#ক্যানভাস_পর্ব : (৭)
লেখনীতে : তামান্না রাহাত তানু
খুঁজতে খুঁজতে সামিকে দেখতে পায়। সামি চেয়ারে বসে হাতে বিয়ারের বোতল নিয়ে বিয়ার গিলতে যাচ্ছে। সামি যেই বিয়ারটা মুখে দিতে যায় অমনি ইরা এক চড়ে সামির গাল লাল করে দেয়। সামির হাত থেকে বিয়ারের বোতলটা নিচে পড়ে যায়। ধুম করে আওয়াজ হলেও আশেপাশে কারো কানে এর শব্দ পৌঁছায়নি, কারণ; খুব জুড়ে মিউজিক বাজছে। সামি লাল লাল চোখ করে ইরার দিকে তাকায়। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইরাকে চড় মারতে যাবে ইরা সাথে সাথে সামির হাতটা ধরে নেয়। ইরা রাগে সামিকে বলে উঠল,
_কী ভাবো তুমি নিজেকে? একদম হিরো হয়ে গেছো তাই না? জ্ঞান বলতে কিছুই নেই তোমার মাঝে।
_আর ইউ ম্যাড?
_আরে ম্যাড তো তুমি। একতরফা ভেবে ভেবে নিজেই একা-একা কষ্ট পাচ্ছো আর সেই কষ্টে আমাকে তিলে-তিলে শেষ করছো।
_এক্সকিউজ মি ম্যাম! আমার মনে হয় আপনি পাগল হয়ে গেছেন? আপনাকে পাবনা মেন্টাল ক্লিনিকে এডমিট করা উচিৎ।
_আবার একটা কথা বললে, ঠাস করে আরেকটা চড় দিয়ে ওইপাশের গালটাও লাল করে দিব। ফাজিল কোথাকার।
_আজব তো! কে আপনি এইভাবে আমাকে শাসাচ্ছেন কেন?
_আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে?
সামি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। ইরার হাতটা মুচড়ে ধরে আস্তে করে ইরার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
_ডান্স করেছি বলে ভেবে নিও না আমি তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তোমার মতো হাজার হাজার মেয়ে আমার পিছনে ঘুরে। আমি ইচ্ছে করেই তাঁদের পাত্তা দেই না।
_ওহ রিয়েলি! তুমি যে বোকা তাঁর প্রমাণ আবারও দিলে। আমি জাস্ট অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমার এই চেহারা দেখে।
_মানে!
_যে রোজ রোজ বিরহের স্ট্যাটাস দেয় সে আর যাই হোক মেয়েদের রিজেক্ট করার সাহস রাখতে পারে না।
_স্ট্যাটাস! কোন স্ট্যাটাস? কে তুমি?
_আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে? হাতে ব্যথা লাগছে হাত ছাড়। নয়তো আমি চিৎকার করে সবাইকে বলব তুমি জোর করে আমাকে…
_জাস্ট অসহ্য! যাও এখান থেকে।
সামি ইরার কথায় ইরাকে ছেড়ে দেয়। ইরা দৌঁড়ে পালায়। ইরা চলে যাওয়ার পর সামি ভাবতে থাকে ইরাকে নিয়ে। কে এই ইরা? কী পরিচয় তাঁর? আর ফেইসবুকের স্ট্যাটাসটাই বা জানলো কীভাবে? কোন আইডি থেকে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে এই ইরা? সামি ভাবতে ভাবতে কিছু বের করতে পারে না। কারণ ইরা নামের কেউ সামির ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। মাথা বেশি না ঘামিয়ে আদনানের কাছে যায়।
১৬!!
মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে বলল,
_আমাদের এবারের জুটি দুজন। যারা এখন আমাদের সবার সামনে গানের সাথে নাচ পরিবেশনা করবে। তাঁরা হলো আমাদের আদনান কবির আর চিত্রশিল্পী ঈশানা নওরিন।
সামির মুখে নামগুলো শুনে নওরিন বড় করে কাশি দেয়। নওরিনের এই অবস্থা দেখে আদনান মুচকি হাসে। মেঘ নওরিনকে ইশারা দিতেই নওরিন এগিয়ে যায় স্টেজে। সব আলো নিবে যায়। কিছু রঙিন বাতির মিটিমিটি আলোতে নওরিন নিজের ডানহাতটা উপরে রেখে বা’হাতটা ডানপায়ের কাছে নিয়ে পা মুড়িয়ে ফ্লোরে বসে। আদনান এক হাঁটু নিচে ফেলে অন্য হাঁটু অল্প ফ্লোরে চেপে নিজের দু’হাত দিয়ে নওরিনের দুহাত আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে ধরে। মিউজিক অন হওয়ার সাথে সাথে ডান্স শুরু করে দু’জনে।
“কেন রে তোর মাঝে ডুবে থাকি সারাক্ষণ?
কে আমার তুই শুধু জানে আমার এ মন?
মন প্রিয়া, তোর স্বপ্নে বিভোর!
কাটেনা ঘোর! লাগে এতো আপন।”
একে অপরের মাঝে মিশে গানের তালে তালে নাচতে ব্যস্ত। নাচের একেক ভঙ্গিতে আদনান আর নওরিন একে অপরের অনেক কাছাকাছি আসছে। আদনান নওরিকে এক হাত দিয়ে ধরে অন্যহাত নওরিনের কোমরে রাখে। নওরিন হাল্কা কেঁপে উঠে। চোখ বন্ধ করে আবারও তাকায় আদনানের দিকে। আদনান দু’চোখ ভরে দেখতে ব্যস্ত নওরিনকে। নওরিন মাথা নিচের দিকে নামিয়ে নিজের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দেয় আদনানের হাতের উপর। আদনান আরেকটু ঝুকে পড়ে নওরিনের দিকে। কিছুক্ষণ এভাবে থেকে নওরিনকে ঘুরিয়ে কোলে তুলে নেয় আদনান। নওরিন ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। আদনান নওরিনকে দাঁড় করিয়ে নওরিনের পিঠে হাত রেখে এক পা তুলে নওরিনের মাথা আবার নিচের দিকে নামিয়ে রাখে। এইভাবে বিভিন্ন এঙ্গেলে নাচতে থাকে এই জুটি। সাথে মিউজিকের তালে তালে গান তো আছেই।
“ঘুম দেশে তুই, জাগরণে তুই,
তুই বেঁচে থাকার কারণ।
যদি না দেখি, তোর এই আঁকি,
যেন আসেরে মরণ।।
মন প্রিয়া, তোর স্বপ্নে বিভোর!
কাটেনা ঘোর! লাগে এতো আপন।”
“এ কথা বলার, একাকি চলার,
পথ হবে কি আর শেষ?
হয়েছি উজাড়, আজই বারে বার,
সবখানে তোর আবেশ।।
মন প্রিয়া, তোর স্বপ্নে বিভোর!
কাটেনা ঘোর! লাগে এতো আপন।”
আদনান ধীরে ধীরে ফ্লোরে বসে পড়ে। নওরিন আদনানের কোলের উপর বসে আদনানের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখে। আদনান নিজের দুহাত নওরিনের দু’হাতে চেপে ধরে নওরিনের কোমর চেপে ধরে। দুজনে ঠোঁট নেড়ে গান গাইতে গাইতে গান শেষ করতে থাকে।
“কেন রে তোর মাঝে ডুবে থাকি সারাক্ষণ?
কে আমার তুই শুধু জানে আমার এ মন?
মন প্রিয়া, তোর স্বপ্নে বিভোর!
কাটেনা ঘোর! লাগে এতো আপন।”
মিউজিক শেষ অথচ নওরিন আর আদনান এখনও একইভাবে বসে আছে। মেঘ ঠোঁট দিয়ে শিষ বাজাতেই নওরিন কেঁপে উঠে। তাড়াতাড়ি আদনানের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। উড়নাটা ঠিক করেই দৌঁড়ে চলে আসে স্টেজ থেকে। আদনান মেঘের দিকে তাকিয়ে হাসতেই মেঘও হেসে উঠে। মেঘ হাত দিয়ে বুঝায় ‘খুব মানিয়েছে।’ আদনান আবারও মুচকি হেসে স্টেজ থেকে নেমে আসে।
১৭!!
