#ক্যানভাস_পর্ব : (১)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
১!!
মেঘ! এই মেঘ! ঘুম শেষ হয়নি?
আর কত ঘুমাবে? এবার তো জাগো। একবার তাকিয়ে দেখো, আমি তোমার কত কাছে? মেঘ তুমি শুনতে পাচ্ছো? আমার ডাক কি পৌঁছোয় না তোমার কাছে? প্লিজ মেঘ আর বেশি ঘুমিও না। এবার উঠে পড়। তুমি যদি না উঠো আমি সত্যি চলে যাব। হারিয়ে যাব তোমার থেকে। অনেক দূরে…
এক লাফে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠে মেঘ। টেবিল ল্যাম্পের আলোতে পুরো রুমটা ভালো করে দেখছে। নাহ! কোথাও কারো আসার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই? কে ডাকলো মেঘকে?
মেঘ যে তাঁর ডাকে ঘুম থেকে কেঁপে উঠলো। মেঘ চারিদিকটা ভালো করে দেখে, কিন্তু কাউকে পায় না। মোবাইল অন করে টাইম দেখতে লাগল। ফজরের আজান হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্ত এই সময়। মেঘ চোখ বন্ধ করতেই মেঘের চোখের সামনে ভেসে উঠে অস্পষ্ট একটা চেহারা। যার দু’টো চোখ শুধু মেঘকে ইশারায় ডাকে। মেঘ বুঝে উঠতে পারে না, কে সে? কেন আসে রোজ মেঘের স্বপ্নে? কেন প্রতিবার একই কথা বলতে আসে? কথা গুলো বলা শেষ হলেই আবারও হারিয়ে যায়।
মেঘ বিছানা ছেড়ে উঠে। ততক্ষণে মসজিদের মুয়াজ্জিন তাঁর অতি মধুর সুরে আজান দিলেন। মেঘ ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়। অযু করে ফজরের নামাজটা আদায় করে নেয়। তারপর নিজের রুমে রাখা ক্যানভাস গুলোর কাছে যায়। ভালোবাসার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয় সেই ক্যানভাস গুলোতে।
এই ক্যানভাসটা মেঘ খুব যত্ন করে এঁকেছে। প্রতিদিন অন্যান্য আর্টের পাশাপাশি ওই দু’টো চোখ আঁকা মেঘের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মেঘ জানে না এই চোখ দু’টো কার? আদৌ এই চোখ দু’টোর মানুষ এই পৃথিবীতে আছে কি’না সেটা নিয়ে মেঘের মনে অনেক সংকোচ? মেঘ নতুন একটা আর্ট-পেপার বের করে ক্লিপের সাথে আটকে নেয়। রং-তুলি গুলো হাতে তুলে আবারও সেই দু’টো চোখের ছবি আঁকতে থাকে। যা কিছুক্ষণ আগেই অজানায় হারিয়ে গেছে।
মেঘের মা সকালের নাশতা রেডি করে মেঘকে ডাকতে আসেন। মেঘের রুমের ভেতরে লাইট অন দেখে তিনি বুঝে নেন, মেঘ ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। মেঘের এই ডেইলি রুটিন সবার মুখস্ত। তাই মেঘের মা সোজা মেঘের পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। মেঘের কাঁধে হাত রাখতেই মেঘ পিছু ফিরে তাকায়। মেঘ মায়ের দিকে তাকিয়ে ভুবন ভুলানো হাসি টানে ঠোঁটে। মেঘের এই একচিলতে হাসি মেঘের মায়ের সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে যথেষ্ট। মেঘের মা ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। তারপর মেঘকে বললেন,
_বাহ্! খুব সুন্দর হয়েছে! সকাল সকাল উঠেই এই কাজ না করা পর্যন্ত তুই মুখে পানিও তুলিস না। যদি আর্ট কমপ্লিট হয়ে থাকে তাহলে আয় নাশতা করে নিবি, তোর বাবা বসে আছে।
_তুমি যাও আমি আসছি।
মা চলে গেলে মেঘ রঙতুলিটা হাত থেকে রেখে দেয়। ক্যানভাসে আঁকা ছবিটা ক্লিপ থেকে খুলে দেয়ালে একটা পিনের সাথে আটকে দেয়। একেবারে রেডি হয়ে নাশতার টেবিলে যায়। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে মেঘ। যেমন সোনায় সোহাগা তেমনি জেদি আর অভিমানি। চেয়ারে বসতে বসতেই মেঘ বাবাকে বলল,
_গুড মর্নিং বাবা।
_গুড মর্নিং প্রিন্সেস। কেমন ঘুম হলো?
