ক্যানভাস_পর্ব : (৫)

0
608

#ক্যানভাস_পর্ব : (৫)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

সেন্টার টেবিলে ফোন রেখে ঘুমানোর জন্য লড়াই করছে। কিন্তু ঘুম আসেনা শ্রাবণের চোখে। বারবার আনুর ফেইসবুকের রিসেন্ট পোস্ট, একটা ছেলের সাথে এনগেজড্ হওয়া। তাঁর হাতে হাত রেখে ছবি আপলোড করা। উপরের নানান ক্যাপশন আরো বিভিন্ন কথা শ্রাবণের ভেতরে যন্ত্রণার পাহাড় গড়ে তুলছে। যে পাহাড়ের সীমানা অতিক্রম করার সাধ্য কারো নেই। যে পাহাড়ের বোঝা বয়ে বেড়ানোর মতো শক্তি কারো নেই। অথচ বাকি জীবন কি’না আনুকে ছাড়াই কাটাতে হবে। এসব ভাবতেই শ্রাবণের ভেতরে চিৎকারের আওয়াজ বাড়তে থাকে। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নের ছড়াছড়ি আনুকে নিয়ে। আনুর এই ঘটনার পিছনে কি কাহিনি থাকতে পারে সেটা ভাবছে শ্রাবণ। দুদিন আগেও ওদের সম্পর্কে এমন কিছু কথা উঠেনি যার ফলে আনু রাতারাতি শ্রাবণকে ভুলে আরেকজনের সাথে এনগেজড্ হয়ে যাবে? অনেক প্রশ্ন শ্রাবণের মনে ভীড় জমিয়েছে। যার উত্তর শ্রাবণের জানা নেই। জানার মাধ্যম একটা আর সেটা আনু নিজে। শ্রাবণ জানে না আর আনুর সাথে দেখা হবে কি না। তবে দেখা হলে আনুকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেই হবে। নয়তো শ্রাবণের অশান্ত মন শান্ত হবে না।

আনুর জন্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে শ্রাবণ। পরেরদিন নাশতার টেবিলে শ্রাবণের চুপচাপ থাকাটা শ্রাবণের বাবা-মাকে কিছু একটা ইঙ্গিত করে। মায়ের মন সবসময় সন্তানের কষ্ট উপলব্ধি করতে সক্ষম। তেমনি শ্রাবণের মা বুঝে নিলেন তাঁর ছেলে কোনো ব্যাপারে কষ্টে ভুগছে। শ্রাবণের মা শ্রাবণকে বললেন,

_ওইভাবে চুপটি মেরে আছিস কেন বাবা?
_না তো।
_কী হয়েছে তোর? তোর চোখগুলো ফুলা কেন?
_এটা তেমন কিছুনা, রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি।
_তাহলে আজকে অফিস যাওয়ার দরকার নেই। পারলে বাইরে থেকে একটু ঘুরে আয়।
_ঠিক আছে চেষ্টা করব।

শ্রাবণ চুপচাপ নাশতা শেষ করে নিরব হয়ে সোফায় বসে স্পর্টস চ্যানেলে খেলা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুসময় পর সাকিবের কল পেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় শ্রাবণ। সাকিবের সাথে কথা বলতে বলতে একটা ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়ায়। আশেপাশে ভালো করে দেখে ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করে। অফিস কক্ষের সামনে গিয়ে প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে চায়। প্রিন্সিপাল স্যার কারণ জানতে চাইলে বলে একজনের খোঁজ করতে এসেছে। শ্রাবণ স্যারদেরকে বারবার কাশফিয়া হাসান মেঘের ঠিকানা দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকে। শুধু ঠিকানা নয় মেঘের একটা ছবি যাতে ওনারা শ্রাবণকে দেখান সেইজন্য রিকুয়েস্ট করতে থাকে, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। ওনাদের একটা কথা ওনারা অপরিচিত কারো হাতে মেঘের ছবি দিয়ে মেঘের ক্ষতি করতে চান না। তাই সোজা শ্রাবণকে না করে দেন। শ্রাবণ মন খারাপ করে সাকিবকে নিয়ে ভার্সিটির ক্যাম্পাসে অপেক্ষা করতে থাকে। শ্রাবণ সাকিবকে বলল,