কিছুসময় ব্রেকের পর আদনার আর সামি দুজনেই আবার মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে নেক্সট জুটির নাম ঘোষণা করতে থাকে।
_এবারের জুটি তারাই যাদের জন্য আজকের এই আয়োজন। যাদেরকে নতুন জীবনের জন্য এগিয়ে দিতে আজকের এই সন্ধ্যা। সেই দু’জন ভাগ্যবান আর কেউ না আমাদের মেঘ ওফসস সরি রাত্রি আর শ্রাবণ। এই দু’জন কাপলের জন্য হাততালি হয়ে যাক।
এনাউন্সমেন্টের পর সবাই হাততালি দিতে থাকে। মেঘ রাগী চোখে সামির দিকে তাকায় আবার শ্রাবণের দিকে তাকায়। সামি কানে হাত দিয়ে বলে ‘সরি মিস্টেক হয়ে গেছে, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে, ইচ্ছে করে করিনি।’ মেঘ শুধু রাগ দেখায় আর মনেমনে ভাবে শ্রাবণ কিছু শুনলো কি না? অন্যদিকে শ্রাবণ একবারে অন্যমনস্ক। সামির কথা শ্রাবণের কানেই যায়নি। শ্রাবণ মেঘের দিকে তাকিয়ে চোখ নাড়া দিয়ে বলল,
_কী দেখছো?
_কিছু শুনতে পাওনি?
_কী শুনব?
_বাঁচা গেছে। ( মিনমিন করে) আমাদের দুজনকে ডান্স করতে হবে।
_ওহ, কিন্তু আমি তো ডান্স জা নিনা।
_আমি আছি তো। সব শিখিয়ে নিব। রাত্রি থাকতে শ্রাবণ ডান্স পারবে না এটা হয় না।এসো…
মেঘ নিজের হাত বাড়িয়ে দেয় শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ মনেমনে কি সব চিন্তা করে মেঘের হাতে নিজের হাত রাখে। মেঘ শ্রাবণের হাত ধরে এগিয়ে যায় স্টেজের দিকে। চারিদিক সম্পূর্ণ অন্ধকার। কয়েকটা লাল, নীল, সবুজ, বাতির আলো নিবু নিবু জ্বলে আবছা আলোর একটা প্রকৃতির সৃষ্টি করেছে। যে আবছা আলোতে শুধু দু’জনকেই দেখা যাচ্ছে। মিউজিক শুরু সাথে ডান্সও শুরু।
“মে দুনিয়া ভুলাদুঙ্গা, তেরি চাহাত মে।
হ দুশমন জামানা, মুজে না ভুলানা,
মে খুদকো মিটাদুঙ্গা, তেরি চাহাত মে।”
“মে দুনিয়া ভুলাদুঙ্গি, তেরি চাহাত মে।
তেরা সাথ জুটা, ইয়ে ওয়াদা জো তোটা,
মে খুদকো মিটাদুঙ্গি, তেরি চাহাত মে।”
দুজনেই একেবারে হারিয়ে যাচ্ছে গানের মাঝে। শ্রাবণ গানের ঘোরেই মেঘকে বারবার স্পর্শ করছে। শ্রাবণের আলতো হাতের স্পর্শ মেঘকে প্রতিবারই কাঁপাচ্ছে। মেঘের গালে হাত রাখতেই মেঘ ঘোরের মাঝে চলে যায়। শ্রাবণ মেঘকে হাতের উপর ভর করিয়ে উপরে তুলে। মেঘ সাথে সাথেই শ্রাবণের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নেয়। নিরব গানের সাথে তাল মিলিয়ে খুব সুন্দরভাবে নেচে যাচ্ছে একটি সুন্দর জুটি। যদিও শ্রাবণ নাচতে জানেনা তারপরেও মেঘের সাথে তাল মিলিয়ে মুটামুটি নাচের একটা আইডিয়া বুঝতে পেরেছে শ্রাবণ। তাই সেই অনুযায়ী নাচের তাল ঠিক রাখার চেষ্টা করছে দুজনে।
“মেরি সাসে, তেরি খুশবু!
মেরি দিলমে, তেরি দারকান!
