কয়েন,পর্ব_১

0
1034

কয়েন,পর্ব_১
রহস্য_গল্প
পৃথা_সামন্ত_ঘোষ

লেপের ঢাকনাটা অল্প সরিয়ে মুখটা বার করে ঘড়ির দিকে তাকালো আলিশা । ইশ , বেলা হয়ে গেছে বেশ ! রৌনকটা আজও ডেকে দিলোনা , এমন পাজি । মাথার কাছে রাখা গরম জামাটা গায়ে চাপিয়ে মেঝেতে পা রাখলো আলিশা বিছানা থেকে । নিউ টাউনে ঠান্ডাটা একটু বেশিই পড়ে কলকাতার তুলনায় । ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কিচেনে ঢুকেই মাথাটা গরম হলো । চা পাতার ডাব্বার ঢাকনা খোলা , গুঁড়ো দুধ ছড়িয়ে রয়েছে স্ল্যাবের ওপর , পিঁপড়ের দল মনের সুখে চিনির দানা পিঠে চাপিয়ে নিয়ে চলেছে সার বেঁধে । কতবার বলেছে সে রৌনককে… জায়গার জিনিস জায়গায় রাখবি , কে শোনে কার কথা ! একে একে সব গুছিয়ে নিজের জন্য এককাপ কফি বানালো আলিশা ।

কলসেন্টারের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে আজ মাস কয়েক হলো । সাথে এসে জুটেছে এই রৌনক । সে এক আজব কিসসা ! বাবা মার সাথে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়ার উপক্রম প্রায় । ফলে পাকাপাকি ভাবে এই ফ্যাটেই বসবাস শুরু । কাজের খবর বলতে কয়েকটা জটিল তবে পেটি কেসের সমাধান করেছে গত কয়েক মাসে । উপায় মন্দ নয় যদিও ! তবে রৌনক বলে — তোর পসার জমতে এখনও বহুত দেরি । তোকে দেখে মনেই হয়না যে তুই ডিটেক্টিভ , কেমন যেন কলেজ গার্ল কলেজ গার্ল বলে মনে হয় ! তোকে সিরিয়াসলি কে নেবে বলতো !

কিছু বলেনা আলিশা । হাসে কেবল । রৌনক বলে — হাসিস না , যেদিন বড় কোনো কেস সামনে আসবে… মিলিয়ে নিস আমার কথা । কেউ মানবেই না… তুই ডিটেক্টিভ ।

রৌনক একটা সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করে । ভালো ইনকাম , ভালো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড , হ্যান্ডসাম… শুধু মাথায় একটু ক্র্যাক । ভুলভাল বকে প্রায়ই । তাই ওর কথা তেমন সিরিয়াসলি নেয়না আলিশা । নটায় বেরিয়ে যায় রৌনক । তারপর অখন্ড অবসর তার । বই পত্র নামিয়ে পড়তে বসে রোজ নিয়ম করে । পড়তে পড়তে ক্ষিদে পেলে ম্যাগি ট্যাগী করে কাজ চালায় ।

মা ফোন করে কখনো সখনো । বলে — আমরা তো সব মেনেই নিয়েছি । ছেলেটাও ভালো । তাহলে বিয়েটা কেন করছিস না তোরা ? তারপর তো আর কিছু বলার থাকেনা কারো ! রৌনককের বাবা মাই বা কেমন ! কিছু কি বলেননা ছেলেকে ?

আলিশা উত্তরে বলে — বলেন হয়তো ! তাই তো রৌনক ঝামেলা করে আমার সাথে । এই যেমন তোমরা করো !

— তাহলে তোর আপত্তিটা কেন… কিসের জন্য ?

— আমি এভাবে দুম করে কারোকে বিয়ে করে নিতে পারবোনা । বিয়ে করে তারপর যদি ওকে আর ভালো না লাগে ! তখন ?

— যা ইচ্ছা কর তাহলে । তোকে আলাদা থাকতে দেওয়াটাই আমাদের ভুল হয়েছে । একদম হাতের বাইরে চলে গেছিস তুই ।

— আমাকে মাথা থেকে বার করে দাও এবার । একটু পড়তে দাও এখন । রাখি !

