়ালেট। ”
লজ্জা পেলো তানভীর তাহেরার কথায়।কিন্তু চেহারায় তা প্রকাশ পেতে দিলো না।আমতাআমতা করে বললো,”আরে দূর,ওয়ালেট না তো,আমার ঘড়ি খুঁজছি।”
তাহেরা বিরক্ত হয়ে বললো,”ভাইজান কি আন্ধা না-কি?
হাতে ঘড়ি দিয়া বইস্যা আছেন আবার কইতাছেন ঘড়ি পান না।”
তানভীরের প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। তাহেরার সাথে আর একটা কথাও না বলে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো। এই পূরবী মেয়েটার উপর ভীষণ অভিমান জন্মেছে তানভীরের। মেয়েটা চড়ুই পাখির মতো শুধু ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়াল দিয়ে পালিয়ে যায় তানভীরের হাত থেকে।কিছুতেই তানভীর বন্দী করতে পারছে না একে।
তাহেরা রান্নাঘরে গিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো।পূরবী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাহেরার দিকে।হাসি থামিয়ে তাহেরা বললো,”তানভীর ভাই মিছা কতাও কইতে জানে না ভাবী।খাটের উপরে মানিব্যাগ,আমারে কয় আপনারে ডাইকা দিতে মানিব্যাগ নাকি খুঁইজ্যা পায় না।আমি কইলাম ওই তো খাটের উপর। তারপর কয় না ভুল হইছে,আমার ঘড়ি পাই না।
আমি কইলাম ঘড়ি তো হাতে দিয়াই বইসা আছেন।বেচারা আর কিছু না বইলা চিৎ হইয়া শুইয়া পড়লো খাটে।”
লজ্জায় পূরবীর ফর্সা দুই গাল পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেলো। ধীর পায়ে হেটে গেলো রুমের দিকে।
যতোই রুমের দিকে যাচ্ছে পূরবীর হার্টবিট ততই বেড়ে যাচ্ছে।পূরবীর মনে হলো আর এক পা সামনে আগালে সে মরেই যাবে।
তবুও গেলো রুমে।গিয়ে দেখে চা পড়ে আছে ড্রেসিং টেবিলের উপর। তানভীর শুয়ে আছে।পূরবীকে দেখেই তানভীর জড়িয়ে ধরলো। তারপর রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।
বাড়ির সবাই একে একে ঘুম থেকে উঠতে লাগলো। খাবার টেবিলে বসে সবাই নাশতা করছে।বাদ শুধু সুরভী আর তানভীর। তমিজ মিয়া ভাজি মুখে দিয়ে বললেন,”ফার্স্টক্লাস ভাজি বানাইছস আজকে তাহেরা।জীবনে প্রথম তুই এতো ভালো রান্না করছস।”
তাহেরা হেসে বললো,”খালুজান কি কন,রান্না তো করছে নতুন ভাবী।হের রান্নার হাত ভালা।”
আনিকা রুটি ছিড়ে মুখে পুরতে পুরতে বললো,”ভালোই তো,বাড়িতে নতুন রাধুনির আগমন হয়েছে।এসব রান্নাবান্নার কাজ আমার জাস্ট পেইন লাগে।”
তারিন বললো,”আগুনের তাপ আমার সহ্যই হয় না ভাবী।’
রেবেকা কথা না বলে খেলেন।তমিজ মিয়া খেতে খেতে বললো,”যে রান্ধে,হে চুল ও বান্ধে বুঝলা।পূরবীর মেট্রিকের রেজাল্ট জানো?