মেরি মেহফিল, তেরি বাতি।
মেরি আঁকে, তেরা দার্পান।
বিন তেরে কুচবি নেহি মে,
বিন তেরে কুচবি নেহি মে।”
“মে সাব কুচ লুটাদুঙ্গা, তেরি চাহাত মে।
হ দুশমন জামানা, মুজে না ভুলানা,
মে খুদকো মিটাদুঙ্গা, তেরি চাহাত মে।।”
গানটা যেমন দুজনের মনে নাড়া দিচ্ছে। ঠিক এই গানের নাচটা সবার মনে গিয়ে নাড়া দিচ্ছে। সবাই মিউজিকের তালে তালে হাততালি দিয়েই চলেছে আর সেই হাততালির জোর শ্রাবণ আর মেঘের নাচের গতি আরো বাড়িয়ে দিল। দু’জনে স্টেজটা মাতিয়ে তুলছে।
“সিনে মে লাগজা তু,
মে হু তেরা দিওয়ানা।
মুজে তুজসে মিলনে সে,
রুখেগা ক্যায়া এ জামানা।”
চু রুঙ্গা না সাথ তেরা,
চু রুঙ্গা না সাথ তেরা।।”
“মে হারগাম উঠালুঙ্গি, তেরি চাহাত মে,
তেরা সাথ জুটা, ইয়ে ওয়াদা জো তোটা,
মে খুদকো মিটাদুঙ্গি, তেরি চাহাত মে।
মে দুনিয়া ভুলাদুঙ্গি, তেরি চাহাত মে।।”
ডান্স শেষ হওয়ার আগ মুহুর্তেই দু’জন দু’জনকে টাইট করে জড়িয়ে ধরে। এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যেন এরা আগে থেকেই একে অপরকে খুব বুঝে। অথচ আজকেই প্রথম দুজনের এতো কাছে আসা। মেঘ বুঝতেই পারল না সে শ্রাবণের বুকের সাথে মিশে আছে। শ্রাবণ তো মেঘকে আনিকা ভেবেই এতক্ষণ কল্পনার মাঝে ডুবে ছিল।
১৮!!
সবাই খুব জুড়ে করতালি বাজায়। শ্রাবণের হাত হুট করেই মেঘের পিট থেকে সরে আসে। মেঘ নিজেকে হাল্কা দূরে সরিয়ে নেয়। মাথা নিচু করে কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রাবণ চারিদিকে একবার তাকিয়ে মেঘের দিকে তাকায়। অস্পষ্ট স্বরে মেঘকে বলল,
_রাত্রি আ’ম সরি, আমি আনিকা ভেবে তোমাকে!
মেঘ শ্রাবণের মুখে আনিকার নাম শুনে অবাক হয়ে একবার তাকায়। শ্রাবণের চোখের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। নাহ! এই চোখের মেঘের জন্য কোনো অনুভূতি নেই, তাই শ্রাবণ অনায়াসেই আনিকার কথা বলে দিল। মেঘ শ্রাবণের কথায় কোন জবাব দিল না। এক’পা দু’পা করে পিছাতে পিছাতে পালিয়ে আসে শ্রাবণের থেকে। দৌঁড়াতে থাকে সিঁড়ি দিয়ে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটা সময় রুমে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় মেঘ। চিৎকার করে কেঁদে উঠে মেঘের ভেতর। যতক্ষণ শ্রাবণের কাছে ছিলো ততক্ষণ শুধু মনে হয়েছিল, এতদিনে মেঘের স্বপ্নের রাজকুমার মেঘের জীবনে সত্যি সত্যি এলো। কিন্তু শ্রাবণ যখন আনিকার কথা তুলল, মুহূর্তেই মেঘের মনে ভয় ঢুকে যায় শ্রাবণকে হারানোর। মনে অনেক প্রশ্ন জাগে মেঘের। কীভাবে আনিকার অস্তিত্ব মুছাবে মেঘ? মেঘ তো চেয়েছিল ভালোবেসে শ্রাবণের মন থেকে চিরদিনের জন্য আনিকার নাম মুছে দিবে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে মেঘের ভালোবাসার সব শক্তি শেষ হয়ে যাবে। শ্রাবণ যত ভালোবাসে আনিকাকে, তার তুলনার মেঘের ভালোবাসা হয়তো খুব তুচ্ছ তাই এতো চেষ্টা করেও মেঘ বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। মেঘ চোখের জল মুছে নিজেকে শক্ত করে। আয়নার দিকে তাকাতেই অপরপাশে হুবহু মেঘের মতো দেখতে একজন মেয়ে এসে খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। মেঘ মেয়েটার পরনের সাদা ড্রেস দেখে ভয় পেয়ে যায়। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে পরনে কালো লেহেঙ্গা। তাহলে এই সাদা ড্রেস পরা মেয়েটাই বা কে? দেখতে একদম মেঘের মতো! মেঘ ড্রেসিং টেবিলে রাখা ফুলদানিটা ছুড়ে মারতে যায় আয়নার মাঝে, অমনি আবার মেয়েটা হেসে উঠে। ওপাশের মেয়েটার হাসি দেখে মেঘ রাগে কটমট করতে করতে ঐ মেয়েটাকে বলল,
_কে তুমি? এখানে কী চাই তোমার? তুমি এতো জঘন্য কেন? অন্যের কষ্ট দেখে এতো খুশি হও কেন তুমি?
