কয়েন,অন্তিম_পর্ব
বড়_রহস্য_গল্প
পৃথা_সামন্ত_ঘোষ
ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকের চোখ এখন আলিশার দিকে । আলিশা ঘরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পায়চারী করতে করতে বলতে শুরু করলো — কেসটা নিয়ে কুশল বাবু যেদিন আমার কাছে এসেছিলেন কেসটাকে এতটা কমপ্লিকেটেড বলে মনে হয়নি সেদিন । যত দিন গেছে… বুঝতে পেরেছি এই কেসটা আমাকে রীতিমতো হন্ট করছে । এই মুহূর্তে এই ঘরে উপস্থিত প্রায় প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত এই কেসের সাথে । কিভাবে এবং কেন… আমি সেটাই আজ বলবো । কুশল বাগচীর দিকে তাকিয়ে বলল — আঙ্কল , আমরা প্রত্যেকেই জানি , ঈশা আর কোনোদিন ফিরে আসবেনা । কিন্তু সে যাতে তার প্রাপ্য জাস্টিসটুকু পায়.. আমি হার্ড এন্ড সোল সেই চেষ্টা করেছি ।
কেউ কোনো কথা বললোনা । আলিশা আবার বলতে আরম্ভ করলো — ঈশা আর এনা , যমজ দুই বোন । এই ঘটনার সূত্রপাত হয়তো এখান থেকেই ! যমজ হলেও দুই বোনের শারীরিক এবং চারিত্রিক সাদৃশ্য ছিল না একেবারেই । মিসেস বাগচী নিজের সুবিধামত বেছে নিয়েছিলেন ঈশাকে তাঁর প্রিয় কন্যা হিসেবে ।
মিসেস বাগচী উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন । আলিশা হাত দেখিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে — আপনি বলার সুযোগ পাবেন , আমার কথাগুলো আগে শেষ হোক ! হ্যাঁ , যেটা বলছিলাম… মিসেস বাগচীর এই কাজের পক্ষে একটা গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি ছিল অবশ্যই । আর সেটা ছিল ইশার প্রতি এনার মারাত্মক প্রতিহিংসাপরায়ণ স্বভাব । আঙ্কল ! আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই । ওরা যখন বেশ ছোটো… পুলের জলে ইশাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল এনা । আপনি সেটা জানতেন । এনার এই স্বভাব আপনাকে কেন কখনও ভাবিয়ে তোলেনি , বলতে পারেন !
— আমরা ওর ট্রিটমেন্ট করিয়েছিলাম । লাভ হয়নি কোনো । কয়েকবছর পর এটা ও আবার করেছিল ।
— আর তারপর কোনোদিন চেষ্টাই করলেন না । উল্টে… ইশার ভালো , মন্দ , ওর সাফল্য সমস্তকিছু এনার চোখের সামনে সেলিব্রেট করতে থাকলেন । আপনাদের মনে হলো না… এগুলো করে আপনারা আপনাদের দুই মেয়েকেই হারাতে বসেছেন ! কেন একটু অন্যভাবে ভাবতে পারলেননা বলুনতো ?
মিস্টার আর মিসেস বাগচী বসে রইলেন চুপ করে । সত্যিই কিছু বলার নেই আজ তাঁদের । আলিশা এবার এনার দিকে ফিরলো ।
— নিজের বোনকে মারতে হাত কাঁপলোনা একটুও !
— আমি… আমি ওকে মারিনি ।
— তাহলে ওর ফোন , দরজার হাতল , টেবিল , চেয়ার এসবের ওপর তোমার হাতের ছাপ এলো কিভাবে ?
— আমি গিয়েছিলাম ওর ঘরে একবার । ও তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল ।
— ওর ফোনে হাত দিয়েছিলে কেন ?
চুপ করে যায় এনা । আলিশা বলে — এনার হাতের ছাপ বাকি জায়গায় পড়লেও যে ছুরিটা দিয়ে ঈশাকে খুন করা হয়েছিল তাতে কিন্তু এনার হাতের ছাপ ছিলোনা , ইনফ্যাক্ট কোনো হাতের ছাপই ছিলোনা ।
— আমি তো বললাম… ওকে আমি মারিনি ।
— সেটা এখনো প্রমান সাপেক্ষ এনা । চুপ করে বসে থাকো এখন । এনা এবং আলেখ্যর সম্পর্কের কথা এখন আপনারা সবাই জেনে গেছেন । কিন্তু এখানে এমন দুজন উপস্থিত , যাঁরা কিন্তু আগে থেকেই জানতেন… ওদের এই সম্পর্কের কথা এবং অন্যায় জেনেও সেটা আটকানোর কোনো চেষ্টা তাঁরা করেননি । আলিশার দৃষ্টি এখন মিস্টার এবং মিসেস দাশগুপ্তর ওপর স্থির । সুনন্দিতা উদ্ধত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে । আলিশা বললো — ভুল বললাম মিসেস দাশগুপ্ত ?
