ক্যানভাস-পর্ব : (৩)

0
601

#ক্যানভাস-পর্ব : (৩)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

৬!!
মেঘের বাবা-মা আজ খুব খুশি মেঘের সাকসেসে। মেঘের মা মেঘকে জড়িয়ে বললেন,

_আমি জানতাম আমার মেয়েটা পারবে। যে মেয়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে দিনরাত এই একটা মানুষের চোখ নিয়ে পড়ে থাকত সে পারবে না সেটা হতেই পারে না।
_থেংক ইউ মা। সবই তোমাদের দুজনের দোয়া।
_আচ্ছা মেঘ তুই এই স্কেচটা আঁকলি কীভাবে? তুই তো ছেলেটাকে দেখিসনি?
_দেখিনি তো কি হয়েছে? ওর আবছা চেহারার যে ছবি আমার হৃদয়ে আঁকা সেটা তো মুছার নয়। আর গুড নিউজটা কী জানো? এই চেহারায় মানুষ সেদিনের সেই ছেলেটা।
_কোন ছেলে?
_ওই যে যেদিন নিজে না এসে বন্ধুকে দিয়ে আমাকে পানির বোতল পাঠিয়েছিল সে।
_একদিন নিয়ে আসবি বাসায়?
_আমি নিজেই তো থাকে সরাসরি দেখলাম না।
_দেখা-সাক্ষাৎ হলে একদিন নিয়ে আসবি।
_আচ্ছা আনব। জানো মা সে তাঁর বন্ধুকে দিয়ে আমার কাছে কিছু ক্যানভাস চেয়েছে।
_সমস্যা নেই, তোর আঁকা বেষ্ট ক্যানভাস গুলো থেকে কয়েকটা ক্যানভাস তাকে গিফট করবি।
_না মা আমি পুরোনো কিছু থাকে দিতে চাইনা। আমি চাই নতুন আর স্পেশাল কিছু তাঁর জন্য তৈরী করতে। যে আমার স্বপ্নে এসে আমাকে এতো জ্বালায় তাকে সামনাসামনি এই সামান্য উপহার গুলো নিজের হাতে দিতে চাই।
_তাহলে নতুন করে আঁকতে শুরু কর।
_হুম, সেটাই করব।

মেঘ মাকে ছেড়ে বাবা-মায়ের সাথে একসাথে ডিনার করতে করতে অনেক আড্ডা দেয়। রাত প্রায় বারোটা। সাকিব, (শ্রাবণের অন্য আরেক বন্ধু) শ্রাবণকে কল করল, শ্রাবণ ঘুমঘুম চোখে সাকিবকে বলল,

_আরে ইয়ার কাল সকালে মিটিং আছে, এত রাতে কী বলতে ফোন করলি?
_শালা পাগল, তোকে নিয়ে গোটা দেশ দিশেহারা আর তুই কি না নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিস?
_আজব! আমি কি কোথাও গিয়ে চোরাকারবারি করেছি না’কি যে পুরো দেশ আমাকে খুঁজবে?
_আরে বুদ্ধু তাড়াতাড়ি নিউজ দেখ, একটা মেয়ে পুরো দেশকে চমকিয়ে দিয়েছে তোর স্কেচ এঁকে তাও তাঁর স্বপ্নে।
_হোয়াট!

শ্রাবণ কল কেটে তাড়াতাড়ি ফোনের ডাটা অন করে। ইন্টারনেটের নিউজফিড গুলো দেখতে তাকে। একটা স্কেচ আর নিচে কিছু কথা লেখা। শ্রাবণ লেখাটা পড়তে থাকে। “এটা আমার ড্রিমের একটা অংশ, এই ছবিটার মানুষ রোজ আমার স্বপ্নে এসে আমার সাথে কথা বলে, তাঁর কথা ফুরিয়ে গেলে সে হারিয়ে যায়, জানিনা সে আদৌ এই পৃথিবীতে আছে কি’না? যদি সে এই পৃথিবীতে থাকে আর যদি সে কখনও আমার সামনে আসে, অনেক কথা বলবো তাকে। অনেক কথা বাকি আছে বলার, তবে জানিনা সেই কথাগুলো শোনার সময় তাঁর হবে কি’না”
—“কাশফিয়া হাসান মেঘ”