_প্রতিদিনের মতো।
_আজও কি সেই স্বপ্ন দেখেছিস?
_হ্যাঁ! বাবা আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে? খুব বিরক্তিবোধ করি একেক সময়। আবার কখনও মনে হয় এইভাবে চলতেই থাকুক। একটু সল্যুশন দাও না আমায়।
_তোর এই সমস্যার সমাধান তোর নিজেকেই করতে হবে।
_কিন্তু বাবা কীভাবে?
_তুই এই স্বপ্নের মানুষটাকে চেনার চেষ্টা কর। দেখ সেই চোখের মিপ আমাদের চারিপাশে পরিচিত সব চেহারাদের কারো মাঝে আছে কি’না? যদি তাকে তাহলে তুই তাকে নিজেই জিজ্ঞেস করবি, কেন সে তোর স্বপ্নে এসে তোকে বিরক্ত করে?
_আচ্ছা, আমি দেখব যদি পাই ইচ্ছামতো বকে দিব। কে সেই শয়তান আমাকে জানতেই হবে ?
_ওকে, যত পারিস বকা দিস, আগে নাশতাটা শেষ কর। ক্যাম্পাসে যেতে হবে তো না’কি?
_হ্যাঁ, তুমি ড্রপ করে দিও। আজকে শুধু আর্ট ক্লাসে যাব।
_আচ্ছা, তাড়াতাড়ি নাশতা খেয়ে নে।
মেঘ বাবা-মায়ের সাথে নাশতা শেষ করে বাবার সাথে বেরিয়ে পড়ে ক্যাম্পাসে যাবে বলে। ক্যাম্পাসে পৌঁছে নওরিনকে ফোন করে। নওরিন ফোন তুলতেই মেঘ জুড়ে চিৎকার করে বলল,
_ওই তুই কই রে?
_আমি তো রিকশায়।
_দশমিনিটের মধ্যে ক্যাম্পাসে আয়। আমি অপেক্ষা করছি।
_আসছি তো, এত রাগ দেখাস কেন? তুই ডিপার্টমেন্টের সামনে থাক আমি আসছি।
_আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আয়।
মেঘ কল কেটে নিজেদের আর্ট ক্লাসের সামনে গিয়ে নওরিনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নওরিন এসে মেঘের সামনে দাঁড়ায়। মেঘ অন্যমনস্ক হয়ে মুখে কলম রেখে কি যেন ভাবছিল? নওরিন মেঘের চোখের সামনে হাত নাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
_কি রে কী ভাবিস তুই?
_তুই এসে গেছিস।
_হ্যাঁ, কিন্তু তুই কী ভাবছিস?
_আমার ভাবনা কি রোজ আলাদা হয়?
_আলাদা হবে কেন?তোর ভাবনা তো রোজ একটা টপিককে নিয়ে।
_আমি কী করবো বলতে পারিস? এসব আমি আর টলারেট করতে পারছি না।
_কেন? তুই কি জানিস তুই ওই দু’টো চোখের স্কেচ কত যত্ন করে আঁকিস? একবার যদি সে তোর স্বপ্নে আসা বন্ধ করে দেয়, তাহলে তুই আর্ট করবি কীভাবে?
_তুই ঠিক বলেছিস, আচ্ছা আয় আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে কম্পিটিশনের।
_হ্যাঁ সেটাই! চল যাই।
মেঘ আর নওরিন দুজনেই ওদের ক্লাসের ভেতরে যায়। সবাই যে যার মতো ক্লাসে আর্ট নিয়ে ব্যস্ত। পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জীব-জন্তু, পশু-পাখি, বৃক্ষলতা, চন্দ্র-সূর্য, ফুল-ফল এমনকি কিছু অসম্ভব সংস্কৃতির ফুটিয়ে তুলছে একেকজন একেক ক্যানভাসে। মেঘ নিজের রঙতুলি বের করে মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকতে থাকে। ছবি আঁকা শেষ হলে মেঘ ক্লিপে ছবিটা রেখে মোবাইলে ছবিটার একটা ছবি তুলে রাখে। নওরিন মেঘের এই কান্ড দেখে মেঘকে বলল,
_মেঘ এক কাজ যে দু’টো চোখের ছবি তুই আঁকিস এই ছবি গুলোর মতো সেই চোখ দু’টো তুই ফেইসবুকে তোর পেইজে সব জায়গায় ভাইরাল কর। যদি তোর ফ্রেন্ডলিস্টে এই চোখের মালিক থাকে তাহলে সে আসবেই এই ছবির খোঁজে।
_না নওরিন, এটা একান্তই আমার ব্যাপার। এই ছবি আমি সবার সাথে এখন শেয়ার করতে চাই না। আমার খুব বড় প্লেন আছে এই ছবিটা নিয়ে।
_আচ্ছা কি প্লেন শুনি?