ফোন রেখে আবার বইয়েয় পাতায় ডুবে যায় আলিশা । আজও এরকমই কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বই হাতে ব্যালকনিতে পায়চারি করছিল । বেল বাজার শব্দ এলো কানে । টেবিলের ওপর বইটা উল্টো করে রেখে কফির কাপ হাতে নিয়ে দরজাটা খুললো আলিশা । সামনে দাঁড়িয়ে বিদ্ধস্ত চেহারার একজন বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক । আলিশা বললো — বলুন !

— আলিশা সোম আপনিই ?

— হ্যাঁ । আমিই ।

— নমস্কার , আমি কুশল বাগচী । আমার মেয়ে… গতকাল রাতে কেউ ওকে খুন করেছে । চোখ থেকে নেমে আসা অবাধ্য কান্না মুছে ফেলে বলেন ভদ্রলোক ।

কপালে ভাঁজ জমে আলিশার নিজের অজান্তেই । বলে — ভিতরে আসুন । ভদ্রলোককে নিয়ে এসে বসায় লিভিংয়ে ।

ভদ্রলোক বেশ অস্থির ভাবে বলে উঠলেন — আমি চাই ওর খুনের তদন্ত আপনি করুন । ও আমার বড় আদরের ছিল ।

— পুলিশ কি বলছে ?

— জানিনা , আমার কোনো ভরসা নেই ওদের ওপর । আমি আপনার নাম শুনেছি আমার এক ক্লায়েন্ট কাম বন্ধুর থেকে । শুনেছি আপনি ভীষণ আন্তরিকতার সাথে ইনভেস্টিগেট করেন , দায়সারা গোছের কাজ আপনি করেননা , তাই আসা আপনার কাছে । আমাকে ফেরাবেননা প্লিজ !

— বেশ । এবার বলুন তো… ঠিক কি হয়েছিল গতকাল !

— ল্যান্সডাউন রোডে আমার বাড়ি । স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার । জানিনা , কার নজর লাগলো তাতে । গতকাল শেষ দিন ছিল বছরের । আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে প্রতিবছর এই দিনটা হৈচৈ করি একটু । গতকালও ছিল এমনই একটা দিন ।

— আপনার দুই মেয়ের মধ্যে খুনটা কার হলো ?

— আমার দুই মেয়ে যমজ । কয়েক মিনিটের ছোটবড় ছিল ওরা । আমার বড় মেয়ে ঈশা…. ওই কাল….

ভদ্রলোক চুপ করে যান । কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর বেশ । আলিশা উঠে গিয়ে এক গ্লাস জল এনে ওঁর সামনে রাখে । বলে — বেশ , তারপর !

— জানিনা , কিছুই বুঝতে পারছিনা । কিভাবে কখন হলো… ওরা দুজনেই আনন্দে ছিল । ঈশা বেশ খুশি ছিল । ওরই অনারে ছিল গতকালের স্পেশাল পার্টি ।

— কেন ?

— এনগেজমেন্ট এনাউন্স করেছিলাম কাল ওর । তাই ।

আলিশার চোখে সামান্য বিদ্যুৎ খেলে গেল এবার । সে প্রশ্ন করলো — কত বয়স আপনার মেয়ের ?

— এই বছরেই শেষ হত ওর এম বি এ । আলেখ্য আমার বিজনেস পার্টনারের একমাত্র ছেলে । ওরা পছন্দ করতো দুজন দুজনকে । আমরা ভাবলাম… এনগেজমেন্টটা হয়ে থাকুক এখন , বিয়ে নাহয় পরে দেওয়া যাবে । চাকরি বাকরি কোথায় করে… সেসব ভেবেই…

— আলেখ্য কি করে ?

— এমবিএ করে বাবার বিজনেস জয়েন করেছে ।

— পার্টিতে যারা এসেছিলেন… তারা প্রত্যেকেই আপনার পরিচিত ছিল ?