_ওরা ঠিকানা দিবে কি না সেটা তোর আগে জেনে আসা উচিৎ ছিল।
_আমি বুঝতে পারিনি ওনারা এইভাবে আমাদের ফিরিয়ে দিবেন। মেঘ একজন নামকরা চিত্রশিল্পী তাই তাঁর বিপদের কথা ভেবে হয়তো দেননি। সেলিব্রিটিদের তো আবার বিপদের অভাব হয় না।
_বাজে কথা বলিস না। মেয়েটা ভালো থাকুক এটাই চাই। কিন্তু যার জন্য এখানে আসা তাকেই তো পেলাম না।
_আমরা আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে পারি।
_আমার মনে হয় না সাকিব, মেঘ আজকে আর আসবে।
_অপেক্ষা করে দেখি আরো কিছুসময়।
_ঠিক আছে তোর ইচ্ছে।

দুজনে মিলে বেশ কয়েকঘন্টা বটতলায় বসে থাকে। কখনও ক্যান্টিনে যায় আবার কখনও ভার্সিটির গেইটের কাছে আসে। এসব করতে করতে তিনঘন্টা পেরিয়ে যায়, তবুও মেঘ আর আসে না। শ্রাবণ আর বেশি অপেক্ষা না করে সাকিবকে নিয়ে চলে আসে মেঘের ভার্সিটি থেকে।

১১!!
বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা…
মেঘ রেডি হয় ভার্সিটি যাওয়ার জন্য। সব ক্যানভাস গুলো একসাথে নিয়ে গাড়িতে তুলে। তারপর নওরিনকে আসতে বলে ভার্সিটির পথে বেরিয়ে পড়ে মেঘ। ভার্সিটি পৌঁছে সবগুলো ক্যানভাস কমনরুমে রেখে অপেক্ষা করতে লাগল আদনাদের জন্য। নওরিন আসতেই নওরিনকে জিজ্ঞেস করল আদনান কখন আসবে। নওরিন কিছু জানেনা বলে উত্তর দিতে পারল না। দুজনে মিলে ক্লাস শেষ করে নিল। তারপর আবার কমনরুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল আদনানের জন্য। নওরিন জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে আদনান আসছে। কিন্তু আদনান একা নয় সাথে শ্রাবণ আর শ্রাবণের আরেকবন্ধু। নওরিন বেশ অবাক হয়, শ্রাবণের তো আসার কথা ছিল না। তাহলে আসলো যে? মেঘ রাগে জ্বলছে আদনানের উপর কিন্তু রাগ প্রয়োগ করা যাবে না। অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। চট করেই মেঘ একটা আইডিয়া বের করে, আর সেই আইডিয়া অনুযায়ী নওরিনকে অভিনয় করতে বলে। আদনান নওরিনের খোঁজ করতে করতে কমনরুমের কাছে আসে। ঠিক তখনই মেঘ সব ক্যানভাস গুলো নিয়ে বের হয়। সব গুলো ক্যানভাস গিফট কাগজ দিয়ে মুরানো। তাই ভেতরে আঁকা ক্যানভাসের আসল চেহারা দেখা যাচ্ছে না। শ্রাবণ এগিয়ে যায় মেঘের দিকে। মেঘকে দেখে বেশ অবাক হয় শ্রাবণ। মেঘ কোনো কথা না বলে চুপচাপ ক্যানভাস গুলো তুলে দেয় শ্রাবণের হাতে। শ্রাবণ মেঘের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,