_সেটা তো তুই ক’দিন পরেই দেখতে পারবি।
_অপেক্ষায় থাকলাম, এইবার চল কিছু খেয়ে আসি।
_ক্যান্টিনে যাবি?
_না, আজ ক্যান্টিনে নয় আজ বাইরে গিয়ে ফুচকা খাব।
২!!
মেঘ, নওরিন দু’জনে ফুচকা খেতে ক্যাম্পাস থেকে কিছুটা দূরে একজন ফুচকা বিক্রেতার কাছে গেল।
দু’প্লেট ফুচকা অর্ডার করে দু’জনে দু’টো চেয়ারে বসল। তারপর আড্ডা দিতে দিতে ফুচকা খেতে শুরু করল। ফুচকা খেতে খেতে হুট করে মেঘের বিষম লেগে যায়, ফুচকায় অতিরিক্ত ঝাল থাকার ফলে। মেঘ ঝালে কথা বলতে পারছে না। চোখ থেকে অবিরাম জল পড়ছে। নওরিন পানি আনার আগেই মেঘের মুখের সামনে কেউ পানির বোতল বাড়িয়ে দিলো। মেঘ বোতল নিয়েই ডগডগ করে পানি গিলতে শুরু করল। চোখ-মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে পানির বোতলটা বাড়িয়ে দিতেই মেঘ চারশো বিশ ডোজের একটা শকড খেল। গায়ে চিমটি কেটে ‘উফফ’ বলে ব্যথায় চিৎকার দিল। মেঘের এই চোখ পিটপিট করে তাকানো দেখে মেঘের সামনে থাকা মানুষটা অসম্ভব জুড়ে হাসতে শুরু করে। তাঁর সে হাসি দেখে মেঘের মুখের হাসি সরে চোখ-মুখে আমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে। মেঘ গুল গুল চোখে ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটা মেঘের চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে মেঘলে বলল,
_এই যে ম্যাম, হা হয়ে কী দেখছেন?
_আপনি কে?
_কে মানে! আপনাকে এইমাত্র হেল্প করলাম। এক্ষুণি তো ঝালে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন, আমি হেল্প না করলে কী হতো ভেবে দেখেছেন?
_হলে হতো, এতে আপনার সমস্যা কি?
_আমার কোনো সমস্যা নেই, তবে আমার বন্ধু কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে সহ্য করতে পারে না। আমি পাশের স্টলেই বন্ধুদেরকে নিয়ে ফুচকা খেতে এসেছি। আপনাকে কষ্ট পেতে আমার বন্ধু আমাকে পাঠাল তাই আমি পানির বোতলটা আপনাকে দিতে এলাম। এতো ঝাল যখন সহ্য হয়না তখন ঝাল বেশি খাচ্ছিলেন কেন?
_ঝাল খুব পছন্দ তাই, কিন্তু বিষম লাগায় ঝালটা বেড়ে চোখ দিয়ে জল আসছিল, আর কিছু না।আপনাকে আর আপনার বন্ধুকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
_বাই, ভাল থাকবেন।
ছেলেটা যেই চলে যেতে পা বাড়াল অমনি নওরিন চিল্লিয়ে ওই ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল,
_এক্সকিউজ মি!
_জ্বি আমাকে বলছেন?
_হ্যাঁ আপনাকেই।
_বলুন কী বলবেন?
_আমার বেষ্টুকে হেল্প করার জন্য থেংক্স।
_আর কিছু।
_যদি কোনো সমস্যা না থাকে বন্ধুত্বের খাতিরে আমরা কি জানতে পারি আপনার কী নাম? যে মানুষটা আজ আমার ফ্রেন্ডকে হেল্প করলো, তাঁর পরিচয় তো জানতেই পারি?