— হ্যাঁ , একেবারেই পরিচিত । শুধু পরিচিত বললে ভুল বলা হবে , প্রত্যেকেই আমার বহুদিনের পরিচিত । কেন বলুনতো !

— বলছি । তার আগে বলুন… পার্টির শেষে কি হয়েছিল ? ঈশা তখন স্বাভাবিক ছিল কি ?

— হ্যাঁ , একদম স্বাভাবিক ছিল । খাওয়া দাওয়া করলাম আমরা একসাথে । ও একটু ওয়াইন খেলো । আমার স্ত্রীও খেলো ।

— আর আপনার আরেক মেয়ে ! সে ওয়াইন খেলোনা ?

— না , ওর বরং একটু শরীর খারাপ ছিল কাল । ও খায়নি । তবে আমাদের সাথেই খাওয়াদাওয়া করেছিল । তারপর যে যার ঘরে চলে গেলাম ।

— রাতে কেউ কোনোরকম শব্দ পাননি ?

— না , মিস সোম , জানতে পারলে কি তখনই ছুটে যেতাম না ? মুষড়ে পড়া স্বরে বলে ওঠেন মিস্টার বাগচী ।

— পরদিন সকালে কে প্রথম জানতে পারলেন ?

— আমার বাড়ির চাকর প্রথম দেখতে পেয়ে চিৎকার করতে শুরু করে । তখন আমি আর আমার স্ত্রী গিয়ে সবটা…. দেখতে পাই ।

— কি দেখলেন ?

মাথা নামিয়ে চুপ করে রইলেন ভদ্রলোক । কিছুক্ষন পর মাথা তুলে বললেন — এই দৃশ্য কেমন ভাবে বলবো আমি আপনাকে ? কোনো বাবা এমন দৃশ্য কি বলতে পারে ? লেপটা লাল হয়ে ছিল রক্তে ভিজে । ওর বুকের বাঁদিকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিল কেউ । রক্তে ভিজে গিয়েছিল ওর পোশাক , বিছানা , বালিশ । চোখদুটো খোলাই পড়ে ছিল । কেঁদেছিল বোধহয় শেষ মুহূর্তে , জানেন ! কান্নার দাগ দেখেছিলাম ওর চোখের পাশে , গড়িয়ে এসেছে বালিশ পর্যন্ত ।

নড়েচড়ে বসলো আলিশা । বললো — পার্টির পরে গেস্টরা সবাই চলে গিয়েছিল ?

— হ্যাঁ , সবাই চলে গিয়েছিল । শুধু আমার এক ভাই , তার স্ত্রী আর তার ছেলে থেকে গিয়েছিল কারণ আজ তাদের কলকাতায় অন্য একটা কাজ ছিল । ইনফ্যাক্ট এখনো তারা আমার বাড়িতেই রয়েছে ।

— আপনার স্ত্রী আর মেয়ে ?

— আছে , কেমন আছে তারাই জানে ! আমার মাথা কাজ করছেনা । আমি শুধু চাই আপনি আমার মেয়ের খুনিকে খুঁজে বার করুন । প্লিজ !

— চলুন , আমি এখন একবার আপনার বাড়ি যাবো ।

উঠে দাঁড়ালো আলিশা । একসাথে বেসমেন্টে এসে গাড়ির সিটে বসলো । মিস্টার বাগচী নিজেই ড্রাইভ করে এসেছেন এতটা পথ । ভদ্রলোকের স্বনিয়ন্ত্রন বেশ ভালো বলতে হবে…. ভাবলো আলিশা । চুপচাপ ড্রাইভ করছেন ভদ্রলোক । আলিশা টেরা চোখে জরিপ করছে মাঝেমধ্যে তাঁকে । হঠাৎ বলে উঠলো — ঈশার সাথে আপনার সম্পর্ক যে সুন্দর ছিল সেটা আমি বুঝতেই পারছি মিস্টার বাগচী , আপনার স্ত্রী আর বোনের সাথে ওর সম্পর্ক কেমন ছিল ?

