#ক্যানভাস_পর্ব : (১৪)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
আনিকার সেই মিষ্টি হাসি! যে হাসির মাঝে একসময় হারিয়ে ছিল শ্রাবণ। এখন সে হাসিটা কেবলই ছলনার মনে হচ্ছে। মনের অজান্তেই আনিকার নাম্বারে ডায়াল করল শ্রাবণ। কিন্তু আনিকার সেই বন্ধ সিম আর ওপেন হয়না। ফেইসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম, ইমো, ওয়াটসঅ্যাপ সব জায়গায়ই শ্রাবণ ব্লকলিস্টে। সবগুলো রাস্তা বন্ধ দেখে শ্রাবণ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। ব্যর্থ হলো শ্রাবণের এতদিনের ভালোবাসা। শ্রাবণের এত মূল্যবান ভালোবাসা আর নিষ্পাপ মনটাকে এইভাবে শাস্তি দিলো আনিকা। এটা ভাবতেই শ্রাবণ কান্নায় ভেঙে পড়ে। কষ্টে বুক ফাটে শ্রাবণের। যখন আনিকার অবহেলার কাছে মেঘের মায়াবী মুখটা ভেসে উঠে তখন শ্রাবণের কেবল এটাই মনে হয়, মেঘের নিষ্পাপ মনের ভালোবাসাকে কষ্ট দিচ্ছে।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আর না! অনেক দিয়েছে রাত্রিকে কষ্ট এইবার নিজেকে কষ্ট দিয়ে হলেও রাত্রিকে শ্রাবণ সুখী রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবেই। আর ক’টা দিন পর বিয়ে। এইভাবে মেয়েটাকে অবহেলা করে কষ্ট দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। ভালোবাসতে নাই পারুক, এটলিস্ট ভালো রাখতে তো পারবে। এই কথার মাঝেই শ্রাবণ নিজের সিদ্ধান্ত অটুট রাখে। যেভাবে হোক রাত্রিকে সে সুখী করবেই।
৩৪!!
ইরা বার বার সামির আইডিতে ঢু মারে। কিন্তু সামিকে ক’দিন ধরে একটিভ দেখায় না। দেখাবে কীভাবে সামি তো হাসপাতালে! সামির অমন চেহারাটা দেখে ইরা কষ্ট পেলেও সরাসরি কিছু বলার সাহস হয়নি। তাই তো চুপ থেকে সবটা দেখে গেল। ইরার এক্ষুণি ইচ্ছে করছে সামির কাছে ছুটে গিয়ে সামির কষ্ট গুলোর সাক্ষী থাকতে। একসাথে সামির কষ্ট গুলো স্বীকার করতে। সামিকে সব বলে দিতে। এমন কি এটাও জানতে যে সামি কাউকে ভালোবাস তো কি না? ইরার ভেতরে অনেক প্রশ্ন। নিউজফিড ঘাটাঘাটি করতে করতে দেখে ইরার সেদিনের কমেন্টের রিপ্লে সামি দিয়েছে তাও কিছুক্ষণ আগে। রিপ্লেটা এমন…
“এই যে হ্যালো, আপনাকে বলছি। আপনি কে আমি জানিনা। চিনি ও না। এইভাবে আর পারসোনাল ব্যাপারে কেন ইনটাফেয়ার করার চেষ্টা করছেন? আমি ব্লক করার আগে আপনি আমায় ব্লক করে দিন, নয়তো ভালো হবে না বলে দিলাম।”
ইরা রিপ্লেটা দেখে রীতিমতো শকড খায়। সামির হুট করে অনলাইনে আসাটা ইরাকে চমকে দিল, ইরা সেটার রিপ্লে করল,
“আপনি এমন কেন? আমি কী এমন খারাপ কথা বললাম যে আপনি এইভাবে রাগ দেখাচ্ছেন?”
এইটা দেখে সামি আরও রেগে যায়। রিপ্লে করে বলল,
“দেখুন আমার পিছনে অনেকদিন ধরে আপনাকে দেখছি। আমার সব পোস্টে আপনি লাভ রিয়েক্ট দেন, এমনকি সবসময় কমেন্ট করে নিজেকে আমার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেন, কেন করেন এমন?”