_এটা তেমন বড় কিছু না, আপনার বন্ধুর কষ্ট হচ্ছিলো দেখে আমার বন্ধু আমাকে পাঠিয়েছে। আপনার বন্ধুর জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি এবং আমার বন্ধু ঠিক এটাই করতাম। আর নাম; নামে কোনো অসুবিধা নেই।আমি আদনান কবির।
_আমি ঈশানা নওরিন।
আদনান হাত বাড়িয়ে দেয় নওরিনের দিকে। নওরিন, আদনান একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে পরিচিত হয়ে নেয়। নওরিনের নাম জানার পর আদনান নিজের ডানহাতটা বাড়িয়ে দেয় মেঘের দিকে, মেঘ একটু অবাক হলেও পরক্ষণে মুচকি হেসে নিজের ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
_কাশফিয়া হাসান মেঘ,
_নাইস নেইম।
_থেংক ইউ।
_আচ্ছা বাই, ভাল থাকবেন।
_একটু শুনুন।
_বলুন।
_আপনার বন্ধু নিজে আসলেন না কেন?
_সে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত।
_তাঁর নামটা কি জানতে পারি?
_শ্রাবণ মাহমুদ। ওই যে ওই ব্লু টি-শার্ট পরা ও সেই ছেলে।
মেঘ সামনের দিকে তাকালে ব্লু টি-শার্ট পরা ছেলেটাকে দেখতে পেলেও ছেলেটার সম্পূর্ণ চেহারা দেখিনি, শুধু পিছন সাইডের সামান্য দেখল। তারপর আদনানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
_আমার হয়ে ওনাকে থেংক্স জানাবেন।
_অবশ্যই।
_বাই, সি ইউ।
আদনান বিদায় নিলে নওরিন মুচকি হেসে মেঘের পাশে দাঁড়ায়। মেঘ ব্যাগটা নিয়ে ফুচকাওয়ালার দাম মিটিয়ে নওরিনকে নিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দেয়। দু’জনে রিকশায় করে বাসায় যাচ্ছে। নওরিন শুধু আদনানকে নিয়ে বকবক করে মেঘের মাথা খাচ্ছে। নওরিন মেঘকে বলল,
_মেঘ দেখলি ছেলে দু’টো কত ভাল? অচেনা অজানা মেয়েকে এইভাবে আগ বাড়িয়ে হেল্প করতে আসলো।
_অতি চোরের বেশি ভক্তি। এতো বকবক করিস’না তো। চুপচাপ ভাব কম্পিটিশনে ফার্স্ট হবি না’কি গোল্লায় যাবি।
_সেটা পরে দেখা যাবে, শোন না!
_হুহ্ বল।
_ছেলেটা না খুব হ্যান্ডসাম!
_কোন ছেলে?
_ওমা! ভুলে গেলি? আদনান রে আদনান।
_নওরিন আর একবার যদি এইসব ফাজিল ছেলেদের নিয়ে একটা কথা শুনি, আমি কিন্তু তোকে এই রিকশা থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিব।
_আরে বাবা যা সত্যি তাই তো বললাম, এতো রাগ দেখানোর কি আছে?
_আরে বুদ্ধু এসব ছেলেরা মেয়েদের ইমপ্রেস করার জন্য ওতপেতে থাকে, কীভাবে মেয়েদের সামনে নিজেদের অতিরিক্ত দায়িত্বশীলতা প্রকাশ করবে? সেই চিন্তা নিয়েই এরা মেয়েদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়।
_তোর কেন এমন মনে হলো? ওরা তো ভালোও হতে পারে?
_বোন মাফ কর। আমি তোকে আর বুঝাতে পারব না।আমি নামছি, ভাল থাকিস।
_আচ্ছা রাতে ফোন দিস।
_দিব, আল্লাহ হাফেজ।
_আল্লাহ হাফেজ।
মেঘ বাসার সামনে রিকশা থামিয়ে নেমে পড়ে।নওরিনকে বিদায় দিয়ে বাসায় ঢুকে। গরমে শরীর ঘেমে একাকার। রুমে গিয়ে সিলিং ফ্যান অন করে বাতাস খেতে বসে। একটু শীতল অনুভব হলে মেঘ ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবারটা মায়ের সাথে খেয়ে নেয়।
বিকেলবেলা মেঘ ছাদে বসে হাটুর উপর আর্ট পেপারটা নিয়ে ছবি আঁকতে মনোযোগ দেয়। মেঘের মা মেঘের জন্য জুস বানিয়ে ছাদে এসে দেখেন মেঘ ছবি আঁকাতে বেশ মন দিয়েছে। মেঘকে ডেকে হাতে জুসটা বাড়িয়ে দেন। মেঘ মাকে বলল,
_কীভাবে বুঝলে এখন আমার জুসটা দরকার?