— ভালো , আমরা বরাবরই খুব ক্লোজ এন্ড নিট কাইন্ডা ফ্যামিলি ।

— হুম , আর বাকি যারা কাল রাতে আপনার বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন… তাঁদের সাথে ?

— ওদের সাথে খুব বেশি দেখা হয়না আমাদের । ওরা গতকাল নিমন্ত্রিতও ছিল না । একটা কাজে কলকাতাতে এসেছে , থাকার জায়গার অভাব , তাই আমার বাড়িতে এসে উঠেছে ।

— দূর সম্পর্কের আত্মীয় ?

— কাইন্ড অফ !

— ছেলেটি কেমন ! যার সাথে এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা ছিল ঈশার ?

— খুবই ভালো ছেলে । বহুদিন চিনি আমি ওর বাড়ির লোককে । ওর বাবা আমার ছেলেবেলার বন্ধু । অবাধ যাতায়াত ছিল দুই বাড়ির মধ্যে । বাচ্চারা একে অন্যকে চিনতো ছোটবেলা থেকে । একসাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছে ।

ভাঁজ পড়লো আলিশার ভ্রূযুগলের মাঝে । কোথাও একটা কোনো নির্দিষ্ট হিসেব মিলছে না । সে চুপ করে গাড়ির বন্ধ কাঁচের ওপারে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে রইলো । ব্যস্ত কলকাতা শহরকে পিছলে পিছনে হারিয়ে যেতে দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল বাগচী ম্যানসনের বিশাল গেটের সামনে । গেট পেরিয়ে গাড়ি বারান্দার নিচে গিয়ে থামলো গাড়ি । নেমে এলো আলিশা মিস্টার বাগচীর সাথে । গেটের মুখে একজন উর্দি পরা কনস্টেবল পাহারায় জারি আছে । ভিতরে প্রবেশ করলো আলিশা । সোফায় বসে আছেন একজন সুদর্শনা মহিলা… সম্ভবত মিসেস বাগচী ! তাঁর পাশে বসে একজন অফিসার । চলছে প্রশ্নোত্তর পালা । ওদের দেখে অফিসার বলে উঠলেন — এরপর আপনার টার্ন মিস্টার বাগচী , বসুন । তারপর আলিশার দিকে তাকিয়ে বললেন — আপনাকে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে !

— আমি আলিশা সোম । নাম শুনেছেন কিনা জানিনা । এই কেসের দায়িত্ব মিস্টার বাগচী আমার ওপরে দিয়েছেন । আমারই বাড়ি গিয়েছিলেন উনি ।

অফিসারের চোখ ঘুরে গেছে মিস্টার বাগচীর দিকে । বলেছেন — বিশ্বাস নেই মনে হচ্ছে আমাদের ওপর ! মিস্টার বাগচী , সবাই কিন্তু অপদার্থ নয় । এটা মনে রাখবেন । আর আপনি নিজেও সন্দেহের আওতার বাইরে নন ! বলে আবার তাকালেন আলিশার দিকে । আলিশা নিজের হাতদুটো ভাঁজ করে বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে দাঁড়ালো । অফিসার মিসেস বাগচীর দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন — তারপর বলুন, কখন শুতে গেলেন সবাই ?

মিসেস বাগচী এতক্ষনে একটা কথাও বলেননি । শুধু কয়েকবার অলিশাকে দেখেছেন । এবার বললেন — বলছি । তার আগে একটা কথা বলতে চাই । ভেঙে আসা স্বরে বলে চললেন উনি — আপনি বা উনি… যেই ইনভেস্টিগেট করুন… আমাদের মেয়ের খুনিকে খুঁজে বার করে দিন । নিজেদের মধ্যে ইগো নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে ঈশার কথাটা প্লিজ ভুলে যাবেননা ! আমাদের অবস্থাটা একটু বুঝুন । প্রয়োজন হলে আমরা নিজেদের ইনফ্লুয়েন্স কাজে লাগাতেই পারি , কিন্তু আমরা আপনাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে চাই । তাই চাইবো নিজেরা নিজেদের কাজটা করবেন !