সামি চেক করে দেখে প্রায় দশমিনিট হয়ে যায় এই কমেন্টের রিপ্লে আসে না। হঠাৎই ইনবক্সে ঢু মারে ইরা। সামি এমন একটা টেক্সট দেখে পুরোপুরি শকড হয়। এই মেয়ে এতকিছু জানে কীভাবে! ইরার ম্যাসেজ….
_কী ভাবো নিজেকে হিরো হয়ে গেছো তাই না? হিরো সাজবে সাজো তবে সেটা কেবল আমার জন্য। একদম বাইরের মেয়েদের সামনে হিরো সাজার চেষ্টা করবে না। যদি কখনও এমন করতে দেখি তাহলে তোমার চোখের সামনে আমি সুইসাইড করবো। বলে রাখলাম।
_আপনি কি পাগল?
_হ্যাঁ আমি পাগল। তোমার জন্য পাগল। কেন বুঝো না তুমি? তুমি কী ভাবো তুমি অসুস্থ হয়ে আজ তিনদিন ধরে হাসপাতালে পড়ে আছো আমি সেটা জানি না? তাহলে তুমি ভুল ভাবছো, তুমি এটা ভালো করে জেনে রাখো। যেখানে তুমি থাকো ঠিক সেখানে আমিও থাকি। যেখানে তোমার শেষ পদচিহ্ন সেখান থেকে আমার পথচলা শুরু। তোমার প্রতিটা কাজই আমি ফলো করি। এমনকি আমি এটাও বুঝতে পারছি তুমি কোনো ব্যাপার নিয়ে কষ্টে আছো যা তুমি কারো সাথে শেয়ার করতে পারছো না। তবে তুমি ভেবো না এই সত্যিটা জানতে আমার বেশিদিন লাগবে না।
_আপনি আমার সাথে এইভাবে কেন কথা বলছেন? কোন অধিকারে এইভাবে ধমকাচ্ছেন আমায়? কে আপনি? কোথায় থাকেন? চোরের মতো নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন কেন? সাহস থাকলে সামনে এসে মুখোমুখি হন। এইভাবে আমাকে বিব্রত করার চেষ্টা করবেন না।
_ওকে, ওয়েট এন্ড সি… বাই।
ইরা রাগে অনলাইন থেকে বেরিয়ে আসে। রাতে ডিনার করে প্লেন করে রাখে৷ কাল যেভাবে হোক সামির সাথে দেখা করতে হবে। সামির জন্য মন কেমন করছে ইরার। ইরা বালিশে মাথা দিয়ে এসব একমনে ভেবে চলেছে। মেঘ ইরাকে ভাবনারত অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল,
_ইরা কী হয়েছে? কী ভাবছিস?
_একটা হেল্প করবি।
_কী হেল্প?
_কাল সামিকে দেখতে হাসপাতালে যাবো।
_তো যাবি সমস্যা কী?
_কাল আমার সাথে গেলে সব বুঝতে পারবি। তুই শুধু আমাকে হাসপাতালে থাকা অবস্থায় খানিকটা হেল্প করবি। তোর হেল্প না হলে সামির সাথে দেখা করাও পসিবল না।
_ঠিক আছে। হেল্প করবো। এইবার ঘুমা তো।
_ঘুমাচ্ছি।
ইরা, মেঘ দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়ে।
নওরিন বালিশে এপাশ ওপাশ করছে। ঘুম আসছে না চোখে। বার বার আদনানের বলা কথাগুলো চোখের সামনে ভাসছে। সত্যি কী আদনান আর নওরিনের সামনে আসবে না? নওরিনের কিছু কিছু বোকামির জন্য নওরিন এখন পস্তাচ্ছে। আদনানের নাম্বারে কল করতে গেলে নাম্বার বারবার ওয়েটিংয়ে দেখায়। নওরিন প্রথমে ভাবে হয়তো কারো সাথে কথা বলতে ব্যস্ত, কিন্তু বারবার একই কথা শোনার জন্য নওরিনের সন্দেহ হয়। আধাঘন্টা পর আবারও চেকিং করে একই কথা শুনতে পেলে নওরিন বুঝে নেয় আদনান ওকে ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ আদনানের নাম্বারে ডায়াল করবে ওয়েটিং দেখায়। ওয়াটস-এপ, ইমো, সব জায়গায় ব্লক। এইবার নওরিন একটু কষ্ট পায়। বুঝতে পারে আদনানের প্রত্যেকটা ইঙ্গিত, এমনকি এটাও বুঝে নেয় আদনানের তখনকার বলা কথাগুলো কতটা সত্যি ছিলো! বুঝতে নওরিনের দেরী হয়ে গেল। বোকার মতো কিছু কাজ মানুষকে সবশেষে আফসোস উপহার দেয়। সময়ের কাজ সময়ের মধ্যে না সম্পন্ন করলে পরবর্তীতে আর কিছুই করার থাকে না। নওরিনের এই বোকামির ফল নওরিন এখন হারে হারে টের পাচ্ছে।
৩৫!!