_আমি শ্রাবণ মাহমুদ। আপনি সেই মেয়ে তাই না, যে সেদিনের স্কেচটা এঁকেছিলেন?
_সরি আপনি ভুল ভাবছেন।
_কীসের ভুল? ওহ আপনি সেদিনের ব্যবহারের জন্য কষ্ট পেয়েছেন। আমি সরি বলছি আনুর হয়ে প্লিজ মনে কিছু নিবেন না।
_সেদিনের সব কথা আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি। এসব মনে রেখে আরেকজনের গায়ে আমি থু থু ফেলতে চাই না। আর আপনি যা ভাবছেন ভুল ভাবছেন আমি মেঘ নই। আমি মেঘের বন্ধু রাত্রি।
_ওহ সরি। আসলে আপনার হাতে ক্যানভাস গুলো দেখে আমি আপনাকে মেঘ বলে ভেবে নিয়েছি। ক্যানভাস নিয়ে তো মেঘের আসার কথা?
_হ্যাঁ মেঘ এখানেই ছিল, কিন্তু বাসা থেকে জরুরি ফোন আসায় চলে যায়। আপনার জন্য আনা ক্যানভাস গুলো আমার হাতে দিয়ে বলে, আমি যেন এই ক্যানভাস গুলো আপনার হাতে তুলে দেই।
_ওহ,
_এই নিন, মেঘের রেখে যাওয়া আপনার জন্য কিছু উপহার।
_কী কী আছে এখানে?
_আপনি নিজে গিয়ে দেখবেন, আজ আসছি।

মেঘ, নওরিন চলে আসতে নিলে শ্রাবণ মেঘকে আটকে নেয়। শ্রাবণ মেঘের সাথে কিছু দরকারি কথা বলতে চায়। ওদেরকে সুযোগ দিয়ে আদনান নওরিনকে আলাদা সরিয়ে নেয়। এমনভাবে নওরিনের হাত চেপে ধরে যে নওরিন ব্যথায় আদনানকে ধমক দিয়ে উঠল,

_কী করছেনটা কি? হাতে ব্যথা লাগছে।
_সরি, মেঘের অভিনয় দেখে রাগ সামলাতে পারছি না।
_এখানে রেগে যাওয়ার কি আছে? মেঘ যা বলল নিজের কানেই তো শুনলেন, তাহলে আবার আমাকে টেনে আনলেন কেন?
_মেঘ মিথ্যে বলল কেন?
_সেদিনের ঘটনার জন্য।
_কোনদিনের জন্য?

নওরিন সব কথা আদনানকে খুলে বলে। নওরিনের কথা শুনে আদনান কপালে হাত দিয়ে নওরিনকে বলল,

_সরি ওইভাবে রিয়েক্ট করার জন্য। আমি জানতাম না ওদের আজকের আগেও দেখা হয়েছে।
_সেটা ক্ষণিকের দেখা ছিল। শ্রাবণ ভাইয়া তখনও জানতেন না, এই সেই মেঘ যে শ্রাবণ ভাইয়াকে নিয়ে শত স্বপ্ন বুনে যাচ্ছে। এই সেই মেঘ যে নিজের স্বপ্নে দেখা পুরুষকে স্কেচের মাধ্যমে তুলে ধরেছে। কিন্তু মেঘ নিজেও জানতো না ওর এই স্বপ্ন ওকে এতটা কষ্ট ফিরিয়ে দিবে।
_মানে!
_আজ মেঘ নিজের পরিচয় লুকিয়েছে শুধুমাত্র নিজের ভালোবাসাটাকে লুকানোর জন্য। নিজের অনুভূতিটাকে চাপা দেওয়ার জন্য। এই রাত্রি নামের আড়ালে হারিয়ে যাবে মেঘের মনের সকল চাওয়া পাওয়া।
_মেঘের ভালোবাসা?
_হ্যাঁ, মেঘ এতদিনে স্বপ্নে দেখা সেই ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু; মেঘের এই ভালোবাসা সেটাও ছিল ক্ষণিকের মেহমান। সেদিন শ্রাবণ ভাইয়ার সাথে ওনার গার্লফ্রেন্ডকে দেখে মেঘ যতটা না কষ্ট পেয়েছে তাঁর থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছে ওই মেয়ের করা ব্যবহার গুলোতে। যার জন্য মেঘ আজ নিজেকে আড়াল করে নিল।
_এইভাবে কতদিন?
_হয়তো যতদিন বেঁচে আছে ততদিন।
_একদিন তো শ্রাবণ সব সত্যি জানবে।
_জানলে জানুক, তাতে ওর কিছু যায় আসে না।
_একটা মানুষ কীভাবে নিজেকে এতো কষ্ট দিতে পারে?
_সেটা আমি নিজেও জানি না। প্লিজ আপনি এই সত্যি গুলো কোনোদিনও শ্রাবণ ভাইয়াকে জানাবেন না। মেঘ জানতে পারলে আমার উপর খুব রাগ করবে।
_ঠিক আছে, এটা লুকিয়ে কি লাভ হবে আমি জানি না। শুধু আমি একটা কথা বলতে পারি, মেঘের ভালোবাসাকে আমি হেরে যেতে দিব না।
_সেটা কীভাবে?
_ভয় পেও না। আজকের কথা শ্রাবণ কোনদিনও জানবে না। সবটা আমার উপর ছেড়ে দাও, আমি সামলে নিব।
_কী করবেন আপনি?
_সেটা সময় বলবে।