শ্রাবণ লেখাটা পড়ে হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ একা-একাই হাসল এরপর স্কেচটা মনোযোগ দিয়ে দেখল। শ্রাবণ বেশ অবাক হলো, হুবহু দেখতে শ্রাবণের মতো। স্কেচটা দেখে শ্রাবণ মনে মনে ভাবতে লাগল,

_এটা কীভাবে সম্ভব! একটা মানুষ আমাকে না দেখে আমার পুরো ফেইসটা আর্ট করে ফেলল। এমনকি বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি আর্টে, এতো গুছালো আর্ট কেউ কীভাবে আঁকতে পারে? জানতে হচ্ছে কে এই মেয়ে? দেখতে তো তাকে হবেই।

শ্রাবণ একা-একা এসব বিড়বিড় করছে আর মেঘকে নিয়ে ভাবছে। হুট করে আবারও শ্রাবণের ফোন বেজে উঠলো। শ্রাবণ ফোন হাতে নিয়ে দেখে ‘মহারানী ভিক্টোরিয়া’ সেইভ নাম থেকে কল এসেছে। এই মহারানী শ্রাবণের গার্লফ্রেন্ড আনিকা। একজন আরেকজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। শ্রাবণ ভাবল ঘন্টা খানেক আগেও কথা হয়েছে তাহলে এতো রাতে আবার কেন ফোন করল, কোনো সমস্যা হলো না’তো? এসব ভাবতে ভাবতে শ্রাবণ কল পিক করে।

_জ্বী মহারানী আপনার মহারাজ বলছি। এত রাতে ফোন করলে যে, ঘুম আসছে না বুঝি?
_একদম ফাজলামি করবা না।
_রাত-বিরেতে আমি তোমার সাথে ফাজলামি করছি?
_আমার তো তাই মনে হচ্ছে।
_একদম ঝগড়ার সাইডে যাবা না বলে দিলাম।
_না না আজ এতো রাতে ঝগড়া করছি না কাল তোমাকে দেখাব মজা, অফিসে আসো একবার।
_কাল মিটিং আছে সোনা, তোমাকে টাইম দিতে পারব না।
_তুই দিবি তোর বাপ ও দিবে।
_তাহলে যাও আমার বাবার সাথে ডেটিং করো।আমাকে কেন ফোন করেছো?
_প্লিজ এমন করো না।
_তুমি আমার রাগটা বাড়িয়ে দিচ্ছো আনু।
_সরি গো, আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলবে?
_আমি কবে তোমাকে মিথ্যে বলেছি?
_না কখনও বলনি, এইজন্য মাঝেমধ্যে ভয় লাগে যদি কখনও তোমায় হারিয়ে ফেলি?
_বাজে কথা বন্ধ করে কী বলতে ফোন করেছো সেটা বল।
_ওই মেয়েটা কে শ্রাবণ? যার স্বপ্নে রোজ তুমি যাও, যার সাথে অনেক অনেক আড্ডা দাও স্বপ্নের মাঝে।
_তুমি সেই চিত্রশিল্পীর কথা বলছো, আরে বুদ্ধু আমি তো ওই মেয়েটাকে চিনি না। দেখিনিও নি কোনোদিন।
_তাহলে ওই মেয়েটা না দেখলে তোমার স্কেচ আঁকলো কীভাবে?
_মেয়েটা তো বলেই দিয়েছে সে আমাকে তাঁর মাঝে রোজ দেখে তাই তো আন্দাজ করে এঁকে ফেলেছে।
_সত্যি তুমি মেয়েটাকে চিনো না?
_নারে বোকা চিনিনা, কেন তোমার ভয় হচ্ছে?
_খুব!
_একদম ভয় পেয়ো না, আমি শুধু তোমার।
_ভুল করেও ওই মেয়েকে ফলো করার চেষ্টা করবা না বলে দিলাম।
_আচ্ছা করব না, এইবার ঘুমাতে দাও প্লিজ, সকালে মিটিং এ্যাটেন্ড করতে হবে।
_হুম, গুড নাইট।
_লাভ ইউ, গুড নাইট।