সকালবেলা মেঘ ইরা নাশতা করেই বেরিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশে। হাসপাতালে ঢুকে দেখে সামির কেবিনে একজন নার্স আর সামির মা। মেঘ, ইরা দুজনেই নার্সকে বাইরে ডেকে আনে। তারপর আলাদা কথা বলে নেয়। মেঘ নার্সের হাতে কিছু টাকাও গুজে দেয়৷ মেঘ সামির কাছে আছে বলে সামির মাকে বাসায় যাওয়ার কথা বলে। ওনি মানতে চাননি মেঘ ওখানে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসার কথা বলে। মেঘের কথায় ভরসা পেয়ে সামির মা চলে যান। সামিকে সাবধানে থাকতে বলে সামির মা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসেন। মেঘ, ইরা দুজনই সামির সাথে গল্প করছে। ইরা অবশ্য কিছুই বলছে না। চুপ করে ওদের কথা শুনে যাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে হুম, হ্যাঁ এসব বলছে। মেঘ আর সামি গল্প করছে এমন সময় ইরা বলে উঠল,
_মেঘ আমি একটু নিচে যাব।
_কেন?
_আমার ফোনের রিচার্জ কার্ড আনতে হবে।
_আমারও তো আনতে হবে।
_কিন্তু মেঘ আমি তো কার্ড নিয়ে এদিকে আর আসবো না। বাসায় চলে যাব।
_আমি তো যেতে পারব না। সামির পাশে থাকতে হবে। আন্টি আসলে আমি যাব।
_আচ্ছা তুই থাক আমি আসছি।
ইরা সুযোগ খুঁজে বাইরে বেরিয়ে আসে। বিশ মিনিট পর ইরা নার্সের ড্রেস-আপ নিয়ে কেবিনে ঢুকে। মুখে মাস্ক লাগিয়ে নেয়। যেন সামি ইরাকে চিনতে না পারে। হাতের ট্রেতে পানি আর কিছু ঔষধ নিয়ে আসে। সাথে একটা ইনজেকশন। ট্রে রেখে ইরা সামিকে সোজা হয়ে বসতে বলে। ইরার গলার আওয়াজ যাতে চিনতে না পারে সেইজন্য কন্ঠস্বর চেঞ্জ করে নেয়। সামি ইরাকে নার্স ভেবে জিজ্ঞেস করল,
_বসতে হবে কেন?
_বারে ইনজেকশন দিতে হবে না।
_কাল রাতে না দিলাম।
_রাতে তো রাতেরটা ছিল, এখন সকালের ইনজেকশন। নয়তো ঘা’য়ের জায়গায় সেফটিক হয়ে যাবে না।
_সরে যান আমি ইনজেকশন দিব না।
_ইনজেকশন দিতে এত ভয় পেলে চলবে না। অবশ্য আপনি এমনিতেও ভীতু।
_আমি ভীতু আপনি জানেন কীভাবে?
_ওমা ইনজেকশন দেখে এত দূরে সরে আছে! এতে সহজেই বুঝা যায় আপনি যে ভীতু।
_ওহ।
মেঘ ভেবেছিল ইরা এবার ধরা খেয়ে যাবে। ইরার চালাকি কথা শুনে মেঘ মনে মনে বলল,
_লজিক আছে। নয়তো এত সাহস নিয়ে কেউ এইভাবে আসে না কি?
ইরা সামিকে ইনজেকশনের জন্য রাজী করাতেই পারছে না। শেষে মেঘকে ইশারা দিতেই মেঘ সামির হাতটা ধরে। সামির সাথে গল্প জুড়ে দেয় মেঘ। সেই সুযোগে ইরা চট করে ইনজেকশন দিয়ে দেয়। ইনজেকশন দেওয়া শেষ হলে মেঘ ইরাকে বলল,
_সিস্টার,
_জ্বি ম্যাম।
_আপনার ডিউটি এখানে কতক্ষণ?