— কি জানতাম আমরা ? বলে উঠলেন তিনি ।
— আলেখ্য আর এনার গোপন সম্পর্কের কথা আপনারা জানতেন না বলছেন ?
— না , আমরা কিছুই জানতাম না । আলেখ্যর সাথে ইশার বিয়ে হবে… এটা ডিসাইডেড অনেকদিন থেকে । অন্যরকম কিছু জানতাম না আমরা ।
— মিথ্যে বলছেন আপনি । আমার কাছে প্রমান আছে , আপনি মিথ্যে বলছেন ।
— কি প্রমান ?
— এনার ফোনে অগুনতি ফোটো আপনাদের সাথে , আলেখ্য আর এনা… আপনাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এনা…এমন বহু ফ্যামিলি ফটোগ্রাফস ওর ফোনের মেমোরি কার্ডে জমে আছে । সেসব ফটোতে ঈশা কোথাও নেই । ফোটোগুলো আপনাদের বাড়িতেই তোলা হয়েছে । কয়েকটা অন্য জায়গায় ফটোও রয়েছে সেই সাথে । এবার বলুন তো… কিভাবে বলবেন… আপনারা কিচ্ছু জানতেন না ! বরং দিনের পর দিন প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন ওদের দুজনের স্বেচ্ছাচারিতা !
কুশল বাগচী সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন । বললেন — এসব কি উত্তীয় ? ইশাকে তোর ছেলের বউ করতে তুইই তো চেয়েছিলি একদিন ! ওকে যদি পছন্দ ছিলোনা , তাহলে এসব করতে গেছিলি কেন ? আমার মেয়ে সুন্দরী , শিক্ষিতা , নরম স্বভাবের… তাকে তোদের হাতে তুলে দেওয়ার চেয়ে অনেক ভালো হতো… তাকে যদি কখনও নিজের থেকে দূরে না করতে পারতাম ! করতে হলেও… আরও ভালো কারো হাতে তুলে দিতাম তাকে ! তোদের পরিচয় জানার পরে এই মুহূর্তই তোদের আমার বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া উচিত , সিকিউরিটি ডেকে । কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয় । কিন্তু আজকের পর এই বাড়িতে তোদের আমি যেন আর কখনো না দেখি ।
— তুই ভুল বুঝছিস আমাকে ! মিস্টার দাশগুপ্ত বলে ওঠেন । আমরা ইশাকেই চেয়েছিলাম পুত্রবধূ হিসেবে , কিন্তু আলেখ্য হঠাৎ জড়িয়ে পড়লো এনার সাথে । এনাও তোরই মেয়ে । আমরা কি করবো… ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি । মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি করতাম বল !
মিস্টার বাগচী স্খলিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তাঁর তথাকথিত প্রিয় বন্ধুর দিকে । আলিশা বলে উঠলো — ভালো বললেন মিস্টার দাশগুপ্ত । ছেলের ভয়ে ছেলেকে শাসন করা যাবে না , তাইতো ! ছেলে যতই অন্যায় করুক , একটি মেয়ের জীবন নিয়ে খেলুক , তাকে বাধা দেওয়া যাবে না ! সবটা জেনেও হাত গুটিয়ে বসে রইলেন ! এখন আবার নিজেকে ডিফেন্ড করছেন ?
— আমরা বাবা মায়েরা ছেলেমেয়ের কাছে বড় অসহায় !
— অন্যায় টা অন্যায়ই হয় মিস্টার দাশগুপ্ত ! অন্যরকম ভাবে সেটাকে কখনোই ক্লারিফাই করা যায়না । যাই হোক , আলেখ্যর সাথে ইশার সম্পর্কের শুরুর দিকগুলো ছিল ছবির মত সুন্দর । আমি ইশার ডায়রী পড়েছি । সেখানে সে লিখে গেছে আলেখ্যর প্রতি তার ভালোবাসার কথা , তার প্রতি নির্ভরতার কথা ইত্যাদি । ওর ঘর থেকে কয়েকটা ফটোগ্রাফস পেয়েছিলাম সেদিন , যেগুলোর মধ্যে একটা ফোটো ছিল আলেখ্য এবং এনার । ইশার স্টাডিটেবিলে একটা খামের ভিতর রাখা ছিল সেটা আরও কতগুলো ফটোগ্র্যাফের সাথে । ওদের এই সম্পর্কের কোনো আঁচ ঈশা অনুভব করেছিলো কিনা… ডায়রির কোথাও সেকথা লিখে যায়নি ঈশা । তবে এনা যে কোনো নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছিল , সেটা ইশার নজর এড়ায়নি । সেকথা ডায়রীতে সে লিখে গেছে । ঈশা হয়তো আলেখ্যকে সত্যিই ভালোবেসেছিল , যার যোগ্য ছিলোনা আলেখ্য । প্রথম প্রথম আলেখ্য ইশার প্রতি মনোযোগী থাকলেও… এনার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করার মতো ব্যক্তিত্ব ছিলোনা তার । গভীর রাতে এনার ফোনকল অথবা হঠাৎ হঠাৎ ভিডিওকল গুলোকে প্রতিরোধ করতে পারছিলোনা সে । ফলে সে বেছে নেয়… দু নৌকায় পা রেখে চলতে থাকা একটা অনিশ্চিত জীবন । কিছুদিন পর ইশাকে তার আর ভালো লাগেনা । ইশার নৈতিক মূল্যবোধ , বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে তাকে বাড়িতে আসতে বারণ করা , এসব তাকে ততদিনে বেশ বোর করে ফেলেছে । অথচ বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তার ইশারই সাথে । এনার সাথে আলোচনায় বসে এবার আলেখ্য । ইশার থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে এবার হবেই !
