কোথাও কেউ ভালো নেই -১১,১২

0
1391

কোথাও কেউ ভালো নেই -১১,১২
জাহান আরা
১১

সুরভীর জ্ঞান ফিরলো কামরুলের কাঁধে। অচেনা লোকের কাঁধে নিজেকে দেখে সুরভী নেমে যাবার জন্য লাফ দিয়ে উঠলো। কামরুলের শক্ত হাতে চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না।কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো কঠোর হাতের লোকটা তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।

বাড়ির কথা ভাবতেই ভয়ে সুরভীর গলা শুকিয়ে গেলো। এই বাড়ি সুরভীর কাছে জেলখানার চাইতেও নিকৃষ্ট।সুরভী আকুল গলায় ডাকলো,”বুবু,বুবু গো কই তুই।আমাকে কেনো বাড়িতে পাঠিয়ে দিলি তুই?
আমি এখানে কিভাবে থাকবো?
আমি কি তোকে বেশি জ্বালিয়েছি না-কি? তবে কেনো তুই এভাবে লুকিয়ে আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলি বুবু?তোকে ছেড়ে আমি থাকবো কি করে। আমার আর কে আছে এই দুনিয়ায় তুই ছাড়া বুবু?
মা মরে গিয়ে তোর কাছে রেখে গেছে,তুই কার কাছে দিলি আমাকে বুবু?”

————–
তানভীর পূরবীকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো,পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।
হাতে পায়ে তেল মালিশ করতেই আস্তে-ধীরে পূরবী চোখ খুলে তাকালো।তারপর কোথাও সুরভীকে না দেখে চিৎকার করে বললো,”আমার বোন কই?
আমার বোনকে ওরা কেনো নিয়ে গেছে?আপনি আমার বোনকে নিয়ে আসেন।আমার বোন আমার কলিজার টুকরা। এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র আপনজন শুধু আমার বোনটাই আছে।এতো কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুবু বলে ডাকার জন্য আল্লাহ একটা মানুষকেই দিয়েছে।আমার বোনকে আপনি ফিরিয়ে আনেন না প্লিজ,কেনো গেলেন আপনি বাজারে।আপনি থাকলে তো ওরা আমার বোনকে নিয়ে যেতে পারতো না এভাবে।আপনার জন্য আমার বোনকে ওরা নিয়ে গেছে।”

পূরবীর কথা শেষ হলে তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”কে নিয়ে গেছে,আমাকে বলো আগে সব খুলে।”

পূরবী একে একে সব কিছু খুলে বললো। নিজের মায়ের ব্যবহারে তানভীরের মাথা লজ্জায় নিচু হয়ে গেলো।
সব বলার পর পূরবী আবারও কাঁদতে লাগলো। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি দিতে দিতে বললো,”আপনি এখনই যান,আমার বোন কে নিয়ে আসেন আপনি। আমি মরে যাবো আমার বোনকে না পেলে।আমার সুরভীর যে ভীষণ জ্বর ছিলো। ওকে যদি ছোট মা আবারও মারে ও তো মরে যাবে।আমার মা তো আমার হাতে দিয়ে গেছে এই ছোট্ট পাখিকে।আমি কেনো পারলাম না তাকে রক্ষা করতে। আপনি যান এখনই। ”
কিছু সময়ের জন্য ঝড় থেমে আবারও প্রলয়ঙ্কারী ঝড় শুরু হলো। মনে হচ্ছে যেনো আকাশ প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়বে।বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লাগার যোগাড়। মেঘে মেঘে আঘাত লেগে কড়াৎ কড়াৎ শব্দ হচ্ছে।

তানভীর পূরবীর হাত ধরে বললো,”কাল সকালেই যাবো পূরবী। এখন দেখো কেমন ঝড় হচ্ছে। এই রাতে আমরা কিভাবে যাবো বলো?
তুমি ও তো হাটতে পারবে না। ঝড় থামুক,দিনে গিয়ে নিয়ে আসবো।”

————–

সুরভীর গলা শুকিয়ে গেলো। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে সুরভীর।সুরভীদের ঘরের পিছনে পারভীনের কবর।সুরভী চিৎকার করে ডাকলো এবার নিজের মা’কে। মেয়ে থেকে ৫-৬ হাত দূরে মাটির ঘরে শুয়ে থাকা পারভীন পারলো না কোনো জবাব দিতে।