আলিশা চুপ করে থাকলেও অফিসারটি বলে উঠলেন — আমি আমার কাজটা জানি মিসেস বাগচী । পাঁচটা বছর হলো তো ডিপার্টমেন্টে ! আপনি বলুন কখন গেলেন শুতে ?

— এগারোটার আশেপাশে ।

আলিশা মিস্টার বাগচীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো — আমি একটু এনার সাথে কথা বলতে চাই । তারপর মিসেস বাগচী আর বাকিদের সাথে এক এক করে ।

— আসুন ।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আলিশা লক্ষ্য করলো পাশের দেওয়াল জুড়ে পরিবারের বিভিন্ন স্মৃতি …ফ্রেমবন্দী হয়ে ঝুলছে । ঈশা আর এনার ছবি দেখে বোঝা যায়না কে ঈশা আর কে এনা । তবে যমজ হলেও… চেহারায় প্রায় কোনো মিলই নেই দুই বোনের । দোতলায় এসে দ্বিতীয় ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করলেন মিস্টার বাগচী । ভিতর থেকে উত্তর এলো — এসো !

দরজা ঠেলে ভিতরে মুখ বাড়ালেন মিস্টার বাগচী — আসছি । বলে ঘরে ঢুকলেন , অলিশাও এসে দাঁড়ালো এনার ঘরে । বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে এনাকেও । মিস্টার বাগচী বললেন — উনি ডিটেক্টিভ আলিশা সোম । ঈশার কেস ইনভেস্টিগেট করবেন । তোকে কিছু প্রশ্ন করবেন । কথা বল । আমি নিচে আছি , অফিসার আমাকে ইন্টারোগেট করবেন এখন । চলি ।

বেরিয়ে গেলেন উনি । এনা চেয়ে রইলো আলিশার দিকে । আলিশা এখন জানে এনা কে আর ঈশা কে । তফাতটা এখন তার সামনে । আলিশা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে নিজেই বসে পড়লো এনার মুখোমুখি । এনা বললো — বলুন !

— আমাকে তুমিও বলতে পারো । আমি হার্ডলি কয়েক বছরের বড় হবো তোমার চেয়ে ।

— আমার থেকে কি জানার আছে ?

— কয়েকটা জিনিস । এক… তোমার সাথে ঈশার সম্পর্ক কেমন ছিল ?

— ভালো , খুবই ভালো । উই ওয়ার টুইন্স !

— হুম , শুনলাম । যদিও তোমাদের দেখতে কিন্তু একদম আলাদা । ছবি দেখলাম ।

— হ্যাঁ , সবাই তাই বলতো ।

এনার ঘরটা ভালো করে জরিপ করতে করতে আলিশা প্রশ্ন করলো আচমকা — প্রেম করো নিজে ?

এনা বিরক্ত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো — সেটা এই কেসের সাথে রিলেটেড কি ?

— হতেও পারে , নাও হতে পারে ! যাইহোক , গতকাল ঈশার এনগেজমেন্ট এনাউন্স হয়েছিল শুনলাম । ঈশা খুশি ছিল ? কিছু বলেছিল তোমাকে এই ব্যাপারে ? কিছু শেয়ার করেছিল ?

— খুশি ছিল নিশ্চয়ই ! প্রেমিকের সাথে এনগেজমেন্ট এনাউন্স হলে সবাই খুশি হবে । আপনিও হবেন ।

— আমার কথা থাক । তুমি ঈশার কথা বলো ।

এনা সামান্য বিরক্ত হলো যেন ! বললো — ও খুশি ছিল বলেই মনে হলো । হেসে হেসে কথা বলছিল সবার সাথে । আলেখ্য ছিল ওর পাশে । তবে আমাকে আলাদাভাবে কিছু বলেনি ও । আমি আগে শুতে চলে এসেছিলাম কাল । আমার মাথাটা খুব যন্ত্রনা হচ্ছিল ।

— ঈশার ঘর কোনটা ? খোলা আছে সেটা এখন ?