আনিকা ফোন কেটে দিলে শ্রাবণ ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে ‘আমার পাগলিটা’ এরপর বালিশে মাথা রেখে ঘুমে তলিয়ে যায়।

৭!!
প্রতিদিনের মতো মেঘ আজকেও ফজরের আজানের সময়টাতে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে। আজকের স্বপ্নটা একটু ভিন্ন হলেও মেঘের মুখে একটু হাসির রেখা আছে। কারণ আজে মেঘের স্বপ্নে শ্রাবণের সম্পূর্ণ চেহারা সুন্দর ভাবে ভেসে উঠেছে। শ্রাবণ মেঘকে স্বপ্নের মাঝে এসে ‘কনগ্রেচুলেশন’ জানাচ্ছে আরো কতরকম গল্প করছে দু’জনে মিলে? মেঘ মনে মনে ভাবে,

_এসব কি শুধুই স্বপ্ন নাকি আমার একাই সাজিয়ে যাওয়া কিছু আবেগের মুহূর্ত? সবটাই কি এইভাবে থাকবে নাকি অজানায় হারাবে? কিছু বুঝতে পারছি না। দিনকেদিন আমি কেমন ওর প্রতি উইক হয়ে যাচ্ছি? যাকে চিনিনা, জানিনা তাকে নিয়ে ভাবা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু কেন সে আমাকে এইভাবে জ্বালায়? কেন আসে রোজ আমার স্বপ্নে? কি চাই তাঁর আমার কাছে? হে আল্লাহ, তুমি বলে দাও আমি কি করবো?

এসব ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে প্রতিদিনের মতো নামাজ পড়ে ক্যানভাস নিয়ে বসে। আর্ট কমপ্লিট করে নাশতা শেষ করে ছাদের দুলনায় দুলে একটু বাইরের হাওয়া-বাতাসের মাঝে জুড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মেঘ ভাবনার জগতে হারিয়ে যায়। ভাবতে থাকে শ্রাবণকে নিয়ে। নানারকম ভাবনা নানানভাবে মেঘের মনে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে। ফোনের টিউনে ঘোর কাটে মেঘের। তাকিয়ে দেখে সামি ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে মেঘ কথা বলা শুরু করল,

_কেমন আছো?
_এইতো ভাল, তুমি?
_আলহামদুলিল্লাহ! কিছু বলবে।
_মানুষ কি বলার জন্যই ফোন করে?
_না ঠিক তা নয়, এমনি কৌতূহল জাগলো তাই জিজ্ঞেস করলাম।
_আমরা কি দেখা করতে পারি?
_আজকে?
_হ্যাঁ আজকে, পারবে আসতে।
_বিকেলে আসি, এখন বের হতে পারবো না।
_তুমি যখন ফ্রি থাকো তখন আসলেই হবে।
_আচ্ছা ঠিক আছে, বের হওয়ার আগে আমি ফোন করব।