কামরুল ঠিক করেছে রাতটা এখানেই থেকে যাবে।এই ঝড়বৃষ্টির রাতে আর এতো দূরের পথ যাওয়া সম্ভব হবে না।কিছু মানুষকে শয়তান তার কঠিন অনুসারী বানিয়ে ফেলে,যাদের মানুষ বলে শয়তানের চ্যালা। কামরুল ও তেমন। লোকে কামরুলকে বলে, “বাঘে ছুঁলে হয় ১৮ ঘা, পুলিশে ছুঁলে হয় ৩৬ ঘা,আর ওসি কামরুল ছুঁলে হয় ১৩৬ ঘা।”
অর্থ ও নারী লোভী কামরুলের চোখে ৭ বছর বয়সী শিশু যা,২৭ বছরের যুবতী ও তা আর ৭০ বছরের বৃদ্ধা ও তা।
পূরবীকে দেখে কামরুলের মনে যে কামনার আগুন জ্বলে উঠেছে তা এই রাতের ঝড় যেনো আরো বাড়িয়ে দিলো।এই রাতে একটা নারীদেহ না পেলে কামরুলের কিছুতেই চলবে না।

সালমা কামরুলের মনোভাব বুঝতে পারলো। কিন্তু কিছু জানতে চাইলো না কামরুলের কাছে।আর না কোনো কিছু বললো। কামরুল থাকতে চাইলে সালমা সাদরে গ্রহণ করলো।
কামরুল হেসে বললো,”তোর ঘরে থাকলে মজা পামু না,তুই তো এখন ডিমওয়ালা মাছের মতো।”

কামরুলের অশ্লীল কথায় সালমা খিলখিল করে হাসলো।তারপর বললো,”ওই ঘরে দুইডা বিছানা আছে কামরুল ভাই।তোমার কোনো অসুবিধা অইবো না অই ঘরে। ”

সুরভীর ঘরে এসে কামরুল সুরভীকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখলো।হাটু পর্যন্ত পরনের সেলোয়ার উঠে আছে।সুরভীকে অচেতন মনে করে কামরুল হাত দিলো সুরভীর হাটুতে।একটা নোংরা স্পর্শে ঘৃণায় রি রি করে উঠলো সুরভীর সারা শরীর।
বিড়বিড় করে কামরুল বললো,”পা তো নয়,যেনো মাখন।ছোটটা এরকম কচি,বড়টা তো তাইলে একেবারে রসালো।শালার আমার **ভাগ্য আসলেই ভালো। এই রকম একটা রাতে এরকম তাজা ফুল কেউ পায় না-কি! ”

এসব অশ্লীল কথার মানে সুরভী না বুঝলেও এটুকু বুঝলো স্কুলে ম্যাডামরা মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্য সবসময় যেসব উপদেশ দিতো,যেসব লোকদের থেকে দূরে থাকতে বলতো এই লোকটা তেমনই লোক।এদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতেই কতো মেয়েরা নিজের প্রাণ ত্যাগ করে তবুও নিজেকে ধরা দেয় না এদের হাতে।

কামরুলের হাত সুরভীর কোমরে উঠে আসতেই সুরভী চিৎকার করে উঠে বসলো। তারপর বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে ধরলো কামরুলের গালে।দুই হাত দিয়ে কামরুল এলোপাতাড়ি কিল বসাতে লাগলো সুরভীর পিঠে।
মার খেয়ে সুরভীর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো কিন্তু তবুও ছাড়লো না সুরভী।
মেয়েদের মন অল্পতেই অনেক কিছু বুঝে যায়।তাই সুরভী ও বুঝে গেলো এই লোকটা তার সাথে খারাপ কিছু করতে চায়।কিছুতেই সে এই লোকের উদ্দেশে সফল হতে দিবে না।

কামরুল সুরভীর চুলের মুঠি চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই সুরভী ছেড়ে দিলো। কিন্তু যেটুকু সময় পেয়েছে তাতেই কামরুলের গাল কেটে রক্ত বেরুতে লাগলো।সুরভী নিজের জিহবায় রক্তের নোনতা স্বাদ পেলো।
বুনো পশুর মতো কামরুল হানা দিলো সুরভীর উপরে। ছোট পাখির বাচ্চার মতো হালকা শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো মানুষরূপি জানোয়ারের নিচে পড়ে।

