ক্যানভাস_পর্ব : (১৬)

0
462

#ক্যানভাস_পর্ব : (১৬)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

ইরা মেঘের পাশে বসে মেঘকে ধাক্কা দিতেই মেঘ কেঁপে ওঠে। মেঘ সোজা হয়ে বিছানায় বসে। ইরা মেঘের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। মেঘ সামান্য পানি খেয়ে গ্লাসটা সেন্টার টেবিলে রেখে দিল। ইরা মেঘকে জিজ্ঞেস করল,

_কী হয়েছে তোর? হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর থেকেই দেখছি তুই কেমন যেন চুপসে গেছিস? মেঘ কিছু তো শেয়ার কর না হলে তোর প্রবলেমটা আমরা বুঝবো কীভাবে?
_ইরা আমি আবারও একটা অন্যায় করছি।
_কী বলছিস মেঘ?
_ইরা এই বিয়েটা বন্ধ কর বোন।
_পাগল হয়ে গেছিস তুই?
_আমি ঠিকই বলছি। আমি এইভাবে আর শ্রাবণকে ঠকাতে চাই না।
_মেঘ কী বোকার মতো কথাবার্তা বলছিস তুই?
_আমি ঠিকই বলছি ইরা। এমনিতেও মিথ্যে পরিচয়ে একটা অন্যায় আমি করছি আর পারবো না।
_মেঘ কী হয়েছে তোর? কেন এসব বলছিস তুই?
_আমি এক্ষুণি শ্রাবণকে সব সত্যি বলে দিবো।
_কী বলবি তুই?
_২০১৪ সালের সেই দিনের কথা।
_হেভ ইউ গন মেড?
_জানি না ইরা। আমি শুধু জানি শ্রাবণকে সব সত্যি জানাতে হবে।
_কী বলবি তুই? সেদিন কী হয়েছিলো সেই কথা? ঠিক আছে বল। আমি বাধা দিবো না। কিন্তু একটা কথা, এই কথা জানার পর যদি ভাইয়া এই বিয়েটাই ভেঙে দেয় তখন কী করবি?
_ভেঙে দিক বিয়ে। তাতে কিছু যায় আসে না আমার। এটলিস্ট আমাকে মিথ্যের আশ্রয় নিতে হবে না।
_সবসময় মিথ্যে কিন্তু অন্যায় হয় না মেঘ।
_মিথ্যে খুব বড় অন্যায়। আর চাপ নিতে পারছি না আমি। সব বলে দিবো। আমি যে মেঘ সেটাও বলবো।
_মেঘ আমার কথা শোন।
_কোনো কথা না। আমি এখনি বলছি।
_পাগলামি করিস না মেঘ।

ইরা মেঘকে বার বার বাধা দিচ্ছে কিন্তু মেঘ ইরার কথা শোনার মতো সেন্সে নেই। মেঘের ভেতরে একটাই জেদ এখন, সব কথা শ্রাবণকে জানাতে হবে। নয়তো শ্রাবণকে ঠকানো হবে। এইভাবে এত বড় অন্যায় চাপা দেওয়া যায় না। সব জানা দরকার শ্রাবণের। মেঘ শ্রাবণের ফোনে বার বার কল দিতে থাকে। অনেক ট্রাই করেও শ্রাবণের সাথে কথা হলো না। মেঘ হাত থেকে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে। মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে মেঘ। আলতো স্বরে নিচু গলায় বলতে লাগল,

_আমায় ক্ষমা করো শ্রাবণ। আমি চাই না আনিকার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করাতে। আমি জানি আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি, কিন্তু আমি নিরুপায় শ্রাবণ। ক্ষমা করো আমাকে।

ইরা মেঘকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকে। মেঘের চোখের জল মুছে মেঘকে বলল,