— মনগড়া কাহানি বানিয়ে বলে চলেছেন তো ? আলেখ্যর রাগী স্বর ভেসে আসে ।
— মনগড়া ! হেসে বলে ওঠে আলিশা । তাহলে সত্যি কাহানিটা আপনিই বলুন ! আলেখ্যকে ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে সে । আলেখ্য চোখ সরিয়ে নেয় ।
— এবার আসি সোহমের প্রসঙ্গে । আপনারা জেনে রাখুন , সোহম এই কেসে মূল অভিযুক্তদের মধ্যে একজন । একটা কারণ আমি একদম প্রথমেই বলেছি । এবার আসছি কেন সে এই কাজ করেছিল । এনা আর আলেখ্য দুজনে মিলে আলোচনায় বসে , কিন্তু কোনো ফুলপ্রফ প্ল্যান কোনোভাবেই তাদের মাথায় আসেনা । এদিকে সোহম একজন অত্যন্ত অকালপক্ক ছেলে এবং ইশাকে দিদি না ভেবে সে প্রেমিকা ভাবতে বেশি পছন্দ করে । ঈশার কাছে কোনোদিনই পাত্তা পাবেনা জেনে ইশার অনুপস্থিতিতে সে তার ঘরে লাগায় হিডেন ক্যাম , রেকর্ড করে তার ব্যক্তিগত মুহূর্ত এবং বাড়ি ফিরে গিয়ে শুরু করে ইশাকে ব্ল্যাকমেইল করতে । ঈশা ভয় পায় , বোঝানোর চেষ্টা করে… ডিলিট করতে বলে সবকিছু । বদলে সোহম একটা ডিল করে ইশার সাথে । জানায়.. ডিলিট সে সব করে দেবে কিন্তু তার বিনিময়ে তার চাই থোক টাকা । ঈশার পক্ষে তা সম্ভব ছিলোনা , সে স্বনির্ভর ছিলোনা । পরে ঠিক হয়… ভবিষ্যতে যখনই টাকার প্রয়োজন পড়বে ঈশাকে যোগান দিতে হবে সেই টাকা । সেই কারণে কারোকে কিছু না জানিয়ে ত্রিদিববাবুর হাতে ল্যাপটপ কেনার টাকা তুলে দিয়েছিল সে… ভয়ে । ঈশার উচিত ছিল প্রথমেই ঘটনাটা সকলের সামনে আনার । সেটা না করে বোকামো করেছিল সে আর সুযোগ করে দিয়েছিল অপরাধীর কালো হাত আরও লম্বা হতে ! সোহম নতুন ব্যবসা করতে চায় । অথচ পুঁজির অভাব । ঈশা সেভাবে টাকার যোগান দিতে পারছিলনা তাকে । ত্রিদিববাবু কুশল বাবুর কাছে হাত পেতেই রেখেছিলেন , কিন্তু ছেলের নতুন ব্যবসার কথা তাঁকে বলার সুযোগ পাচ্ছিলেননা । তবে ছেলে যে সঠিক পথে হাঁটছে না… সোহমের মা রমা সেটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন । কিন্তু এখানেও ঘটনা সেই একই । ছেলের ভয়ে ছেলেকে শাসন করতে পারেননি তিনিও । ছেলের অন্যায় আটকানোর কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি , ঠিক মিস্টার এবং মিসেস দাসগুপ্তর মতো !