_আমায় তুমি চিনবে না মেঘ, আমি তোমার বিবেক।
_আমার বিবেক! কী চাই তোমার আমার কাছে?
_আরে বোকা, তুমি এতো অধৈর্য কেন বলতে পারো?
_আমি মোটেও অধৈর্য নই।
_তাই নাকি? তাহলে এতো কষ্ট পাচ্ছো কেন?
_কষ্ট পাবো না কেন? তোমার হবু বর যদি তোমার সামনে অন্য কোনো মেয়েকে নিয়ে ঢলাঢলির কথা চিন্তা করে তাহলে তোমার কষ্ট লাগবে না?
_একদমই লাগবে না।
_লাগবে কীভাবে? তোমার তো প্রাণই নেই। তুমি তো কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা রাখো না।
_কে বলছে রাখি না? যদি না রাখতাম তাহলে আজ তোমার সামনে আসতাম না তোমাকে সাহস দেওয়ার জন্য।
_মানে!
_আরে বুদ্ধু শোণ, আজ যদি তুমি একটা ছেলেকে ভালোবাসতে, সে ছেলে যদি তোমায় ছেড়ে অন্যকারো হাত ধরে চলে যায় তাহলে কি তুমি কষ্ট পাবে না?
_অবশ্যই কষ্ট পাব।
_তাঁর কথা কি তোমার মনে পড়বে না? তাঁর সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো কি তোমার মনের কোণে নাড়া দিবে না? বারবার কি বলবে না দেখো আমার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে? খুব কষ্টে আছি আমি তোমায় ছাড়া।
_তারমানে শ্রাবণ এখনও আনিকাকেই ভালোবাসে।
_হুম। শ্রাবণের ভালোবাসা গভীর হলেও সেই ভালোবাসায় জোর খুব কম ছিল, তাই আনিকা শ্রাবণকে ছেড়ে চলে যেতে পেরেছে। আজ যদি শ্রাবণের ভালোবাসার জোর থাকতো তাহলে আনিকা এইভাবে অবেলায় হারিয়ে যেত না। তুমি তো খুব ভাগ্যবান মেয়ে যে নিজের স্বপ্নের রাজকুমারকে আপন করে পেতে চলেছো। এতো কিছুর পরেও তোমার এতো কষ্ট কেন থাকবে?
_শ্রাবণ যে আনিকাকে ভালোবাসে।
_তাতে কী হয়েছে? আনিকা শ্রাবণের অতীত, আর তুমি বর্তমান। শ্রাবণ যদি বুদ্ধিমান হয়ে থাকে তাহলে শ্রাবণ একদিন বুঝবে অতীত নয়, বর্তমানকে নিয়ে বেঁচে থেকে ভবিষ্যতের সন্ধানে ছুটে যাওয়াই আসল বুদ্ধিমানের কাজ। যে বুঝে সে কখনোই অতীত নিয়ে পড়ে থাকবে না।
_শ্রাবণের মন থেকে আনিকাকে সরাবো কীভাবে?_ভালোবাসার ছোঁয়া আর ভরসার হাত দিয়ে। যে ভরসা পেলে শ্রাবণ নিজের মনে শক্তি পাবে সুন্দর করে আগামীর স্বপ্ন দেখার। আর সেই শক্তিই শ্রাবণের মন থেকে একদিন আনিকাকে মুছে দিয়ে সেখানে নতুন এক ভালোবাসার সূচনা করবে তোমাকে নিয়ে।
_আমি পারবো তো?