মেঘ ফোন কেটে আবারও ভাবনায় তলিয়ে যায়। অন্যদিকে সামি খুশিতে লুঙ্গি ডান্স দিতে শুরু করে। এতদিনে একটা মেয়েকে ভালো লেগেছে সামির। যে কিনা একেবারে সাদাসিধে, কোনো অহংকার নেই, মুহূর্তেই কেমন যেন আপন হয়ে গেছে। মন কেড়ে নেয় তাঁর মিষ্টি মিষ্টি কথায়। যে কেউ নির্দ্বিধায় প্রেমে পড়বে এই মেয়ের। তেমনি সামিও পড়েছে। সামি ভাবছে মেঘকে নিয়ে, মেঘ ভাবছে শ্রাবণকে নিয়ে আর শ্রাবণ ভাবছে আনিকাকে নিয়ে। একেবারে ত্রিংগেল লাভ যাকে বলে, ওদের ক্ষেত্রেও তাই।

শ্রাবণ অফিসে মিটিং শেষ করে নিজের ডেস্কে বসে বসে কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল চেক করছে। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে আনিকা এসে দাঁড়িয়ে আছে। আনিকার একটাই অভ্যাস শ্রাবণ অনুমতি না দিলে ভেতরে আসবেই না। ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। আনিকা কিছু না বলে চুপ করে আছে। শ্রাবণ চেয়ার থেকে উঠে দুহাত প্রসারিত করে মেলে ধরে, আনিকা ছুটে আসে শ্রাবণের বুকে। শ্রাবণের বুকে মাথা রাখতেই আনিকার সব চিন্তা মুছে গেল। যত চিন্তা ছিল শ্রাবণকে নিয়ে।কিছুসময় পর শ্রাবণ আনিকা ছেড়ে চেয়ারে বসতে বলে আনিকা শ্রাবণের কথায় বলল,

_বসব না, চলো বাইরে যাব।

আনিকা শ্রাবণের হাত টেনে ধরে। শ্রাবণ হাত ছাড়িয়ে আনিকাকে চেয়ারে বসায়। শ্রাবণের এমন কাজে আনিকা গাল ফুলিয়ে বসে রইল চেয়ারে। শ্রাবণ আনিকার দিকে তাকিয়ে বলল,

_দশমিনিট বসো, আমি হাতের ফাইলটা রেখে তোমাকে নিয়ে বাইরে যাব, আজ সারাদিন আমরা ঘুরব।
_সত্যি!
_হ্যাঁ সত্যি।

শ্রাবণ আনিকাকে হাসিয়ে ফাইল চেক করতে লাগল। ফাইল চেক করা শেষ হলে কয়েকটা সিগনেচার করে ফাইলটা ম্যানেজারকে ডেকে তাঁর হাতে তুলে দিল। এরপর আনিকাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হলো। শ্রাবণ ড্রাইভ করছে আর আনিকা শ্রাবণের বামহাত টাইট করে ধরে শ্রাবণের কাঁধে মাথা রেখে শান্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী কাপল। যে দেখবে সেই হিংসে করবে।

সামি একটা কফি-শপে বসে আছে মেঘের জন্য। মেঘ দরজা গিয়ে ভেতরে আসতেই সামি হাত নাড়া দিয়ে মেঘকে ডাকে। মেঘ মুচকি হেসে সামির অপজিটের চেয়ারে বসে। সামি মেঘকে বলল,

_আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি?
_না, কি অবস্থা তোমার?
_এইতো,
_কখন আসছো?
_ত্রিশ মিনিট আগে।
_ইশ! আ’ম সরি। আমার জন্য আধাঘন্টা কষ্ট করে অপেক্ষা করতে হলো।
_মানুষ তো আপনজনদের জন্যই অপেক্ষা করে। সে অপেক্ষা ঘন্টা, মাস, বছর হিসেব করে না করে শুধু আপনজনদের অপেক্ষা।
_বুঝলাম না!
_দূর বোকা, বন্ধু কি আপন হয় না?
_ওহ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
_কি খাবে বলো অর্ডার করি?
_শুধু একটা চকলেট ফ্লেভার আইসক্রিম।
_শুধু আইসক্রিমে পেট ভরবে?
_আইসক্রিম কি পেট ভরে খাওয়ার জিনিস?
_আর কিছু অর্ডার করি আইসক্রিমের সাথে।
_তোমার পছন্দের কিছু করো।
_ওকে।