অস্বস্তিকর আবহ তৈরি হয়েছে ঘরের মধ্যে । রমা রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে তারই দিকে । একটু আগে সেই একই দৃষ্টির সম্মুখীন হয়েছে সে সুনন্দিতার তরফ থেকেও । অবজ্ঞার দৃষ্টি তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আলিশা একটা বোতল খুলে জল খেলো কিছুটা । আবার বলতে শুরু করেছে — ইশাকে যে কেউ ব্ল্যাকমেইল করছে একথা সে একজনকেও জানায়নি । একমাত্র আলেখ্যকে সে জানাতে চেয়েছিল । আলেখ্য বুঝেছিল… কিছু একটা ঘটনা আছে ইশার জীবনে… যেটা ঈশাকে বারেবারে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল । ঠিক এই ট্রাম্প কার্ডটাই সঠিক সময় খেলে ফেলে আলেখ্য । এনাকে সে বলে এই কথা , দায়িত্ব দেয়… জানতে… কোন ঘটনা বদার করছে ইশাকে !
আলেখ্য মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে আলিশার বক্তব্যকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো । আলিশা একটিবার সেদিকে তাকিয়ে বলল — ডিল হওয়ার পরেও ইশার ঘর থেকে ক্যামটা খুলে নেয়নি তখনও সোহম , যদিও ঈশাকে সে বলেছিল… ক্যামটা সে নষ্ট করে দিয়েছে । ঈশা বিশ্বাসও করেছিল তার সেই কথা । ইশার অনুপস্থিতিতে এবার তার ঘরে এনা আসতে শুরু করে , প্রায়ই ! তল্লাশি চালায়… জানার চেষ্টা করে কি সেই ঘটনা ! যা কাজে লাগাতে পারে তারা ! একদিন লুকিয়ে রাখা ক্যামটা চোখে পড়ে যায় এনার । জানলা দিয়ে তার তার নেমে গেছে একতলায় । নীচে নেমে আসে এনা , দেখে তারটা ঢুকে গেছে একতলায় ত্রিদিববাবুদের ঘরের জানলা দিয়ে । আর সময় নষ্ট করেনা সে । আলেখ্যকে জানায় সবটা । আলেখ্যর কথামতো সোহমের সাথে কথা বলে এনা । প্রথমটায় সোহম স্বীকার না করলেও পরে মোটা টাকার লোভে স্বীকার করে সবটাই । তাকে সাথে করে আলেখ্যর নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় এনা , সেখানে বসে মাস্টারপ্ল্যান বানায় তিনজন । গ্লাভস জোগাড় হয় , দিন , ভেন্যু সব ডিসাইডেড হয় , কেনা হয় নতুন চকচকে ধারালো একটা ছুরি যেটা কিচেন নাইফ বলে সহজেই কিচেনে চালান করে দেওয়া যাবে যে কোনো মুহূর্তে । আর ঈশাকে চিরকালের মতো বিদায় জানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় সোহমকে । দিন স্থির হয় তাদের এনগেজমেন্টের রাতে ভেন্যু ইশার নিজের বেডরুম । তার বিনিময়ে যে টাকা সোহমকে ওরা দিতো… তাতে ওর ব্যবসা দাঁড়িয়ে যেত ভালোভাবেই ।
— কি প্রমান আছে আপনার কাছে ? আপনি ছিলেন তখন ইশার রুমে ? দেখেছিলেন আমাকে ঢুকতে , ওর রুম সার্চ করতে ! কিকরে জানলেন ওকে মারার প্ল্যান করেছি আমরা !
— ওকে খুন করার পরে ক্যামটা খুলে নিলেও তাড়াহুড়োয় তারটাকে সরিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলে তুমি , তারটা কিন্তু এখনো একইরকম অবস্থায় থেকে গেছে । সেই তার একতলায় সোহমের ঘরের জানলায় এসে শেষ হয়েছে । আর সোহম যে তোমাদের কথাতেই ঈশাকে খুন করতে রাজী হয়েছিল সেটা সোহমের সাথে তোমাদের কনভারসেশন দেখলেই বোঝা যায় । ত্রিদিববাবু ! সোহমের কোনো ব্যাংক একাউন্ট নিশ্চয়ই আছে ! আমাকে সেটার ডিটেইলস টা একবার পাঠান তো ! ঠিক কত মূল্যে বিক্রি হয়েছিল ইশার জীবন… আমরা সবাই সেটা জানতে চাই ।
কুশল বাগচীর দিকে তাকানো যাচ্ছেনা , মিসেস বাগচী স্থবিরের মতো নিশ্চল । আলিশা বলে চলে — সোহমের ওপর দায়িত্ব দিয়েও নিশ্চিত হতে পারেনি আলেখ্য আর এনা । এবার দায়িত্ব তুলে নেয় এনা নিজের কাঁধে । আলেখ্যকে বলে… চিন্তা না করতে , সোহম না পারলে প্ল্যান বি তার ভাবাই আছে । এবার প্রশ্ন কি ছিল সেই প্ল্যান বি ! এনা , তুমি কিছু বলতে চাও ?