গোল্ডেন এ প্লাস পাইছে ও,আর তোমাগো না আছে বিদ্যা না আছে বুদ্ধি আর না আছে কাজের গুণ। ও কাজ ও করছে বাপের ঘরের,পড়ালেখা ও করছে।”
মিম বললো,”ঠিকই কইছেন আব্বা।পূরবীর আরেকটা গুণ ও আছে,ওর রূপ।আমগো তো বিদ্যা,বুদ্ধি,রূপ কোনোটাই নাই,এরজন্যই বিয়ার এতো বছর হইছে নিজের স্বামীরে হাত করতে পারি নাই।আমাগো স্বামীরা আমাগো কথামতো উঠে না,বহেও না।আর পূরবীর কি গুণ দেখেন আব্বা,বিয়া হইতে না হইতে সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসরে নিজের হাতের মুঠায় নিয়া নিছে।তানভীর এহন বউয়ের আঁচলের নিচে ঘুরঘুর করে তাই।”
মিমের এরকম জবাবে তমিজ মিয়া হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন।চেয়ারে বসে থাকা বাকি সদস্যদের মুখে ২০০ ওয়াটের বাল্বের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো। রেবেকা নিজেও খুশি হলেন।
তমিন মিয়া টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন।তমিজ মিয়া উঠে যেতেই খাবার টেবিলে হাসির রোল পড়ে গেলো।
দরজা খুলে তানভীড় বের হয়ে এলো পূরবীকে নিয়ে।চেয়ার টেনে পূরবীকে বসতে বলে নিজেও বসলো।
প্লেটে খাবার নিতে নিতে তানভীর মিমকে বললো,”মেজো ভাবী,বউয়ের আঁচলের নিচে থাকা যদি এতোই খারাপ হয়ে থাকে তবে তুমি কেনো প্রতি সপ্তাহে জোবেদা খালার বাড়িতে যাও মেজো ভাইয়ের জন্য পান পড়া আনতে।”
রেবেকা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো মিমের দিকে।মিমের মুখ শুকিয়ে গেলো ভয়ে।গমগমে গলায় রেবেকা বললেন,”আমার খেয়ে,আমার পরে তুই আমার পোলার লাইগ্যা তাবিজ করছ যাতে আমার পোলা আমার কথা না শুনে?”
তারিন বললো,”ছি মেজো ভাবী,ভালোবাসা দিয়া স্বামীর মন জয় করতে না পারলে এসব করে মন জয় করতে চাও ক্যান?”
তানভীর হেসে বললো,”আপা,তুই ও এমন কোনো সাধু মহিলা না,গত দুদিন আগেই তো তুই আর মা মিলে গেলি খালার বাড়িতে। তুই গেলি তোর স্বামীর জন্য আর মা গেলো আমার জন্য।এমনকি সেই চিনি মা গতকাল আমার চা’য়েও মিশিয়ে দিয়েছিলো।তোরা পারিস ও সবাই।এতো অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে থাকিস কিভাবে সবাই?
এভাবে যদি মানুষ বশ করা যেতো তবে রাজনৈতিক নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে এসব করে জিতে যেতো।”
তানভীর পূরবীকে নিয়ে পূরবীদের বাড়ি যাচ্ছে। পূরবী ভীষণ খুশি আজ।সুরভীকে আজকে লেডিস হোস্টেলে দিয়ে দিবে তাই আনতে যাচ্ছে তাকে।
বাড়িতে পা দেয়ার সাথেসাথে পূরবীর এতোক্ষণের আনন্দ সব উবে গেলো। সালমার ঘরের বারান্দায় সুরভী উপুড় হয়ে পড়ে আছে বেহুশ অবস্থায়। ফর্সা হাত পা নীল হয়ে আছে মারের দাগে।
পূরবীর বুক ফাটা আর্তনাদ শুনে সালমা ঘর থেকে বের হলো।বের হয়ে দেখে পূরবী আর তানভীরকে।বিরক্ত হলো সালমা।কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে গেলো।
সুরভীর হুঁশ এলো দশ মিনিটের মধ্যে। বোনকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সুরভী। কান্না করতে চেয়েও পারলো না কান্না করতে।
শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো বোনকে।
সুরভীর এই অবস্থা দেখে তানভীরের আকাশচুম্বী রাগ উঠলো।সে এই বাড়ির জামাই সেটা ভুলে গিয়ে লাথি মেরে সালার রান্নাঘর ভেঙে ফেললো,রান্নাঘরে থাকা চুলা,বালতি,হাড়ি পাতিল আছড়ে সব ভেঙে ফেললো।
সালমা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো তানভীরের দিকে।এবং সাথে সাথে নিজের স্বামীকে ভিডিও কল দিয়ে সব দেখালো।
ফয়েজ আহমেদ এখনো মেয়ের জামাইয়ের সাথে কথা বলেন নি।নতুন জামাইয়ের এই কাজ দেখে অত্যন্ত রেগে গেলেন তিনি।তানভীরকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে সালমাকে বললেন ফোন দিতে তানভীরের কাছে।সালমা কিছুটা ভয় পেলো যদি তানভীর তার গায়ে হাত তোলে তবুও ভয়ে ভয়ে গেলো।