_এইতো ম্যাম আধাঘন্টা।
_আপনি কষ্ট করে সামির পাশে একটু থাকুন না, আমার নিচে একটা দরকার আছে। আমি বিশ মিনিটে চলে আসব।
_শিওর ম্যাম।
মেঘ সামিকে বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে বলে নিচে যায়। ইরা সামিকে সবগুলো ঔষধ খাইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
_এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করে না।
_করবে না কেন? এখানে থাকতে আমার অসহ্য লাগছে। কতদিন হয়ে গেছে বাইরের আবহাওয়া দেখিনি?
_বাইরে যাবেন।
_কী!
_বাইরে গেলে আপনার শরীরটা ভাল লাগবে। মনটাও ফুরফুরে হয়ে যাবে। অসুস্থ রোগীর মাঝেমধ্যে বাইরের হাওয়া-বাতাসের প্রয়োজন আছে।
_কিন্তু মেঘ।
_সমস্যা নেই, ওনি আসলেই আমরা একসাথে যাব।
_আপনার ডিউটি তো আধাঘণ্টা।
_একজন রোগীকে সুস্থ করতে প্রয়োজনে আরো দু’ঘণ্টা এক্সট্রা সময় দিব।
_আচ্ছা এক্সট্রা সময় দিলে কী এক্সট্রা আয় হবে?
_শুধু কী লাভের আশায় মানুষ মানুষের সাহায্য করে?
_রাগ করলেন।
_না, আপন মানুষদের কথায় রাগ করতে নেই।
_কী!
_হ্যাঁ, এই হাসপাতালে যারা আসে আমরা সবাই তাঁদেরকে আপন বলে গ্রহণ করে নেই। আমাদের কাজ দিয়ে সেবা দিয়ে আমরা তাদের সুস্থ করে তুলি। যাদেরকে সুস্থ করি তাঁরাই আপন হয়ে যায়। এই হাসপাতালে যারা রোগী হয়ে আসে তাঁদের সুস্থ করে, সেবাযত্ন করে, সঠিকভাবে ভালো করে তোলার দায়িত্ব তো আমাদেরই। আমার মতো প্রত্যেক নার্স এই দায়িত্বে নিয়োজিত।
_তাহলে তো যেতেই হচ্ছে।
_এক কাজ করি আমি আপনার শরীরটা মুছে দেই। আপনি টি-শার্টটা খুলুন।
_কী!
_হ্যাঁ, কোনো অসুবিধা?
_অবশ্যই অসুবিধা। আমি কোনো মেয়ে মানুষকে আমার শরীর দেখাতে পারব না।
_আমি নজর দিচ্ছি না। বিশ্বাস রাখতে পারেন।
_সত্যি তো।
_আই স্যোয়ার।
সামি নার্সের কথা বিশ্বাস করে নিজের টি-শার্ট খুলার প্রস্তুতি নিল। ইরা একটা রুমাল চোখে বেধে নেয়৷ হাতের টাচে বাটির পানিতে ছোট একটা ফ্রেশ টাওয়াল ভেজায়। পানি শুকিয়ে ধীরেধীরে সামির হাত-পা শরীর মুছে দিতে লাগে। ইরার প্রতিটা স্পর্শ কেন যেন সামির চেনা চেনা লাগছে। ইরা আলতো হাতে স্পর্শ করছে যেন সামি ব্যথা না পায়। ইরা যেভাবেই স্পর্শ করে প্রতিবার সামির শরীরে হাজারো অনুভূতি খেলা করে। এই হাত, এই স্পর্শ সামি যেন আরো আগে ছুঁয়ে দেখেছে। সামির ভেতরে কেমন যেন একটা টান তৈরী হচ্ছে। যে টান, যে অনুভূতির নাম সামির জানা নেই। সামি নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল,
_কী নাম তোমার?
_কেন? নাম দিয়ে কী করবেন?
_বলতে অসুবিধা নেই। তবে জানানোর ইচ্ছা নেই।
_কেন?
_সবাইকে সব বললে নিজের পারসোনাল বলতে তো কিছু থাকলো না।
_থাক দরকার নেই। কেন জানি না মনে হলো আমি আপনাকে চিনি আর আপনি আমাকে!