_যখন এই দু’টো চোখ থেকে অনুতাপের জল ঝরে তখন কেবল মানুষের মনে তাঁর ভালোবাসার মানুষটার জন্য যে অনুভূতি, যে ভরসা আর যে ভালোবাসা জন্মায় সেটা আর কোনোভাবেই মুছে ফেলা যায় না। একটা কথা কী জানিস মেঘ? একটা মিথ্যে যখন কাউকে সুখী করতে, কাউকে নতুন জীবন দিতে, কাউকে ভালোবাসতে শিখাতে, কাউকে ভালো রাখার আর ভালোবাসার দায়িত্ব নেয় তখন সেই মিথ্যের কোনো মিথ্যেই হয় না। তখন কেবল সেই মিথ্যেটাই একটা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। কারণ একটা মিথ্যে তখন একটা জীবন গড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এই মিথ্যে কোনো অন্যায় নয় মেঘ। এই মিথ্যে একটা মানুষকে ভালোবাসার জন্য সৃষ্টি, একটা মানুষকে ভালো রাখার জন্য সৃষ্টি, তাই এই মিথ্যে এখন মহামূল্যবান। তুই শত চাইলেও আর শ্রাবণ ভাইয়াকে সত্যি বলতে পারবি না। কারণ তুই জানিস তুই শ্রাবণ ভাইয়াকে ভালোবাসিস। তুই-ই এখন একমাত্র অবলম্বন ভাইয়ার। তাই তুই এমন কোনো কাজই এখন করবি না যার ফলটা শুধু তোকেই ভোগ করতে হয়।
_ইরা আমি তো অন্যায় করছি সত্যিটা লুকিয়ে?
_বললাম তো এটা কোনো অন্যায় নয়। বরং এটা ভালোবাসার অন্য একটা অস্ত্র। যে অস্ত্র কেবল ভালো রাখার দায়িত্ব নেয় কাউকে ঠকানোর দায়িত্ব নয়।

এরমাঝেই মেঘের ফোনটা বেজে ওঠে। মেঘ ফোন হাতে নিয়ে ইরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা ফোন তুলতে বললে মেঘ ফোন কানে তুলে। ইরা মাথা নাড়িয়ে বার বার মেঘকে বাড়ন করছে সত্যিটা যে না বলে। মেঘ কী কথা বলবে খুঁজেই পাচ্ছে না। গলার স্বরটা কেমন যেন কাঁপছে শুধু। মেঘ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

_হ্যালো।
_তুমি তখন ফোন করেছিলে, আমি ড্রাইভে ছিলাম খেয়াল করিনি।
_হ্যাঁ, তুমি পৌঁছালে কি না সেটা জানতে ফোন করেছিলাম।
_আমি মাত্র বাসায় ঢুকেছি। চিন্তা করো না আমি ঠিক আছি।
_তুমি কীভাবে বুঝলে আমি চিন্তা করছি?
_যে আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়েছে সে আমার জন্য চিন্তা করবে, আমাকে কেয়ার করবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি?
_হ্যাঁ, আচ্ছা এখন রাখি তাহলে। পরে ফোন করবো।
_ওকে, সাবধানে থেকো।
_আল্লাহ হাফেজ।

কোনোরকম পালাই পালাই করে ফোনটা কেটে দেয় মেঘ। ইরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মেঘকে বলল,

_দেখলি তো, তুই পারিস নি সত্যি বলতে।
_আমি কী করবো বলতে পারিস?
_আচ্ছা মেঘ এই এত বছর অতিবাহিত হওয়ার পরে আজ হঠাৎ কেন তোর পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়লো?
_আবির ফিরে এসেছে ইরা।
_মানে! আবির তো জেলে?
_জেল থেকে পালিয়েছে ওই বদমাশ। আজকে আমাকে ফোন করেছিল।
_ভয় পাস না। শত চাইলেও আবির এবার আর তোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
_আবির যদি কোনোভাবে শ্রাবণকে কন্টাক্ট করে নেয়?
_কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয়ই বের হবে। এত ভাবিস না। আমরা আছি তো।
_তোরা আছিস বলেই তো আমিও আছি। আবিরের মতো একটা পিশাচকে সঠিক শাস্তি যতদিন না দিতে পারছি ততদিন আমি শান্তি পাবো না ইরা।
_আবিরকে শাস্তি দিতে আইন আছে। আর প্রয়োজনীয় প্রমাণও আমাদের কাছে আছে। শুধু আবিরের লোকেশন পাওয়ার অপেক্ষা।
_হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। ওর পাপের শাস্তি ওকে পেতেই হবে।
_অন্যায়কারীরা কখনও বাঁচতে পারবে না মেঘ। এসব নিয়ে চিন্তা না করে এখন শুধু তুই শ্রাবণ ভাইয়াকে নিয়ে ভাব, আর তো মাত্র ক’দিন। তারপরেই তো বিয়ের সানাই বাজবে। আমাদের মেঘ রানী কনে সাজবে। তাঁর একটা সংসার হবে। দু’একটা বাচ্চাকাচ্চা হবে। সারাদিন সেই বাচ্চাদের পিছনে টইটই করে ঘুরে বেড়াবে। আর মা মা চিৎকার শুনবে।
_ইরা…
_ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর এই ড্রেস আর শাড়ি গুলো চেক করতে হবে।