কোনোরকম হেডফোন না থাকায় তানভীর শ্বশুরের দেওয়া গালি সবটা শুনতে পেলো নিজ কানে।
এরকম অশ্রাব্য ভাষার গালি শুনে তানভীর হাত মুষ্টি করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো।সফল না হলেও কোনোমতে বললো,”আপনাদের যখন এতো সমস্যা,আমি আজকেই সুরভীকে নিয়ে যাবো।ও আর এখানে থাকবে না।”
ফয়েজ আহমেদ বললেন,”আমার মাইয়া আমার বাড়ি ছাইড়া কোত্থাও যাইবো না।যেই ….. পোলা আমার মাইয়ারে নিতে চাইবো তারে আমি দেইখা লমু।”
তানভীরের রাগ বহুগুণ বেড়ে গেলো। পূরবীর কোল থেকে সুরভীকে নিয়ে কোলে তুলে নিলো। তারপর বললো,”আমি যাচ্ছি সুরভীকে নিয়ে,আজ থেকে আমি জানলাম আমার শ্বশুর বাড়ি নাই,শাশুড়ী মারা যাবার সাথে সাথে আমার শ্বশুর ও মরে গেছে। পূরবী সুরভীর বাবা মারা গেছে।কোনোদিন কেউ যদি বাবার দাবি নিয়ে ওদের সামনে যায় তবে আমি নিজ হাতে তার গলায় চুরি চালামু।”
তারপর সালমার সামনে গিয়ে বললো,”মহিলা মানুষ বলে আপনি বেঁচে গেছেন,নয়তো আপনার মতো ডাইনি মহিলাকে আমি আমার এই শক্ত হাতের এক থাপ্পড়ে সোজা করে দিতাম।”
এই টুকু বলে থুথু এনে তানভীর থুথু মারলো সালমার পায়ের উপর। তারপর বললো,”মনে রাখবেন,এই থুথু আপনার পায়ে না,আমি আপনার মুখে মেরেছি।আমি ভালোর ভালো,আবার বেয়াদবের চূড়ান্ত। ”
সালমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তানভীর চলে গেলো। পূরবীর মাথা এখনো ঘুরছে।কি থেকে কি সব হয়ে গেলো পূরবী বুঝতে পারছে না এখনো।
চলবে…….
জাহান আরা
কোথাও কেউ ভালো নেই -১০
বাড়িতে আসার পর থেকে পূরবীর মাথা ধরে রইলো।পূরবীর মনে হচ্ছে সব কিছু যেন ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সুরভীর পুরো শরীরে মারের দাগ।কালসিটে পড়ে গেছে। পূরবী পরম মমতা নিয়ে পেইন রিলিফ মলম লাগিয়ে দিলো বোনের সারা শরীরে। সুরভী বোনের কোলে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। একটু সময় পর সুরভী বললো,”বুবু,আমি আর বাড়িতে যাবো না।এবার ছোট মা’র হাতের মুঠোয় গেলে আমাকে জীবিত রাখবে না আর।”
পূরবী শক্ত করে বোনের হাত চেপে ধরে বললো, “কিচ্ছু হবে না তোর,তোকে আর যেতে হবে না ওই বাড়িতে। ওই বাড়িতে আমাদের কেউ নাই এখন আর।”
সুরভী আরো শক্ত করে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। পূরবী দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলো, একটা মাত্র জীবন। অথচ সেই জীবনে কতো তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর।বেঁচে থাকাটাই এখন বিস্ময়কর লাগছে পূরবীর কাছে।
মাথার উপর থেকে মা একজন চলে গেলে মানুষের জীবন কতো ছন্নছাড়া হয়ে যায় তা পূরবীর চাইতে ভালো আর কে জানে?
মাগরিবের কিছু সময় আগে তানভীর বের হলো বাজারের উদ্দেশ্যে। সুরভীর জন্য কিছু কেনাকাটা করবে।আগামীকাল সুরভীকে হোষ্টেলে দিয়ে আসবে।তাই টুকটাক যা লাগবে সব কিনে দিতে চাচ্ছে তানভীর।
মাগরিবের নামাজের পর বৃষ্টি শুরু হলো। শুধু বৃষ্টি না,সেই সাথে শুরু হলো তুমুল বজ্রপাত। বাতাসের তীব্রতায় গাছপালা ভেঙে পড়ছে।গাছের কাঁচা আম সব টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে বাতাসের দাপটে।বিদ্যুৎ চলে গেলো সাথেসাথে।
রুমের সোলারের লাইট অন করে পূরবী সুরভীকে জড়িয়ে ধরলো।
সুরভীর গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। পূরবীর ভীষণ ভয় করলো।তানভীর বাড়ীতে না থাকায় পূরবীর ভয় আরো বেড়ে গেলো। কাকে ডেকে বলবে সে সুরভীর জ্বরের কথা।আর এরা যেমন মানুষ কেউ এগিয়ে আসবে না।সুরভী জ্বরের ঘোরে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করলো।
পূরবীকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো,”মা আসছে বুবু,মা ডাকছে আমাকে।বুবু,মা কি যে সুন্দর হয়ে গেছে।
ও মা,মা……
না না,কোনো কথা নাই তোমার সাথে তুমি কেনো আমাদের রেখে চলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি?
আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও না মা।কতোদিন তোমার গায়ের গন্ধ পাই না আমি।”
পূরবী চিৎকার করে কাঁদলো এসব শুনে।সুরভী খামচে ধরলো পূরবীকে।পূরবী সুরভীকে ছেড়ে দিয়ে শাশুড়ীর রুমের দরজায় পাগলের মতো নক করতে লাগলো।
ঝড়ের শব্দে রেবেকা প্রথমে শুনতে পেলো না।কিছুক্ষণ পরে যখন শুনলো বাহিরে কেউ ডাকছে।
শীতল হাওয়ায় রেবেকার চোখে তন্দ্রা লেগে এলো।পূরবীর মা মা বলে ডাক রেবেকার কাছে যথেষ্ট বিরক্তিকর লাগলো।
যাকে দেখতে নারি,তার চলন বাঁকা।
তাই পূরবীর আকুল গলায় মা বলে ডাকা ও যেনো রেবেকার মন বিষিয়ে তুললো।আরামদায়ক উষ্ণতা ছেড়ে গিয়ে দরজা খুলে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলো,”কী সমস্যা,এতো চেঁচাচ্ছ কেনো এই সন্ধ্যায়?”
ভয়ার্ত গলায় পূরবী বললো,”আমার বোনটার ভীষণ জ্বর উঠেছে মা,ও প্রলাপ বকছে।আমি কী করবো এখন?
আপনি একটু কিছু করুন না মা।আমাকে বলে দিন আমি কি করবো এখন।”
রেবেকার রাগ তুঙ্গে উঠে গেলো। কথায় সেই রাগ লুকানোর চেষ্টা না করেই যথেষ্ট রাগী গলায় রেবেকা বললো,”আমি কি ডাক্তার না-কি?
আমার কাছে কোনো ঔষধ নাই,বৃষ্টি থামলে দেখা যাবে তখন।”
পূরবী আর কথা বলার সুযোগ পেল না।রেবেকা দরজা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়লো। পূরবী কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।তারপর হঠাৎ করেই মনে পড়লো লেবু সিদ্ধ পানি খাওয়ানোর কথা। পূরবীর মা বেঁচে থাকতে জ্বর জলে লেবু সিদ্ধ করে পানি খাওয়াতো,এতে বেশ উপকার পাওয়া যায় জ্বরে।
পূরবী ছুটলো তখন রান্নাঘরের দিকে।অন্ধকার রান্নাঘরে ঢুকে পূরবী খেই হারিয়ে ফেললো। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় পূরবী কোনো কিছু খুঁজে পেলো না।রান্নাঘরে সোলারের লাইট না থাকায় পূরবীর জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে গেলো সব কিছু খুঁজে পাওয়া।হাতড়ে হাতড়ে ফ্রিজ খুঁজে বের করলো। লেবু দুটো বের করে বটি অথবা চুরি খুঁজলো হাতড়ে হাতড়ে।
ভাগ্য বিরূপ হলো পূরবীর। খাঁড়া করিয়ে রাখা বটি অন্ধকারে পূরবী দেখলো না।পায়ে লেগে গেলো বটির তীক্ষ্ণ ফলা।মুহুর্তেই রক্তারক্তি শুরু হয়ে গেলো।
পূরবীর সেসব খেয়ল নেই,আগে সুরভীর কথা ভাবতে হবে তার।সেই বটি তুলে নিয়ে সিংকে ধুয়ে লেবু টুকরো করে নিলো।তারপর সিংকের উপর থেকে একটা ছোট পাতিল নিয়ে লেবু সিদ্ধ করলো।চুলার আগুনের আলোয় দেখলো পা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে।
একটা কাপে লেবুর পানি নিয়ে বের হলো নিজের রুমের দিকে।
রুমের সামনে যেতেই শুনলো সদর দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে।তানভীর এসেছে ভেবে গিয়ে দরজা খুললো পূরবী। দরজা খুলে দেখে বাহিরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সালমা দাঁড়িয়ে আছে।
ভয়ে পূরবীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। তানভীর বাড়িতে নেই,তমিজ মিয়া ও বাড়িতে নেই।চাঁদমোহর থানার ওসি সালমার খালাতো ভাই। সালমা থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ করেছে তানভীরের বিরুদ্ধে।
পূরবীকে দেখে সালমার মুখ থেকে একটা নোংরা গালি বের হয়ে এলো। সুরভী না থাকলে ঘরের সব কাজ সালমার করতে হবে,আজকালকার দিনে কাজের মেয়ে পাওয়া গুপ্তধন পাওয়ার চাইতেও দূরুহ কাজ।সেই হাতের লক্ষ্মীকে সালমা কিভাবে পায়ে ঠেলবে?
সুরভীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাই সালমা এতো দূর এগিয়েছে।
ওসি কামরুল ইসলাম পূরবীর দিকে তাকালো লোভাতুর দৃষ্টিতে। সন্ধ্যা বেলার ঘরের এই হালকা আলোয় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুতি শাড়ি পরা মেয়েটিকে মনে হচ্ছে অপ্সরা।চোখের জলে দুচোখের কাজল লেপ্টে আছে,ফোলা ফোলা চোখ দুটো,এলোমেলো চুলের খোঁপা,শাড়ির ফাঁকে বের হয়ে থাকা বাঁকা কোমর কোনোটাই কামরুলের দৃষ্টি এড়ালো না।
ফিসফিস করে সালমাকে বললো,”এরকম তাজা একটা ফুল তোর বাড়িতে ছিলো আমাকে জানালি মা তুই?”
সালমা চিমটি কেটে বললো,”ছোটটাও বড়টার মতোই,ছোট বলে এখনো নজরে পড়ছে না।”
পূরবী থরথর করে কেঁপে উঠে বললো,”ছোট মা,আপনি….? ”
কামরুল বললো,”মিসেস সালমা আহমেদ আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ওনার ছোট মেয়েকে আপনারা জোর পূর্বক তুলে এনেছেন ওনার বাড়ি থেকে।সেই সাথে আপনার স্বামী তানভীর হোসেন ওনার বাড়িতে ভাঙচুর করেছে,খুন করার হুমকি দিয়েছে।আমরা তানভীর সাহেবকে এরেস্ট করতে এসেছি এবং সুরভীকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
পূরবীর মনে হলো একে একে সাত আসমান যেনো ওর মাথায় ভেঙে পড়ছে।
কি সব কথা বলছে এই লোকটা?কামরুল সবাইকে নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলো পূরবীর অনুমতি না নিয়েই।তারপর পূরবীর রুম থেকে গিয়ে সুরভীকে তুলে নিলো কামরুল।
পূরবী ছুটে গিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে দিলো।পাগলের মতো চিৎকার করে বললো,”আমার বোনকে কোথাও নিবেন না।ও আমার প্রাণ।ওকে উনি খুন করে ফেলবে।”
কামরুল হেসে বললো,”ম্যাডাম,আমাদের কাছে অভিযোগ আছে।সুরভীর অভিভাবক আপনি না।সুতরাং আপনার কোনো অধিকার নেই ওকে আটকে রাখার এখানে।তানভীর সাহেবকে তো আজ পেলাম না,আমরা আগামীকাল আবার আসবো।”
হতভম্ব পূরবীকে সেখানে রেখেই সালমা পুলিশসহ চলে গেলো সুরভীকে নিয়ে। অচেতন সুরভী জানতেও পারলো না কোথায় যাচ্ছে এখন,কে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।
তুমুল ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে সুরভীকে নিয়ে চলে গেলো। পূরবী তখনো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তারপর কখন যেনো পূরবী জ্ঞান হারালো তা পূরবী নিজেও জানতে পারলো না।হাত থেকে কাঁচের কাপ পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হলো।
পা থেকে রক্ত বের হয়ে রক্তে ভেসে গেলো পূরবীর পরনের শাড়ি।এতোগুলা মানুষ একটা ঘরে থাকার পরেও কেউ জানলো না কি হয়ে গেলো।
তানভীর বারবার কল দিতে লাগলো পূরবীকে।সুরভীর আজুতার সাইজ কতো তা জানার জন্য। কিন্তু পূরবী কল রিসিভ করলো না।বৃষ্টি থামলো রাত নয়টার দিকে। তানভীর বাড়িতে এসে দেখে সদর দরজা হাট করে খোলা,পূরবী দরজার সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। পাশেই ভাঙা কাঁচের টুকরো।
কেটে যাওয়া পা থেকে রক্ত বের হয়ে হলুদ শাড়ি এখন খয়েরী রঙের হয়ে গেছে।
বারকয়েক সুরভীকে ডাকলো তানভীর কিন্তু সাড়া পেলো না।প্রকৃতির ঝড় থেমে গেলেও সুরভীর জীবনে যে ঝড় উঠেছে তা যে থামে নি তা কি তানভীরের ধারণা ছিলো!
কখনো কি ভেবেছে কেউ!
চলবে…….