এরপর দুজনে আরো অনেক আলোচনা করে। শ্রাবণ মেঘের সাথে কথা বলতে গিয়ে মেঘের সব তথ্য জানার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু মেঘ কোনো তথ্য দিতে রাজী না। শ্রাবণ মেঘকে বলল,

_একবার তো তাঁর সাথে দেখা করার সুযোগ দিন।
_আমি মেঘকে বলে দেখব, যদি মেঘ আপনার সাথে দেখা করতে রাজী হয় তাহলে আমি আপনাকে জানাব।
_মেঘের ফোন নাম্বার, বা ফেইসবুক একাউন্ট কোনো কিছু দেওয়া যাবে?
_হ্যাঁ, নাম্বার দিতে পারব না তবে ফেইসবুক একাউন্ট রাখতে পারেন।
_থেংক ইউ।

মেঘ নিজের ফেইসবুক একাউন্ট শ্রাবণকে দিয়ে শ্রাবণের থেকে বিদায় নেয় নওরিনকে নিয়ে। নওরিন আর মেঘ চলে আসলে শ্রাবণ আর আদনান একসাথে বাসায় আসার পথে রওনা দেয়। বাসায় আসার পথে শ্রাবণ আদনানকে আনুর কথা বলে। সব কথা জানার পর আদনান চুপচাপ বসে আছে। আদনান ভাবছে কীভাবে শ্রাবণকে সত্যিকারের ভালোবাসাকে উপলব্ধি করাতে শিখাবে? আবার আনুর কথা ভাবতে গিয়েই মনে পড়ে আনুর ভালোবাসাটাও সত্যি ছিল। যার মাঝে মিথ্যের কোনো ছায়া ছিল না। তাহলে আজ কেন আনু শ্রাবণকে একা রেখে আরেকজনের হাত ধরার সিদ্ধান্ত নিল? আনুর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে যা শ্রাবণ জানে না।