সুরভীর দুই ঠোঁট কামড়ে ধরলো প্রচন্ড রাগে।ব্যথায় সুরভী চোখে সর্ষে ফুল দেখলো যেনো।অসুরের ন্যায় শক্তিশালী একটা লোকের সাথে এভাবে পেরে উঠবে না সুরভী বুঝতে পারলো।
একে এভাবে না অন্যভাবে পরাস্ত করতে হবে,যায় তবে প্রাণ যাবে তবুও এভাবে নিজেকে খাবলে খেতে দিবে না সে এই লোককে।
সুরভী নিজের নড়াচড়া বন্ধ করে দিলো।কামরুল ভাবলো সুরভী হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এমনিতেই সে দেখছে জ্বরে এই মেয়ের শরীর পুড়ে যাচ্ছে,তাছাড়া এরকম ছোট একটা মেয়ের তার সাথে পেরে উঠার কথা না এতোক্ষণ সময়।
আবারও একবার কামরুলের অহংকার হলো নিজের শক্তি দেখে।কামরুল সুরভীর দুই হাত ছেড়ে দিয়ে পরনের জামা টেনে খোলায় মনোযোগ দিলো।
দেহে অবশিষ্ট যেটুকু শক্তি ছিলো সুরভী সেটুকু সঞ্চয় করে লাফিয়ে উঠে নিজের দুই আঙুল ঢুকিয়ে দিলো কামরুলের একচোখে।
একটা তীব্র আর্তনাদ এই ঝড়-ঝঞ্ঝা ভেদ করে সালমার কানে গিয়ে পৌছালো। চোখ চেপে ধরে কামরুল গোঙ্গাতে লাগলো। চোখ থেকে রক্ত পড়ছে তার।
দুই লাফে সুরভী উঠে নেমে গেলো বিছানা থেকে। তারপর সোজা গিয়ে ঘরের তাকে থাকা ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে নিলো। চোখ চেপে ধরে কামরুল হাতড়ে হাতড়ে উঠে এলো সুরভীকে ধরার জন্য। সুরভী দ্রুত দৌড়ে বের হয়ে গেলো।
বিষক্রিয়া ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। নীল হয়ে গেলো ফর্সা মুখখানা। অবসন্ন দেহটা কোনোমতে নিয়ে গেলো মায়ের কবরের উপর। চিৎকার করে পূরবীকে ডেকে বললো,”বুবু রে, ও বুবু…..
আমি মরে যাচ্ছি রে বুবু,আর কোনো দিন তোর বোন তোকে ডাকবে না রে বুবু।আর জ্বালাবে না তোকে। তোলে আর বোনের চিন্তা করতে হবে না।এই পৃথিবীর মানুষেরা বড়ই নিষ্ঠুর বুবু,এরা সবাই একটা নোংরা মন নিয়ে চলাফেরা করে। এরা আমাকে আরো কয়েকটা দিন বাঁচতে দিলো না এই পৃথিবীতে। মা একজন এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর মানুষেরা তাদের আসল রূপ দেখিয়ে দিলো আমাকে।আমার আশ্রয় কারো কাছেই হলো না বুবু।তুই ও পারলি না আমাকে আশ্রয় দিতে।আমি আবার আমার মায়ের কাছে চলে যাচ্ছি।আমার মা-ই পারবে শুধু আমাকে তার বুকের মধ্যখানে জায়গা দিতে।”
তারপর মায়ের কবর জড়িয়ে ধরেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো একটা অবুঝ ও নিষ্পাপ পাখি। যে পাখি আর তার মধুর সুরে বুবু বলে ডাকবে না কাউকে।যে পাখি আর বারবার ক্ষিধে পাওয়ায় বোনকে জ্বালাতন করবে না।
যাকে নিয়ে সবার চিন্তা ছিলো,সবার চিন্তার অবসান ঘটিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে।

চলবে……..