_বিকেলবেলা ছবি আঁকতে আঁকতে ক্লান্ত তুই তাই তোর ক্লান্তি দূর করতে জুসটা আনা। আমি জানতাম তুই এখন একটু গলা ভিজাবি, কিন্তু তোর আঁকাটা এতো ইম্পর্ট্যান্ট যে, একবার নিচেও নামতে পারছিস না, তাই আমি নিজেই নিয়ে এলাম।
_থেংক ইউ। বাবা চলে এসেছে।
_হ্যাঁ, একটু আগেই।
_আচ্ছা মা তুমি বলো আজকালকার যুগে যে ছেলে স্বেচ্ছায় মেয়েদের হেল্প করতে আসে, সে নির্ঘাত ডাকাত, নয়তো খারাপ মস্তিষ্কের লোক।
_কোনো সমস্যা হয়েছে?
_আজ একটা ছেলে আমাকে হেল্প করেছে। সে নাকি মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। আচ্ছা মা তুমি’ই বল যদি হেল্প করার হলো তাহলে নিজে এসে কেন পানির বোতল দিলো না। বন্ধুকে পাঠালো কেন?
_হয়তো খুব একটা আনইজি ফিল করে না, নয়তো ইচ্ছে করেই আসেনি।
_না মা, আমার কেমন যেন একটা রহস্য লাগছে?
_কেমন?
_পরে বলবো, আগে আমি শিওর হয়ে নিই, যা ভাবছি তা সত্যি কি’না?
_আচ্ছা, তাহলে তুই আঁকতে আঁকতে ভাবতে থাক, আমি নিচে গেলাম।
_আচ্ছা।
মেঘের মা চলে গেলে মেঘ আবারও ছবি আঁকতে মনোযোগ দেয়। অন্যদিকে শ্রাবণ আর ওর বন্ধুরা মিলে শ্রাবণদের বাসার ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে। শ্রাবণের বন্ধু আদনান শ্রাবণকে বলল,
_শ্রাবণ আগামী সপ্তাহে একটা কম্পিটিশন আছে আর্টের উপর, কলেজে যাবি তুই?
_আর্টের উপর! আচ্ছা ঠিক আছে যাব। যদি অফিসে কোনো মিটিং না রাখি।
_আরে গাধা সেই যে কবে কলেজের বারান্দা পেরিয়ে এসেছি, আর তো কলেজে যাওয়া হলো না।প্লিজ দুস্ত যেভাবে পারিস মিটিং ক্যান্সেল করে হলেও আমাদের সাথে জয়েন করিস। আর এইটা আর্ট কলেজ এখানে গেলে কোনো সমস্যা হবে না? আমরা কতদিন নিজেদের কলেজ ছাড়া বাইরের কলেজে যাইনি বল?
_কিন্তু বাবাকে বুঝাবো কীভাবে?
_একদিন অফিস না গেলে কর্মচারীরা কিছু ভাববে না, আর এতদিনে একদিন আমাদেরকে সময় দিলে তোর খুব বড় লস হবে না।
_আচ্ছা ঠিক আছে বাবা যাব।
_এই আমি তোর বাবা নয় আমি তোর বন্ধু।
_হা হা হা…
শ্রাবণ জুড়ে হেসে উঠে। এরপর দুইবন্ধুতে মিলে অনেকটা সময় আড্ডা দেয়। সন্ধ্যের আগেই আদনান চলে যায় নিজেদের বাসায়। আজ অনেকদিন পর শ্রাবণ সব বন্ধুদেরকে নিয়ে একটু আড্ডা জমিয়েছিল। আর আদনান, আদনান হলো শ্রাবণের বেষ্ট ফ্রেন্ড, যে নিজের থেকে বেশি বুঝে শ্রাবণকে। আদনান চলে যাওয়ার পর শ্রাবণ ছাদের দুলনাতে দোল খেতে খেতে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। মাগরিবের আজানের ধ্বনি শুনে শ্রাবণ ধীরো পায়ে ছাদ থেকে নেমে আসে। নামাজ পড়ে বাবা-মায়ের সাথে বসে চা, নাশতা খেতে খেতে গল্প জুড়ে দেয়। শ্রাবণের মা শ্রাবণকে বললেন,
_কেমন কাটলো আজকের দিন?