৪০!!
দুজনই ফ্রেশ হয়ে ড্রেস আর শাড়ি কালেকশন গুলো দেখছে। মেঘের জন্য কেনা প্রত্যেকটা শাড়ি আর ড্রেস শ্রাবণের পছন্দের। জুতো, জুয়েলারি, আরো সাজগোজের অনেক জিনিস যা শ্রাবণ একাই পছন্দ করেছে। মেঘ প্রতিটা জিনিস গুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে শ্রাবণকে পেয়ে সব অপূর্ণতা মুছে গেছে। দামী কাপড়, দামী জুয়েলারি এসবের জন্য নয়। একটা মানুষ মেঘকে এতটাই বুঝার চেষ্টা করছে যে, একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে এই বুঝাটা খুব দরকার। শ্রাবণ নিজের জন্য মেঘের থেকে পাওয়া উপহার গুলো আলমারিতে রেখে একটু বিশ্রাম নিতে বিছানায় শরীরটা হেলিয়ে দিলো।

আদনান ঘুমোতে গিয়ে নওরিনের সেদিনের কথা মনে করতেই একটু কষ্ট পায়। এইভাবে নওরিন ওকে পর করে দিলো এইভেবে। নওরিনের সাথে দেখা হয়নি চারদিন ধরে। এর ভেতরে নওরিন অনেকবার আদনানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু আদনান প্রতিবারই নওরিনকে অবহেলা করে গেছে। যখন বিনা বাধায় মানুষ সুখ অর্জন করে তখন সে তার মর্যাদা দিতে ভুলে যায়। আর যখন কোনো সুখের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তখন সে সুখের দাম থাকে অনেক। তাই মানুষ দামী জিনিসটারই বেশি মূল্যায়ন করে। আর এই দামী, কম দামী জিনিসগুলোর তফাৎ খুঁজতে মানুষ অনেক সময় অনেক ভুল করে যা সে তখন বুঝে না। যখন হারিয়ে যায় সেই দামী জিনিস আর বেদনার নীল রঙ জমে উঠে মনের গহীনে তখন সে বুঝে, সে ভুল করেছে।

অবহেলা খুব ভয়ংকর একটা অভিশাপ। কাউকে বিনা দোষে অবহেলা করাটা বোকামী ছাড়া কিছুই না। কিন্তু কাউকে একটু ভালোবাসা বুঝানোর জন্য, একটু অনুভূতি জাগানোর জন্য অবহেলা করাটা দোষের কিছু না। আদনান এখন ঠিক সেটাই করছে। এতে আদনানের বা নওরিনের কারোই কোনো দোষ নেই।
যখন নওরিন বুঝবে তখন হয়তো সেদিনের করা ব্যবহারটার কথা একটু হলেও ভাববে। আদনান জানে তাঁর এই ত্যাগের বিনিময়ে একদিন নওরিন ঠিকই তাঁর ভালোবাসার মায়াজালে ধরা দিবে। যে মায়াজাল উপেক্ষা করার শক্তি কোনো মায়াবিনীর নেই। জোর করেও কেউ পারে না উপেক্ষা করতে।

নওরিনের জন্য আদনানের ভেতরটা চটপট করছে। বারবার নওরিনকে দেখতে চাইছে। কতদিন মেয়েটার গলার আওয়াজ শোনা হয়নি! হাসিমাখা মুখকানিও দেখা হয়নি। কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব হয় নওরিনকে ছাড়া। তবুও কষ্ট করে ঘুমাতে যায় আদনান।

ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষটাকে এক মুহূর্ত না দেখলে ভেতরের যে কী পরিণতি সেটা সবাই বুঝেনা। আদনান, নওরিন দু’জনেরই ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা একই। দু’জনই একে অপরকে গভীরভাবে অনুভব করে কিন্তু সাহস হয় না মুখ ফুটে সত্যিটা প্রকাশ করার। তাই তো একই বেদনায় দু’জনই প্রতিদিন, প্রতিরাত, প্রতিটা সময় পুড়ে মরে।

২ দিন পর…
আজ সামিকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হবে। মেঘ ইরাকে নিয়ে অনেক আগেই হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। সামির বাবা ডিসচার্জ পেপারে সই করে দিলেন। মেঘ সামির লাগেজটা নিজের গাড়িতে নিয়ে রেখে দেয়। তারপর সামিকে নিয়ে বিদায় নেয় সামির বাবা-মায়ের থেকে। সামির মা আর মেঘ মিলে সামিকে গাড়িতে বসায়। ইরা পিছনে বসেছে আর পাশে সামিও। মেঘ নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। ইরা না সামির দিকে তাকাচ্ছে আর না সামিকে ভালো করে লক্ষণ করছে। খুব দূরত্ব রাখার চেষ্টা করছে। সামি বারবার আজকের ইরা আর সেদিনের ইরার মাঝের পার্থক্যটা খোঁজার চেষ্টা করছে। সেদিনের সেই ইরা ছিল বড্ড চঞ্চল আর মনমোহিনী, কিন্তু; আজকের ইরা যেন সামির কাছে খুব অচেনা। বাইরের প্রকৃতির সাথে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে ইরা। সামি ইরার দিকে আড়চোখে তাকালেও কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারে না।

গাড়ি থেকে নেমে মেঘ সামির লাগেজ নিয়ে ভেতরে যায়। আর ইরাকে বলে সামিকে ধীরে ধীরে ভেতরে নিয়ে আসতে। ইরা গাড়ি থেকে নেমে হাত বাড়ায় সামির দিকে। সামির ভেতরে কেমন যেন সংকোচ কাজ করছে তাই হাত ঘুটিয়ে রেখে দেয়। ইরা সামির এমন অবস্থা দেখে বলল,

_ভয় নেই, তোমাকে একা ফেলে আমি ভেতরে ঢুকবো না। আর তোমাকে সাথে নিয়ে গেলেও কষ্ট পেতে দিবো না। আমাকে ভরসা করতে পারো।
_আমি তো হোঁচট খাওয়ার ভয়ে হাত ঘুটিয়ে নেইনি। আমি তোমাকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে হাত সরিয়ে নিয়েছি।
_কারো হেল্প করলে কষ্ট হয় না, বরং মনের ভেতরে এক অদ্ভুত সুখ আর তৃপ্তি পাওয়া যায়। সেই তৃপ্তির কাছে এই সামান্য কষ্ট কোনো দাগ কাটে না।
_সত্যি তো!
_হুম একদম।
_ঠিক আছে। তাহলে ভর দিলাম।
_নিঃসংকোচে দিতে পারো।

সামি মুচকি হেসে ইরার দিকে হাত বাড়ায়। ইরা সামির একহাত মুঠোয় নিয়ে, অন্যহাতে কাঁধের অন্যপাশে ধরে ধীরে ধীরে সামিকে গাড়ি থেকে নিচে নামায়। ইরা সামিকে ঠিক সেইভাবেই জড়িয়ে রাখে যেভাবে রেখেছিলো সেদিন নার্স হয়ে। সামি ইরার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। ভেতরে অন্যরকম একটা সুখের মাতাল হাওয়া ভয়ে যায়। ভেতরের অস্থিরতা কাটিয়ে এক সীমাহীন অনুভূতি জাগিয়ে তুলে। এই স্পর্শ! এই হাত! এই দু’টি চোখ কেমন যেন সামির কাছে অদ্ভুত আর চেনা চেনা লাগে। ইরা সামির অবাক চোখে তাকানো দেখে বলল,