জাহান আরা

কোথাও কেউ ভালো নেই ১২

সারা রাত পূরবী অপেক্ষায় ছিলো কখন পূব আকাশে সূর্য উদয় হবে।অপেক্ষা করতে করতে পূরবীর মনে হলো আজকের রাতটা যেনো পৃথিবীর দীর্ঘতম রাত।কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। ঘড়ির কাটা সেকেন্ডের ঘর পার হতেও যেনো ঘন্টা লাগছে।
অবশেষে তিমির কেটে উদয় হলো ভোরের আলো,সারা জাহান ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো।
ঝড়ের আঘাতে ভেঙে গিয়েছে গাছপালা,মানুষের ঘরবাড়ি।
লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে সব।প্রকৃতি শান্ত হয়ে আছে।যেনো গতরাতে কিছুই হয় নি। ভোরের ঠান্ডা বাতাস মন প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে সবার।শুধু পূরবী টের পাচ্ছে,বাতাসে আজ ভেসে বেড়াচ্ছে যেনো একটা চাপা গুঞ্জন।
কে জানে কিভাবে পূরবীর মন সেই গুঞ্জন টের পেলো। যেনো বাতাস ফিসফিস করে পূরবীকে কোনো দুঃসংবাদ দিচ্ছে।
পূরবীর বুকের ভেতর জ্বলছে ধিকিধিকি আগুন।ছোট বোনটা কেমন আছে না জানা পর্যন্ত এই আগুন নিভবে না।
এতো বড় একটা পৃথিবীর কেউ-ই জানলো না একটা মেয়ে বুকের ভেতর চেপে রেখেছে একটা দুঃখের নদী। যে নদীর ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে যাচ্ছে মেয়েটার ছোট্ট বুকটা।

নামাজ পড়েই তানভীর পূরবীকে নিয়ে বের হলো। তানভীরের মোটেও ইচ্ছে ছিলো না দ্বিতীয় বার ওই বাড়িতে যাওয়ার। কিন্তু পূরবীর জন্য যেতে হচ্ছে।
আড়চোখে তাকালো পূরবীর দিকে তানভীর। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে পূরবী।

পূরবী নিজেদের বাড়িতে পা দিতেই টের পেলো বাড়িটা আজকে নিরব হয়ে আছে। এক অজানা ভয় পূরবী কে চেপে ধরলো। বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো পূরবীর।
জোর গলায় পূরবী ডাকলো সুরভীর নাম ধরে।

একবার ডাকলো,দুইবার ডাকলো,তারপর বারবার ডাকলো।
নেই নেই নেই,কোথাও নেই আজ সেই কোকিলকণ্ঠী। পূরবী ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো পূরবীর কাছে। কেউ জবাব দিলো না।
সালমা বিরক্ত হলো ভীষণ। এতো ভোরে আবারও এরা এসে হাজির হয়েছে।
কামরুল এক চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। অন্য চোখে সে দেখলো ঘরের পিছনে সুরভী শুয়ে আছে। সুরভীর মুখ দেখেই কামরুল বুঝে গেলো এই মেয়ে আর বেঁচে নেই।তড়িঘড়ি করে কামরুল বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। পূরবীদের পাশ দিয়েই ছুটলো সে কেউ কিছু জানার আগেই।এই বাড়ি থেকে বের হবার আর কোনো দ্বিতীয় রাস্তা নেই।

কামরুল কে ওই ঘর থেকে বের হতে দেখে তানভীর দৌড়ে এলো ঘরে। কোথাও সুরভীকে পেলো না।
ডাকতে ডাকতে ঘরের পিছনে গেলো। পূরবী ও গেলো তানভীরের পিছনে।
সুরভীকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তানভীর ডাকতে নিলো।পূরবী থামিয়ে দিয়ে বললো,”ডাকবেন না ওকে,সুরভী ঘুমাচ্ছে।ঘুমাক ও,আপনি কোলে করে নিয়ে ওরে ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিন।আর দেখুন তো ওর জ্বর আছে কি-না। ”

তানভীর সুরভীর গায়ে হাত দিতেই ওর সারা শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। এই শরীর তো বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে।
চমকে তাকালো নিজের বউয়ের দিকে।পূরবী দেখলো তানভীরের দুচোখ আস্তে আস্তে জলে টইটম্বুর হয়ে যাচ্ছে। তারপর টুপ করে এক ফোটা জল শিশির বিন্দুর মতো ঝরে পড়লো তানভীরের চোখ থেকে।