— আছে । তবে কোনো জিনিস হাত দেওয়া যাবেনা ।

— জানি । চলো একবার ওর ঘরে ।

এনার ঠিক পাশের ঘরটাই ঈশার । এই ঘরের সামনেও একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে । আলিশা নিজের পরিচয় দিয়ে ঘরটায় ঢুকলো । সাদা চাদরটা রক্তাক্ত অবস্থায় দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে বিছানার উপর । রক্তের ছাপ বালিশের কভারেও । আলিশা পায়ে পায়ে হেঁটে ঘরের কোণে রাখা স্টাডি টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো । পাশেই কাঁচের জানলা… তার ওপারে গাড়ি বারান্দা । জানলার পাশে টানা কাঁচের দরজা বারান্দায় বেরোনোর জন্যে । এনার ঘরের ঠিক উল্টো ডিজাইনে বানানো এই ঘরটা । আলিশা ঘাড় ঘোরালো একবার… এনা দাঁড়িয়ে আছে একভাবে । আলিশা সামান্য হেসে বললো — চিন্তা নেই , আমার লাইসেন্স আছে এই ঘরে যে কোনো কিছু টাচ করার । পাহারা দেওয়ার দরকার নেই ।

— আমাকে কি আর লাগবে ? আমি একটু বিশ্রাম নেবো । একটু একা থাকতে চাই ।

— একটা ছোট্ট প্রশ্ন । তুমি তো পাশের ঘরেই ছিলে । ঈশার চিৎকার শুনতে পাওনি ?

— ও ঘরে আসার আগেই হয়তো আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । শরীর ভালো ছিলোনা আমার । ওষুধ খেতে হয়েছিল ।

— বেশ , তুমি যেতে পারো আপাতত । আবার ডাকতে পারি কিন্তু !

— ঠিক আছে । বলে সরে গেল এনা । আলিশা ফিরলো আবার স্টাডি টেবিলের দিকে । পরপর সাজানো ম্যানেজমেন্টের বই । কয়েকটা অন্য বই ও চোখে পড়লো । ড্রয়ার টেনে দেখলো টুকটাক জিনিসের মধ্যে রয়েছে চার ইঞ্চি বাই সাত ইঞ্চির একটা সাদা খাম । আলিশা খামটা হাতে তুলে নিলো । ঠিক সেই সময়ে ফোনটা বেজে উঠলো ওর । পকেট থেকে ফোনটা বার করে দেখলো রৌনক কল করছে । ফোনটা রিসিভ করে কানে চাপলো ।

— বল ।

— কোথায় তুই ? বেরিয়েছিস নাকি ?

— হ্যাঁ , কেন ?

— মনে হলো এমনি । কখন ফিরবি ?

— তোর আগেই ফিরবো । তুই আজও আমাকে ডেকে দিস নি ।

— হ্যাঁ , দিইনি । ইচ্ছা করেই দিইনি । সেলফ ডিপেন্ডেন্ট হ এবার । বিয়ে যখন করবিনা , এত ডিপেন্ট করিসনা ।

— ওকে । দেন ভালোই করেছিস । আচ্ছা , একটা কেসে ফেঁসে আছি । পরে কথা বলছি , রাখছি । ফোনটা কেটে দেয় আলিশা ।

খামটা ধরা রয়ে গেছে হাতে । সেটা খুললো এবার । বেরিয়ে এলো পরপর কয়েকটা ফোটো… ঈশা এবং আলেখ্যর ডুয়েট ফোটো । একটা ফোটোতে ওদের দুজনের পাশে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে এনাও । আলিশা ফোটোগুলো ভরে ফেললো খামে । তারপর জ্যাকেটের পকেটে ভরে ফেললো দ্রুত । আরও খানিক খোঁজাখুঁজি করে একটা ছোট ডায়েরি পেলো সে , বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে রাখা ছিল সেটা । আর তেমন বিশেষ কিছু দেখতে পেলোনা । ডায়রিটা পকেটে চালান করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে । কনস্টেবলটিকে বললো — দুটো জিনিস সাথে নিয়ে যাচ্ছি । কেউ জানতে চাইলে বলে দিয়ো ।