সামি ওয়েটারকে ডেকে মেঘের পছনের আইসক্রিম অর্ডার করলো। কিছুসময় পর ওয়েটার সব অর্ডার করা খাবার নিয়ে আসলো। দুজনে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আর কফি খাচ্ছে। কফি খেতে খেতে হঠাৎ মেঘের চোখ পড়ে পাশের ডানসাইডের চেয়ারে বসা দু’জন কাপলকে। মেঘ বেশ অবাক হয় শ্রাবণকে এখানে দেখে। আরো বেশি অবাক হয় শ্রাবণের পাশে বসা মেয়েটাকে দেখে। দুজনে একে অপরকে খাইয়ে দিচ্ছি আর প্রেমালাপ করছে। বিষয়টা মেঘের হৃদয়ে গিয়ে হার্ট করলেও পরক্ষণেই ভাবল, সবাই তো আর সিংগেল না। নিশ্চয়ই শ্রাবণ ওই মেয়েটাকে ভালোবাসে, নয়তো এভাবে কেউ খোলা মাঠে কাউকে জড়িয়ে ধরত না। এসব ভাবতে ভাবতে মেঘ আবারও ভাবে, শুধু শুধু শ্রাবণকে নিয়ে কেন এতো মাথা ঘামাচ্ছে?

শ্রাবণ তো শুধু ওর স্বপ্নে, বাস্তবে ওর কেউ-ই হয় না, যে কেউ হয় না তারজন্য ভাবনা সাজানো বোকামির কাজ। এইভেবে মেঘ আবারও সামির সাথে আড্ডা দিতে মন দেয়। কিন্তু; কোনভাবেই আড্ডায় মন বসাতে পারছে না, কারণ ওর স্বপ্নের রাজকুমার অন্য একটা মেয়ের সাথে এই বিষয়টা মেঘকে ভীষণভাবে কষ্ট দিচ্ছে। মেঘ না চাইতেও বারবার শ্রাবণের দিকে তাকাচ্ছে। দু’চোখ ভরে দেখছে তাঁর অপরিচিত সেই অচেনা চেহারার মানুষটাকে, যাকে জীবনে কখনও সামনাসামনি দেখেনি। খুব ইচ্ছে ছিল মেঘের, স্বপ্নের মানুষটাকে সামনাসামনি দেখবে। আজ যখন দেখল তখন খুশি হওয়ার বদলে কষ্ট পেল, যার কারণ তাঁর স্বপ্নের রাজকুমারের হাত অন্য একজন শক্ত করে ধরে আছে। শুধু সেই মেয়েটা একাই হাত ধরেনি শ্রাবণ নিজেও আনিকার হাত ধরেছে। মেঘ শ্রাবণকে দেখতে দেখতে বুঝতেই পারল না, ওর চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু জমে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে সামি মেঘের সাথে বকবক করে মেঘের কোনো সাড়া পাচ্ছে না। সামি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মেঘ অন্যমনস্ক। সামি মেঘের চোখের সামনে তুড়ি বাজায়, মেঘ ঘাবড়ে উঠে।সামি মেঘকে বলল,

_তোমার চোখে পানি কেন?
_মনে হয় ধুলো পড়েছে।
_দাঁড়াও আমি দেখছি।
_ইট’স ওকে সামি, সেরে যাবে। তেমন বেশি জ্বালা করছে না। সামি আমরা কি উঠতে পারি?
_হ্যাঁ শিওর।