তানভীর আস্তে করে বললো,”সুরভীর ঘুম আর কখনো ভাঙবে না পূরবী। ”

একটা কথাই পূরবীর চিন্তাভাবনা সব কিছু এলোমেলো করে দিলো। ধপ করে মাটিতে বসে গেলো পূরবী। তারপর কোমল সুরে বললো,”চলে গেছে?
মায়ের কাছে বুঝি নিয়ে গেছে মা ওকে?
মা ওকে বেশি ভালোবাসতো তো,ছোট বলে। তাই বুঝি আদরের মেয়েকে ছেড়ে মা থাকতে পারলো না বলেন?
দেখলেন তো,এই দুনিয়ায় আমাকে কেউ-ই ভালোবাসে না।আমাকেও সাথে নিলে কি এমন ক্ষতি হতো মা’য়ের?
আমি কি সুরভীর আদরে ভাগ বসাতাম না-কি বলেন? ”

পৃথিবীর সব ভাষা যেনো আজ থেমে গেছে পূরবীর কথা শুনে।কি জবাব দিবে পূরবীকে তানভীর?

সুরভী কে কোলে করে নিয়ে গেলো তানভীর। উঠোনে পাটি পেতে শোয়ালো সুরভীকে।বিষে নীল হয়ে যাওয়া মানুষটার মুখে যন্ত্রণার চাপ।
তানভীর পূরবীর দিকে তাকালো,পূরবী ও তাকালো তানভীরের দিকে।
যা বুঝার পূরবী বুঝতে পেরে গেছে।বোনের পায়ের পাশে বসে পূরবী বললো,”কাউকে কিছু বলবেন না প্লিজ,আমার অনুরোধ রইলো। পুলিশ জানতে পারলে আমার বোনটাকে পোস্টমর্টেম করতে নিবে।আমার বোনকে তো আমি ফিরে পাবো না আর।তবে শুধু শুধু এসব করে কি লাভ হবে।তাছাড়া আজকাল মর্গেও মেয়েদের লাশ নিরাপদ না।”

তানভীর পূরবীর কথায় যতোটা আঘাত পেলো তারচেয়ে বেশি অবাক হলো পূরবীকে এরকম শান্ত থাকতে দেখে।কোনো চিৎকার করছে না,কাঁদছে না।কেমন শান্ত হয়ে আছে।
যেনো কিছুই হয় নি।সুরভী মরে যাবারই ছিলো যেনো।গতরাতের দেখা সেই অস্থির মেয়েটার সাথে আজকের এই শান্ত মেয়েটির কোনো সাদৃশ্য তানভীর খুঁজে পেলো না।
পূরবীর হাত ধরে তানভীর কেঁদে দিয়ে বললো,”পূরবী তুমি কেনো কাঁদছো না,তোমার এই শান্ত ভাব আমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি একটু কাঁদো পূরবী,কেঁদে হালকা হয়ে নাও তুমি। ”

মুচকি হাসলো পূরবী। তারপর হেসে বললো,”কেনো কাঁদবো বলেন?
যাকে আমি নিজেই শক্ত হাতে ধরে রাখতে পারলাম না তার জন্য এখন মায়া কান্না করে কি লাভ হবে?
আমার বোনটাও বুঝি বুঝে গেছে যে তার বোন একটা অযোগ্য মেয়ে,দায়িত্বজ্ঞানহীন মেয়ে।তাই তো সে মায়ের কাছে চলে গেলো। আমার তো খুশি হবার কথা।আমার আর কোনো পিছুটান নেই।কাউকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না।আমি এখন সুতো কাটা ঘুড়ি।”

পূরবীর বলা প্রতিটি কথা যেনো কাঁটার মতো বিঁধছে তানভীরের বুকে।তানভীর জানে এই মেয়েটা মেন্টালি আনস্টেবল,এ কি বলছে কিছুই বুঝে বলছে না।
পূরবী গিয়ে সালমা কে ডেকে বললো,”ছোট মা,সুরভী মরে গেছে। আর কোনো যন্ত্রণা রইলো না আপনার। ”