আদনানের বাসার কাছে আসতেই আদনান শ্রাবণকে বিদায় দিয়ে নেমে পড়ে। শ্রাবণ নিজেদের বাসার দিকে গাড়ি ঘুরায়। কয়েক মিনিট পর বাসায় এসে সব ক্যানভাস গুলো নিয়ে নিজের রুমে যায়। শ্রাবণের মা শ্রাবণের হাতে এসব দেখে জিজ্ঞেস করলে শ্রাবণ মেঘের কথা বলে। শ্রাবণের মা মেঘের কথা শুনে বেশ অবাক হন। একটা মেয়ে না দেখে তাঁর ছেলের ছবি এতো যত্ন করে এঁকেছে নিশ্চয়ই সে মেয়ের মনটা অনেক সুন্দর আর গুছানো। শ্রাবণ একটা একটা করে সবগুলো ক্যানভাসের বাঁধন খুলে। তারপর মুড়িয়ে রাখা কাগজ গুলো খুলতে থাকে। প্রথমটা খুলে শ্রাবণ বেশ অবাক হয় এটা শ্রাবণের চোখের একপাশের অংশ। এরপর আরেকটাকে শুধু আবছা দুটো চোখের স্কেচ, অন্যটাতে চোখ, নাক, মুখের স্কেচ আর আরেকটাতে শ্রাবণের সম্পূর্ণ চেহারায় স্কেচ। আর লাস্ট #ক্যানভাসটা বেশি আকর্ষণীয় যার মাঝে শ্রাবণের মুখের একপাশের অংশ থেকে শুরু করে ঘাড়ের শেষ পর্যন্ত স্কেচ। শ্রাবণ সবগুলো স্কেচ যত্ন করে ছুঁয়ে দেয়। নিজের রুমের দেয়ালে সবগুলো স্কেচ টানিয়ে রাখে।

১২!!
ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে অনলাইনে ঢুকে মেঘের ম্যাসেজ বক্সে ঢু মারে। চট করেই একটা টেক্সট পাঠিয়ে দেয় মেঘের আইডিতে। মেঘ গল্পের একটা বই নিয়ে তখন পড়তে ব্যস্ত ছিল। ম্যাসেজ টিউন শুনে ফোন হাতে নিয়ে চেক করে দেখে শ্রাবণ মাহমুদ আইডি থেকে একটা ছোট ম্যাসেজ।

_হাই চিত্রশিল্পী!
_হ্যালো, আপনার ক্যানভাস গুলো পেয়েছেন?
_হুম পেলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনাকে দেখা হলো না।
_আপনার জিনিস পৌঁছাতে পেরেছি এটাই অনেক। আমাকে দেখে কী করবেন?
_যে আমাকে নিজের কল্পনার মাঝে সারাক্ষণ সাজিয়ে রাখে তাকে দেখাটা কি খুব বড় অন্যায়?
_অন্যায় হবে কেন? তখন মা ফোন করে বাসায় আসতে বলল তাই চলে আসি।
_যে মানুষটার মন এতো সুন্দর! যার ভাবনা এতো সাজানো গুছানো, যার চিন্তাধারা এতো পরিপাটি। নিশ্চয়ই সে আল্লাহর সৃষ্টির অন্যতম এক সুন্দর সৃষ্টি।
_কবি কবি ভাব।
_বলতে পারো, যাই হোক কেমন আছো?
_আমি ভালো আছি, আপনি?
_আমিও ভালো আছি, আবার ভালো না।
_এটা কেমন?
_ভালো এইজন্য আপনার আঁকা সেরা ক্যানভাস গুলো পেয়ে। আবার ভালো না এইজন্য আজ যাকে দেখতে ক্যাম্পাসে গেলাম তাকেই পেলাম না। আমার খুব ইচ্ছে ছিল আপনাকে একবার সামনে থেকে দেখব। কিন্তু আফসোস! আমাদের দেখা হল না।
_আজ হয়নি তো কি হয়েছে, অন্যদিন হবে!
_কবে হবে?
_আল্লাহর উপর ছেড়ে দিন।
_দিলাম, কী করছেন?
_গল্পের বই পড়ছি।
_বাহ্! ভালো তো।
_আপনি কী করছেন?
_এইতো ক্যানভাস গুলোকে দুচোখ ভরে দেখছি। দেখছি একজন শিল্পীর জাদুর হাতে ছোঁয়া কিছু আর্টস।
_ইশ! আচ্ছা পরে একসময় কথা হবে। এখন একটু ঘুমাবো।
_ওকে বাই।