_থেমে গেলে কেন?
_কে তুমি?
_কে আমি মানে!
_তোমাকে আমি কী আগে থেকে চিনি?
_হ্যাঁ চিনো তো।
_কবে থেকে?
_বাহ রে, মেঘের এনগেজমেন্টের দিন। তুমি আমি ডান্স করলাম।
_না, সেদিনের তুমি আর আজকের তুমি সম্পূর্ণ আলাদা।
_কীভাবে?
_সেদিনের তুমি ছিলে বড্ড চঞ্চল আর দুষ্টু মায়াবতীদের একজন। অথচ আজকের তুমি কেমন যেন অচেনা। যেন আজকেই আমাদের প্রথম দেখা। তোমার এই বিষণ্ণতা দেখে মনে হচ্ছে তুমি কতকাল ঘুমোও নি। চোখের নিচে কালি, মুখে কথার ঝুরি নেই, মনটাও কেমন অন্যমনস্ক। কী হয়েছে তোমার?
_আমার কী হবে। আমি ঠিক আছি। হয়েছে তো আমার কাছের একজনের।
_কার কী হয়েছে?
_আমার হৃদয়ের।
_হৃদয়! ঠাট্টা করছো আমার সাথে?
_মোটেও না। আমার হৃদয়ের বালুচরে যে উত্থাল বালির ঢেউ জেগেছে। অভাগা ঘূর্ণিঝড় এসে আমার হৃদয়টাকে অস্থির করে দিয়েছে। তোলপাড় করে দিয়েছে আমার ভাবনা গুলোকে। ঝড়েরবেগে আঘাত হেনে কষ্ট দিচ্ছে আমার হৃদয়টাকে। হৃদয়ে থাকা মানুষটাকে। অথচ আমি কাছে থেকেও তাকে ছুঁয়ে দিতে পারি না। এই কষ্ট নিয়ে আমি চঞ্চলতা কোথায় খুঁজবো বলতে পারো তুমি?
_ভালোবাসো সেই হৃদয়ের গভীরে থাকা মানুষটাকে?
_হুম, খুব ভালোবাসি। কিন্তু সে বুঝে না।
_কেন বুঝে না?
_তাঁর মনে অন্যকেউ।
_ওহ, আ’ম সরি। আমি জানতাম না। কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করে ফেলেছি।
_ইট’স ওকে। এসো ভেতরে যাব। সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

ইরা সামিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকা মাত্রই মেঘের বাবা-মা বাবা-মা দু’জনই সামির কাছে গিয়ে সামিকে নিয়ে সোফায় বসেন। সামির শরীরের অবস্থা জিজ্ঞেস করে জানতে চান সামি কি খেতে চায়। সামি শুধু চা খেতে চায় বলে সম্মতি জানায়। মেঘের মা সামির জন্য চা তৈরি করতে বলে ইরাকে বলেন সামিকে নিয়ে সামির রুমটা দেখিয়ে দিতে। ইরা ওনার কথামতো সামিকে নিয়ে উপরের ঘরে যায়। একটা রুমের ভেতরে ঢুকে সামিকে নিয়ে। ভেতরে ঢুকেই সামি বেশ অবাক হয়। রুমটা খুব সুন্দর আর পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা। সামিকে বিছানায় বসিয়ে রেখে ইরা ওয়ারড্রব থেকে সামির জন্য একটা পাতলা টি-শার্ট আর প্যান্ট বের করে আনে। সামি ইরার হাতে এসব দেখে জিজ্ঞেস করল,

_ইরা এসব কেন?
_ওমা রোগী বলে কী? এতদিন হাসপাতালে ছিলে। তোমার শরীরটা অনেকটা দুর্বল। হাসপাতালে থাকাকালীন কত বাজে গন্ধ সহ্য করতে হয়েছে। এখন একটু ফ্রেশ হয়ে আসো আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসছি।
_কিন্তু ইরা আমি তো…

সামি একা একা ওয়াশরুমে যেতে পারবে না এটা ইরা ভুলে গিয়েছিল। সামির অমন মুখভার করে কথা বলাটা ইরার বুকে গিয়ে আঘাত করলো। ইরা সামির কাছে গিয়ে বসে বলল,