এনার মুখটা এখন ঘোরানো অন্যদিকে । আলিশা সামান্য হাসলো — পার্টি শেষ হলে সেদিন ইশার শুতে যেতে রাত হয়েছিল । এনা শুতে চলে গিয়েছিল আগেই । কিন্তু আসলে শুতে সে যায়নি , সে গিয়েছিল ইশার ঘরে । দেওয়াল ঘেঁষে জ্বালিয়ে দিয়েছিল একধরণের বিষাক্ত গ্যাস যার নাম… হাইড্রোজেন সায়ানাইড ! ছোটো একটা গ্যাস স্টোভের ওপর ফুটছিলো সেটা প্রায় সারাটা রাত । লিকুইড ফর্ম থেকে গ্যাসে কনভার্ট করার জন্যে এই ব্যবস্থা । ঘরে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই গ্যাসের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায় ইশার ওপর । সে অসুস্থ বোধ করে , আলেখ্যকে কিছু জানাতে চায় , ফোন করে তাকে , কিন্তু সেই ফোন আলেখ্য ধরেনা । আলেখ্য যদিও সেকথা স্বীকার করেনি । পার্টি থেকে ফেরার পর একবারই কথা হয়েছিল ইশার সাথে তার , সেটুকুই বলেছিল । আমার সৌভাগ্যবশত ইশার একটা ফোন আমার হাতে এসে পড়ে । আরও অনেক নতুন তথ্য জানা হয়ে যায় আমার । এই অদ্ভুত এবং জটিল কেসটা একটু একটু করে স্পষ্ট হতে থাকে আমার কাছে । সেখান থেকে জানতে পারি… ইশার করা শেষ ফোন আলেখ্য রিসিভ করেনি । নিজের ঘরে অপেক্ষায় ছিল এনা , না ঘুমিয়ে জেগেই ছিল সে । এরপর সোহম যখন গ্লাভস হাতে দরজা ঠেলে ইশার ঘরে ঢোকে , ঈশা তখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ! হাইড্রোজেন সায়নাইডের রসুনের মতো ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা দেয় তারও । কিসের গন্ধ বুঝতে না পেরে সেসব অগ্রাহ্য করে ধারালো ছুরি বসিয়ে দেয় সোহম ইশার বুকে , আবার এবং বারবার । চুপ করে আলিশা । একটানা কথা বলে অল্প হাঁফাচ্ছে সে ।
একটু পরে বলে — ঈশা তার আগেই অচেতন হয়ে গিয়েছিল , মস্তিষ্কে অক্সিজেন পৌঁছানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার । ছুরির আঘাতে তার মৃত্যুকে নিশ্চিত করে সোহম এবার । কাজ শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে আসে সে বাইরে , হাইড্রোজেন সায়ানাইড ততক্ষনে হালকা প্রভাব ফেলেছে তার স্নায়তন্ত্রের ওপরেও । কোনোরকমে নেমে এসে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে সে । এভিডেন্সগুলো দেখতে দেখতে ইশার ঘরের একটা ছবিতে চোখ আটকে গিয়েছিল আমার , পরে বুঝেছিলাম স্টোভ জ্বলার জন্যেই কালো দাগের জন্ম হয়েছিল সেদিন ইশার ঘরের সাদা দেওয়ালে । তরলটাকে ২৫.৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ফোটালে তৈরি হয় এই গ্যাস , এক্ষেত্রে আমার ধারণা আরও বেশি টেম্পারেচার কাজে লাগানো হয়েছিল ! গভীর রাতে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ইশার রুমে আসে এনা , দেখে সোহম ঠিকঠাকভাবেই পালন করেছে তার দায়িত্ব ! বিকার , স্টোভ ইত্যাদি নিয়ে চলে আসার আগে ইশার ফোন থেকে কল করে সে আলেখ্যকে । আলেখ্য জানতো কাজ মিটলে তাকে কল করবে এনা । ইশার ফোন থেকে কল আসাতে ভয় পেয়ে যায় সে , তাই আগের বারের মতো এবারও সে কলটা রিসিভ করেনা । আবারও ফোন করে এনা । এবার কথা বলে আলেখ্য । সব শুনে নিশ্চিত হয় । ইশার ফোন থেকে রাত তিনটার পরে আলেখ্যর ফোনে ফোন গেছে এটা নিশ্চিত করতে , একটা স্ট্রং এভিডেন্স রাখার জন্যে ফোনটা এনা ইচ্ছা করেই করেছিল সেদিন । মৃত্যুর সময় আর লাস্ট কল টাইমিংকে কনফিউজ করার উদ্দেশ্যেই এনা এই কাজটা করেছিল । কিন্তু সেই ফোনটা কিভাবে পুলিশ , বাড়ির প্রতিটা লোক , সকলের অলক্ষ্যে ইশার ঘরের বেডসাইড টেবিলের তলায় চলে গেল… সেই রহস্যের সমাধান আমি করে উঠতে পারিনি । কিন্তু সেটা ঠিক এসে পড়লো আমার হাতে ।
এবার আসি পরের ঘটনায় । বাড়ির চাকরের আচমকা খুন । ছুরিতে রক্তের ছাপ পাওয়া গেলো ত্রিদিব বাবুর । হাতে ক্ষতও পাওয়া গেলো তাঁরই , অথচ ছুরির বাঁটে তাঁর হাতের ছাপ পাওয়া গেলোনা । এখন প্রশ্ন হলো… খুনটা কেন করলেন ত্রিদিববাবু ! ত্রিদিববাবু আপনি বলবেন নাকি আমি বলবো ?