মেঘ তাড়াতাড়ি ডাটা অফ করে অফলাইনে এসে গল্পের বই পড়তে মনোযোগ দেয়। যত অনলাইনে থাকবে ততই বকবক করে মাথা খাবে। এসব ছেলেরা এমন-ই। বই পড়তে পড়তে মেঘ যে কখন ঘুমিয়ে পড়ল সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সন্ধ্যেবেলা কিছু আর্টস নিয়ে বসে। আগামীতে আরো ভালো আর্টস সবাইকে উপহার দিতে হবে। সবাই যে এই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার জন্য সুন্দর একটা ক্যানভাস উপহার দেওয়া মেঘের দায়িত্ব। মেঘ আপনমনে আঁকা-আঁকিতে ব্যস্ত।

শ্রাবণের বাবা-মা শ্রাবণের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওনারা চান শ্রাবণের বউকে এইবার ঘরে আনতে। মেয়েও তাঁদের পছন্দ শুধু শ্রাবণের হ্যাঁ বলার পালা। শ্রাবণের মা শ্রাবণের রুমে যান শ্রাবণকে খাবার খেতে ডাকার জন্য। শ্রাবণ তখন ল্যাপটপে কাজ করতে ব্যস্ত। শ্রাবণের মা শ্রাবণের পাশে বসে শ্রাবণকে বললেন,

_এইবার আর অমত করিস না শ্রাবণ।
_কোন ব্যাপারে?
_তোর বিয়ের।

বিয়ের কথা শুনেই শ্রাবণ শকড্ খায়। কীভাবে এখন অন্যকাউকে বিয়ে করবে? শ্রাবণ যে আনিকাকে খুব ভালোবাসে। আনিকা ছাড়া আর কাউকে বিয়ে সম্ভব না শ্রাবণের পক্ষে। শ্রাবণের মা ওনার কথা বলে ওনি শ্রাবণের হাতে একটা নাম্বার দিয়ে চলে যান। শ্রাবণ হা করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। শ্রাবণের মা শ্রাবণকে বলে যান, ফোনে কথা বলার পর যদি সামনা-সামনি দেখা করার প্রয়োজন পড়ে তাহলে একদিন সময় করে দুজনে দেখা করে। শ্রাবণ বোবার মতো নাম্বারটা হাতে নিয়ে বসে রইল। সাকিব, আদনান দুজনকেই এই মেয়ের ব্যাপারে বলল। দুজনেই একসাথে বলল বিয়ে করে নিতে। আনিকা যদি নিজেকে ভালো রাখতে আরেকজনের হাত ধরতে পারে তাহলে শ্রাবণ কেন পারে না? আরো অনেক কিছু শ্রাবণকে বুঝালো। শ্রাবণ রাতে ওদের দুজনের কথা অনেক ভাবলো। তারপর মায়ের রেখে যাওয়া নাম্বারটা ফোনে তুলে সেই নাম্বারে ডায়াল করল। কয়েকবার রিংটোন বাজতেই ওপাশের মানুষটা ফোন পিক করল। শ্রাবণ তখন মেয়েটাকে বলল,

_আপনি কি কালকে আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?
_কাল!
_কালতো শুক্রবার অসুবিধা কোথায়? যেহেতু আমরা সারাজীবন একসাথে কাটাবো, সেহেতু আমাদের একে অপরকে দেখে নেওয়া উচিত। দুজন দুজনকে চিনে নেওয়া উচিত।
_আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় আসতে হবে?

শ্রাবণ মায়ের পছন্দ করা মেয়েটাকে একটা ঠিকানা বলে দেয়। তারপর দুজনে ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

১৩!!
সকালে শ্রাবণ রেডি হয়ে নেয় সেই মেয়েটার সাথে দেখা করবে বলে। সাকিব আর আদনানের থেকে অনেকগুলো টিপস নেয় কীভাবে সবটা হ্যান্ডেল করবে। রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হয়। জানতে পারে মেয়েটা অলরেডি আগেই পৌঁছে গেছে শ্রাবণের সাথে দেখা করার জন্য। শ্রাবণ কফিশপে ঢুকে মেয়েটার ফোন নাম্বারে কল করে। আশেপাশেই ফোনটা বেজে উঠতেই শ্রাবণ পিছু ঘুরে তাকিয়ে দেখে রাত্রি মানে মেঘের ফোন বাজছে। শ্রাবণ চারশো বিশ ভোল্টেজের শকড খেয়ে মেঘের অপজিটের চেয়ারে বসে। দুজনই মনে হয় ভীষণ রকম অবাক হয়েছে দুজনকে দেখে। মেঘ তো চোখের পাতা ফেলছেই না। আর শ্রাবণ বোবা হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে শ্রাবণ কিছু খাবার অর্ডার করে মেঘকে বলল,