সামি, মেঘ দুজনে রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মেঘ চাইছিল মেঘ বিল পেমেন্ট করুক কিন্তু সামি মেঘকে বিল দিতে দেয়নি, বরং মেঘকে বকে দিয়েছে। এদিকে শ্রাবণ, বিল পেমেন্ট করে আনিকাকে নিয়ে বের হতে যাবে ঠিক তখনই মেঘ পিছু ঘুরে দাঁড়াতে যায় অমনি পা মচকে পড়তে গেলে সোজা শ্রাবণের উপর পড়ে। শ্রাবণ টাল সামলাতে না পেরে সোজা ফ্লোরে গিয়ে পড়ে, আর মেঘ শ্রাবণের বুকের উপর। মেঘ চোখ বন্ধ করে শ্রাবণের শার্টের কলার চেপে ধরে আছে। শ্রাবণ মেঘের মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে ভুলে যায় সে অলরেডি ফ্লোরে। আনিকার চিৎকারে শ্রাবণ ঘাবড়ে যায়। ফ্লোর থেকে উঠতে যাবে তখন দেখে মেঘ শ্রাবণের উপর। আনিকা রেগে মেগে বলল,

_এই মেয়ে লজ্জা করে না তোমার। অন্যের বয়ফ্রেন্ডকে জড়িয়ে ধরতে।

আনিকার এই কথাটা মেঘের ইগোতে গিয়ে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে। মেঘ তো ইচ্ছে করে পড়েনি, হঠাৎ করে কিভাবে যেন পা’টা মচকে গেল? মেঘ আনিকার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে শ্রাবণের থেকে সরে আসতে চেষ্টা করে অমনি আবার ফ্লোরে বসে পড়ে। পায়ে খুব লেগেছে বিধায় কারো হেল্প ছাড়া উঠা মেঘের সাধ্যে নেই। মেঘ ফ্লোরেই বসে রইল। শ্রাবণ নিজেকে সামলে মেঘকে তুলতে হাত বাড়ায়, ঠিক তখনই সামিও নিজের ডানহাতটা বাড়িয়ে দেয় মেঘের দিকে। মেঘ সামির দিকে তাকিয়ে সামির হাতটা শক্ত করে ধরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর আনিকাকে বলল,

_সবটা না দেখে কাউকে এইভাবে দোষারোপ করা অন্যায়।
_কী বলতে চাইছো তুমি?
_এটাই যে, আমি সেচ্ছায় আপনার বয়ফ্রেন্ডের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়িনি।
_ওহ, তুমি এটা বলতে চাইছো আমি মিথ্যেবাদী।
_শুধু শুধু আমি আপনাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করতে যাবো কেনো? আপনি আমার কোন জন্মের শত্রু?
_আজব মেয়ে মানুষ তো তুমি! নিজেই আমার বয়ফ্রেন্ডকে ফেলে দিয়ে এখন আবার বড় বড় কথা বলছো।
_তাই নাকি! তা আপনি নিজেই আপনার বয়ফ্রেন্ডকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমি ইচ্ছে করে ওনাকে ধাক্কা মেরে ফেলেছি কি’না?
_ওকে।

আনিকা মেঘের থেকে সরে শ্রাবণের কাছে যায়। শ্রাবণ কিছু বলে উঠার আগেই সামি মেঘকে বলল,

_এইসব থার্ডক্লাস মানুষের সাথে কথা না বলাই ভালো। যারা মিনিমাম ভদ্রতাটুকু জানে না তাদের সাথে কথা বলে নিজেকে ছোট করো না তো।
_ঠিক বলেছ, আমি ভুলেই গেছিলাম সবার মন-মানসিকতা এক হয় না। চলো সামি…

৮!!
মেঘ আর একমিনিট ও দাঁড়ায় না, সামির হাত ধরে চলে যেতে চায়, কিন্তু পায়ে প্রচন্ড ব্যথা থাকায় হাঁটার ক্ষমতা নেই। সামি মেঘের দু’পাশে ধরে ধীরে ধীরে মেঘকে গাড়িতে নিয়ে তুলে। গাড়িতে উঠে মেঘ ছলছল চোখে একবার শ্রাবণের দিকে তাকায়, শ্রাবণ কিছু বলতে চেয়েও আনিকাকে দেখে আর কিছু বলার সাহস পায় না। শ্রাবণ আনিকাকে বলল,