— আপনিই বলুন ম্যাডাম ! আপনি এখন সবই জানেন ।
— ইশার ঘর থেকে টলতে টলতে সেদিন সোহমকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল লোকটা , ফলে প্রমান মেটাতে তাকেও মরতে হলো । খুনটা ত্রিদিববাবু করেননি , করেছিল সোহম । ত্রিদিববাবু দেখতে পেয়ে সোহমের হাত থেকে কেড়ে নিতে যান ছুরিটা , আর তাতেই আহত হন তিনি , ছুরির ফলায় লেগে থাকে সেই রক্তের ছাপ । গ্লাভসের আড়ালে চাপা থেকে যায় সোহমের অপরাধী দুটো কালো হাত । ছেলেকে বাঁচাতে চুপ করে থাকেন ত্রিদিববাবু । কুশলবাবুর ওপর এক পাহাড় অভিমান তাঁর বুকে জমেছিল আগেই , হয়তো তাই প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করার সাধ জেগেছিল তাঁর মনেও , আর তাই তিনি একটু আগে ছেলেকেই ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছিলেন ! কি ত্রিদিববাবু ! কিছু বলবেন ?
মাথা নামিয়ে বসে থাকেন ত্রিদিববাবু । আলিশা বলে — আর সবশেষে আমি মিসেস বাগচীকে কয়েকটা কথা বলতে চাই । যদিও আমি যে কথাগুলো বলতে চলেছি… সেগুলো আমার আন্দাজ থেকেই বলা কথা । ঠিক ও হতে পারে আবার ভুল ও হতে পারে । বলবেন আপনি । আপনি ভবিষ্যৎ গণনা করেন , আজ নয় দীর্ঘদিন যাবৎ ! আপনি আফসোস করে আমাকে বলেছেন যে বহু মানুষের ভবিষ্যৎ গণনা নির্ভুল করলেও আপনি ইশার ভবিষ্যৎ দেখতে পাননি । হয়তো আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ঠিক কোথায় আপনার ভুল হয়েছিল ! তাইনা মিসেস বাগচী ?
— মানে ? তোমার কথার মানে বুঝতে পারছিনা ।
— আপনারা সবাই এতদিন জানতেন ঈশা এনার থেকে কয়েক মিনিট আগে জন্মেছিল । কিন্তু সত্যিটা ছিল উল্টো । মিসেস বাগচীর প্রথম সন্তান হিসেবে ঈশা নয় , ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এনা । হসপিটালের ছোট্ট একটা গাফিলতিতে সেটা উল্টো লেখা হলো । দুজনের জন্মসময় গেল বদলে । মিসেস বাগচী সেটা জানতে পারলেন না , ভুল করে বসলেন । তিনি দুই মেয়েরই ভবিষ্যৎ গণনা করলেন । কিন্তু ইশার ভবিষ্যৎ গড়লেন এনার জন্যে আর এনার ভবিষ্যৎ গড়লেন ইশার জন্যে । ধীরেধীরে বড়ো হলো ওরা । ইশাকে এনার হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে বারেবারে এনার ভাগ্যকেই তিনি জিতিয়ে দিয়েছেন । এনার ভাগ্য গণনার কথা তাঁর মনেও আসেনি , ফলে তাঁর প্রিয় সন্তানের ওপর কি বিপর্যয় নেমে আসছিল , তিনি কোনোদিনই তা জানতে পারেননি । জ্যোতিষশাস্ত্র অর্থাৎ এস্ট্রোলজিকে যারা বুজরুকি মনে করেন , তারা হয়তো সত্যিটা না জেনেই তা করেন । বিদিশা বাগচী কিন্তু একজন স্বনামধন্যা জ্যোতিষবিদ এবং ইন্ডিয়ার টপ এস্ট্রোলজারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি নাম । নিজের সন্তানের মৃত্যু তাঁর জন্যে সত্যিই দুঃখের । যেদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন আপনি ইশার ভবিষ্যৎ টা দেখতে পেলেননা , প্রথমটায় ভেবেছিলাম হয়তো এমনিই বলেছেন , কষ্টে অথবা দুঃখে ! পরে যত ভেবেছি… বুঝতে পেরেছি ওই কথাটা বলেছিলেন আপনি কোন বিশেষ কারণে । এবার আপনি বলুন… আমি ঠিক না ভুল ?