_আপনি এখানে?
_আমার ও তো একই প্রশ্ন আপনি এখানে? অবাক হলাম আপনাকে দেখে।
_আমরা দুজনেই দুজনকে চিনি, অথচ জানতামই না আজ আমাদের দুজনের পরিবার আমাদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
_হ্যাঁ, কিন্তু আপনি খুশি তো?
_এই প্রশ্ন কেন করছেন?
_না মানে! সেদিন তো আপনার গার্লফ্রেন্ড?
_ভয় নেই, আমি আপনার অমর্যাদা করবো না, কিন্তু একটা কথা সত্যি আমি আনিকাকে এখনও ভালোবাসি।
_তাহলে এই বিয়েতে মত দিচ্ছেন কেন? আরেকটা মনকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগবে বুঝি?
_সেটা নয়, আমি আনিকাকে ভুলবো বলেই আপনাকে বিয়ে করতে মত দিয়েছি। জানি আপনাকে কষ্টের বদলে ভালোবাসা দিতে পারব না তবুও চেষ্টা করবো।
_এসব সিনেমা নয় মি. একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করা। এটা শুধু সিনেমাতেই ভালো মানায়, বাস্তবে নয়।
_জানি, কিন্তু তাকে ভুলার একটা সুযোগ কি আমায় দেয়া যায় না?
_মানে!
_দেখুন রাত্রি আমি আপনাকে এর আগে যতবার দেখেছি ততবারই মনে হয়েছে, আমি সেদিন আপনাকে চাইলেই অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারতাম। অথচ নিজের গার্লফ্রেন্ডের কথা ভেবে সেদিন চুপ করে ছিলাম। তাই চাই সেদিনের করা ভুলের মাশুল দিতে।
_আপনার গার্লফ্রেন্ড তো কষ্ট পাবে।
_যে আমার নেই সে আমার জন্য কষ্ট পাবে না রাত্রি।
_কেন?
_অলরেডি সিঙ্গাপুর গিয়ে এনগেজড্ হয়ে গেছে।
_কী! কী বলছেন? কবে ঘটেছে এসব?
_এইতো কয়েকদিন আগে। যাই হোক, আপনার কাছে ক্ষমা চাইবার একটা সুযোগটা দিন।
_কিন্তু!
_কোনো কিন্তু নয়, আমি কথা দিচ্ছি আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।
_আপনি যখন এতো করে চাইছেন তাহলে আমি বাধা দিব না। আর আমি আমার বাবা-মায়ের ইচ্ছাকে খুব সম্মান করি।
_থেংক ইউ।

দুজনে আরো অনেক কথাবার্তা বলে। খেতে খেতে অনেক আড্ডা দেয়। তারপর সারাদিন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সারাদিন দুজনে অনেক ইনজয় করে কাটায়। বিদায়বেলা শ্রাবণ মেঘকে মেঘের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে চায়। মেঘ শ্রাবণকে আটকে নেয়। শ্রাবণ আসতে না চাইলেও মেঘ শ্রাবণকে ভেতরে নিয়ে আসে। মেঘের মা শ্রাবণকে দেখে মেঘকে চোখ মারেন।মেঘ মাকে পালটা চোখ মেরে শ্রাবণকে বসিয়ে রেখে নিজের রুমে যায়। হাতের ব্যাগটা রুমে রেখে আবারও শ্রাবণের পাশে আসে। মেঘের মা ততক্ষণে শ্রাবণের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here