_জাস্ট অওসাম! অনেকদিন পর আজকে মনখুলে আড্ডা দিয়েছি।
_গুড, এইভাবে মাঝেমধ্যে নিজেকে কাজের চাপ থেকে মুক্ত রেখে বাইরের হাওয়া-বাতাস খাবি তাহলে শরীর মন দুটোই ভাল থাকবে।
_তুমি ঠিক বলেছো মা, আমি ভাবছি আগামী সপ্তাহ থেকে সাতদিনে একবার করে হলেও বন্ধুদেরকে সময় দিব।
_শুক্রবার তো অফ ডে, শুক্রবার পারবি।
_হ্যাঁ, সপ্তাহে ওই একটাই দিন। ওইদিনটা আমি পুরোটা সময় ওদের সাথে কাটাতে চাই।
_আচ্ছা ঠিক আছে। এইবার চা খেয়ে নে, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
পুরো সন্ধ্যা শ্রাবণ বাবা-মায়ের সাথে অনেক মজা, মাস্তিতে কাটায়। কাজের চাপে রোজ আড্ডা দেয় না। তবে মাঝেমধ্যে এমন করে সময় বের করে নেয়, মা-বাবা আর বন্ধুবান্ধবদের জন্য। মেঘ বাবা-মায়ের সাথে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে গেল। ঘুমোতে যাবার আগে প্রত্যেকটা আর্টের সাথে অল্প অল্প কথা বলে। তাদেরকে আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দেয়। মেঘ নিজেও জানে না,এই চোখ দুটো কার? প্রতিদিন রাতে এসব চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ে মেঘ। আজও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিদিনের মতো আজও মেঘ ঘুমের রাজ্যে হারাল।
৩!!
ঠিক গতরাতের মতো, ফজরের আগ মুহুর্তে আবারও সেই ধ্বনি মেঘের ঘুমে কেড়ে নিল। লাফ দিয়ে উঠে আগে ডগডগ করে পানি গিলতে লাগলো। তারপর দৌঁড়ে ক্যানভাস গুলোর কাছে গেল। আবারও একটা আর্ট পেপার ক্লিপের সাথে লাগিয়ে স্ট্যান্ডের সাথে আটকায়, শুরু করে ছবি আঁকা। চোখ বন্ধ করে আর তাকায়, আবার আঁকতে শুরু করে। এইভাবে এক পর্যায়ে মেঘের ছবি আঁকা কমপ্লিট হয়ে যায়। তারপর ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে আবার তাকায়। অজান্তেই মেঘের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। মেঘ নিজের কনুই মেরে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ‘ইয়েস আই গট ইট’ বলে চিৎকার করে। তারপর ছবিটা হাতে নিয়ে নিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। মেঘের মাও মেঘের মতো খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। মেঘের চিৎকার শুনে তিনি মেঘের দরজায় নক করে। মেঘ তৎক্ষনাৎ আর্ট করা ছবিটা আরেকটা ছবির পিছনে লুকিয়ে রাখে। তারপর অন্য একটা আনকমপ্লিট ছবি ক্লিপের সাথে লাগিয়ে রেখে দরজা খুলে। মেঘ দরজা খুলতেই মেঘের মা মেঘকে জিজ্ঞেস করলেন,
_কি রে ওইভাবে চিৎকার করলি কেন?
_কই চিৎকার করলাম। তুমিও না। কী যে বল?
_তোর গলার আওয়াজ কি আমি ভুল শুনলাম?
_হতে পারে তোমার মনের ভুল, সবসময় তো আমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকো।
এইবলে মেঘ একটু আহ্লাদি হয়ে মাকে পিছন থেকে গলায় জড়িয়ে ধরে। মেঘের মা মেঘের গালে হাত রেখে বললেন,
_আর আহ্লাদ দেখাতে হবে না, চুলায় চা বসিয়ে এসেছি।
_আচ্ছা যাও।
_তুই কি চা খাবি, নাকি ঘুমাবি?
_নামাজ পড়ে একটু ঘুমাব, পরে নাশতা খেয়ে নিব।
_আচ্ছা, আমি গেলাম।
মেঘের মা চলে গেলে মেঘ তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে আবারও ছবিটা বের করে আনে। ছবিটাকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বিছানায় গিয়ে পড়ে।
চলবে…