শ্রান্ত দুটো চোখ তুলে তাকালেন উনি আলিশার দিকে । মুখে কিছু বললেন না । চোখদুটো শুধু সামান্য উজ্জ্বল হয়ে উঠলো বুঝি ! আলিশা বললো — আমার আর বিশেষ কিছুই বলার নেই । এই কেসটা সামলাতে গিয়ে আমার কাছের এক বন্ধুর মাথা ফেটেছে । যদিও এখন সে অনেকটাই সুস্থ । আমাকে ভয় দেখিয়ে থামিয়ে রাখবে , এমনটা যে ভেবেছিল… সে নিজেই এখন ভীষণরকম দুর্বিপাকে , বড্ড আতান্তরে । কি আলেখ্য ! একদম যে চুপ হয়ে গেলেন ! কিছু বলুন এবার ! আমাকে ভয় দেখাতে তো পারলেন না , নিজেকেও বাঁচাতে পারলেননা , এনার সাথে বিয়ের স্বপ্ন টাও এবার বোধয় জেলের গারোদের মধ্যে বসেই দেখতে হবে আপনাকে ! কি বলি বলুনতো ! আসলে নিষ্ঠুরতা ফিরে ফিরে আপনারই কাছে আসবে , দেখবেন ! জেলে বসে পড়বেন ইশার লেখা ডায়রিটা , পড়বেন… যাকে রাস্তা থেকে উপড়ে ফেলতে এত প্ল্যান , এত প্রস্তুতি… সেই মেয়েটা আপনাকে সত্যি কতটা ভালোবেসেছিল ! শেষ মুহূর্তেও সেই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই সে আপনাকে কল করেছিল , আপনি কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি । কিকরে ভেবেছিলেন বলুনতো… এতো কিছুর পরেও আপনি জীবনটাকে নিজের হিসেবে কাটাবেন ?
রুপম দেবরায় বসে ছিল একপাশে । এবার আলিশা তার উদ্দেশ্যে বললো – অফিসার , আমার কাজ শেষ । আপনি এদের এরেস্ট করার ব্যবস্থা করুন । আমাকে এবার বেরোতে হবে ।
একে একে আলেখ্য , এনা আর সোহমকে গাড়িতে তোলা হলো । মিস্টার আর মিসেস বাগচী এখনও বসে একভাবে… ঠায় ! নিজের বাবা মায়ের মুখটা মনে পড়ছে আলিশার , একটু দূরে সহাস্য ইশার মুখটা ছবি হয়ে চেয়ে রয়েছে তারই দিকে । চোখটা সামান্য ঝাপসা হলো আলিশার । দেখলো রুপম দেবরায় এগিয়ে আসছে এদিকে ।
— কেসটা সলভ করার জন্যে কংগ্র্যাটস ! অনেক খেটেছেন , বোঝা গেল । তবে ওই ফোনটা পেলে হয়তো আমিও…
— অবশ্যই ! আর এমনিতেও আপনি আমাকে অনেকই হেল্প করেছেন । সেগুলো না পেলে মুশকিলে পড়তাম , হয়তো আরও বেশি দেরি হতো ইশার খুনিদের খুঁজে বার করতে !
— আবার দেখা হবে তাহলে ! এখন এগোই !
— আসুন ।
রুপম দেবরায়ের হুডখোলা গাড়িটা বাগচী ম্যানশনের গেট ছাড়িয়ে মিলিয়ে যেতে ঘরের ভিতর পা রাখলো আলিশা । মিস্টার এবং মিসেস দাশগুপ্তও বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এতক্ষন , ছেলেকে নিয়ে যেতে তাঁরাও নিজেদের গাড়িতে উঠে বসলেন । হয়তো যাবেন এখন থানায় , আবার খাটাবেন নিজেদের ইনফ্লুয়েন্স ।
মিস্টার আর মিসেস বাগচীর পাশে গিয়ে অল্পক্ষন বসে রইলো আলিশা। বিশাল বাড়িটা জুড়ে নেমে এসেছে এক হিমশীতল নৈঃশব্দ্য ! ত্রিদিববাবু আর তাঁর স্ত্রীকে দেখতে পেলোনা আলিশা । একটু পড়ে বললো — আঙ্কল ! আমি তাহলে আজ আসি ! যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে ফোন করতে হেজিটেট করবেননা । আয়াম জাস্ট এ ফোন কল আওয়ে । টেক কেয়ার অফ ইউ বোথ !