_কী বলেন? আজই আমাদের প্রথম দেখা।
_সেটা তো আমিও ভাবছি।
_ছাড়েন তো, আরো কতকিছু মনে হয় হরদম। সব প্রশ্নের যেমন উত্তর থাকে না। সব জানারও কোন মানে হয় না। কিছু কথা অজানাতেই সুখ খুঁজে বেশি।
_খুব তো গুছিয়ে কথা বলেন।
_আমি বরাবরই এমন।
শরীর মুছা শেষ হলে সামি অন্য টি-শার্ট পরার চেষ্টা করে। হাতে ব্যথা থাকায় ক্ষমতা হয় না টি-শার্টটা গায়ে জড়াবার। সামির নিরবতায় ইরা বুঝে নেয় সামি টি-শার্ট পরতে অসুবিধায় পড়েছে। চোখে বাঁধন রেখেই যত্ন সহকারে সামিকে টি-শার্টটা পরিয়ে দেয়।ইরার কাজ দেখে সামি বেশ অবাকই হয়। কোনো নার্সই এত সেবা করেনি তার। এই কয়েকমিনিটে এই মেয়েটা যত সেবা করছে। কাজ শেষ হলে ইরা সামির সাথে আরও কিছু সময় গল্পসল্প করে সামিকে ভুলিয়ে রাখে। মেঘ এসে দেখে ইরা আর সামি বেশ ছুটিয়ে গল্প করছে। মেঘ আসতেই ইরা মেঘকে বলে সামিকে বাইরে নিয়ে যেতে চায়। মেঘ সব বুঝে আর আপত্তি জানায় নি।
ইরা ধীরে ধীরে সামিকে বেড থেকে নিচে নামালো। পায়ে জুতো পরিয়ে দিল। মেঘ সামিকে ধরতে গেলে ইরা বাধা দিয়ে বলল,
_ম্যাম, এটা আমার কাজ। আমাকেই করতে দিন।
মেঘ হাত ইশারায় ইরাকে বাহ্বা জানায়। ইরা সামির একহাত টাইট করে ধরে আর অন্যহাতে ভর রাখার জন্য একটা স্টিক দিয়ে দেয়। সামি স্টিকে যতটা না ভর ফেলে তাঁর থেকে বেশি ভর ইরার গায়ে ফেলে। ইরা সামিকে আস্তেধীরে হাটতে থাকে। হাসপাতালের পিছনে একটা সুন্দর পরিবেশ আছে। যেখানে রোগীদের সুস্থ করার জন্য মাঝে মাঝে কিছু টেকনিক ব্যবহার করেন ডক্টর আর নার্সগণ। এই অংশটা হাসপাতালের ভেতরেই পরে। হাটতে হাটতে তিনজনে একটা ব্রেঞ্চে বসে। মেঘ ওদের সুযোগ দিয়ে আলাদা সরে যায়।
৩৬!!
নওরিনকে ফোন দিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেঘ। ইরা সামিকে সোজা করে বসিয়ে সামির হাতে বাদামের টোঙ্গাটা দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
_এখন কেমন লাগছে?
_চারদেয়ালের মাঝে দমটা আটকে আসছিল। থেংক ইউ এমন সুন্দর একটা পরিবেশে এনে আল্লাহর আরেক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য।
_ওয়েলকাম! আচ্ছা আপনার ঘুরতে কেমন লাগে?
_ঘুরতে তো ভীষণ ভালো লাগে। তবে জায়গাটা হবে সবুজের সমারোহ। উঁচুনিচু পাহাড়, সাথে পাখিদের মিষ্টি সুর। প্রকৃতির আসল রূপ যেখানে ঝর্ণার পানি ছুটে চলে অবিরাম গতিতে। বাধাহীন এক চঞ্চল সুরে মেতে উঠে পানির প্রতিটা ঢেউ। মাঝেমধ্যে বৃষ্টির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা রাখালের বাঁশির সুর, সাগরের গর্জন আর বিশাল নীল আকাশ সেসব হলে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো যায়।
_এমন জায়গায় যদি সাথে সুন্দরী রমনী থাকে তাহলে।
_ম্যাডাম এসব ধান্ধাবাজিতে আমি নেই।
_বাহ্! ভালো তো। আচ্ছা মানুষ এত সুন্দর পৃথিবীতে এসেছে! সুন্দর করে বাঁচতে পারছে! বেঁচে থাকার জন্য, আলো, বাতাস, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, বিনোদন সবই তো পাচ্ছে। সাথে ফ্রীতে পাচ্ছে সারাজীবন কাটানোর জন্য একজন জীবন সাথী। তবুও কেন মানুষ ভাবে সে খুব কষ্টে আছে।
_আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন। তবে একটা কথা বলি, সব পাওয়াতেই যদি মানুষ নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মনে করতো, তাহলে খোদার দরবারে হাত উঠিয়ে পুনরায় কিছু চাই তো না।
_আল্লাহ যা দিয়েছেন তাই কি যথেষ্ট নয়?