_তোমার অসুবিধা না থাকলে আমিই তোমার শরীর মুছে দিতে পারি।
_এটা ঠিক হবে না।
_কেন হবে না?
_আমরা দুজনই আলাদা আলাদা মানুষ। কোনো অধিকার নেই এই দায়িত্ব পালন করার।
_একজন রোগীর সেবা করা কী দায়িত্বের মাঝে পড়ে না?
_পড়ে, তারপরেও আমি চাই না তুমি আমাকে স্পর্শ করো।
_কেন সামি? আমি তোমাকে ছুঁয়ে দিলে কী তুমি অপবিত্র হয়ে যাবে?
_না ইরা। তুমি শুধু শুধু ভুল ভাবছো। আমি তো কেবল…
_থাক, আর বলতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।

৪১!!
ইরা সামির কথা থামিয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে যায়। একটা মগে সামান্য পানি আর পাতলা গামছা এনে সামির হাতে ধরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দরজাটা হালকা ধাক্কা দিয়ে যায়। সামি ইরার যাওয়ার পানে কিছু সময় তাকিয়ে মনেমনে বলল,

_তুমি জানো না ইরা কেন তোমাকে দূরে সরাচ্ছি। তুমি যতক্ষণ আমার কাছে থাক আমি কেবল তোমাতেই মগ্ন হয়ে যাই। কেমন যেন একটা টান সৃষ্টি হতে থাকে। তোমার ঐ দু’টো চোখ কেবল আমাকে বারবার চুম্বকের মতো কাছে টানে। আমি চাই না এই মায়ার মাঝে জড়াতে। সেইজন্যই তোমাকে এত দূরে সরিয়ে দিতে চাই। যাতে আমি তোমার মায়া উপেক্ষা করার শক্তি অর্জন করতে পারি।

সামি কথাগুলো বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর নিজেই নিজের টি-শার্ট খুলে ধীরেধীরে শরীরটা মুছে নিতে লাগে। পেটের কাঁটা অংশে যখন কাপড়ের স্পর্শ লাগে তখনই সামি ‘আহ’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। সামির চিৎকারে ইরা দ্রুত চায়ের কাপ নিয়ে ভেতরে ঢুকে। সেন্টার টেবিলে কাপটা রেখে সামির হাত থেকে গামছা এনে নিজেই সামির শরীর মুছে দিতে লেগে পড়ে। সামিকে বকা দিতে দিতে সামির শরীরটা মুছে দিচ্ছে ইরা।

_যে কাজ পারো না সেটা করতে যাও কেন?
_আমি পারবো তুমি যাও।
_বোকার মতো আমি কেবল মরুভূমির বালুচরে বৃক্ষ রোপণ করে সেই বৃক্ষের ছায়া পাওয়ার প্রতিক্ষায় আছি। অথচ সেই বালুচরে কখনও বৃক্ষ কেন একফোঁটা শিশিরকণারও জমে থাকার শক্তি নেই। প্রখর রোদ্রের জলন্ত শিখায় সেই চারা বৃক্ষের গাছটি অনেক আগেই মরে গেছে।
_মানে!
_এসব তুমি বুঝবে না সামি। বুঝলে এই প্রশ্নটা আজ করতে না।

ইরা কথাটা বলে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সামি রাগী চোখে ইরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা সামির দিকে পাত্তা না দিয়ে শরীর মুছে কাটার জায়গায় মলম লাগিয়ে দিল। যাতে সেলাইয়ের জায়গাটা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। সেলাই কাটা হলেও ক্ষতটা এখনও রয়ে গেছে তাই কিছুদিন সামিকে হাঁটাচলা একদম কমিয়ে দিতে হবে। হাঁটলেও খুব সাবধানে হাঁটতে হবে। নয়তো সেলাইয়ের জায়গায় টান খেলে সেফটিক হওয়ার চান্স বেড়ে যাবে। ইরা মলম লাগিয়ে একটা টি-শার্ট পরিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইরার হুটহাট অদ্ভুত অদ্ভুত এমন সব কথাবার্তার কোনো মানেই সামি বুঝলো না। অবশ্য সামি ইরার এসব কথায় খুব একটা মনযোগ দিল না। ইরা চলে গেলে সামি চা খেয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা করে নিতে ব্যস্ত হলো।

ইরা মেঘের রুমে গিয়ে দেখে মেঘ বিমর্ষ চেহারা নিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘের এমন মলিন চেহারা দেখে ইরার ভেতরে সাথে সাথেই চিন্তা ঢুকে যায়।

চলবে…

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here