মিস্টার বাগচী বলে উঠলেন — তোমার বাকি টাকাটা নিয়ে যাও আলিশা । তোমার কাজ তুমি শেষ করেছো , ঈশাকে জাস্টিস পেতে হেল্প করেছো । বসো , আমি নিয়ে আসি টাকাটা , নাকি চেক নেবে ! যেটা তোমার সুবিধা !
— আজ থাক আঙ্কল ! বরং কাল একবার আসবো । আপনি ব্যস্ত হবেননা । আজ উঠি ! মিসেস বাগচীকে একটা প্রশ্ন করতে চাই , আপনার সামনেই ।
চোখ তুললেন মিসেস বাগচী । আলিশা বললো — ফোনটা কিভাবে বেডসাইড টেবিলের নিচে রয়ে গেল মিসেস বাগচী ?
— আমি তো জানিনা সেটা ! হয়তো তোমার হাতে পৌঁছনো টা ফোনটার জন্যে ভীষণ জরুরী ছিল ! তোমার হাতে পৌঁছনটাই ওর ভবিতব্য ছিল !
অল্প হেসে সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো আলিশা ।
তারপর মিস্টার এবং মিসেস বাগচীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গেটের বাইরে । রাত হয়ে এসেছে । একটা পথচলটি ক্যাব ধরে ফিরে চলেছে সে তার নিজের আস্তানায় । রৌনককে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠাতে হবে এবার । বরং বাবা মাকে বলবে সঙ্গে এসে থাকতে । মনটা উদাস হয়ে যায় হঠাৎ ! ব্যাগ থেকে পাওয়ার ব্যাংকটা বের করতে গিয়ে চোখে পড়ে যায়… ইশার লেখা ডায়রিটা । পাওয়ার ব্যাংকটা বের করে এনে ব্যাগের চেইনটা বন্ধ করে দেয় সে । ঈশা তাকে অনেক কিছু শিখিয়ে গিয়েছে এই গতকয়েকদিনে । জীবনটাকে কিছুটা হলেও অন্যরকম ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে এই ডাইরিটার মাধ্যমে । তাই ইশার ডায়রী সঙ্গী হয়ে থাকুক তারই সাথে ! ফোনটা বাজছে । এখন কে ফোন করলো ভাবতে ভাবতে… ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অচেনা একটা নম্বর ।
— হ্যালো !
— মিস আলিশা সোম বলছেন তো ?
— হ্যাঁ , বলছি !
— আমি সোহিনী সমাদ্দার কথা বলছি , তালতলা থেকে । একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই । একটা সমস্যা নিয়ে গত কয়েকদিন আমি দুচোখের পাতা………
— আগামীকাল সকাল এগারোটা । এড্রেস সেন্ড করছি , পৌঁছে যাবেন । এসব কথা ফোনে নয়… সামনে শোনাই ভালো ! কাল দেখা হচ্ছে !
ক্যাবটা ছুটে চলেছে নিউটাউনের রাস্তা ধরে । ফিরতি পথে ছুটে চলেছে সহস্র গাড়ি আলো জ্বালিয়ে । বাঁ দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো আলেখ্যর ফ্ল্যাটে যাওয়ার গেটটা ! আরেকটু পরেই এসে পড়বে তারও আস্তানা । গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে একটা সিগনালে । জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল একটা লোক রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে একটা পয়সা কোড়াচ্ছে । একটা কয়েন… তার দুটো পিঠ । রাস্তার আলো পড়ে চকচক করছে তার একটা পিঠ । যেন ভালো মন্দর বেড়াজালে আবদ্ধ স্বতন্ত্র দুটো দিক । ঠিক যেমন হয়তো ঈশা এবং এনা ! বা হয়তো প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতাহীনতা বা আরও কোনোকিছু ! এমন দুটো পিঠ যা পরস্পরের সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে থাকা সত্বেও বিচ্ছিন্ন , অপরিপূরক ! সিগনালে এখনো আটকে আছে গাড়িটা । চৌমাথা মতো জায়গাটা । ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো — এবার কোন দিকে যাবো , একটু বলে দেবেন ম্যাডাম !
— এই তো এসেই পড়েছি , ব্যাস বাঁয়ে ঘুরে সামনে রেখে দিন । কত হলো আমার ?
খুচরো দু টাকার কয়েনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলিশা । ড্রাইভার ফেরত দিয়েছে ব্যালান্স , কয়েনটা দুই আঙুলে তুলে চোখের সামনে এনে ধরেছে । দেখছে দুটো পিঠ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে… আজ প্রথমবার… কয়েনের দুই পিঠ….. ! এবার অপেক্ষা নতুন কেসের… অপেক্ষা শুরু আগামীর জন্যে !
সমাপ্ত