সালমা চমকে গেলো পূরবীর কথা শুনে।সুরভী মরে যাবে এটা তার ভাবনাতেও ছিলো না। মারুক আর যাই করুক,মেরে ফেলতে চায় নি সালমা কখনো। ছুটে এলো সালমা উঠানে। সুরভীর লাশ থেকে বুক কেঁপে উঠলো সালমার।
পূরবী বললো,”ভয় পাবেন না।আমার কোনো অভিযোগ নেই কারো উপর। আল্লাহ বিচার করবে যাদের জন্য আমার বোন আজ দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে। ”

তানভীরের সহ্য হলো না।সালমার দিকে তেড়ে গেলো সে,পূরবী বাঁধা দিলো।

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সুরভীর দাফনকার্য শেষ হয়ে গেলো। গোসল করাতে গিয়ে পূরবী দেখতে পেলো সুরভীর গায়ে নখের আঁচড়।ঠোঁটে কামড়ের দাগ।
বুক ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস এলো পূরবীর। সব কিছু বুঝে গেলো পূরবী।
১০-১২ জন মানুষ নিয়ে জানাজা পড়িয়ে পারভীনের পাশেই কবর দিলো সুরভীকে।

দুপুরের মধ্যেই পূরবী চলে গেলো নিজের শ্বশুর বাড়ি। নিজের রুমে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলো।
শান্ত পূরবীকে দেখে তানভীরের বুক ফেটে যাচ্ছে। কেনো এই মেয়েটা এতো শান্ত হয়ে আছে?
কেনো একটুও আহাজারি করছে না।এতো ব্যথা বুকে জমিয়ে রাখলে ব্যথার চাপে যে এই মেয়েটাও মরে যাবে।
তানভীর বললো,”আমাদের থানায় যাওয়া উচিত ছিলো পূরবী। এভাবে কেনো ছেড়ে দিবে এদেরকে?”

পূরবী বললো, “আইনের রক্ষক যখন ভক্ষক হলো,বিচার করবে কে?আমার বোনকে ওই লোকটা রেপ করতে চেয়েছিলো।যখন আর লড়ার শক্তি পায় নি সুরভী তখনই বিষ খেলো।

আমার বোন কি ফিরে আসবে পুলিশের কাছে গেলে?
আমাদের কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে?
অযথা আমার বোনের লাশটা কাটাছেঁড়া হবে।কম তো যন্ত্রণা পায় নি ও বেঁচে থাকতে,মরে গিয়ে ও শান্তি দিবো না বলেন?
আর কতো?”

তানভীর চুপ করে রইলো।তানভীরের মা ডাকলো দুপুরে তানভীর কে ভাত খেতে যেতে।
তানভীরের আগে পূরবী গেলো খাবার জন্য।পিছন পিছন তানভীর ও গেলো।আর দিনের চাইতে ভালো করে খেলো আজ পূরবী।নিজ থেকে চেয়েই মাছ দুই পিস নিলো।
তানভীর খেতে পারলো না।ভাত নিয়ে নেড়েচেড়ে উঠে গেলো। কাউকে কিছু বললো না বাবাকে ছাড়া।

তমিজ মিয়া ব্যথাতুর নয়নে তাকালো পূরবীর দিকে।চেহারায় কোনো কষ্টের ছাপ নেই,শান্ত হয়ে খাচ্ছে মেয়েটা।
তমিজ মিয়া অবাক হলো পূরবীর সহ্যশক্তি দেখে।কিভাবে হজম করলো মেয়েটা সব?এইটুকু একটা মেয়ের এতো সহ্যশক্তি কিভাবে হলো?

তানভীরের মনে অনুশোচনা জাগতে লাগলো,”কেনো সে রাতে নিয়ে গেলো না পূরবীকে!”

তানভীর কিছু বলার আগে পূরবী নিজেই বললো,”গত রাতে যদি ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমি একবার বাড়ি যেতাম,তবে হয়তো আমার বোনটা আজ বেঁচে থাকতো। আপনি গেলেন না আমাকে নিয়ে। ”

তানভীর কি জবাব দিবে বুঝতে পারলো না। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পূরবীর দিকে।যেই ঝড় ছিলো তাতে বের হবার কোনো অবস্থা ছিলো না তার উপর পূরবীর পায়ের অবস্থা ও খারাপ ছিলো। পূরবী জানালায় মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here