এনার ঘরের বন্ধ দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এলো আলিশা । সোফায় তখন মুখোমুখি বসে মিস্টার বাগচী এবং সেই অফিসার । মিসেস বাগচীকে কোথাও দেখতে পেলোনা । সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো — মিসেস বাগচীর সাথে এবার কথা বলবো মিস্টার বাগচী । তাই একটু বদার করলাম ।

— হ্যাঁ নিশ্চয়ই ! রমলা ! গলা উঁচু করে ডাকলেন মিস্টার বাগচী ।

একটি বছর চল্লিশের মহিলা এসে দাঁড়ালো সাথে সাথে হুকুমের অপেক্ষায় । মিস্টার বাগচী বললেন — এই ম্যাডাম কে নিয়ে যাও ম্যাডামের ঘরে ।

আলিশাকে দোতলার শেষ ঘরটায় পৌঁছে দিয়ে মহিলা বিদায় নিলো । আলিশা খুব ধীরে নক করলো ওঁর ঘরের বন্ধ দরজায় ।

— আসুন ! ধীর স্বর শোনা গেল ভীতর থেকে । দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর পা রাখলো আলিশা । বেশ কিছুটা অন্ধকার ঘিরে রয়েছে ঘরটায় , ভারি পর্দাগুলো টেনে দেওয়ার ফলে ।

— আমি আলিশা ।

— হ্যাঁ , বুঝতে পেরেছি । বসুন ।

— কেমন আছেন ? নরম স্বরে প্রশ্ন করলো আলিশা ।

— জানিনা । বলে একটু চুপ করে থাকলেন , তারপর বললেন — আমার দুই মেয়ে হলেও… ঈশাটাই বরাবর আমার ভীষণ প্রিয় ছিল । মা হয়ে সন্তানদের মধ্যে ভেদাভেদ করবো… এমন মা আমি কোনদিন নই । তবু ঈশার মধ্যে আমি যেন নিজেকে দেখতে পেতাম ! হয়তো তাই এমনটা মনে হতো ! আজ সকালে ওকে ওই অবস্থায় দেখার পর… নিঃশব্দে গড়িয়ে আসা চোখের জল মোছেন মিসেস বাগচী ।

— আপনার কারোকে সন্দেহ হয় ?

— কাকে সন্দেহ করবো ? এখানে সকলেই তো ওর নিজের । নিজের বাবা , বোন , মা… কাকে সন্দেহ করবো ?

— কয়েকজন গেস্ট ও তো ছিল !

— হ্যাঁ , কিন্ত তারাই বা এমন কেন করবে ? ঈশা সেরকম মেয়েই নয় , ওর ওপর কারো এমন রাগ থাকতে পারে , এটা ভেবেই আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি । এমন কাজ কে করতে পারে… আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা । একবার তাকে সামলে পেলে…. বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে ফেলেন উনি ।

আলিশা চুপ করে থাকে । অনুভব করার চেষ্টা করে পরিস্থিতির গভীরতা । একটু পরে বলে — মাথা ঠান্ডা করুন । আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ঈশার খুনিকে শাস্তি দিতে , কিন্তু আপনাকে ধৈর্য্যটুকু রাখতেই হবে ।এই বাড়িতে কারো মধ্যে কোনোরকম অস্বাভাবিক কোনকিছু নজরে পড়লে সাথেসাথে আমাকে জানাবেন । এটা আমার নম্বর… নিজের অফিসিয়াল কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলে আলিশা…. আমার নম্বর ডে এন্ড নাইট অন থাকে ।

মিসেস বাগচীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নীচে নেমে এলো আলিশা । এবার একবার কুশল বাগচীর ভাই , তার স্ত্রী এবং ছেলের সাথে কথা বলতে হবে তাকে… একে একে ।

||এরপর….. ||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here