_শুধু শুধু মেয়েটাকে বকলে কেন? দেখলে তো মেয়েটা হাঁটতে পারছে না ঠিকমতো।
_খুব মায়া হচ্ছে ওর জন্য।
_এটাই তো স্বাভাবিক, মেয়েটা আমার জন্য গালি শুনল।
_কী বলতে চাইছ?
_মেয়েটার কোনো দোষই নেই অথচ বোকার মতো কথাগুলো শুনলো।
_তোমার উপর ঢলে পড়ল তার বেলা কিছুই না।
_ইচ্ছে করে পড়েনি, পায়ে মুচড় খেয়ে পড়েছে।
_হয়েছে থাক, আর ওই মেয়েটার হয়ে সাপাই গাইতে হবে না। বাসায় যাবোল চলো।

শ্রাবণ আর কিছু বলে না চুপচাপ আনিকাকে নিয়ে আনিকাদের বাসায় নামিয়ে দেয়। তারপর সোজা নিজেদের বাসায় এসে রুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে ভাবতে থাকে মেঘকে নিয়ে। অথচ মেঘকে শ্রাবণ আজকের আগে দেখেনি, সেদিন পানি দিয়ে হেল্প করলেও এতো কাছ থেকে চেহারাটা দেখা হয়নি যার ফলে মেঘের চেহারাটা শ্রাবণের অচেনা লাগছে। নিজেকে অপরাধী ভাবছে শ্রাবণ। শুধু শুধু মেয়েটা এতো বকা খেল, কষ্টও পেল, মেয়েটা চাইলেই আনিকাকে অপমান করতে পারত কিন্তু তার কিছুই করেনি, উল্টে বিনা প্রতিবাদে চলে গেল। ব্যাপারটা শ্রাবণকে ভীষণ ভাবাচ্ছে।

সামি মেঘকে মেঘদের বাসার ভেতরে এগিয়ে দেয়। মেঘের মা মেঘের সাথে সামিকে দেখে বেশ অবাক হন। সামি মেঘের মাকে সালাম করে বলল,

_আন্টি মেঘকে বকবেন না প্লিজ, বেখেয়ালিতে পা মুচড়ে যাওয়ায় একটু ব্যথা পেয়েছে। দু’দিন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
_আচ্ছা, কিন্তু বাবা তোমাকে তো চিনলাম না?
_আমি মেঘের বন্ধু সামি, সেদিন আর্ট কম্পিটিশনে আমি সেকেন্ড হয়েছি।
_ওহ তুমিই সামি। কেমন আছো বাবা?
_জ্বী আন্টি আলহামদুলিল্লাহ, আপনারা কেমন আছেন?
_এইতো আল্লাহ যেভাবে রেখেছেন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা আমার মেয়েটাকে সেইফ করে আনার জন্য।
_ইট’স ওকে আন্টি এটা আমার কর্তব্য।
_তুমি বসো আমি চা, নাশতা নিয়ে আসি।
_না আন্টি, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি এখনই বাসায় যাব, বাবা-মা চিন্তা করবে।
_কিছু খেয়ে যাবে না।
_আজ না আন্টি অন্যদিন।
_সে কি! এটা কেমন কথা?
_আন্টি আমি আপনার ছেলের মতো, আজকে যখন বাসার এড্রেস জেনেই গেছি আগামীতে নিশ্চয়ই আসব। ইনফ্যাক্ট রোজ আসব আপনাকে জ্বালাতে।
_তাহলে তো ভালোই হবে।
_আসছি আন্টি, আসসালামু আলাইকুম।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম।

সামি উঠে দাঁড়ায়। মেঘ হাত দিয়ে সামিকে টা টা দেয়। সামি চলে গেলে মেঘ মায়ের কোলে বসে মায়ের সাথে গল্প করতে থাকে আজকের দিনের কাহিনি নিয়ে।

চলবে…

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here