_যারা না চাইতেও কিছু পায় তাঁদের জীবনে পাওয়ার খাতাটা কখনও শেষ হয় না। আর যারা বার বার চাওয়ার পরেও সে জিনিস পায় না, তখন সে ভাবে সে তা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
_লজিক আছে। তারপরেও কেন মানুষ এতকিছু পাওয়ার পরে অসুখী আছে। কেন সে ভাবে না, আমার যা আছে তাতেই আমি খুশি। কেন এটা ভাবে, অন্যজন যা পেল আমি কেন তা পেলাম না? জীবনে কখনও চাওয়া পাওয়ার ক্ষেত্রে আফসোস রাখতে নেই। কঠোর পরিশ্রম আর দৃঢ় মনোবলে সে যা অর্জন করবে সেটাই তো বেষ্ট। তার উর্ধ্বে আর কি বা দামী থাকতে পারে?
_সবাই যদি আপনার মতো ভাবতো তাহলে মানুষ কোনো কিছুতে এত লোভ করতো না। মানুষ জাত খুব খারাপ, কেননা তারা কখন অর্জন করা জিনিস দিয়ে খুশি থাকতে পারে না। তাঁরা কিছু পেলে মনে করে এটা কম হয়ে গেছে আমার আরও বেটার কিছু চাই।
_ভালোবাসার ক্ষেত্রেও কি তাই?
_মানে!
_কৌতূহল জাগলো তাই।
_কেউ যখন কাউকে খুব ভালোবাসে তখন সে তাঁর মর্যাদা দিতে জানে না, যখন সে হারিয়ে যায় তখন সে বুঝে যে, সে তাঁর জীবনে কতটা মূল্যবান ছিল।
_আপনি এর মাঝে কী হারিয়েছেন?
_পারসোনাল প্রশ্ন কেন করছেন?
_যদি মনে কোন চাপা কষ্ট থাকে তাহলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন। কেননা, এটা আপনাকে সুস্থ করতে অনেক কাজে দিবে। আমি একজন নার্স। নার্স হিসেবে আমার কর্তব্য আমার রোগীকে সুস্থ করে তোলা। যে রোগীকে সুস্থ করার দায়িত্ব নেয় সে জানে তাঁর রোগী কীভাবে সুস্থ হবে। শুধু তাই নয়, একজন নার্স খুব ভালো বন্ধুও হয়, যদি একজন রোগী তাঁর যন্ত্রণার কথা তাকে শেয়ার করতে পারে তাহলে একজন নার্সের কাছে খুব সহজ হয় কীভাবে সে তাঁর রোগীকে সুস্থ করে তুলবে। এমনকি তাঁর কখন কী প্রয়োজন সবটাই বুঝতে পারবে।
_আপনি পারবেন সব ঠিক করে দিতে।
_নার্স হিসেবে আমি আমার সবরকম চেষ্টা করবো। তবে আপনার মধ্যে সুস্থ হওয়ার পুরো কনফিডেন্ড থাকতে হবে। মনে জোর রাখতে হবে, আর শরীরের সুস্থতার জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করতে হবে। যাতে আপনি, আমি উভয়ই আমাদের কাজে সফল হই।
_চেষ্টা করবো।
_তাহলে এইবার রিলাক্স হন। আর সব কষ্ট ধুয়েমুছে দূরে সরিয়ে দিন। নিজেকে হালকা করুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।
_ওকে, আই উইল ট্রাই।
_ইয়েস! (মনে মনে)
ইরা সামিকে নিজের সাধ্যমতো জোর দিতে থাকে। সামি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। চোখ বন্ধ করে কল্পনায় হারিয়ে যায় সামি।
চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।