_চেষ্টা করে দেখো, সুযোগ কিন্তু একবারই আসে।
মেঘ মেয়েটির কথায় উপর থেকে নিচ অবধি মাথা নাড়ায়। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে আয়না ঝকঝকে পরিষ্কার। কারো কোনো চিহ্ন নেই আয়নার মাঝে। মেঘ চারিদিকে তাকায় কিন্তু কাউকেই দেখতে পায় না। আয়নাটা আলতো করে ছুঁয়ে দেয় তবুও কারো অস্তিত্ব টের পায় না মেঘ। হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় মেঘ। চোখের পানি মুছে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে গেলেই ইরা দৌঁড়ে ঢুকে মেঘের রুমে। মেঘের সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটুর উপর হাত চেপে জুড়ে জুড়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকে ইরা।
ইরার এমন অবস্থা দেখে মেঘ খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। ইরার কাঁধে হাত রাখতেই ইরা মাথা তুলে তাকায়। তারপর মেঘকে বলল,
_কখন থেকে সবাই তোকে খুঁজছে, আর তুই এখানে। উফফ মেঘ! তুই এতো টেনশন দিস কেন সবাইকে?
_কোথায় টেনশন দিলাম?
_তুই এখানে কী করছিস?
_আমার উড়নাটা ঠিক করতে এসেছিলাম।
_চল নিচে আয়।
_কেন?
_সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য। তুই না গেলে শুরু করতে পারছি না।
_কিন্তু শ্রাবণ!
_ভাইয়া ওখানেই আছে। তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
ইরা একপ্রকার টানতে টানতে মেঘকে নিয়ে নিচে নামতে থাকে। মেঘ এক হাতে লেহেঙ্গাটা সামলে নিয়ে ইরার সাথে নিচে নামছে। নিচে নামতেই মেঘ অবাক হয়। সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে আছে মেঘের জন্য। কিন্তু কেন সবাই অপেক্ষা করছে সেটাই মেঘ জানেনা? সামি, আদনান, নওরিন, শ্রাবণ আরো আত্মীয়স্বজনেরা। মেঘকে শ্রাবণের পাশে দাঁড় করিয়ে ইরা সামির ডানহাতের একেবারে কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। ইরা সামির কাছে যেতেই সামি বা’দিকে একটু সরে যায়। সামি একহাত সরলে ইরা সামির দিকে একহাত সরে। সামিকে ফলো করে করে সব করছে ইরা। সরতে সরতে সামি গিয়ে শ্রাবণের সাথে ধাক্কা খায়। আর শ্রাবণ ধাক্কা সামলাতে না পেরে সোজা মেঘের দিকে হেলে পড়ে। মেঘ শ্রাবণের বুকে হাত দিয়ে শ্রাবণকে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে কন্ট্রোল করে নেয়। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ ধরে।
সামি মেঘকে এইভাবে দেখে একটু কষ্ট পেলেও মেঘের মুখের হাসি দেখে নিজের কষ্ট আড়াল করে নেয়। ইরা সামির দিকে তাকিয়ে দেখে সামি অন্যমনস্ক হয়ে মেঘকে দেখছে। ইরা সামির ডানহাতের কব্জিতে জুড়ে একটা চিমটি কাটে। সামি চিৎকার দিতে গিয়েও লোকলজ্জার ভয়ে থেমে যায়। ইরার দিকে তাকিয়ে দেখে ইরা খিলখিল করে হাসছে। ইরার সেই হাসির সুর সামির বুকের চিনচিন ব্যথা বাড়িয়ে দেয়। সামি বুকে হাত দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে আসলেই কার জন্য সামির বুকের বাপাশের জায়গায়টা!
চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।